আমি বেশ কয়েকজন আরবীভাষী সহপাঠি পেয়েছি । তাদের মধ্যে দু'এক জন আবার নাস্তিক। একজনের সাথে কোরআন নিয়ে কথা হয়েছিল। সে আমাকে জানালো, কোরআনে অনেক ভুল আছে। তাকে বললাম, দেখাও কোথায় কোথায় ভুল আছে। সে যা দেখালো তা একবচন বহুবচন সম্পর্কিত। বললো, গণিতেও ভুল আছে। উত্তারাধিকারদের মধ্যে কোরআনের নিয়মে সম্পদ বণ্টণ করলে কম বেশি হয় । আমি বললাম, পাগলা, কোরআন মজিদ বুঝতে হলে কোরআনের দৃষ্টিতে দেখার দরকার। ব্যাকরণের সৃষ্টি হয়েছে কোরআনের বহু বছর পরে। আরবী ব্যাকরণের ভিত্তিটাও কোরআন। একারণে ব্যাকরণ দিয়ে কোরআনের ভুল ধরা যায়না। আর কোরআনের একবচন বা বহুবচন ব্যবহারের প্রেক্ষাপট কারণ রয়েছে। সম্মানের ভিত্তিতে এবচন বা বহুবচন ব্যবহার করা হয়েছে। এগুলো বুঝতে বালাগাত বা অলঙ্কার শাস্ত্র পড়তে হবে। আর উত্তারাধিকার বণ্টনে কোরআন মিলিয়ে দিলে মুসলমানরা গণিত নিয়ে গবেষণা করতেন না। এর ফলে গবেষণা করতে হয়েছে। এতে আউল আর রাদ ধারণার উদ্ভব হয়েছে। তাছাড়া কোরআনে বলা হয়েছে, ওয়া ফি আমওলিকুম হক্কুন লিসায়িলি ওয়াল মাহরুম। ‘তোমাদের সম্পদে ভিক্ষুক ও বঞ্চিতদের হক রয়েছে।’ সম্পদ বণ্টন উত্তারাধিকারদের মধ্যে মিলে গেলে এই আয়াত বেকার হয়ে যেতো। এটি কারো ভাবনায় আসতোনা। বণ্টন করতে গিয়ে বেশি থাকলে রাদ না করেও গরীবদের দিয়ে দিলেই তো হয়। এছাড়াও কোরআনের মতো একটি আয়াত বানিয়ে দেখানোর যে চ্যালেঞ্জ রয়েছে এটাও সে মানতে নারাজ। সে বলেছে, কিছু দিন আগে করোনার সময় তিউনিশিয়ার একজন করোনা নিয়ে সুরা কারিয়াহ এর আদলে একটা সুরা বানিয়ে সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করে। এতে ব্যাপক দাঙ্গা হাঙ্গামা হয়। একারণে সবাই এটি এড়িয়ে চলে। আমি তাকে বললাম, কুরআন হলো ইউনিক। দশভাবে এটিকে পড়া যায়। এটা না কবিতা না প্রবন্ধ। পাঠ পদ্ধতি বা তেলাওয়াতের কারণে অন্য ধর্মগ্রন্থের সাথে পার্থক্য তৈরি হয়েছে। কোরআনের মতো সুরা তৈরির যে চ্যালেঞ্জটা ছুড়ে দেয়া হয়েছে তা হলো- কোরআনের আদলে সুরা তৈরি নয়। এরকম ইউনিক আরেকটা কোরআন বা সুরা তৈরির চ্যালেঞ্জ দেয়া হয়েছে।
আমি তাকে বললাম, আমাকে সাড়ে ১৪ শ বছর আগের বাংলা পড়ে শুনানো হলে, আমি কিছুই বুঝবোনা। অক্ষরও চিনবোনা। কত বিবর্তন হয়েছে। অথচ কোরআনের আরবী ঠিক এত সময় পরেও স্টান্ডার্ড আরবী। কোন আরবী ভাষাভাষীর বুঝতে একটুও কষ্ট হয়না। আমাদের যাদের মাতৃভাষা আরবী নয়; যারা বিদেশী তবে কোরআনের আরবী বুঝি; তারা কোরআনের আরবী দিয়েই আধুনিক আরবী বুঝতে পারি। যদিও আরবী কথ্য ভাষায় পরিবর্তন হয়েছে।
যাই হোক, কোরআনের বিরোধীতাকারীদের জবাব দিতে এ বিষয়ে কথা বলার উদ্দেশ্য নয়। উদ্দেশ্য হলো- এটা জানানো যে, আরবীভাষীদের মধ্যেও নাস্তিকতা বাড়ছে। এরা আধুনিক শিক্ষিত। তাদের সাথে কথা বলে যা বুঝলাম, ইসলাম নামধারী একটি অংশের উগ্রতা মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ হানাহানির পেছনের কারণ বলে তারা মনে করছে। কেউ এই দুর্ভোগ ও মৃত্যূর জন্য ইসলামকেই সরাসরি দায়ী করছে। ফলত: তারা ধর্ম ছাড়ছে। বর্তমান বিশ্বে অনেকে যেমন মুসলমান হচ্ছেন। আবার অনেকে ইসলাম ধর্মও ত্যাগ করছেন। ইসলামত্যাগী বিখ্যাত মানুষের তালিকা উইকিপিডিয়াতেও আছে। এদের কেউ উগ্র নাস্তিকও হচ্ছে। সম্প্রতি ইরাকের একজন সুইডেন প্রবাসি বারবার কোরআন পুড়িয়ে অবমাননা করেছে। সে আরবীভাষী উগ্রপন্থী নাস্তিকদেরই একজন।
এখন প্রশ্ন হলো- কোরআন পোড়ানো যায় কী না? এ বিষয়ে আলোচনা করা যাক। কোরআনের ১০৬টি আয়াতে কোরআন সম্পর্কে বলা হয়েছে। একটি আয়াতে বলা হয়েছে, কোরআন মজিদ আল্লাহ নাযিল করেছেন। আর আল্লাহই এই কোরআন সংরক্ষণ করবেন। এ কারণে কোরআনকে ধ্বংস করা সম্ভব নয়। এর বড় প্রমাণ হলো- বর্তেমানে বিশ্বে প্রায় সাড়ে ছয় কোটি কোরআনের হাফেজ রয়েছে। একদল মনে করে, কোরআন ছাপানো পুস্তক পুড়িয়ে দিলে বা ছিড়ে ফেললেই তা ধ্বংস হয়ে যাবে। এরা পুরাপুরি বোকার স্বর্গে বাস করে। আবার একদল মনে করে, কাগজে লেখা যে কোরআন তা আগুনে পুড়েনা। এদেরও কোরআন সম্পর্কে সাধারণ ধারণার অভাব রয়েছে। এ কারণেই কোথাও অগ্নিকান্ডের পর প্রায়শই দেখা যায়- কোরআন পুড়েনি বলে প্রচার করা হচ্ছে৷ আর তাতে বেকুব লোকজন হুমড়ি খেয়ে পড়ছে৷ তো আমার প্রশ্ন হলো- কোরআনের বই না পুড়লে সুইডেনে পুড়ালো কীভাবে?
শেষের এই শ্রেণির মানুষের যে বিষয়টা জানা দরকার তা হলো- কোরআন হচ্ছে- শব্দ (লফজ) ও অর্থ (মানাআ) দুটার সমন্বয়। যখন এটা পড়া হয়- তখনি এটা কোরআন। আর কোরআনের শাব্দিক অর্থও পঠিত। মাদরাসায় কোরআনের এ বিষয়ে পড়ানো হয়। সেখানে এ বিষয়ে বিস্তারিত পড়তে হয়। এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়েছে- হালিল কুরআনু লফজান আও মাআনান? কোরআন কী শব্দের নাকি অর্থের? এ বিষয়ে ইমামদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। ইমাম আবু হানীফা রা. এক সময় মনে করতেন অর্থটাই কোরআন। কারণ কোরআনে বলা হয়েছে, ওয়া ইন্নাহু লা ফি ঝুবুরিল আউয়ালিন- কোরআন পূর্ববর্তী কিতাবেও রয়েছে। (সুরা শুআরা:আয়াত ১৯৬) অথচ পূর্ববর্তী কিতাবগুলো আরবীতে লিখিত ছিলনা। একারণে ইমাম আবু হানীফা রা. ফারসিতে কোরআন পড়া যাবে বলে মত দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে হানাফী স্কুল অব থটের ইমাম হযরত আবু ইউসুফ রা. ও ইমাম মুহাম্মদ রা. বলেছিলেন, নামজে আরবীতেই কুরআন পড়তে হবে। শেষ বয়সে ইমাম আবু হানীফা রা. অবশ্য এটা মেনে নিয়েছিলেন। সবশেষ কথা হলো- হানাফী মাজহাবের মতে, কোরআন হলো শব্দ ও তার অর্থের সমন্বয়। কোরআন শুধু শব্দ নয়। শুধু অর্থও কোরআন নয়। তাহলে অর্থ না বুঝে শুধু কোরআন পড়লে কী সওয়াব হবেনা? এই বিষয়টা স্পষ্ট করা প্রয়োজন। সেটা হলো- কোরআন বুঝে পড়ুক বা না বুঝে পড়ুক পড়লেই সওয়াব পাওয়া যাবে। তবে অর্থ বুঝে পড়াটাই ভালো।
সবশেষে বলা যায়, আগুনের বৈশিষ্ট্য পুড়িয়ে দেয়া। এজন্য কাগজে লেখা যেকোন কিছু আগুনে পুড়বে। তাতে কোরআনের কিছু লেখা থাকলে তাও পুড়বে। তবে কাগজে লেখা কোরআনের শব্দগুলো একটি দৃশ্যমান অংশ। এটা আবার অদৃশ্যভাবে বুকেও ধারণ করা যায়। আরেকটি অদৃশ্য বিষয় হচ্ছে- অর্থ। আল্লাহ যা বলেছেন। যখনি পড়া হবে-এই দুটি বিষয় একত্রিত হয়ে কোরআন হবে। এটা পোড়ানো সম্ভব নয়। কেউ কোরআন বইটি পুড়ে ফেললে সেটা কোরআনের অবমাননা হবে নিশ্চয়ই। তবে সে কোরআন পুড়িয়ে দিয়েছে- এমনটা কোনক্রমেই সম্ভব নয়। এছাড়াও সাড়ে ছয় কোটি কোরআনের হাফেজের বুকে আগুন দেয়া সম্ভব নয়। কোরআন হলো নুর। এ নুর নির্বাপিত করাও সম্ভব নয়।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৩