১৯৭৪ সালের মে মাসে দিল্লীতে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে দু'দেশের সীমানা চিহ্নিতকরণসহ অন্যান্য বিষয় নিয়ে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ঐ চুক্তির দিনই ভারত ২ দশমিক ৬৪ বর্গমাইলের বেরুবাড়ি ছিটমহলের মালিক হয়েছে। কিন্তু বিনিময়ে ১৭৮ মিটার * ৮৫ মিটার বা ৩ বিঘা আয়তনের করিডোর বাংলাদেশের কাছে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত দেয়ার কথা থাকলেও আজও তা পায়নি বাংলাদেশ। মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির দিন থেকে ৬ মাসের মধ্যে ১৬৮টি ছিটমহল বিনিময়ের কথা চুক্তির শর্তের মধ্যে থাকলেও ৩৫ বছরেও তা হয়নি। মূলত ভারতের অনাগ্রহের কারণেই ছিটমহলগুলো আজ পর্যন্ত বিনিময় হয়নি। ফলে প্রায় ২ লাখ ছিটমহলবাসী নাগরিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে।
ভূমি জরিপ অধিদপ্তর, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং বিডিআর সদর দফতর থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল রয়েছে। এর আয়তন ৭ হাজার ১শ' ১০ দশমিক শূন্য ২ (৭১১০.০২) একর এবং জনসংখ্যা ১৯৯৬ সালের তথ্য মতে ছিল ৭০ হাজার। বর্তমানে তা বেড়ে ৮০ থেকে ৮৫ হাজার হতে পারে।
অন্যদিকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে রয়েছে ভারতের ১১১টি ছিটমহল। এর আয়তন ১৭ হাজার ১শ ৫৮ দশমিক শূন্য ৫ (১৭১৫৮.০৫) একর। লোকসংখ্যা ১৯৯৬ সালের পরিসংখ্যান মতে ছিল ১ লাখ। বর্তমানে তা বেড়ে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজারে দাঁড়াতে পারে। সব মিলিয়ে দু'দেশের ১৬২ ছিটমহলের আয়তন ২৪ হাজার ২শ ৬৮ দশমিক শূন্য ৭ একর এবং লোকসংখ্যার পরিমাণ মোটামুটি ২ লাখের মত।
ছিটমহলগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের মালিকানাধীন ৫১টির মধ্যে ৩৩টির অবস্থান লালমনিরহাট এবং বাকি ১৮টির অবস্থান কুড়িগ্রাম জেলায়। ভারতের মালিকানাধীন ১১১টি ছিটমহলের মধ্যে লালমনিরহাটে ৫৯টি, পঞ্চগড়ে ৩৬টি, নীলফামারীতে ৪টি এবং কুড়িগ্রামে ১২টি। তবে বাংলাদেশের ছিটমহলগুলোর লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম জেলার অন্তর্ভুক্ত হলেও সেগুলোর অবস্থান ভারতের কুচবিহার জেলায়। অন্যদিকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতীয় ছিটমহলগুলোর দাবিদার ভারতের কুচবিহার জেলা।
১৯৭৪ সালের ১৬ মে ভারতের রাজধানী নতুন দিল্লীতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে এক ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বাংলাদেশ ও ভারত ভূ-খন্ডের সীমানা চিহ্নিতকরণ ও সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি নিয়েই মূলত এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। একটি ভূমিকা, একটি উপসংহার, ৫টি অনুচ্ছেদ এবং ১৫টি উপ-অনুচ্ছেদ ছিল এই চুক্তির অন্তর্ভুক্ত। অনুচ্ছেদ-১ এবং ১২ নং উপঅনুচ্ছেদে বলা হয়েছে বাংলাদেশে ভারতীয় ছিটমহল এবং ভারতে বাংলাদেশের ছিটমহলগুলো অতিসত্ত্বর বিনিময় করতে হবে। এর বাইরে থাকবে চুক্তিতে বর্ণিত ১৪ অধ্যায়ে উল্লেখিত ছিটমহলগুলো যাতে বাংলাদেশে যে বাড়তি এলাকাগুলো পড়বে তার জন্য কোন ক্ষতিপূরণ দাবি করা যাবে না।
এই চুক্তির প্রথম অনুচ্ছেদের ১৪ উপঅনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ভারত দক্ষিণ বেরুবাড়ি ইউনিয়ন নং-১২ এর দক্ষিণ দিকস্থ অর্ধাংশ ও পার্শ্ববর্তী ছিটমহলগুলোর অধিকারী হবে, যে এলাকার পরিমাণ প্রায় ২.৬৪ বর্গমাইল এবং বিনিময়ে বাংলাদেশ দহগ্রাম ও আঙ্গরপোতা ছিটমহলের অধিকারী হবে। বাংলাদেশের পানবাড়ী মৌজার (পাটগ্রাম থানা) সঙ্গে দহগ্রামকে সংযুক্ত করার জন্য ভারত বাংলাদেশকে �তিনবিঘা' নামে ১৭৮ মিটার * ৮৫ মিটার এলাকা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত দেবে।
১৯৭৪ সালের এই চুক্তি স্বাক্ষরের পর দীর্ঘ ৩৫ বছর পেরিয়ে গেছে। ভারত চুক্তির দিনই বেরুবাড়ির মালিকানা স্বত্ব বুঝে নিয়েছে। কিন্তু বিনিময়ে বাংলাদেশকে আঙ্গরপোতা-দহগ্রাম যাওয়ার জন্য তিন বিঘা জমির করিডোরটি আজও চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত দেয়নি
দীর্ঘ বছর পর বর্তমানে শুধুমাত্র দিনের বেলা ১ ঘণ্টা পর পর তিন বিঘা করিডোরের গেট খুলে দেয়া হয় বাংলাদেশের মূল ভূ-খন্ডে যাতায়াতের জন্য। রাতে আঙ্গরপোতা-দহগ্রামবাসী থাকে কার্যত অবরুদ্ধ। রাতে কারো জরুরি ভিত্তিতে ডাক্তারের প্রয়োজন হলেও তাকে মূল ভূখন্ডে আসতে দেয়া হয় না। আবার ভারতেও যেতে দেয় না বিএসএফ। এমনিভাবে প্রতিনিয়ত ঘটছে আঙ্গরপোতা দহগ্রামে নানা বিয়োগান্তক ঘটনা। নিজ দেশেই তারা পরবাসী। তিনবিঘা করিডোর উন্মুক্ত না হওয়ায় সেখানে রাস্তাঘাট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান কোন কিছুই হচ্ছে না, কোন উন্নয়নমূলক কাজ হচ্ছে না। ফলে সব ধরনের নাগরিক ও অতি প্রয়োজনীয় জরুরি সুযোগ-সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে দহগ্রামবাসী।
চুক্তির ১২ নম্বর উপঅনুচ্ছেদ অনুসারে অন্যান্য ছিটমহলগুলো অতিসত্ত্বর বিনিময়ের কথা উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু ছিটমহল বিনিময়ের বিষয়ে বাংলাদেশ পক্ষ সব সময় সোচ্চার থাকলেও ভারতের অনাগ্রহের কারণে বিগত ৩৫ বছরেও তা হয়ে ওঠেনি। ফলে ১৬২ ছিটমহলের দুই লক্ষাধিক মানুষ সমস্ত প্রকার নাগরিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। বর্তমান আওয়ামী মহাজোট সরকার এই অমীমাংসিত বিষয়টির দিকে নজর দেবেন বলে সকলের প্রত্যাশা। কারণ এই চুক্তিটিতেও তাদেরই দলের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমান স্বাক্ষর করেছিলেন।