আমার এখনো বেশ মনে আছে।
মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। আমাদের পাঁচজনের একজন প্রস্তাব দিল, সবার আগে কে পুকুরের মাঝখানে যেতে পারবে? কথা শেষ হওয়া মাত্র সবাই দিলাম ছুট। ছুটতে ছুটতে একসময় থেমে গেলাম। আগপিছ করে যখন সবেমাত্র পুকুরের মাঝখানে এসে পৌঁছেছি তখন আরেকটা নতুন প্রস্তাব আসল। এবার কে আগে পুকুরের তলা থেকে কাঁদা তুলে আনতে পারবে? এটা কারো কাছেই কঠিন কোন বিষয় না। বর্ষায় পুকুরের পানির উচ্চতা একটু বেড়ে গেছে বলে সবাই একটু ইতস্তত করতে লাগল। তবে এই সাধারণ ব্যাপারটায় কেউই আর সময় দিতে চাইল না। পুকুরের চারপাশ শেষবারের মত ভালো করে দেখে নিলাম। পানির উচ্চতা বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে পুকুরের আয়তনও অনেক বেড়ে গেছে। সবাই লম্বা করে দম নেওয়ার প্রস্তুতি নিলাম। এক, দুই, তিন...
কি হইছে?
পুলের উপর দিয়ে পানি আসা শুরু করছে!
প্রথমে মা’র গলা তারপর আব্বার ভারি গলা শোনার পর চোখ খুলে ফেললাম। নতুন কিছু দেখার আগ্রহটা আর ধরে রাখতে পারলাম না। এক লাফে বিছানা থেকে নেমে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। সেখান থেকে একটা ছাতা নিয়েই আঙিনার মাঝখান দিয়ে পা বাড়িয়ে দিলাম। কিন্তু রান্নাঘর থেকে হঠাৎ মা’র কড়া গলা শুনে দাঁড়িয়ে যেতে হলো।
সেন্ডেল পায়ে দিয়ে যা।
মা’র দিকে না তাকিয়ে প্রথমে একবার পায়ের দিকে তারপর মাথা ঘুরিয়ে বারান্দার দিকে তাকালাম। দেখি আব্বা তখনো সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। এবার আঙিনার মাঝখান থেকে নির্ভয়ে দৌড় দিলাম। আমার দৌড় শেষ হলো বাড়ির পাশের সরু রাস্তাটার শেষ মাথায়, সেই পুলের সামনে।
তখনো ঝমঝম করে বৃষ্টি হচ্ছে। গত পাঁচ দিন ধরে চলছে এই বৃষ্টি। শেষ হওয়ার কোন লক্ষণ এখনো ভালো বুঝা যায়নি। আমি আসার আগে এখানে আরো অনেকেই এসে জড়ো হয়েছে। পুলের একপাশে সরু রাস্তাটার উপর দিয়ে পানি গড়িয়ে পার হচ্ছে। পানি আসছে দক্ষিণ পাশের বিল থেকে, যাচ্ছে উত্তরের বিলে। দুই বিলের মধ্যে পানি চলাচলের একমাত্র সুড়ঙ্গ পথ হলো এই পুল। ভিতরে জায়গা শেষ হওয়ায় এখন উপচে উঠেছে।
উপরের সেই অপ্রশস্ত নালী পথের দুই পাশে অনেকেই জায়গা করে নিয়েছে। এদের ভিতরে একজনের উপর চোখ পড়তেই সেখানে দাঁড়িয়ে থাকার আগ্রহ পুরোপুরি হারিয়ে ফেললাম। সে দাঁড়িয়ে আছে পানি আসার নালী পথটার একেবারে শুরুতে। তার পায়ের উপর দিয়ে পানি গড়িয়ে আসছে পিছন দিকে। ওর ডাক নাম ফারে। আমার একমাত্র জ্যাঠাতো বোন। পড়াশোনা ক্লাস ফাইভে। আমার এক ক্লাস উপরে।
ফারের দিকে একবার চোখ পড়তেই চোখ ফিরিয়ে নিলাম। তবে আরেকবার চোখ পড়ল তার বিরক্তিকর গলা শুনে।
কে রে সান্টু, তোর ছাতাটা এত ছোট ক্যান রে?
কোন কথা বলা তো পরের কথা, সেখানে দাঁড়িয়ে থাকার আর কোন প্রয়োজন দেখলাম না। মাথা তুলে বড় রাস্তার দিকে তাকালাম। সেখানে পাড়ার প্রায় অর্ধেক মানুষ।সবার চোখ রাস্তার দুই পাশে, ধানখেতের দিকে। অনেকেরে দৃষ্টি খেতের উপর দিয়ে অনেক দূরে হারিয়ে গেছে। তবে সবার মনেই এক অপ্রত্যাশিত শংকা। অনেক বড় কিছু হতে পারে!
ওদের ভিতরে একজনের চোখ রাস্তার ধার ঘেঁষে, ধানখেতের তলার দিকে । তার ডান হাতে একটা কোঁচ,দাঁড়িয়ে আছে বেশ সতর্ক ভঙ্গিতে। যে দাঁড়িয়ে আছে সে আমার একমাত্র জ্যাঠাতো ভাই। তার ভালো নাম, মাইনুল ইসলাম।
আমি যখন বড় রাস্তার উপর তখন মাইনুল ভাই তার কোঁচটা ধান গাছেরে গোড়ায় তাক করে ফেলেছে। হয়ত এখনি ছুঁড়ে মারবে। আরো কয়েক পা এগিয়ে যাওয়ার পর একবার ছপাৎ করে শব্দ হলো। এরপরই কোঁচটা সে একটানে তুলে আনল । আমি নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। হৈ হৈ করে খবরটা সবাইকে জানিয়ে দিলাম।
বেশ বড় সড় একটা শিং মাছ। কোঁচের দু’টা শিক খুব ভালোভাবে গেঁথে গেছে। আমি মাছের পেটটা একটু টিপে দেখে আরেকবার চিৎকার দিলাম, ভিতরে ডিম আছে তো !
যাদের হাতে কোঁচ নেই তারা একটু আফসোস করে বলল, ধরা না পড়লে মাছটা একসময় অনেক ডিম দিত।
এরপর আমি মাইনুল ভাইয়ে পিছু আর ছাড়লাম না । খানিকবাদে সে আমাকে জিজ্ঞেস করল, সান্টু, বিকালে নদী দেখবার যাবি? নদীর নাকি আখন ভয়াবহ অবস্থা!
এসব প্রশ্নের উত্তরে না বলার কথা আমি কখনো ভাবতে পারি না।
দুপুর হওয়ার অনেক আগেই সরু রাস্তাটা পানিতে ডুবে গেল। এখন পুলের কোন মাথায় আর দেখা যায় না। উপরে দাঁড়ালে পানি হাঁটুর কাছাকাছি চলে আসে। দুপুরের পর মাইনুল ভাইকে সাথে নিয়ে সেই রাস্তা পার হয়ে বড় রাস্তায় উঠে আসলাম।বড় রাস্তার কানায় কানায় পানি লেগে গেছে। অনেক দূরের ছোট বড় ঢেউ এসে ধাক্কা দিচ্ছে দুই পাশে। মনে হয় সুযোগ পেলেই গিলে ফেলবে। ধানখেতের দিকে এখন আর কেউ আগ্রহ নিয়ে তাকাচ্ছে না। কারণ সেখানে ধান গাছের দু চার ইঞ্চি মাথা ছাড়া দেখার মত কিছু নেই!
তারপরেও আমরা অনেক কিছু দেখতে দেখতে,আধাঘন্টা পর গ্রামের বাজারে এসে একটু দাঁড়ালাম।প্রায় পুরোটা পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় বাজার বসেছে রাস্তার উপর। মাইনুল ভাই সেখান থেকেই চাল ডাল কিনতে শুরু করল। আমি ব্যাপারটা ধরতে পারলাম না। আমরা তো আজ বাজার করতে আসিনি। তবে অবাক হওয়ার তখনো অনেক কিছুই বাকি ছিল।
টিপটিপানি বৃষ্টিকে সাথে নিয়ে আমারা আরো বিশ মিনিটের মত হাঁটলাম। যখন নদীর পাশে এসে দাঁড়ালাম তখন আমাদের সাথে আরো অনেকেই দাঁড়িয়ে গেছে। সবাই স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে হিস হিস করে ছুটে চলা এক অকৃত্রিম প্রবাহের দিকে। কারো মুখেই কোন কথা নেই। নদীটাকে এখন চারদিকে হাত পা ছড়ানো এক দীর্ঘকায় দৈত্যের মত দেখাচ্ছে। খানিকবাদে মাইনুল ভাই গলা নিচু করে বলল, দুই দিন আগে একবার দেখে গেছি সান্টু। তখন অবস্থা এত খারাপ আছিলো না।
নদীর গর্জন এই প্রথম আমার কানে লাগল। এই প্রথম একটু ভয়ও পেলাম।
ফেরার পথে বৃষ্টির বেগ অস্বাভাবিক রকম বেড়ে গেল। সাথে ঝড়ো বাতাস। দৌড় দিতে গিয়েও তেমন কোন সুবিধা করতে পারলাম না। মাইনুল ভাই উঁকিঝুঁকি মেরে একটা বাড়ির ভিতরে ঢুকে পড়ল । বেশ পুরাতন এই বাড়ি মূল পাড়া থেকে একটু বিচ্ছিন্ন। দুজনেই আঙিনা পার হয়ে মেঝের উপর গিয়ে দাঁড়ালাম। তবে এ বাড়িতে ঢোকার কারণ হঠাৎ ছুটে আসা ঝড়ো-বৃষ্টি না। আসলে, সবকিছু বুঝে উঠতে আমার অনেক সময় লেগেছিল।
মাইনুল ভাই বাজারের ব্যাগটা একপাশে রেখে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। মেঝের যে পাশে আমরা দাঁড়িয়েছিলাম তার অপর পাশে একজন মহিলা চুপচাপ বসে আছে। বয়স চল্লিশের বেশি না। আমাদের একবার দেখে নিয়ে খনখনে গলায় বলল, কে আসলা বাড়িতে?
আমি মাইনুল। ঝড়ের মধ্যে পড়িছি।
অ, মাইনুল আইছো। এত দূরে ক্যান? কাছে আইসা বসো।
আমরা দুজনেই আরেকটু সরে গিয়ে, একটা খেজুরের পাটিতে বসলাম। একটুপর মাইনুল ভাই কথা বলল, বাড়ি-ঘরের অবস্থা তো খুব ভালো দেখি না। অন্য কোন জায়গায় গিয়া থাকেন।
মহিলা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, হ যামুই তো। ভাবতাছি এই গ্রাম ছাড়ে চলে যামু।
মাইনুল ভাইকে হতাশ দেখাল। বলল, গ্রাম ছাড়ে কোথায় যাবিন?
বাপের দেশত যামু।
অ । আপনের বাপের বাড়ি জানি কোন জায়গায়?
এ প্রশ্নের কোন উত্তর পাওয়া গেল না। হয়ত সে উত্তর দেওয়ার কোন প্রয়োজন মনে করল না।
আসলে,এ গ্রামে তার না থাকাটাই স্বাভাবিক। স্বামী মারা গেছে গত তিন বছর আগে। নদীপারের একমাত্র আবাদি জমিটা হয়ত এবছর পুরোটাই নদী হয়ে যাবে। বিবাহযোগ্য মেয়েটার বয়স প্রতিদিন বেড়েই চলেছে। না, তার এ গ্রামে থাকার যথেষ্ট কোন কারণ নেই।
খানিকবাদে সে মহিলা মাইনুল ভাইয়ের দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকাল। বলল, মাইনুল, তোমাক নিয়ে আজ রাত্রে এটা স্বপন দেখিছি। দেখি তোমার বিয়া হইতাছে! যে মেয়ের সাথে তোমার বিয়া তার মুখটা হইল চাঁদের মতন।
কথা শুনে মাইনুল ভাই পুরোপুরি চুপসে গেল। মাঝ বয়সি মহিলা এবার একটু দম নিয়ে বলল, আমার মেয়েটারে তো দেখছ মাইনুল...
মাইনুল ভাই হঠাৎ অসস্থিতে পড়ল । বলল, হ দেখছি দেখছি। দুই দিন আগেই একবার আইছিলাম। মনে নাই?
কিচ্ছু দেখ নাই মাইনুল। আমার একমাত্র মেয়ে। চাঁদের মতন মুখ। বন্যা, একবার বাহির হইয়া আয় তো বুড়ি।
একটুপর দুজনেই পিছনে তাকালাম। বন্যা নামের মেয়েটা পাশের ঘরের দরজা খুলে বাইরে আসল । চৌদ্দ পনের বছরের একটা মেয়ে।যার গায়ের রং, দেহের গড়ন সবকিছুই মাঝামাঝি। কম খায় বলে মুখটা যতটা না লম্বা তার চেয়েও বেশি লম্বা দেখাচ্ছে।
বাইরে বের হয়েই মেয়েটা মনে হয় একটু ভরকে গেল। এক পা দরজার বাইরে এসে সেখানেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল। বন্যার মা এবার চোখ ফিরিয়ে মাইনুল ভাইয়ের দিকে তাকাল। বলল, মুড়ি খাইবা মাইনুল। বন্যা...
বন্যার মায়ের কথা আর শেষ হলো না। মাইনুল ভাই আমাকে একটানে মেঝে থেকে আঙিনায় নামিয়ে আনল । তারপর ছাতা হাতে নিয়ে হনহন করে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসল । তবে রেখে আসল তার বাজারের ব্যাগটা। অবশ্য সেটা রেখে আসার জন্যই সে এনেছিল।
কিছুদূর আসার পর সে আমার পিঠের উপর একটা হাত রেখে বলল, কি সাংঘাতিক মহিলা!চালাকি বুঝবার পারিছিস?
কিছু না বুঝলেও আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালাম। তবে অনেক পড়ে জেনেছিলাম, এ বাড়িতে মাইনুল ভাই এর আগে একবার না,এসেছিল বেশ কয়েকবার।
বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। বড় রাস্তাটা অনেক আগেই ডুবে গেছে। উপর দিয়ে পানির স্রোত এখন কিলবিল করে পার হয়ে যাচ্ছে। আমার হাফ প্যান্টটা বাঁচানোর অনেক চেষ্টা করেও কোন লাভ হলো না। পানি উঠতে উঠতে প্রায় কোমর পর্যন্ত ভিজে গেল। একবার মনে হলো, আজ আমার উপর দিয়ে ছোট খাটো একটা ঝড় বয়ে যাবে। তবে বাড়ি পৌঁছার পর দেখলাম অন্য কিছু । এরি মধ্যে সবার উপর দিয়ে ঝড় শুরু হয়ে গেছে।
ঘরের ভিতর থেকে দামি আসবাবপত্র সব বের করে আনা হয়েছে। বাইরে আঙিনায় বড় বড় খুঁটির উপর চালা দেওয়া । আর চালার নিচে ছোট ছোট খুঁটির উপর চৌকি। সবাই চৌকির উপর গুটিসুটি মেরে চুপচাপ বসে আছে। মাইনুল ভাইকে এর কারণ জিজ্ঞেস করতেই ব্যাপারটা সহজ ভাষায় বুঝিয়ে দিল।বন্যার পানি আঙিনা পার হয়ে ঘরের দেয়ালে লেগে গেছে। মাটির দেয়াল, কোন ভরসা নাই। একবার উপরে পড়লে কবর খোঁড়া শুরু করতে হবে। এই বর্ষা-বাদলের দিন কবর খোঁড়া নাকি খুবই ঝামেলার কাজ। তাই সবাই মিলে এই ব্যবস্থা করেছে।
সেই সন্ধ্যা বেলা পাঁচ ছয়টা কলা গাছ কেটে সে একটা ভেলা বানিয়ে ফেলল। চারকোনা কলা গাছের ভেলা। ইঞ্জিন চালু হবে আগামীকাল সকাল থেকে।
রাত্রে চৌকির উপর শুয়ে ঘুম আসতে একটু দেরি হলো। কারণ, আমার নিচ দিয়েই পানির স্রোত বয়ে যাচ্ছে। যতবার ভাবছি ততবারই হাত পা শিরশির করে উঠছে। শুয়ে থেকেই বাম হাতটা একবার নিচে নামিয়ে দিলাম। হাতের কবজি পর্যন্ত ডুবে গেল। চারপাশে পানির উপর ঝড়ে পড়া বৃষ্টির শব্দ হচ্ছে টপ টপ করে। একবার মনে হলো আমি একটা বিশাল ভেলার উপর শুয়ে আছি। ভেলাটা পট পট শব্দ করে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে।
টপপপানি বৃষ্টি তখনো থামেনি। সকাল বেলা মাইনুল ভাই এসে আমার ঘুম ভাঙ্গাল। বিছানার উপর উঠে বসতেই চোখ মুখ গম্ভীর করে বলল, আজ রাত্রে খুব খারাপ একটা স্বপ্ন দেখছি সান্টু।
কী স্বপ্ন?
স্বপ্নে দেখি, বন্যা নামের ঐ মাইয়ার সাথে আমার বিয়া হইতাছে।
এইটাতো ভালো স্বপ্ন।
আরে ভালো না। বিয়ার শেষে দেখি মাইয়াটা বিষ খাইছে।
ক্যান?
আমাক ওর পছন্দ হয়নি। চলতো ঐ বাড়ি থাইকা একবার ঘুরে আসি। ভেলা নিয়া যাব। যাবি নাকি?
এসব প্রশ্নের উত্তরে না বলার কথা আমি কখনো ভাবতে পারি না।
কলা গাছের ভেলাটা ধানখেতের উপর দিয়ে ভাসতে শুরু করল। মাইনুল ভাই শক্ত হাতে লগি ঠেলে যাচ্ছে। দুই পাশে পানি কেটে ভেলা নিঃশব্দে এগিয়ে যাচ্ছে। পানির নিচে ধান গাছের পাতাগুলো একান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও দুলে উঠছে। আমরা তাকিয়ে আছি সামনের দিকে। সেই সবুজ ধানখেতে এখন সবুজ বলে কিছু নেই।পুরো বিল ঘোলাটে পানিতে ভরাট। আমরা দেখছি নতুন কিছু।
এক ঘন্টার রাস্তা দুই ঘন্টায় শেষ করে আমরা যখন সেই বাড়িতে এসে ঢুকলাম তখন আমাদের নড়াচড়া প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। বাড়ির চারপাশে পানি লেগে গেছে। উপরের খড়ের চালা সহ ছোট্ট ঘরটার দুইপাশের দেয়াল ভেঙ্গে পড়েছে। তবে ভিতরে কেউ নেই দেখে মাইনুল ভাই স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলল। কিন্তু তারপরেই শুরু হল আসল সমস্যা। আশেপাশের কেউই এদের কোন খোঁজ দিতে পারল না। একজন শুধু সম্ভাবনার কথা বলল। তারা বড় দিঘির পারে যেতে পারে।
আমরা বড় দিঘির দিকে চলতে শুরু করলাম। নতুন রাস্তা, বাহনও নতুন। তবে ভাইকে দেখে মনে হলো না তার কোন অসুবিধা হচ্ছে। আরো একঘন্টা চলার পর সে দিঘির পারে ভেলা দাঁড় করালো।
দিঘির চেহারা পুরোপুরি পাল্টে গেছে। শত শত মানুষ এখানে তাদের শেষ আশ্রয় খুঁজে নিয়েছে। এদের ভিতর বন্যা নামের একজনকে খুঁজে বের করতে মাইনুল ভাই তিনবার চক্কর দিল। খুঁজে না পেয়ে বন্যা বন্যা বলে বেশ কয়েকবার চিৎকারও দিল। তার চিৎকার শুনে যারা একান্ত অনাগ্রহে তার দিকে একবারের জন্য তাকাল, তাদের চোখ দেখলে মনে হবে ভাইয়ের চিৎকার মানানসই হচ্ছে না।
দিঘি থেকে ফেরার পথে এক বয়স্ক লোকের সাথে দেখা হলো। পারের একটা বট গাছের তলায় চুপচাপ বসে আছে। দেখে আধা পাগল হলেও তার কথা শুনে বুঝা গেল পুরোটাই পাগল। মাইনুল ভাই কাছে গিয়ে আশাহতের মতো জিজ্ঞেস করল, এইখানে বন্যা নামের কাউকে দেখিছিন?
লোকটা অনেক আগ্রহ নিয়ে চটপট উত্তর দিল, হ, দেখিছি তো।
কোন জায়গায়?
কোন জায়াগায় মানে? বন্যা তো চারদিকেই দেখা যায়। বিশ্বাস হয় না? তাকায়ে দেখো।
মাইনুল ভাই আর কোন দিকেই তাকাল না। সোজা এসে ভেলার উপর দাঁড়াল।
আমাদের ভেলা আবারো চলতে শুরু করেছে, তবে এবার যথেষ্ট ধীর গতিতে।সামনে খানিকদূর যাওয়ার পর দুজনেই একবার পিছনে তাকালাম। কান ছেড়ে দিয়ে কিছু একটা শোনার চেষ্টা করলাম। চারপাশে সাড়া জাগিয়ে কিছু একটা ছুটে আসছে। একটুপর সবকিছু ছাপিয়ে ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়তে শুরু করল । ছাতার উপর ফুটতে লাগল খইয়ের মত।
ভেলা যখন বিলের মাঝখানে তখন সে গম্ভীর গলায় এক চাঁদ-মুখের গল্প শোনাল। এই দুনিয়ায় দুই রকমের চাঁদমুখ আছে। এক হলো পূর্ণিমা চাঁদের মত মুখ। আর দুই হলো, নতুন চাঁদ, মানে বাঁকা চাঁদের মত মুখ। বন্যা নামের ঐ মেয়েটার মুখ হলো বাঁকা চাঁদের মত।
মাইনুল ভাই কী মনে করে তার ছাতাটা বন্ধ করে ফেলল। হয়ত ছাতা মাথায় লগি ঠেলতে অসুবিধা হচ্ছে। তারপর আরো কিছুদূর যাওয়ার পর আমার ছাতাটাও জোর করে কেড়ে নিল। এবার ভাইকে দেখে মনে হলো, সে এখন চরম রকমের বিরক্ত। তবে এই ধারালো বৃষ্টিকে কোন পাত্তা দিচ্ছে না। সে লড়তে চায় কোন সীমাহীন শক্তির সাথে। তার যত আক্রোশ এই বৃষ্টির উপরে।
সেদিন দুপুরের পর মাইনুল ভাইয়ের দেখা আর পেলাম না। শুধু দেখলাম তার ভেলাটা। বাঁধা পড়ে আছে একটা তালগাছের সাথে। অনেক দূরের ঢেউ এসে ধাক্কা দিয়ে চলে যাচ্ছে। ইচ্ছা না থাকলেও সেটা নড়ে উঠছে। তবে চলমান তরঙ্গের সাথে তাল মিলাতে পারছে না।
বিকেল বেলা চৌকির উপর বসে আছি এমন সময় মা হাসি মুখে আমার সামনে এসে দাঁড়াল। বলল, সান্টু, বন্যার পানিতো কমতে শুরু করছে রে!
আমি আমার মায়ের হাসিতে যোগ দিতে পারলাম না। কারণ পানি কমে যাচ্ছে, এটা আমার কাছে হাসি বাড়ানোর মত কোন খবর না!
এরপর সমস্ত বিকেল প্রায় চৌকির উপরই শেষ হয়ে গেল। তারপর সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত। রাতে শুয়ে পড়তেই ঘুম চলে আসল । ঘুমের ভিতর কয়েকবার আব্বার ভারি গলা শুনতে পেলাম। সে প্রতিবার একি কথা বলছে। বন্যার পানি নাকি হিড়হিড় করে কমে যাচ্ছে। ঘুমের ঘোরেই একটা হাত চৌকির নিচে নামিয়ে দিলাম। হাতে পানির কোন স্পর্শ পেলাম না।
খুব ভোরবেলা ঘুম ভাঙ্গল ছোট বাচ্চাদের বিস্তর চেঁচামেচি শুনে। বৃষ্টি পড়া পুরোপুরি থেমে গেছে। পূর্বাকাশ রাঙা হয়ে আছে। মনে হয় এখনি সূর্যের দেখা পাওয়া যাবে।বিছানা থেকে নামার আগেই দেখলাম আমার পায়ের নিচে একজোড়া সেন্ডেল,কোন পানি নেই।সেন্ডেল পায়ে দিয়ে ধীরে ধীরে রাস্তার উপর এসে দাঁড়ালাম। সেখানে কাঁদার উপর ছোট বড় অসংখ্য পায়ের নরম ছাপ।
পা টিপে টিপে আরো খানিকদূর এগিয়ে গেলাম। তারপর দেখলাম মাইনুল ভাইকে। বড় রাস্তার উপর নির্বিকার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। উদাস দৃষ্টিতে কী যেন দেখছে । তার চোখ সোজা করে হাঁটতে শুরু করলে হাঁটা শেষ হবে ঐ বাড়িটার সামনে।
পূর্বাকাশে চিকচিকে রোদ বের হয়েছে। আরেকটু সামনে যেতেই চোখ পড়ল ফারের দিকে। সে পুলের পাশে সেই সরু স্রোতের উপর পা ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার পায়ের উপর দিয়ে ঘোলা পানি পার হয়ে যাচ্ছে। তবে এবার উল্টো দিকে, উত্তর থেকে দক্ষিণে।
ফারেকে পাশ কাটিয়ে বড় রাস্তার উপর এসে দাঁড়ালাম। তবে তাদের দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারলাম। যেন ডালা ভরে ফেরিওয়ালা সেখানে মজার কিছু বিক্রি করছে। যেন এখনি সব শেষ হয়েছে।
ফারে পুলের কাছে আরো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর সেখান থেকে সরে গেল। বাড়ির দিকে পা বাড়ানোর আগে পিছনের সবকিছু একবার দেখে নিল। এরপর কেন জানি হঠাৎ করে থেমে গেল। মাথা তুলে একবার আকাশের দিকে তাকাল। অনেক দূরে, ঈশান কোণে কয়েক খন্ড মেঘ জমাট বেঁধে আছে। সে কী মনে করে তার বন্ধ ছাতাটা ফুটিয়ে মাথার উপর ধরল। তারপর নির্বিকার ভঙ্গিতে বাড়ির দিকে চলতে শুরু করল।
সেদিন সকালে অনেকে ভালোভাবে বুঝতে পারল, তাদের সব কিছু শেষ হয়ে গেছে। তারা অনেক কিছুই হারিয়ে ফেলেছে । কিন্তু আমরা, এমন কিছু হারিয়ে ফেলেছিলাম, যা চাইলেই পাওয়া যায় না।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই আগস্ট, ২০১৬ রাত ১১:১৬