somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমার বাবা

২০ শে জুন, ২০১১ রাত ১:০৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সকাল বেলা অফিসে যাবার সময় বাবার নিয়ম ছিলো মা'কে "মনু, আমি অফিসে যাই" বলে বের হওয়া। প্রত্যেকটা দিন বাবার ইয়াব্বড় সু তে আমার ছোট্ট পা দু'টো গলিয়ে একটা কিছু বগলদাবা করে আমিও হাঁকতাম, "মনু, আমি অপিতে দাই"

মনে পড়ে, কোন এক আংকেল বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন,

ছেলে তো বড় হচ্ছে, বাব কেন জমি কেনা বা বাড়ি করার দিকে এগোচ্ছে না..

বাবা মুচকি হেসে বলেছিলো, "আমার যা আছে তা দিয়ে ছেলেটাকে তৈরি করে যাচ্ছি, ওর যা দরকার ও নিজেই করে নিতে পারবে।"

বাবার সেই বিশ্বাস আর আস্থার এক কানাকড়ি দাম আমি রাখতে পারিনি।



পিচ্চিকাল থেকেই উদ্ভট সব অসুখ আমাকে তাড়া করে ফিরতো। সোরিয়াসিসে ভয়ানক ভুগেছি এক সময়। পায়ের তলা ফেঁটে চৌচির হয়ে থাকতো, কখনো কখনো মনে হত, হাড় পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। যখন ফোর বা ফাইভে পড়ি, তখনো আমার সব পাজামার হাঁটু ছেঁড়া থাকতো। ঘরে হাঁটতে পারতাম না, কেবল হামাগুড়ি দিয়ে চলতাম। বাইরে যেতে হতো নরম কেডস পরে। একমাত্র সন্তানকে রোজ এভাবে হামাগুড়ি দিতে দেখা যে কোন বাবার জন্যে যে কতটা দুঃসহ, অতটা বোঝার বয়সও আমার হয়নি তখন। বাবা পাগলের মত যেখানে যার কাছে যে চিকিৎসার খোঁজ পেত, তার পিছেই ছুটতো। এলোপ্যাথিতে সোরিয়াসিসের কোন স্থায়ী চিকিৎসা নেই। বাবা তাও একের পর এক ডক্তার দেখাতেন, ড. কবীর চৌধুরী থেকে বাংলাদেশের মোটামুটি ভালো কোন চর্ম চিকিৎসককে বাদ রাখেন নি। একেক সময় কোত্থেকে যে একেকটা ওঝা-বৈদ্য-কবিরাজ ধরে আনতেন, কোত্থেকে যে খোজ যোগাঢ় করতেন সোরিয়াসিসের ভুক্তভোগীদের, জমা করতেন তাদের হিস্ট্রি... আমি অবাক হতাম। শেষে নিয়ে গেলেন ভারতে। যদি কিছু হয়।

কিছুই হয়নি। আমার পুরোপুরি ভালো হওয়া আজো হয়ে ওঠেনি। ডাক্তারদের উপর বিতৃষ্ণা ধরে গেছে। কিন্তু অবস্থা খারাপ দেখলে এখনো মাঝে মাঝে বাবা ধরে নিয়ে যায় ডক্টরের কাছে।



তখন সিক্সে পড়ি। মা'র ওভারিয়ান সিষ্ট অপারেশন করতে গিয়ে ডক্টর কাঁচি চালালেন রেক্টামে। অপারেশন হয়েছিলো খুলনায়। কিছু না জানিয়েই ৪৮ঘণ্টার মধ্যে মা'কে আবার ওটিতে নেয়া হলো। পরপর দু'টো মেজর এনেস্থেসিয়া নিয়ে আর ইন্টারনাল ইনফেকশনের জন্যে মা'র অবস্থা এখন-তখন। আমি ঝাপসা চোখে কেবল পোষ্ট অপারেটিভের সামনে হেঁটে বেড়াই, কাঁচের আড়াল থেকে মা'কে দেখি। মামা খালারা সবাই খুলনাতে জড় হয়েছেন, বড় চাচাও। মা'র অফিসের সহকর্মীরা সবাই এসেছেন হাসপাতালে। সবার মুখে শঙ্কা। সিদ্ধান্ত হলো, মা'কে ঢাকা নিয়ে আসা হবে। পরে জেনেছিলাম, রিলিজ পেপারে সাইন করার সময় ডক্টর বলেছিলেন, "নিয়ে তো যাচ্ছেন, দেখেন, পৌছুতে পারেন কিনা"। [ভদ্রলোক এখন এপোলোতে আছেন।] ছোটমামা বললেন, "কি করবা নাসির?" বাবা বললেন.. আল্লাহ ভরসা দাদা।

আমাদের এম্বুলেন্স ছেড়েছিলো রাত ৩.১৫ তে। সেই রাতে আমি শেষ বার কেঁদেছিলাম। মোনাজাত ধরে বলেছিলাম, আল্লাহ তুমি যা করবে করো, আমি আর কাঁদবো না। কিন্তু মা'কে এভাবে কষ্ট দিও না।প্রায় তিনটা বছর মা ভুগলো। দেড় থেকে দু'টা বছর বাবা হাসপাতালে কাটালো মা'র সাথে সাথে। এরই মধ্যে আমার ডেঙ্গু আর টাইফয়েড। ক্লিনিকে কেবিনের এক বিছানায় মা'র স্যালাইন-অক্সিজেন চলছে, অন্য বিছানায় আমার স্যালাইন। বাবা মেঝেতে ঘুমোন। এখন যখন পিছনে ফিরে তাকাই, সব গল্পের মতো মনে হয়। ছবি ছবি লাগে, বিশ্বাস হতে চায় না।



কলেজে ওঠার পর মা আর বাবা ১৮৪/৩ আরামবাগের চারতলায় আমাকে রেখে গেলেন, যার আগে জীবনে একটা রাতও কাটাইনি ওদের ছাড়া। যাবার পথে বাসে উঠেই ওরা দুজন ঝরঝর করে কেঁদেছিলো, আমার বাবার প্রথম ভেঙ্গে পড়া ছিলো।



ইণ্টারে সেকেন্ড ইয়ারে উঠি যখন, কিভাবে যেন মেরুদণ্ডের কয়েকটা ভার্টিব্রা তেড়ে বসলো। টানা তিন মাস আমি বিছানায়। বাবার দৌড় থামছে না। আমাকে হোস্টেল থেকে ছাড়িয়ে এজিবি কলোনিতে সাবলেটে তুলে দিলেন। সাথে মা থাকতো। হার্ডবোর্ডের উপর সটান শুয়ে থাকতাম ২৪টা ঘন্টা।

টেস্টের পর আরেকটা অদ্ভুত ব্যামো জেঁকে ধরলো। কিছুই করতে পারি না ডান হাতে, প্রচন্ড যন্ত্রণায় হাত কামড়ে দাগ ফেলে দেই। না পারি লিখতে, কোন ভার নিতে বা আর কিছু। সবাই যখন মডেল টেস্ট দিয়ে বেড়াচ্ছে, আমি তখন ছুটছি এ ডাক্তার থেকে ও ডাক্তারের চেম্বারে। আমার সেবার পরীক্ষা দেয়াই একরকম অনিশ্চিত। কেউ কিছু ধরতে পারছে না। নিঊরো রেফার করছে অর্থো-র কাছে, আর অর্থো নিউরোর কাছে। যেন ব্যাডমিন্টন খেলা চলছে। এর মধ্যে নার্ভের কি একটা টেস্টে রিপোর্ট আসলো, কিছু একটা ধরা পড়েছে। রাতে বাবা জানলো ফোনে(বাবা তখন কর্মস্থল সাতক্ষীরাতে ছিলো, আমি মা'কে নিয়ে ঢাকায় থাকতাম)। সকালে যখন MRI এর রিপোর্ট আনতে পপুলারে গেলাম, কাউন্টারে দাঁড়িয়ে আছি, হঠাৎ পিছনে ফিরে দেখি... সব ক্লান্তি আড়াল করে একটা বিধ্বস্ত হাসিমুখ নিয়ে বাবা দাঁড়িয়ে আছে, ব্যাগ কাঁধে।

আমি সেবার পরীক্ষা ড্রপ দিতে চেয়েছিলাম, কোন আশাই ছিলো না। গোটা সেকেন্ড ইয়ার ক্লাস করতে পারিনি, শেষ যে ক'টা দিন ক্লাস করেছি তাও ১০মিনিট ক্লাসে বসতাম, পরের দশমিনিট বাইরে বেঞ্চে শুয়ে থাকতাম.. এভাবে। পড়া যা জমেছিলো তা ক্লিয়ার করতে পারিনি নটরডেমের বিখ্যাত ল্যাবগুলোতে মেকআপ ক্লাস করতে করতে। হতাশার তলানীতে পড়ে আছে মন। বাবা, জোর করে পরীক্ষা দেয়ালেন। পেইনকিলার খেয়ে খেয়ে প্রতিটা পরীক্ষা দিলাম।

বাবা যখন আমার রেজাল্ট জানতে পারেন, বাবার সামনে তার বস ছিলো। বাবা তার বসকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেছিলেন। আমার দেখা সবচে' শক্ত মানুষটার এ ছিলো দ্বিতীয়বার ভেঙ্গে পড়া, তবে খুশিতে। আর যাই হোক, সেবার এ-প্লাস পাওয়াটা অনেক বেশি ছিলো, আমার জন্যে। [যদিও রেজাল্টের জন্য খুব একটা কৃতিত্ব দাবী করি না কখনো, সারোয়ার সহ অন্য বন্ধুদের সাপোর্ট না পেলে এ ছিলো অসম্ভব]

......................



এভাবে বলতে গেলে রাত পার হয়ে যাবে, কথা ফুরোবে না। জীবনে খুব অল্পকটা দিনই ভাগ্য বাবাকে স্বস্তিতে থাকতে দিয়েছে। এখন যত না বয়স, তার চেয়ে অনেক বুড়িয়ে গেছে বাবা, অসুখে.. অ-সুখে.. ক্লান্তিতে.. । তবু বিশ্বস্ত ছায়ার মতন এখনো আগলে আছে আমাকে, আমার বাবা।



মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবি, পৃথিবীর বর্থ্যতম একজন মানুষ হিসেবে এই জীবনে কিছুইতো করা হল না। চোখে ভেসে ওঠে মা আর বাবার পরিশ্রান্ত-বিধ্বস্ত চোখমুখ। বলতে ইচ্ছে করে, তোমরা ভুল মানুষকে নিয়ে কেন এত স্বপ্ন দেখলে?

ক্রমশ ফুরিয়ে আসছে আয়ু।

হায়! জীবন এত ছোট কেন?
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১১ রাত ১:০৬
৬টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হাদির যাত্রা কবরে, খুনি হাসছে ভারতে...

লিখেছেন নতুন নকিব, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৬

হাদির যাত্রা কবরে, খুনি হাসছে ভারতে...

শহীদ ওসমান বিন হাদি, ছবি অন্তর্জাল থেকে নেওয়া।

হ্যাঁ, সত্যিই, হাদির চিরবিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার এই মুহূর্তটিতেই তার খুনি কিন্তু হেসে যাচ্ছে ভারতে। ক্রমাগত হাসি।... ...বাকিটুকু পড়ুন

কওমী মাদ্রাসায় আলেম তৈরী হয় না

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪৯




সূরাঃ ৬২ জুমুআ, ২ নং আয়াতের অনুবাদ।
২। তিনিই উম্মীদের মধ্যে একজন রাসুল পাঠিয়েছেন তাদের মধ্য হতে, যে তাদের নিকট আবৃত করে তাঁর আয়াত সমূহ; তাদেরকে পবিত্র করে এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

'জুলাই যোদ্ধারা' কার বিপক্ষে যুদ্ধ করলো, হ্তাহতের পরিমাণ কত?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৫১



সর্বশেষ আমেরিকান ক্যু'কে অনেক ব্লগার "জুলাই বিপ্লব" ও তাতে যারা যুদ্ধ করেছে, তাদেরকে "জুলাই যোদ্ধা" ডাকছে; জুলাই যোদ্ধাদের প্রতিপক্ষ ছিলো পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি, ছাত্রলীগ; জুলাই বিপ্লবে টোটেল হতাহতের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদিকে মারল কারা এবং ক্রোধের আক্রশের শিকার কারা ?

লিখেছেন এ আর ১৫, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:০৩

হাদিকে মারল কারা এবং ক্রোধের আক্রশের শিকার কারা ?


হাদিকে মারল জামাত/শিবির, খুনি নাকি ছাত্রলীগের লুংগির নীচে থাকা শিবির ক্যাডার, ডাকাতি করছিল ছেড়ে আনলো জামাতি আইনজীবি , কয়েকদিন হাদির সাথে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদির হত্যাকান্ড ও সরকারের পরবর্তি করণীয়!

লিখেছেন আহলান, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:৫১

হাদির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। সে দেশকে ভালোবেসে, দেশের মানুষকে ইনসাফের জীবন এনে দিতে সংগ্রাম করেছে। তাকে বাঁচতে দিলো না খুনিরা। অনেক দিন ধরেই তাকে ফোনে জীবন নাশের হুমকি দিয়ে এসেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×