,তাঁর লেখার অনুরাগী। তাদের কথা বিবেচনা করেই লেখাটি এখানে যুক্ত করে
দিলাম। পড়ার জন্য ধন্যবাদ সবাইকে।
-----------------------------------------------------------------------------
মানবসেবার পরিকাঠামো
দেবেশ রায়
----------------------------------------------------------
দুনিয়ায় এখন একটা নতুন তত্ত্ব নিয়ে কথা উঠেছে। কোনো তত্ত্বই তত্ত্ব হয় না, যদি কঠিন তথ্যের ওপর তৈরি না হয়। নতুন তত্ত্বটি সেই কঠিন তথ্য জোগাড় করছে, এখন।
মাইক্রোসফট ইত্যাদির মালিক বিল গেটস দানধ্যানে আমেরিকার সমস্ত রেকর্ড ভেঙে ফেলছেন। এর আগে রেকর্ড ছিল জন ডি রকফেলারের। ২০০৫ সালের ডলারের দাম অনুযায়ী ৬ বিলিয়ন ডলার। এই সব টাকার অঙ্ক বুঝতে আমাদের অনেকেরই খুব অসুবিধে হয়, যেমন অসুবিধে হয় গ্রহ-নক্ষত্রের দূরত্ব বুঝতে- এ সবই আমাদের ধারণার ক্ষমতার এতোই বাইরে। মিলিয়ন তাও মনে থাকে- দশ লাখ বা এক নিযুত। আর, আমেরিকায় বিলিয়ন হচ্ছে, ‘এ থাউজ্যান্ড মিলিয়ন’, এক হাজার নিযুত বা একশ কোটি।
বিল গেটস ইতিমধ্যেই ৩১০০ কোটি ডলার দান করে ফেলেছেন। তাঁর সারা জীবন তো পড়েই আছে। তাঁর ইচ্ছে জীবনাবসানের আগে তাঁর মোট সম্পদের বেশিটাই তিনি তাঁর ‘বিল এ্যান্ড মিলিন্দা গেটস ফাউন্ডেশন’-এ দান করে যাবেন। ‘ফর্বস’ ম্যাগাজিনের শেষ হিসাব অনুযায়ী সেই সম্পদের মূল্য দাঁড়াবে- প্রায় ৪৭০০ কোটি ডলার (২০০৬-এর ফেব্রুয়ারির হিসাব)। এই সব সংখ্যা অনেক সময় তুলনায় কিছুটা ধারণা করা যায়। ভারতের মতো বড় ও জনবহুল দেশের বার্ষিক বাজেট হয়, গত চার-পাঁচ বছরে, ৪০০০ কোটি ডলারের মতো। তার চাইতে বেশি টাকা একজন লোক, মাত্র একজন লোক, দান করে দিচ্ছেন আমেরিকায়।
বিল গেটস ১৯৯৮ থেকে দানধ্যানে নেমেছেন। তাঁর দেখাদেখি যাঁরা সুপাররিচ বা মহাধনী, তাঁরা সকলেই দানধ্যান শুরু করেছেন। কার্নেগির দাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলোর চেয়ারম্যান বার্তান গ্রেগরিয়ান বলেছেন, ‘জনসেবাকে বিল গেটস নিত্যকর্ম করে দিয়েছেন। তুমি যে জনসেবায় দান করবে, সেটা একটা সাধারণ প্রত্যাশা।’
এই তথ্য থেকেই নতুন একটি তত্ত্ব মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। তার নাম বাংলায় বলতে পারি, ‘মানবসেবকধনতন্ত্র’ (দি ইকনমিস্ট ২৫ ফেব্র“য়ারি, ২০০৬ সংখ্যা)।
ইতিহাসের নানা ঘটনা থেকে এই দাতব্যপুঁজির বিষয়টি আমরা বুঝতে চেষ্টা করতে পারি। সেই প্রত্যেকটি চেষ্টাই ভুল হবে। আমাদের দেশে সেই পাঠান-মুঘল আমল থেকেই তো জলের জন্য দীঘি কাটানো, পুজোর জন্য মন্দির বানানো, নামাজের জন্য মসজিদ তৈরি করানো হয়ে আসছে। খুব ভিতরের সব মফস্বলে জমিদাররা যাতায়াতের রাস্তা বানিয়ে বা খাল কেটে দিতেন। এই কলকাতার গঙ্গার ধারে ঘাট তৈরি করিয়ে দিয়েছেন বাঙালি-অবাঙালি বাবুরা- পুরুষদের ও মেয়েদের আলাদা ঘাট। আগেকার দিনে ‘সজ্ঞানে গঙ্গাপ্রাপ্তি’ ছিল হিন্দুদের স্বর্গের টিকিট। সেই কারণে মরণাপন্নকে নিয়ে যাওয়া হতো গঙ্গার ঘাটে। গঙ্গাযাত্রীদের জন্য শেড বানিয়ে দিয়েছেন বাবুরা- মাদার তেরেসা যেমন বানিয়েছেন কালীঘাটে মরণাপন্নদের প্রতীক্ষালয়। নিজের টাকা বেশি হলে দানধ্যানে দেয়ার নির্দেশ সব ধর্মেই আছে। নইলে আর তিরুপতির মন্দিরে নিজেকে গোপন রেখে লাখ লাখ টাকা থলিতে ফেলে কেন ভক্তজন?
নতুন এই দাতব্যপুঁজি ঐ সব পুরোনো-নতুন ব্যাপার থেকে একেবারে আলাদা। এই নতুন ধারণায় দানধ্যান বিষয়টিকেই পুঁজি হিসেবে খাটানো হচ্ছে। যেমন, আমাদের জলতেষ্টা পায়- এই বিষয়টিকেই পুঁজি হিসেবে খাটিয়ে ঠাণ্ডা পানীয়ের বাজার ও খদ্দের তৈরি হয়। যেমন, এই বাদাম-চানাচুর-ঝালমুড়ি-ফুচকা খাওয়ার মতো খেলার ছলে জিভ-চালানোর অভ্যেসকে পুঁজি করে তৈরি হয়েছে চুটকি খাবারের বিশাল শিল্প। যেমন, বেশ প্রাণ খুলে সেক্স করার ইচ্ছেকে পুঁজি করে তৈরি হয়েছে কনডোমের বাজার, যেন কনডোম একটি অতিরিক্ত লিঙ্গ। তেমনি একটু দানধ্যানের মানবিক ইচ্ছেকে পুঁজি করে তৈরি হতে চলেছে দাতব্যপুঁজির নতুন বিনিয়োগ।
ভারতের ‘সান গ্রুপ বিনিয়োগ সংস্থা’ শিল্পপতি খেমকাদের পুরোনো বংশগত ব্যবসা। এখন তার কর্তা হয়েছেন, উদয় খেমকা। তিনি বলেছেন, ‘যদি জয়েন্ট স্টক কোম্পানিগুলোর সঙ্গে তুলনা করা যায়, তা হলে বলতে হয়, এই দাতব্যপুঁজির বিনিয়োগ ১৮৭০ সালে পড়ে আছে। কিন্তু ক্রমে ক্রমে এই দাতব্যতা ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির পরিচায়ক হয়ে উঠবে।’ উদয় আরো বলেছেন, ‘আমি দাতব্যতার পরিকাঠামো উন্নত করতে টাকা খাটাব।’
এই প্রত্যেকটি শব্দ খুব জরুরি।
দাতব্যতা। পরিকাঠামো। উন্নয়ন। বিনিয়োগ।
একটু ঘুরিয়েও বলা যায় বা বলতে হয়। যেমন বাড়িঘর তৈরিতে যারা টাকা খাটান তাদের বলা হয়- ‘ডেভেলাপার’, বা ‘প্রোমোটার’, বা ‘রিয়্যালটার’। এগুলো শুধু শব্দ নয়, আলাদা-আলাদা অর্থের জন্য আলাদা-আলাদা শব্দ। সেই সব অর্থের মধ্যে একটা অর্থ লাল কালিতে দাগানো- কাজটা করতে যে টাকাটা লাগবে, সেটা ওরা খাটাচ্ছেন না-ঐ যারা ডেভেলাপার বা প্রোমোটার। টাকাটা আপনি খাটাচ্ছেন- আপনার একটি ফ্ল্যাটের জন্য।
ধরা যাক ১৫ বা ২০ লাখই খাটাচ্ছেন। খাটাচ্ছেন পুরো কাজটির জন্যই- যেমন লিমিটেড কোম্পানির শেয়ার কিনে, শেয়ার-হোল্ডার, কোম্পানির পুরো কাজেরই পুঁজি জোগায়। সেই কারণেই, কোম্পানির পুরো কাজে লাভ হলে শেয়ারহোল্ডার লাভের অংশ বা ডিভিডেন্ট পায়। বা শেয়ারের দাম বেড়ে যায় ও শেয়ার বেচে দিয়েও শেয়ারহোল্ডার লাভ করতে পারে। ‘ডেভেলপার’ বা ‘প্রমোটার’ বা ‘রিয়্যালটার’কে টাকা আপনি জোগালেও আপনি কোনোভাবেই অংশীদার বা শেয়ারহোল্ডার হতে পারেন না। জয়েন্ট স্টক কোম্পানি তৈরি করে পুঁজি জোগাড় করার পদ্ধতি থেকেই আধুনিক ধনতন্ত্রের জন্ম ও বাড়বাড়ন্ত। যে নামেই ডাকা হোক, হাই ক্যাপিটালিজম, পোস্টমডার্ন ক্যাপিটালিজম, গ্লোবালাইজিং ক্যাপিটালিজম, গ্লোক্যালাইজিং ক্যাপিটালিজম- একুশ শতকের ধনতন্ত্র আর শেয়ার বেচে পুঁজি জোটাতে চায় না। চায় না এই একটি মাত্র কারণে যে, শেয়ার মানেই তো অংশ, শেয়ারহোল্ডার মানে অংশীদার, বা লাভের ভাগীদার- একুশ শতকের ধনতন্ত্র অংশীদারও চায় না, ভাগীদারও চায় না। একুশ শতকের ধনতন্ত্র,এখন দাতব্যতা বা মানবতা বা সেবা উৎপাদন করতে নেমেছে। সেই উৎপাদনের পরিকাঠামো এখন তৈরি হচ্ছে।
এই মানবতার পরিকাঠামো গড়ার বিনিয়োগই এখন ধনতন্ত্রের প্রধানতম কর্মসূচি। ইন্দোনেশিয়ার সেলিম গোষ্ঠী যে রাজার হাটে শহর ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র বানাচ্ছে, সে তো মানবতার পরিকাঠামো। সেই পরিকাঠামো তৈরি করে দিতে পারলে, মানুষজনকে আধুনিকতম নগর জীবনযাপনে এনে ফেলতে পারলে, আরো কতো নতুন চাহিদাই না তৈরি হবে। হাওড়ার পশ্চিমে মোটরবাইক কারখানা খোলা হচ্ছে দুটি কারণে।
একটা কারণ ঐ দাতব্য পুঁজির মধ্যেই পড়ে। এককালে যেমন নাইট স্কুল বসিয়ে নিরক্ষরতা দূর করা হতো, এখন তেমনি বাইক তৈরির কারখানা গড়ে আমাদের উন্নয়নসূচক ধারণাই বদলে ফেলা হবে। উন্নয়ন বলতে লোক-ধারণা এতে প্রশ্রয় পাবে- উৎপাদন> নিয়োগ> বিক্রি উৎপাদন> নিয়োগ> লাভ। মোটরবাইকের কারখানায় কোনো দেশ আর বাইরের পুঁজি খাটায় না। আর তার বাজারও এখন গুটিয়ে আসছে- লোকজন এখন ছোটখাটো গাড়ি কেনার দিকে ঝুঁকেছে। ১৯৯৯-এ হার্ভার্ড বিজনেস রিভিয়ু-এ মাইকেল পোর্টার ও মার্ক ক্র্যামার একটি প্রবন্ধ লেখেন- ‘মানবসেবার নতুন কর্মসূচি : মূল্যমান তৈরি করা’। এই শেষাংশটুকু হয়তো কারো কারো কাছে ইংরেজিতেই সহজবোধ্য, ‘ক্রিয়েটিং ভ্যালু’। সংস্কৃত ব্যাকরণ অনুযায়ী সুন্দর ও সরল একটা বাংলা হয় ‘পণ্য’। যার পণ, বা দর, বা ভ্যালু আছে, সেটা পণ্য। তা হলে ১৯৯৯-এর ঐ তাত্ত্বিক ও দিকদিশারী প্রবন্ধটির বাংলা হতে পারে- ‘মানবসেবার নতুন লক্ষ্য এখন পণ্য হতে পারা।’
‘মানবসেবার এই বাজার’কে ‘লাভজনক’ করতে হলে তিনটি কাজ করা দরকার বলে এরা মনে করছেন। ১. যেমন লিমিটেড কোম্পানিগুলোর লাভক্ষতি সাব্যস্ত হয় শেয়ার মার্কেটে, তেমনি সামাজিক পুঁজি বিনিয়োগীদের তৈরি চাহিদা পূরণের জন্য ‘মানবসেবা’র কোন দিকটাতে টাকা খাটানো যাবে তার স্পষ্ট সঙ্কেত। ২. ‘মানবসেবা’তে টাকা খাটাতে হলে একটা পরিকাঠামো দরকার- যেমন এখন আছে শেয়ার মার্কেট, বিনিয়োগী ব্যাংক, গবেষণা কেন্দ্র, ম্যানেজমেন্ট ইত্যাদি। ৩. ‘মানবসেবা’ যারা করতে চান, তাদের পুঁজি খাটুয়ে হতে হবে।
এর সঙ্গে আরো অনেক কথা আছে। সব দেশেই, বিশেষ করে আমেরিকায়, মানবসেবার কাজে টাকা দিলে ট্যাক্স ও শুল্ক থেকে অনেক রেহাই পাওয়া যায়। তা হলে তো এই সব সংগঠনের কাজকর্মের ওপর কংগ্রেসের সদস্যদের নিয়ন্ত্রণ থাকছে।
ম্যানজমেন্ট গুরুদের মধ্যে অনেকেই বলেছেন মানবসেবার জন্য যেসব ফাউন্ডেশন তৈরি হয়েছে তাদের ওপর কারো কোনো নিয়ন্ত্রণ খাটে না। এমনকি রেডক্রসও এক খাতে বরাদ্দ টাকা কাউকে না জানিয়ে আর এক খাতে খরচা করে। এনজিও মারফৎ যে টাকা খরচা হয় তার কোনো মাথামুণ্ডু নেই। এমন ফাটকা বাজারে কী করে পুঁজি খাটানো যাবে?
দেবেশ রায় : কথাসাহিত্যিক।
------------------------------------------------------
দৈনিক ভোরের কাগজ ,ঢাকা । ১০ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ মংগলবার
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ সকাল ৭:৫৬