সকাল বেলা অফিসে যাবার সময় বাবার নিয়ম ছিলো মা'কে "মনু, আমি অফিসে যাই" বলে বের হওয়া। প্রত্যেকটা দিন বাবার ইয়াব্বড় সু তে আমার ছোট্ট পা দু'টো গলিয়ে একটা কিছু বগলদাবা করে আমিও হাঁকতাম, "মনু, আমি অপিতে দাই"
মনে পড়ে, কোন এক আংকেল বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন,
ছেলে তো বড় হচ্ছে, বাব কেন জমি কেনা বা বাড়ি করার দিকে এগোচ্ছে না..
বাবা মুচকি হেসে বলেছিলো, "আমার যা আছে তা দিয়ে ছেলেটাকে তৈরি করে যাচ্ছি, ওর যা দরকার ও নিজেই করে নিতে পারবে।"
বাবার সেই বিশ্বাস আর আস্থার এক কানাকড়ি দাম আমি রাখতে পারিনি।
পিচ্চিকাল থেকেই উদ্ভট সব অসুখ আমাকে তাড়া করে ফিরতো। সোরিয়াসিসে ভয়ানক ভুগেছি এক সময়। পায়ের তলা ফেঁটে চৌচির হয়ে থাকতো, কখনো কখনো মনে হত, হাড় পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। যখন ফোর বা ফাইভে পড়ি, তখনো আমার সব পাজামার হাঁটু ছেঁড়া থাকতো। ঘরে হাঁটতে পারতাম না, কেবল হামাগুড়ি দিয়ে চলতাম। বাইরে যেতে হতো নরম কেডস পরে। একমাত্র সন্তানকে রোজ এভাবে হামাগুড়ি দিতে দেখা যে কোন বাবার জন্যে যে কতটা দুঃসহ, অতটা বোঝার বয়সও আমার হয়নি তখন। বাবা পাগলের মত যেখানে যার কাছে যে চিকিৎসার খোঁজ পেত, তার পিছেই ছুটতো। এলোপ্যাথিতে সোরিয়াসিসের কোন স্থায়ী চিকিৎসা নেই। বাবা তাও একের পর এক ডক্তার দেখাতেন, ড. কবীর চৌধুরী থেকে বাংলাদেশের মোটামুটি ভালো কোন চর্ম চিকিৎসককে বাদ রাখেন নি। একেক সময় কোত্থেকে যে একেকটা ওঝা-বৈদ্য-কবিরাজ ধরে আনতেন, কোত্থেকে যে খোজ যোগাঢ় করতেন সোরিয়াসিসের ভুক্তভোগীদের, জমা করতেন তাদের হিস্ট্রি... আমি অবাক হতাম। শেষে নিয়ে গেলেন ভারতে। যদি কিছু হয়।
কিছুই হয়নি। আমার পুরোপুরি ভালো হওয়া আজো হয়ে ওঠেনি। ডাক্তারদের উপর বিতৃষ্ণা ধরে গেছে। কিন্তু অবস্থা খারাপ দেখলে এখনো মাঝে মাঝে বাবা ধরে নিয়ে যায় ডক্টরের কাছে।
তখন সিক্সে পড়ি। মা'র ওভারিয়ান সিষ্ট অপারেশন করতে গিয়ে ডক্টর কাঁচি চালালেন রেক্টামে। অপারেশন হয়েছিলো খুলনায়। কিছু না জানিয়েই ৪৮ঘণ্টার মধ্যে মা'কে আবার ওটিতে নেয়া হলো। পরপর দু'টো মেজর এনেস্থেসিয়া নিয়ে আর ইন্টারনাল ইনফেকশনের জন্যে মা'র অবস্থা এখন-তখন। আমি ঝাপসা চোখে কেবল পোষ্ট অপারেটিভের সামনে হেঁটে বেড়াই, কাঁচের আড়াল থেকে মা'কে দেখি। মামা খালারা সবাই খুলনাতে জড় হয়েছেন, বড় চাচাও। মা'র অফিসের সহকর্মীরা সবাই এসেছেন হাসপাতালে। সবার মুখে শঙ্কা। সিদ্ধান্ত হলো, মা'কে ঢাকা নিয়ে আসা হবে। পরে জেনেছিলাম, রিলিজ পেপারে সাইন করার সময় ডক্টর বলেছিলেন, "নিয়ে তো যাচ্ছেন, দেখেন, পৌছুতে পারেন কিনা"। [ভদ্রলোক এখন এপোলোতে আছেন।] ছোটমামা বললেন, "কি করবা নাসির?" বাবা বললেন.. আল্লাহ ভরসা দাদা।
আমাদের এম্বুলেন্স ছেড়েছিলো রাত ৩.১৫ তে। সেই রাতে আমি শেষ বার কেঁদেছিলাম। মোনাজাত ধরে বলেছিলাম, আল্লাহ তুমি যা করবে করো, আমি আর কাঁদবো না। কিন্তু মা'কে এভাবে কষ্ট দিও না।প্রায় তিনটা বছর মা ভুগলো। দেড় থেকে দু'টা বছর বাবা হাসপাতালে কাটালো মা'র সাথে সাথে। এরই মধ্যে আমার ডেঙ্গু আর টাইফয়েড। ক্লিনিকে কেবিনের এক বিছানায় মা'র স্যালাইন-অক্সিজেন চলছে, অন্য বিছানায় আমার স্যালাইন। বাবা মেঝেতে ঘুমোন। এখন যখন পিছনে ফিরে তাকাই, সব গল্পের মতো মনে হয়। ছবি ছবি লাগে, বিশ্বাস হতে চায় না।
কলেজে ওঠার পর মা আর বাবা ১৮৪/৩ আরামবাগের চারতলায় আমাকে রেখে গেলেন, যার আগে জীবনে একটা রাতও কাটাইনি ওদের ছাড়া। যাবার পথে বাসে উঠেই ওরা দুজন ঝরঝর করে কেঁদেছিলো, আমার বাবার প্রথম ভেঙ্গে পড়া ছিলো।
ইণ্টারে সেকেন্ড ইয়ারে উঠি যখন, কিভাবে যেন মেরুদণ্ডের কয়েকটা ভার্টিব্রা তেড়ে বসলো। টানা তিন মাস আমি বিছানায়। বাবার দৌড় থামছে না। আমাকে হোস্টেল থেকে ছাড়িয়ে এজিবি কলোনিতে সাবলেটে তুলে দিলেন। সাথে মা থাকতো। হার্ডবোর্ডের উপর সটান শুয়ে থাকতাম ২৪টা ঘন্টা।
টেস্টের পর আরেকটা অদ্ভুত ব্যামো জেঁকে ধরলো। কিছুই করতে পারি না ডান হাতে, প্রচন্ড যন্ত্রণায় হাত কামড়ে দাগ ফেলে দেই। না পারি লিখতে, কোন ভার নিতে বা আর কিছু। সবাই যখন মডেল টেস্ট দিয়ে বেড়াচ্ছে, আমি তখন ছুটছি এ ডাক্তার থেকে ও ডাক্তারের চেম্বারে। আমার সেবার পরীক্ষা দেয়াই একরকম অনিশ্চিত। কেউ কিছু ধরতে পারছে না। নিঊরো রেফার করছে অর্থো-র কাছে, আর অর্থো নিউরোর কাছে। যেন ব্যাডমিন্টন খেলা চলছে। এর মধ্যে নার্ভের কি একটা টেস্টে রিপোর্ট আসলো, কিছু একটা ধরা পড়েছে। রাতে বাবা জানলো ফোনে(বাবা তখন কর্মস্থল সাতক্ষীরাতে ছিলো, আমি মা'কে নিয়ে ঢাকায় থাকতাম)। সকালে যখন MRI এর রিপোর্ট আনতে পপুলারে গেলাম, কাউন্টারে দাঁড়িয়ে আছি, হঠাৎ পিছনে ফিরে দেখি... সব ক্লান্তি আড়াল করে একটা বিধ্বস্ত হাসিমুখ নিয়ে বাবা দাঁড়িয়ে আছে, ব্যাগ কাঁধে।
আমি সেবার পরীক্ষা ড্রপ দিতে চেয়েছিলাম, কোন আশাই ছিলো না। গোটা সেকেন্ড ইয়ার ক্লাস করতে পারিনি, শেষ যে ক'টা দিন ক্লাস করেছি তাও ১০মিনিট ক্লাসে বসতাম, পরের দশমিনিট বাইরে বেঞ্চে শুয়ে থাকতাম.. এভাবে। পড়া যা জমেছিলো তা ক্লিয়ার করতে পারিনি নটরডেমের বিখ্যাত ল্যাবগুলোতে মেকআপ ক্লাস করতে করতে। হতাশার তলানীতে পড়ে আছে মন। বাবা, জোর করে পরীক্ষা দেয়ালেন। পেইনকিলার খেয়ে খেয়ে প্রতিটা পরীক্ষা দিলাম।
বাবা যখন আমার রেজাল্ট জানতে পারেন, বাবার সামনে তার বস ছিলো। বাবা তার বসকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেছিলেন। আমার দেখা সবচে' শক্ত মানুষটার এ ছিলো দ্বিতীয়বার ভেঙ্গে পড়া, তবে খুশিতে। আর যাই হোক, সেবার এ-প্লাস পাওয়াটা অনেক বেশি ছিলো, আমার জন্যে। [যদিও রেজাল্টের জন্য খুব একটা কৃতিত্ব দাবী করি না কখনো, সারোয়ার সহ অন্য বন্ধুদের সাপোর্ট না পেলে এ ছিলো অসম্ভব]
......................
এভাবে বলতে গেলে রাত পার হয়ে যাবে, কথা ফুরোবে না। জীবনে খুব অল্পকটা দিনই ভাগ্য বাবাকে স্বস্তিতে থাকতে দিয়েছে। এখন যত না বয়স, তার চেয়ে অনেক বুড়িয়ে গেছে বাবা, অসুখে.. অ-সুখে.. ক্লান্তিতে.. । তবু বিশ্বস্ত ছায়ার মতন এখনো আগলে আছে আমাকে, আমার বাবা।
মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবি, পৃথিবীর বর্থ্যতম একজন মানুষ হিসেবে এই জীবনে কিছুইতো করা হল না। চোখে ভেসে ওঠে মা আর বাবার পরিশ্রান্ত-বিধ্বস্ত চোখমুখ। বলতে ইচ্ছে করে, তোমরা ভুল মানুষকে নিয়ে কেন এত স্বপ্ন দেখলে?
ক্রমশ ফুরিয়ে আসছে আয়ু।
হায়! জীবন এত ছোট কেন?

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


