সে বহুদিন আগের কথা ।
সেদিন বিকেল বেলা আলতা রানি পায়ে আলতা মেখে রাজা কিয়াজকে এসে বলল, রাজামশাই দেখেনতো, আমাকে আজ কেমন লাগছে ?
রাজা কিয়াজ রানির রঙিন পায়ের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর বলল, বাহ! এতো ভারি চমৎকার। তোমাকে আজ অস্বাভাবিক সুন্দর লাগছে ।
আলতা রানি রাজার খুব কাছাকাছি এসে দাঁড়াল । তারপর গলায় মিনমিনে সুর তুলে বলল, রাজামশাই আজকে আমার একটা আবদার রাখতে হবে। বলেন, রাখবেন?
রাজা কিয়াজ রানির কথা শুনে হাসিতে ফেটে পড়ল । হাসতে হাসতে বলল, তুমি যে কি বল রানি । আমিত আর সবার মত না । দশটা না বিশটা না তুমি আমার একমাত্র রানি । একটা কেন দরকার হলে তুমি আমার কাছে একশ’টা আবদার করতে পার । হ্যাঁ, এবার তাড়াতাড়ি বল।
ঠোঁটের কোনায় রাঙ্গা হাসি ফুটিয়ে আলতা রানি বলল, না রাজা মশাই আমার একটা আবদার রাখতে পারলেই চলবে।
রাজা বেশ আগ্রহী হয়ে অনুমতি দিল, ঠিক আছে, তোমার আবদারের কথা বল।
আলতা রানি লম্বা শ্বাস নিয়ে বলতে শুরু করল, আলতা পায়ে আজ বিকেল বেলা আমি যতদূর পর্যন্ত হেঁটে যাব আপনাকে ঠিক ততখানি লম্বা একটা দিঘি খনন করতে হবে ।
রানির কথা শুনে রাজার হাসিহাসি মুখটা হঠাৎ চুপসে গেল । কপাল ভাজ করে চারপাশটা একবার দেখে নিয়ে তাকাল আকাশের দিকে । সেদিনের আবহাওয়া ছিল যথেষ্ট ভালো । আকাশে এক বিন্দু কালচে মেঘও নেই যে রানিকে বলবে, রানি, আজ না হয় থাক। আকাশ খারাপ, ঝড় বৃষ্টি হতে পারে ।
রাজাকে চুপচাপ দেখে আলতা রানি আবার মুখ খুলল, রাজামশাই, হঠাৎ চুপ মেরে গেলেন যে?
রাজা কিয়াজ তার উদাস দৃষ্টি আকাশের দিকে রেখেই বলল, তেমন কিছু না, ভাবছি ।
কি ভাবছেন ?
রাজা কিয়াজ এবার রানির দিকে তাকিয়ে বলল, আজকে তোমাকে যেমন অসাধারণ লাগছে তোমার আবদারটাও তেমনি অসাধারণ?
রাজার কথা শুনে রানির রাঙ্গা হাসিটা আরো একটু রাঙ্গা হয়ে উঠল । সেই হাসি দেখে রাজার চুপসে যাওয়া মুখটা কেন জানি আরো খানিকটা চুপসে গেল ।
রাজসভায় দিঘি খননের প্রস্তাবটা প্রথমে মন্ত্রী মুহিমুদই উত্থাপন করল । এ প্রস্তাব অবশ্য সবার সন্মতি নেওয়ার জন্য নয় । বিষয়টা সবাইকে জানানো যে রাজা মশাই বিশাল একটা কিছু করতে যাচ্ছে । এ ব্যাপারে মন্ত্রী মুহিমুদের আগ্রহই সবচেয়ে বেশি । কারণ সবকিছু দেখাশোনার দায়িত্ব তার কাঁধেই । পরিশ্রম না করে কিছু কামিয়ে নেওয়ার আনন্দটা অন্যরকম ।
মন্ত্রীর পাশেই বসে আছে রাজার বাল্যকালের বন্ধু জাহিরুল । জাহিরুল রাজসভার কোন দায়িত্ব পালন না করলেও তার পরামর্শ ছাড়া রাজা কোন সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন না । পণ্ডিত জাহিরুল এ রাজসভার উজির পর্যায়ের একজন। জাহিরুল বই পড়তে ভালবাসেন । সব সময় বই না পড়লেও চোখে চশমা আঁটা থাকে সারাক্ষণ ।
মন্ত্রী মুহিমুদ অবশ্য তাকে কোন চোখেই দেখতে পারে না । তার কথায় একটা মানুষ ভালো হতে না পারলে খরাপ হয়ে যাক । ভালোও না আবার খারাপও না এরকম বৈশিষ্ট্য অন্তত মানুষের থাকা উচিৎ না । রাজা কিয়াজ কিছুক্ষণ আগে জাহিরুলের মনোযোগ আকর্ষণ করে বলল, জাহিরুল, দিঘি খননের ব্যাপারে তোমার কি মত শুনি ?
জাহিরুল তার সামনে ধরে রাখা বইটা ঠাস করে বন্ধ করল । তারপর কিছুসময় এপাশ ওপাশ তাকানোর পর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, আগে দিঘি খনন শেষ হোক তারপর কিছু একটা বলা যাবে ।
দিঘি খনন শুরু হয়ে গেল । প্রায় তিন হাজার শ্রমিক একসাথে কাজ করতে শুরু করল । দিন নেই রাত নেই কেবল ধুপ ধাপ মাটি কাটার শব্দ । এদের মধ্যে কাজ করছিল দুই অন্তরঙ্গ বন্ধু । রাজবাড়ির কাছাকাছি একি পাড়ায় ওদের বাড়ি । একজন ধোপার ছেলে ফাইসাল এবং আরেকজন চাষীর ছেলে মুত্তাকিম ।
তিন মাস পর দিঘি খননের কাজ শেষ হলো । তারপর সেই দিঘির এক কোনায় নকশা করা পাথর দিয়ে একটা সুন্দর ঘাট বাঁধা হলো । রানির নাম থেকে দিঘির নাম রাখা হলো ’আলতা দিঘি’ ।
মাটি কাটার শেষ দিন, বিশালাকার সেই দিঘির ঘাটের এক পাশে বসে ধোপার ছেলে ফাইসাল চাষীর ছেলে মুত্তাকিমকে বলল, দোস্ত, এত বড় দিঘিতে একটা মাত্র ঘাট, এর মানে কি বুঝেছিস ?
মুত্তাকিম হাসতে হাসতে জবাব দিল, বুঝেছি, এই দিঘি শুধু আমাদের মহারাজা আর মহারানির জন্যে ।
ফাইসাল বলল, তুই যাই বলিস, আমাদের কাজ কিন্তু এখনো শেষ হয়নি ।
এমন সময় একজন সিপাহী তাদের কাছে এসে দাঁড়াল । কর্কশ গলায় বলল, তোমাদের কাজ শেষ, এখানে বসে থেকে সময় নষ্ট না করে বিদায় হয়ে যাও ।
এক হাতে ডালি আর অন্য হাতে কোদালটা কাঁধে নিয়ে ফাইসাল আর মুত্তাকিম তাদের বাড়ীর দিকে রাস্তা ধরল । যেতে যেতে ফাইসাল একবার মুত্তাকিমকে বলল, দোস্ত, জীবন থাক বা না থাক, এই দিঘিতে আমি একদিন গোসল করতে আসব ।
মুত্তাকিম তাকে ভয় দেখিয়ে বলল, তোরে শূলে চড়িয়ে মারবে ।
ফাইসাল মনে হয় তেমন কোন ভয় পেল না । বলল, শূলে চড়ে মরার ভাগ্য কিন্তু সবার হয় না দোস্ত ।
দিঘি খননের পর তা লোকচক্ষু থেকে আড়াল করার জন্য এর চারপাশে হাজার হাজার গাছপালা লাগানো হলো । অবিন্যস্ত সেই গাছপালা দেখলে মনে হবে যেন একটা বন কেটে তার মাঝখানে দিঘি খনন করা হয়েছে । এরপর সেই গাছপালার মধ্যে দিয়ে সুন্দর একটা রাস্তা তৈরি করা হলো । রাম্তাটা দিঘি থেকে শুরু হয়ে শেষ হলো রাজবাড়িতে । সেই পথ ধরে প্রায় প্রতিদিন একবার রাজা ও রানি হাতির পিঠে চড়ে গোসল করতে আসে । গোসল শেষে আবারো সেই হাতির পিঠে চড়ে চলে যায় । রাজা রানির গোসলের সময় ছাড়া বাকিটা সময় দিঘির চারপাশে কড়া পাহাড়া দেওয়া থাকে । ভুলেও কারো পানি ছোয়ার সাধ্য নেই ।
ধোপার ছেলে ফাইসাল একদিন সেই অসাধ্য সাধন করল । সেদিন সন্ধ্যাবেলা তারা দুই বন্ধু কাজ করে আলতা দিঘির পাশ দিয়ে যাচ্ছিল । দিঘির কাছাকাছি আসতেই ফাইসাল হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল । তারপর মুত্তাকিমকে ফিসফিস করে বলল, চল দিঘি থেকে গোসল করে আসি ।
মুত্তাকিম পুরোপুরি ভরকে গেল । বলল, না দোস্ত আমার গোসল লাগবে না, কাল থেকে সর্দি সর্দি ভাব ।
আরে চল না, একদিনইত যাব ।
তোর মাথা খারাপ ওখানে সব সময় পাহাড়াদার থাকে ।
ফাইসালের আগ্রহের একটুও কমতি হল না । বলল, এখনত প্রায় রাত লেগে গেছে । দিঘিতে নেমেই একটা ডুব মারব, তারপর যতদূর পারি মাঝখানে গিয়ে ভেসে ওঠব । সেখান থেকে আবার এক ডুব দিয়ে পারে এসে ওঠব ।
মুত্তাকিম নিচু গলায় বলল, আমার মনে হয় তুই একাই যেতে পারবি। আমার খুব সর্দি ।
ফাইসাল একাই গেল । তবে ডুব দিয়ে আসার পথে ধরা পড়ে গেল । পাহাড়াদার লোকটা মানুষ ভাল । প্রথমবার তাই তেমন কিছু করল না । গুনে গুনে বিশটা বেতের বারি দিয়ে বিদায় করে দিল । ফেরার পথে ফাইসাল মুত্তাকিমকে শুধু একটা কথাই বলল, এই বেতের বারি যদি শতগুণ বাড়িয়ে ফেরত দিতে না পারি তবে আমি বাপের বেটা না ।
এভাবে দিন যায়, সপ্তাহ যায় । মাস গড়িয়ে বছর আসে । ধুমধাম করে দিঘি খননের বার্ষিকী পালন করা হয় । রাজ্যের ধনী গরিব সবাইকে সেদিন পেট পুরে পোলাও কোর্মা খাওয়ানো হয় । শুধু সেদিনই সবাই দুই হাত তুলে রাজা রানির দীর্ঘ জীবন কামনা করে ।
আলতা দিঘির খবর ক্রমান্বয়ে দেশ থেকে দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়ে । কত রাজপুত্র রাজকন্যা, রাজা মহারাজারা সেই দিঘি দেখতে আসে । দিঘি দেখে ফেরত যায় রাজার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে । কেউ চোখ কপালে তুলে বলে, কি বিশাল দিঘি, বাহাদুর মানুষ বটে !
অনেকেই আবার চোখ নামিয়ে বলে, আর বাহাদুরি, জঙ্গলের মধ্যে একটা জংলী পুকুর আর কি!
দিঘির কোন কথা ফাইসালের কানে আসলেই তার মেজাজটা খারাপ হয়ে যায় । কি করলে সবচেয়ে ভাল কাজটা করা যায় সে এতদিনে সেটাই খুঁজে বের করতে পারেনি । তবে সত্যি সত্যি একদিন পেয়ে গেল । এক রাতে মুত্তাকিমকে তার বাড়িতে ডেকে আনল । চোখ মুখ গম্ভীর করে বলল, দোস্ত একটা কাজ করতে পারবি ।
কি কাজ?
আমাদের রাজামশাইকে একটু ভয় দেখাব ।
মুত্তাকিম একটু দম নিয়ে বলল, ফাজলামি করিস না আমার সাথে ।
ফাইসালের আগ্রহ দ্বিগুণ বেড়ে গেল । বলল, তোকে কিছু করতে হবে না । শুধু আজ রাতে আমি যখন চিৎকার দিয়ে বাড়ি থেকে দৌড় দিব তুইও তোদের বাড়ি থেকে বের হয়ে আমার পিছনে দৌড় দিবি ।
মুত্তাকিম ডোক গিলে বলল, দৌড় দিয়ে কোথায় যাব ?
ফাইসাল মুচকি হেসে বলল, আলতা দিঘিতে যাব । অবশ্য তুই না আসলেও তেমন কোন সমস্যা হবে না ।
সে রাতে মুত্তাকিম ঘুমানোর অনেক চেষ্টা করেও পারল না । হঠাৎ মাঝরাতে ফইসালের চিৎকার শুনে বিছানা থেকে উঠে পড়ল । তারপর চিৎকার অনুসরণ করে তার পিছনে পিছনে দৌড়াতে লাগল । ফাইসাল একটু পর পর চিৎকার দিচ্ছে, ছাগলের বাচ্চা ধরে নিয়ে গেল! শিয়ালের বাচ্চা ধরে নিয়ে গেল! সেই চিৎকার শুনে ফাইসালের পিছনে আরো কয়েকজন বের হয়ে আসল ।
মুত্তাকিম যখন আলতা দিঘির পারের উপর এসে দাড়াল তখন ফাইসাল পার বেয়ে নিচে নেমে পড়েছে । তার পিছনে পিছনে দু’জন সিপাহিও ছুটছে। তার একটার পর একটা অশ্লীল গালিগালাজ করতে করতে দৌড়াচ্ছে । হঠাৎ দিঘির পানিতে কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দ হতেই ফাইসাল দাঁড়িয়ে গেল । সিপাহি লোক দুটা পিছন থেকে এসে একটা ধাক্কা দিতেই ফাইসাল হঠাৎ আবারো চেঁচিয়ে উঠল, খবরদার আর এক পাও সামনে যাবেন না ।
সিপাহী লোক দুটা একটু দমে গিয়ে বলল, কেন কি হয়েছে ?
ফাইসাল এবার গলা কাঁপাতে কাঁপাতে বলল, জলজ্যান্ত দুইটা কুমির, কিছুক্ষণ আগে পানিতে নেমে গেল ।
তারপর সিপাহী লোকদুটা ফাইসালের মুখে সব কিছু শুনল। তারা রীতিমত ভরকে গেল। তবে সবকিছু শোনার পরও ফাইসালকে ছাড়ল না । সকাল হওয়া পর্যন্ত বেঁধে রাখল ।
পণ্ডিত জাহিরুল আসার পরই সকালের রাজসভার কাজ শুরু হল । ফাইসালের দু্ই হাত তখনো বেঁধে রাখা হয়েছে । হাত খুলে দেওয়ার পর রাজা কিয়াজ তাকে গত রাতের ঘটনা খুলে বলতে বলল । ফাইসাল তার দুই চোখে প্রচণ্ড রকমের আতঙ্ক নিয়ে কথা বলতে শুরু করল, মাঝরাতে হঠাৎ ছাগলের বাচ্চার চিৎকার শুনে ঘুম ভেঙ্গে গেল । ঘর থেকে বের হয়েই দেখি একটা শিয়াল দরজার ফাঁক গলে পার হয়ে যাচ্ছে । পিছনে দিলাম ছুট ।
ফাইসাল একটু দম নিয়ে আবার বলতে শুরু করল, শিয়ালটার পিছনে গাছ পালার ভিতর দিয়ে এসে দাঁড়ালাম দিঘির পারে । সেখানে এসে দেখি শিয়ালটা ছাগলের একটা বাচ্চা মুখে নিয়ে দিঘির পারের নিচ দিয়ে দৌড়াচ্ছে । সাথে সাথে আমিও নেমে পড়লাম । এরপর কিছুদূর শিয়ালটার পিছনে দৌড়ানোর পর হঠাৎ এক জায়গায় এসে দাঁড়িয়ে গেলাম । ভালো করে সামনে তাকিয়ে দেখি দিঘির পানি থেকে একটা কুমির বের হয়ে শিকয়ালটার পিছনের দুটা পা কামরে ধরেছে । একটুপর আরেকটা কুমির বের হয়ে এসে আমাদের ছাগলের বাচ্চার মাথাটা কামরে ধরল । তারপর দুটাকেই একটানে পানির ভিতর নিয়ে গেল । চাঁদের আলোতে দেখেছি রাজামশাই । একেবারে পরিষ্কার দেখেছি। দুই দুটা কুমির!
রাজা ভয় পেয়েছে নাকি রেগে গেছে ঠিক বুঝা গেল না। কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর ফাইসালকে প্রশ্ন করল, তো, কুমির হঠাৎ নদী ছেড়ে দিঘিতে এসে নামল কেন ?
ফাইসাল চটপট উত্তর দিল, নদীতে এখন মাছের খুব অভাব হুজুর ।
রাজা এবার সত্যি সত্যি রেগে গেল । একলাফে চেয়ার থেকে উঠে বলল, মশকরা করছ আমার সাথে । তুই জানিস না, আলতা দিঘিতে কোন মাছ নেই ।
ফাইসাল তার কণ্ঠ মোলায়েম করে বলল, সে কথা আমি জানি হুজুর । কিন্তু মানুষের মাংশের স্বাদ মাছের থেকে কম কিসে!
চুপ কর বেয়াদব!
ফাইসালের শেষ কথায় রাজা কিয়াজের মথায় আগুন ধরে গেল । তবে রাজসভার সবাই হঠাৎ চুপ মেরে গেল । কেউ আর টু শব্দটিও করছে না । এক অচেনা আতঙ্কে সবার ভিতরেই ধুকপুক করতে শুরু করেছে । ভয়টা ঠিক রাজার জন্য না কি কুমিরের জন্য বুঝা গেল না ।
খানিকবাদে পণ্ডিত জাহিরুলও রাজা কিয়াজের কথায় সায় দিয়ে বলল, আমি এই বেয়াদবটার কথায় সন্দেহের আভাস পাচ্ছি ।
রাজসভার প্রায় সবাই একসাথে বলল, কি রকম আভাস?
জাহিরুল তার চশমাটা খুলে হাতে নিয়ে ধীরস্থির কণ্ঠে বলতে শুরু করল, ঐ দুটা কুমির না হয়ে রক্তচোষা হতে পারে । কারণ আমি অনেক বইয়ে পড়েছি, রক্তচোষারা সবসময় রাতের বেলা আক্রমন করে । প্রথমে চার হাত পায়ে কোন প্রাণীকে পেঁচিয়ে ধরে। এরপর ধীরে ধীরে ধারালো দাঁত বসিয়ে দেয় । তারপর একটানে সব রক্ত বের করে আনে ।
জাহিরুলের কথায় রাজসভায় এক অসহ্য নীরবতা নেমে আসল। আগের ভয়টা হঠাৎ লাফ দিয়ে দশ গুণ বেরে গেল । রাজসভার কেউ আর কোন কথা না বললেও মন্ত্রী মুহিমুদ জাহিরুলের পাণ্ডিত্যের খুব প্রশংসা করল।
দুপুর হওয়ার আগেই কুমিরের গল্পটা রাজ্যের প্রতিটা ঘরে পৌঁছে গেল । আগে পিছে অনেক রঙ লাগিয়ে গল্পটা এখন বেশ শোনার মত হয়েছে । সেদিনই বিকেল বেলা একজন বলল, আলতা দিঘির কুমিরগুলা নাকি বেশ বেয়ারা হয়ে উঠেছে । আশেপাশে কাউকে যেতে দিচ্ছে না । হোক সেটা মানুষের বাচ্চা, আর না হয় মুরগির বাচ্চা ।
এরপর রাজার আদেশে দিঘিতে বোতলে বোতলে বিষ ঢালা হলো । কয়েকবার করে জাল টানা হলো । কিন্তু কারো সন্দেহের সামান্য অংশও কমল না । এখনো মাঝে মাঝে, মাঝ রাতে অনেকে দূর থেকে দিঘিতে পানি ঝাপটা ঝাপটির শব্দ শুনতে পায় ।
এভাবে দিন যায়, সপ্তাহ যায় । মাস গড়িয়ে বছর আসে । আলতা দিঘিতে আর কোন দিন রানি গোসল করতে আসে না । দিঘির চারপাশে আর কোন পাহাড়াদার রাখার দরকার হয় না । কেউ ভুল করেও পা ধোয়ার জন্য আর দিঘির পানিতে নামে না । বিভিন্ন রাজ্য থেকে রাজকন্যারা আর দল বেঁধে আসে না । আর কোন দিন আলতা দিঘির বার্ষিকী পালন উপলক্ষে খাওয়া দাওয়ার আয়োজন করা হয় না ।
এরপরের আরো কয়েকটা বছর ঠিক এভাবেই পার হয়ে যায়।
চারপাশের এই ভূতুরে পরিবেশের মধ্যে হঠাৎ একদিন দেখা যায় ফাইসালকে। সে আলতা দিঘিতে নেমে গোসল করছে । দিঘির পারে দাড়িয়ে আছে তার অন্তরঙ্গ বন্ধু মুত্তাকিম । সে অনেক কিছুই বিশ্বাস করতে পারছে না ।
এরপরের দিন ওরা দুজন একসাথে নামে । আরো কিছুদিন পর দিঘিতে চারজন একসাথে গোসল করে । এভাবে একদিন একদিন করে সংখ্যাটা বাড়তেই থাকে । শ পার হয়ে যায় মাসের মধ্যে । খবরটা রাজা কিয়াজের কানে যেতেই সে একদিন দুপুর বেলা একা একাই তার দিঘি দেখতে আসে । দেখে সত্যই সেখানে শত শত মানুষ নেমে আছে । রাজা মনে মনে ভাবে এই মানুষগুলোর কি নিজের জীবনের কোন ভয় নেই? যারা বেশিদিন বাঁচতে চায় তারাই কি কেবল নিজের ক্ষণস্থায়ী জীবনটাকে এত মূল্যবান মনে করে?
আলতা রানি এখনো মাঝেমধ্যে পায়ে আলতা মাখে । হঠাৎ কোনদিন বিকেল বেলা রানি আলতার বাটি বের করে আনলে রাজা কিয়াজ বিছানায় গিয়ে চুপচাপ চোখ বন্ধ করে শুয়ে পরে । ঘুম চলে আসে সাথে সাথেই । ঘুমের ভিতর সে সুন্দর একটা সপ্ন দেখে । সপ্নে দেখে সে রানিকে সাথে নিয়ে আলতা দিঘির পাশ দিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে । দিঘির পানিতে শত শত মানুষ এপার থেকে ওপারে ছুটে বেড়াচ্ছে । আলতা রানি সেদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে । হঠাৎ করে রাজা কিয়াজের চোখ পরে রানির পায়ের দিকে । রানি পায়ে আলতা মেখে এসেছে ।
রাজা কিয়াজ অসহায় দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকায় । তবে সেখানে সে আজ কালো মেঘের ঘনঘটা দেখে। একটুপড়েই বৃষ্টি পড়তে শুরু করে । বৃষ্টির পানিতে রানির পায়ের আলতা ধুয়ে যেতে থাকে । রাজা কিয়াজ এবার স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে । মনে মনে বলে, আমি মানুষটা খুব স্বার্থপর না ।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই এপ্রিল, ২০১৬ রাত ১১:০৬