প্রচুর ট্যাবুর দেশ বাংলাদেশ । আর তার একশোটার মধ্যে একটাও খুঁজে পাওয়া যাবেনা যেটা ভালো বা দরকারী; বরং বিপরীতটাই পাওয়া যাবে- একশো ট্যাবুর তালিকা তৈরী করলে তার সবগুলোই অদরকারী এবং কোন কোন ক্ষেত্রে ভীষণ ক্ষতিকর । মেয়েদের ঋতুকালীন সময় বা তার আনুষঙ্গিক যে কোন বিষয় নিয়ে কথা বলা এরকমই একটা বিষয় ।
কথা বলছি ঋতুকালীন বা মেন্স-সাইকেল চলাকালীন সময়ে এবং পরবর্তী সময়ে মেয়েদের স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে । এটাও যে একটা বিষয় হতে পারে ভাববার বা বলবার, সেটাই আমরা এখনও বেশীর ভাগ মানুষ ভাবতে পারিনা । কারণ, এটা খুবই নিষিদ্ধ, খুবই গোপন, খুবই লজ্জার একটা বিষয়...! মেন্স-সাইকেল নিয়ে কথা বলতে গেলে গলার স্বর অবধারিতভাবে ফিসফিস হয়ে যায়, বিভিন্ন সাংকেতিক ভাষায় বলা হয় এসব কথা । কিন্তু কেন যে সেটা নিষিদ্ধ আর কেনইবা সেটা লজ্জার, তা কেউ বলতে পারেনা। প্রকৃতিতে মানবপ্রজাতি সহ যেকোন প্রজাতি তার বংশবিস্তার করে সে প্রজাতির মাতৃগোষ্ঠীর মাধ্যমে। তাহলে মাতৃত্বের পরিচায়ক বস্তুটি লজ্জা আর নিষিদ্ধ হয় কেমন করে...? তাছাড়া সম্মান বা গর্ব তো পরে করবে-বেঁচে বর্তে থাকলে তবে তো করবে ! শুধুমাত্র এ সম্পর্কে অসচেতনতার কারণেই বছরে শত শত মহিলা মৃত্যুকে কাছে ডেকে নিচ্ছে- সে সম্পর্কেও আমরা ভাববার প্রয়োজন বোধ করিনা ।
ফেসবুকে একটা ইভেন্ট চলছে- বছরব্যাপী চলবে । ইভেন্টটার বিষয় হলো- পথশিশু-কিশোরী ও বস্তিবাসী হতদরিদ্র শিশু-কিশোরী দের মধ্যে স্যানিটারী ন্যাপকিন বিতরণ । বিষয়টা আমার ভালো লেগেছে। আন্তরিকভাবে স্বাগত জানাই এবং চাই ইভেন্টটি সফল হোক । অনেক দেরীতে হলেও আমরা প্রচলিত ট্যাবু ভেঙে বেরিয়ে আসছি এবং এ বিষয়টা নিয়ে কথা হচ্ছে, কাজ হচ্ছে, ব্যাপারটা চমৎকার । (ইভেন্টের লিংক প্রথম কমেন্টে।)
আমি এ ইভেন্ট থেকেই এ তথ্যটা জেনেছি যে, অসংখ্য হতদরিদ্র কিশোরী, তরুণী তারা তাদের মেন্স-সাইকেল চলাকালীন সময়ে “শুকনো পাতা” বা “খড়” ব্যাবহার করে এবং আক্ষরিক অর্থে আঁতকে উঠেছি!!! আমার পক্ষে কল্পনা পর্যন্ত করা অসম্ভভ কথাটার মানে!! কাপড় বা তুলা ব্যাবহারের ফলে স্যাঁতসেঁতে ও অপরিচ্ছন্ন থাকার কারণে হাজার হাজার মহিলা জরায়ুর ইনফেকশান, টিউবের ইনফেকশান, টিউমার, ক্যান্সার এ আক্রান্ত হয় । তারউপর খড় বা শুকনো পাতায় কী হবে ভাবতেই আমার মাথা হ্যাং হয়ে যায়!! তাই এ ইভেন্ট এর মাধ্যমে যে কেবল সাহায্যই করা হবে তা না, একটা বিশাল সচেতনতা সৃষ্টি হবে সব ঋতুবতীর মধ্যে । নিঃসন্দেহে “পথশিশুদের নিয়ে আম উৎসব” , “পথশিশুদের সাথে ইফতারীর” চেয়ে একহাজার গুণ দরকারী ও কার্যকরী কর্মসূচী এটি ।।।
এবারে ইভেন্ট এর বাইরে এসে কিছু কথা বলবো ।
একটা বিষয় আমরা খেয়াল করবো, ধনী হোক, দরিদ্র হোক, মেয়েদের কাপড় ব্যাবহার করবার মূল কারণ কিন্তু “রিসাইক্লিং” ! স্যানিটারী ন্যাপকিন যেখানে ওয়ান টাইম ইউজ সেখানে একই কাপড়ের টুকরা ধুয়ে ধুয়ে বছরের পর বছর ব্যাবহার করতে পারছে তারা । “খরচ” এর প্রশ্ন আসছে সেখান থেকেই । শারীরিক বৈশিষ্ট্য ভেদে সবার প্রতি মাসে ১০টা থেকে ২০টা করে ন্যাপকিন লাগে । সুতরাং “১০০ থেকে ২০০ টাকা খরচ করার চেয়ে খরচ শূণ্য থাকাই বরং ভালো” এরকম একটা মানসিক প্রবণতা প্রত্যেকের মধ্যে থাকে ।
একটা কথা স্পষ্ট হওয়া দরকার, যেসব পরিবারের ছেলেমেয়েরা জীবনের কোন চাহিদার ক্ষেত্রেই আর্থিক সমস্যার সম্মুখীন হননি, তাদের পক্ষে এরকম মানসিক প্রবণতা বুঝতে পারা কঠিন হতে পারে , কিন্তু নিম্ন মধ্যবিত্ত বা দরিদ্র পরিবারগুলোর জন্য এটা খুবই স্বাভাবিক বিষয়; আর হতদরিদ্র বা ছিন্নমূল পরিবারগুলোর কাছে তো অকল্পনীয় এবং বাতুলেরও অধিক বিষয় এটি...
বস্তিবাসী কিংবা ছিন্নমূল শিশু-কিশোরী যারা তাদের নিত্যকার দুই বেলা খাবারের যোগানে অস্থির থাকে, তাদের পক্ষে দামী ন্যাপকিন ব্যাবহার বাস্তবিক অকল্পনীয় কেবল দামের কারণেই । শুধু ঋতুকালীন ভালো ন্যাপকিনই নয়, স্বাস্থ্য রক্ষা সংশ্লিষ্ট যাবতীয় কর্মই তাদের কাছে আকাশ কুসুম চিন্তা !
আবার একজাতের ধনীর কথা বলতে পারি, যাদের টাকাশালে টাকা, গয়নাশালে গয়না, কাপড়শালে কাপড়, খাবার শালে খাবার- অভাব শব্দটার বানানের সাথেও যারা অপরিচিত- তাদের ঘরের মেয়ে/বউরাও এই মেন্স চলাকালীন সময়ে শাড়ির ছেঁড়া টুকরা ব্যাবহার করে...! তাদের ভাষ্য হলো, “মেয়েদের এইসব নোংরা, নাপাক জিনিষের জন্য আবার কিসের খরচাপাতি”! অথবা “দোকান থেকে একজন পুরুষ দোকানীর কাছ থেকে এসব কী করে কিনবো” কিংবা “বাপ-ভাই- স্বামীকে কী করে এসব কিনতে বলি ছি ছি, আল্লাহ গুনাহ্ দিবে..” ! ! ! এই অবস্থা সকলে হাসিমুখে মেনে নিয়েছে বিশ্বাস করুন, করুণ অপারগতায় নয়!!!
সুতরাং বুঝাই যাচ্ছে, সমস্যাটা যতটা আর্থিক প্রতিবন্ধকতার, ঠিক ততটাই মানসিক প্রতিবন্ধকতারও বটে !
ফেসবুকের যে ইভেন্টের কথা বলেছি, তার মূল সফলতা সচেতনতা বৃদ্ধিতে । সাথে হতদরিদ্র মানুষদের কিছু ন্যাপকিন দিয়ে সাহায্য করাতে । নিঃসন্দেহে মহতী প্রচেষ্টা । কিন্তু এই বিতরণ করা ন্যাপকিনগুলো শেষ হয়ে গেলে তারা কী করবে??? আমি বলতে চাইছি, এতক্ষণ আমি যেসব প্রতিবন্ধকতার কথা বললাম, সেসবের কোন স্থায়ী বা দীর্ঘমেয়াদী কোন সমাধান আছে কি না??? যদি আমরা স্থায়ী বা নিদেনপক্ষে দীর্ঘমেয়াদী কোন সমাধানেও না যাই, তাহলে হঠাৎ দু’-একমাস ভালো ন্যাপকিন ব্যাবহার করে, তারপর আবার খড়ে ফিরে গেলে সেই স্বাস্থ্য ঝুঁকিটা কিন্তু থেকেই গেল ।
এখানেই আসে একটা সম্মিলিত প্রচেষ্টার কথা । কেবল দুই একজন মানুষের প্রচেষ্টায় এই ভীষণ স্বাস্থ্য ঝুঁকি যা মৃত্যু পর্যন্ত গড়ায়, তা রোধ করা অসম্ভব ।
• প্রথমে বলি, অল্প দামে ভালো ন্যাপকিন বাজারে পেতে হলে আমরা আমাদের দেশী ব্র্যান্ড এর পণ্যকে প্রমোট করতে পারি । ন্যাপকিনের দাম একটা স্থিতিশীল ও সব শ্রেণীর মানুষের সীমার মধ্যে রাখাটাই মূল তর্ক। এ কথা আমরা অনেকেই জানি যে, আমাদের দেশী ওষুধ শিল্প কিন্তু বেশ ভালো করছে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক দুই বাজারেই । আমরা যদি তাদের পণ্য প্র্রমোট করি এবং ন্যাপকিন ব্যাবহারের প্রতিবন্ধকতাগুলো নিয়ে যদি বিশেষভাবে ক্যাম্পেইন করি তাহলে তারাও এর দাম স্থিতিশীল রাখবে বলে আমি আশা করি । কনডমের দাম যদি একজন রিকশাচালকের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে পারে আমাদের ওষুধ কোম্পানিগুলো, তাহলে সেনিটারী ন্যাপকিন কেন নয়???
• গ্রাম ও মফস্বল পর্যায়ে কমিউনিটি ক্লিনিক, থানা সদর হাসপাতাল , জেলা সদর হাসপাতালে নবজাতকদের টিকা, কিশোরী বা মহিলাদের ধনুষ্টংকার টিকা, মহিলাদের প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ক বিভিন্ন টিকা/ট্যাবলেট প্রভৃতী বিনামূল্যে প্রদান করা হয় । এসব হাসপাতাল স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রচুর পরিমাণে স্যানিটারী ন্যাপকিন মজুত করে কিশোরী ও মহিলাদের বিনামূল্যে বিতরণ করা যেতে পারে ।
• বিটিভি নামক সরকারী প্রচার যন্ত্রটির প্রচুর বদনাম আছে । কিন্তু যাদের কোন না কোন সময়ে বিটিভি দেখার অভ্যাস ছিলো, তারা জানেন যে, বিটিভির কিছু স্বাস্থ্য বিষয়ক প্রোগ্রাম বা জনসচেতনতামূলক প্রোগ্রাম ঘনঘন প্রচার করতো । ডেঙ্গু প্রতিরোধ, যক্ষার চিকিৎসা, এইডস বিষয়ক সচেতনতা, জন্ম নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক সচেতনতা - এসব কিন্তু বিটিভিই মানুষের কাছে তোতা পাখির মত মুখস্থ করিয়ে ছেড়েছে! কখনো গান গেয়ে, কখনো অভিনয় করে, এমনকি চিত্রতারকাদের মুখ দিয়ে বলিয়ে নিয়ে কথাগুলো পৌঁছে দেয়া হয়েছে মানুষের কাছে! একেবারে প্রান্তিক অঞ্চলের গ্রাম্য, অশিক্ষিত ও অসচেতন মানুষ থেকে শুরু করে, শহরের বস্তিবাসী, দরিদ্র ও দারিদ্রসীমার নীচের জনগোষ্ঠী- প্রত্যেকের কোন না কোন রকম সচেতনতা তৈরী করতে পারে এই অনুষ্ঠানগুলো ।
এরকম একটা হাতিয়ার নিশ্চই আমাদের মিস করা ঠিক হবেনা । অন্যান্য স্বাস্থ্য ও সামাজিক সচেতনতার অনুষ্ঠানের মধ্যে এই বিষয়টা কেবল ইনক্লুড করে দিলেই হলো ।
• এছাড়া আমরা নিতে পারি বিভিন্ন এনজিও এর সহায়তা । UNICEF, USAID এসবের মত এনজিও গুলো নারীশিক্ষা, পুষ্টি, পুষ্টিসমতা, গর্ভকালীন সচেতনতা এমনকি সেনিটারী ল্যাট্রিন ইত্যাদি প্রজেক্ট নিয়ে এদেশে প্রচুর কাজ করে । মীনাকার্টুন, সিসিমপুর ইত্যাদি প্রজেক্ট বেশ সফলতা পেয়েছে সামাজিক সচেতনতায় । সুতরাং এক্ষেত্রেও তারা কাজে লাগতে পারে।
• তবে সবচেয়ে বড় কাজটা করে দিতে পারেন আমাদের শ্রদ্ধেয় স্কুল টিচাররাই । ৬ষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণী পর্যন্ত মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড “শারীরিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্য” নামক একটি বিষয় প্রবর্তন করেছে ১০০ নম্বরের । এ বইতে প্রতিটি ছেলে মেয়ের বয়ঃসন্ধিকালের সচেতনতা ও স্বাস্থ্য বিষয়ক জটিলতা , যত্ন ইত্যাদি বেশ ভালোভাবে বলা আছে । এবং অবশ্যই প্রত্যেক শ্রেণীতে শ্রেণী অনুযায়ী ধাপে ধাপে । শ্রদ্ধেয় শিক্ষকগণের দায়িত্ব কেবল বিষয়গুলো কিশোর-কিশোরীদের কাছে খোলাসা করা । তাদের জড়তা এবং অজ্ঞানতা দূর করে ট্যাবু থেকে বের করে আনা ।
আমার ধারণা আর্থিক এবং মানসিক যে প্রতিবন্ধকতার কথা বলেছি আগে, এই স্টেপগুলো ঠিকমত নিতে পারলে সেগুলো অনেকটাই দূর করা যাবে । আর কোনটার জন্যেই এখানে আলাদা বাজেটের দরকার নেই । বর্তমান অবকাঠামোর মধ্যেই কাজগুলো করা সম্ভব ।
পচা বাঁশের খাঁচা ভেঙে পড়ুক । ভেঙে পড়ুক অজ্ঞানতার দেয়াল ।
মুক্ত হোক যুক্তির পাখি ।।।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে জানুয়ারি, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:১৮