আমি মাঝে মাঝে আমার আশ পাশের
ছেলেগুলোকে দেখে খুব কষ্ট পাই।
তাদের কথা একটু মন দিয়ে ভাবলেই
কেমন মন খারাপ হয়ে যায়। এই জগতে
ছেলেরা না থাকলে আমাদের কিন্তু
খবরই ছিল। হঠাৎ করে ছেলেদের প্রতি
এত আবেগ উথলে উঠার কারন ব্যাখ্যা
করি। আসলে প্রায়ই উঠে। বলা হয়ে
উঠেনা। চারপাশে যে হারে
মেয়েদের জন্যে সিমপ্যাথি উড়ে
বেড়ায় বা মেয়েদের ত্যাগের মহিমা
নিয়ে লেখালেখি হয়, সেভাবে
আমরা কখনোই ছেলেদের উদারতার
কথা লিখিনা। তাদের জীবন যুদ্ধের
খোঁজ আমরা খুব কম ই রাখি। তাই আজ শুধু
ছেলেদের ত্যাগের গল্প বলবো।
সত্যিকারের গল্প।
একটা পরিবারে পিঠেপিঠি দুই ভাই
বোন বড় হয় একেবারেই দুই রকমের
ভাবনা নিয়ে। অস্বীকার করার উপায়
নেই। ছেকেটাকে বড় হয়ে একজন
সাকসেসফুল মানুষ হতে হবে।
সাকসেসফুল বলতে আমরা বুঝাই ভাল
পড়াশুনা, ভাল রেজাল্ট, ভাল জব বা
বিজনেজ, সর্বোপরি ভাল ইনকাম।
ছোট বোনটার ধুমধাম করে বিয়ে দিতে
হবে। বাবা মার সমস্ত খরচের দায়িত্ব
নিতে হবে, নিজের ছেলেটার জন্যে
ভবিষ্যৎ গড়ে দিতে হবে, থাকার জন্যে
একটা বাড়ি করতে হবে। বিয়ের পরে
বোনটার কোন বিপদ হলে পাশে
দাঁড়াতে হবে, বউ এর বাবা মা সহ ছোট
ভাই বোন থাকলে তাদের দায়িত্ব ও
কিন্তু কম বর্তায় না। এমন হাজারো
লিখিত অলিখিত দায়িত্ব কাঁধে
নেয়ার প্রস্তুতি নিয়েই একটা
ছেলেকে বড় হতে হয়। একজন সুস্থ
সয়ংসম্পূর্ন মানুষের যেই দায়িত্ব একজন
কানা খোঁড়া ছেলের ও একটা
সংসারে একই দায়িত্ব থাকে। কারন
তাদের সংসারের মাথা বলা হয়। বট
বৃক্ষ বলা হয়।
এর মাঝে আমরা খোঁজ রাখি সেই
ছেলেটার যে পাড়ার মোড়ে
দাঁড়িয়ে হিসেব রাখে, কোন মেয়ের
জামার গলা কত বড়। কোন মেয়েকে
দেখে ছেলেটা সিটি বাজালো বা
কোন ছেলেটা নেশা করে বিপথে
গেল।
আমরা কেউ সেই ছেলেটার খোঁজ হয়ত
রাখিনা, যে ছেলেটা বন্ধুদের
আড্ডায় চায়ের বিল দেয়ার ভয়ে
আড্ডায় না গিয়ে আর একটা নতুন
টিউশনি নিয়েছে। যেন পরের মাসে
মায়ের হাতে কিছু টাকা তুলে দিতে
পারে। আমরা সেই ছেলেটার খবর
রাখিনা, যে নিজের পড়াশুনার খরচ
নিজে চালাতে সন্ধ্যার পর মুখ ঢেকে
নিজের এলাকার বাইরে এসে রিকশা
চালায়, বা শখের গিটার টা বিক্রি
করে বাবার ঔষুধ কিনে, বা
প্রতিমাসে মাত্র সাতশো টাকা আয়
করে নিজের প্রাইভেট খরচ দেয় ছয়শ
টাকা আর একশ টাকা রাখে সারা
মাসের হাত খরচের জন্যে। আমরা সেই
ছেলেটার খবর ও কখনো রাখিনা, যে
পারিবারিক দৈন্যতা দেখে পড়ার খরচ
চালাতে না পেরে বুয়েটে চান্স
পেয়েও ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন কে
ছুঁতে পারেনি।
মুহিন, বয়স ৩৬। এখনো বিয়ে করেনি।
বাবাকে দেখেছে অল্প বয়সে ক্লান্ত
পরিশ্রান্ত চেহারায় ঘরে ফিরতে।
মেয়েটার ভাল একটা বিয়ে দেয়ার
চিন্তায় রাতের পর রাত জেগে
কাটাতে। অল্প কিছু হলেও বাড়তি
আয়ের জন্যে দিনের পর দিন ওভার টাইম
করে অসুস্ত হয়ে অনেক দিন বিছানায়
পড়ে থেকে বাবাটা চোখের সামনে
মারা গেল। মুহিন কিছুই করতে
পারেনি। পারেনি ভাল চিকিৎসা
দিয়ে বাবাকে সুস্থ করার চেষ্টা
করতে।
আশফাক, ঢাকা ভার্সিটি থেকে
চারুকলায় পড়াশুনা করে সেরকম সুবিধা
করতে পারছিল না বলে আঁকা আঁকি
ছেড়ে দিয়ে এখন সে হোটেল
বিজনেজ করে। সংসার এর হাল তো
ধরতে হবে।
জামান। বিরাট বড় লোকের ছেলে।
ঘুষের টাকায় বাপ দালানের পর
দালান তুলছে। সব থেকে দামী গাড়ি
জন্মদিনে গিফট পায়। বাবার পাপের
প্রতিবাদ করতে একদিন ঘর ছেড়ে
বেরিয়ে আসে। তারপর বুঝতে পারে
জীবন যুদ্ধ আসলে কি? ভালবেসে এক
মেয়েকে বিয়ে করে, টানাটানির
সংসার বেশিদিন টেকেনি। বউটা
ওকে ছেড়ে চলে যায়। জামান বুঝতে
পারেনা বেঁচে থাকার জন্যে আসলে
কি প্রয়োজন? সততা নাকি টাকা??
আমরা মেয়েরা কত ভাগ্য নিয়ে এই
পৃথিবীতে এসেছি! আমাদের খবর
রাখতে হয়না আমাদের বাবারা সকাল
ছয়টা থেকে রাত এগারটা পর্যন্ত
বাইরে কি করে? অফিসে তাদের
অন্যের কথা শুনে মাস শেষে সেলারী
গুনতে হচ্ছে কিনা। আমাদের খোঁজ
রাখতে হয়না, সামনের মাসের ছেলের
সেমিস্টার ফাইনালের পঞ্চাশ
হাজার টাকা স্বামী কোথা থেকে
যোগাড় করে আনলো? রুপাকে কখনো
বুঝতে হয়না ওর শখের চাকরী টা
সংসারে কতটা প্রয়োজনীয় ভুমিকা
রাখতে পারে! নিশিকে কখনো বুঝতে
হয়না, মারুফের একার ইনকামে সংসার
চালাতে মারুফ সামনের মাসে
অফিসের পরে ও একটা পার্ট টাইম জব
করবে।
বউ মা শখ করেছে সামনের মাসে সমুদ্র
দেখতে যাবে। ওরা জানেনা, রিপন
বসের পেছন পেছন ঘুরেও এখনো লোনটা
নিতে পারেনি। রিপনের ছোট
ভাইটা পড়াশুনা শেষ করে একটা
চাকরি যোগাড় করতে না পেরে
লজ্জায় কারোর সামনে আসেনা। বড়
ভাই এর একার রোজগারে বাসায়
খেতেও তার লজ্জা করে।
কি অদ্ভুত সব গ্লানী !! কি কঠিন জীবন
যুদ্ধ আমাদের বাবা ভাইয়াদের,
স্বামীদের !! নিজেকে ওদের জায়গায়
ভাবলে কেঁপে উঠি। আল্লাহ কতটা
মনোবল দিয়ে ছেলেদের এই পৃথিবীতে
পাঠিয়েছে !! কতটা নির্ভরতায়,
ভালোবাসায় ওরা আমাদের আগলে
রাখে !! কতটা মনের জোর থাকলে এত
কষ্ট করেও হাসি মুখে শুনে যায় বাবা,
মা, ভাই, বোন, বউ, বাচ্চার অনেক কিছু
না পাওয়ার আক্ষেপের খোঁটা। কতটা
উদার হলে কখনো হিসেব করতে বসে
না ইনকামের একটা পয়সাও তো নিজের
জন্যে জমানো হয়না !! অনেক দিন
নিজের জন্যে একটা ভাল শার্ট কেনা
হয়না, অফিসের চটি জোড়াও পুরনো
হয়ে গেছে! হাতের ঘড়িটা সেই কবে
বউ গিফট করেছিল! মাঝে দুইবার
ব্যাটারি চেঞ্জ করতে হয়েছে।
আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে
এমন হাজারো গল্প। মন খারাপ করা
জীবনের এক এক টা পরিচ্ছেদ।
colllected...........