somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রাইন ইন ফ্লামেন

২৬ শে এপ্রিল, ২০১০ দুপুর ২:৩০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

দেখে এলেম ‘রাইন ইন ফ্লামেন’৷ ‘রাইন ইন ফ্লামেন’ অর্থাৎ রাইন নদীতে আগুনের ফুলকি৷ শুনলে মনে হয়, নদীর মধ্যে থেকে উঠে আসা আগুন৷ এ আবার কেমন কথা! নিজের চোখে না দেখলে সত্যি বিশ্বাস হয় না এ দৃশ্য!

প্রতিবছর মে মাসের প্রথম শনিবার লিনৎস থেকে বন শহরের মধ্যে বয়ে যাওয়া রাইন নদীর বাঁকে বাঁকে উদযাপন করা হয় ‘রাইন ইন ফ্লামেন'৷ অপূর্ব আতশবাজি দিয়ে রাঙানো হয় রাইনের আকাশ৷ আর এ সময় ৭৫টি যাত্রীবাহী প্রমোদতরী রাইন নদীর উপর দিয়ে ভেসে যায়৷ মূলত এই প্রমোদতরীর যাত্রীদের উদ্দেশ্যে আয়োজন করা হলেও পুরো বন শহরের মানুষ এতে অংশগ্রহণ করে৷ এমনকি জার্মানির দূর-দূরান্তের শহর থেকে মানুষ এসে হাজির হয় রাইন নদীর পারে, এই অপূর্ব আতশবাজি দেখতে৷

রাইন নদীতে ভ্রমণের উদ্দেশ্যে যে প্রমোদতরীগুলো চলাচল করে তাদের মালিক সমিতির সবাই মিলে আয়োজন করে এই উৎসব৷ উৎসবের দিন প্রমোদতরীগুলোতে যাত্রার ভাড়া অনেক বেড়ে যায়৷ জনপ্রতি যাত্রীর ভাড়া ৬০ থেকে ৮০ ইউরো৷ সারাটি দিন ধরে যাত্রীরা রাইন নদীর উপর জাহাজে চেপে ঘুরবে, আমোদ করবে এবং রাত নামলে আকাশে আতশবাজির রঙিন খেলা দেখবে৷ এই আয়োজনে যোগ দেয় বন শহরের পৌর কর্তৃপক্ষ৷ তারা রাইন নদীর পাড়ের গ্রামগুলোতে আয়োজন করে মেলা আর কনসার্টের৷ উল্লেখ্য, লিনৎস আর বন ছাড়া অন্যান্য অঞ্চলেও ‘রাইন ইন ফ্লামেন' পালন করা হয়৷ যেমন এবছরের জুলাই মাসের প্রথম শনিবারে নিদারহাইম বাইখ থেকে বিনগেন/ রুইডিশহাইম পর্যন্ত পালন করা হবে এই আতশবাজি উৎসব৷ আগষ্ট মাসের প্রথম শনিবারে স্পে থেকে কোবলেন্স পর্যন্ত৷ মূলতঃ মাসের প্রথম শনিবারকে প্রাধান্য দিয়ে রাইন নদীবর্তী পালন করা হয় ‘রাইন ইন ফ্লামেন'৷

‘রাইন ইন ফ্লামেন'কে ঘিরে রাইন নদীর আশেপাশের এলাকায় চলে নানা উৎসব৷ লিনৎস থেকে কোয়িনিগ্সভিন্টার, তারপর রাইনাউ পার্কের পুরোটা জুড়ে মেলা বসে৷ সারাদিন ধরে মানুষজন নদীর পাড়ে জায়গা দখল করতে শুরু করে৷ কেউ কেউ আবার খাবার দাবার নিয়ে উঠে যায় ড্রাখেনফেলসের পাহাড়ে৷ রাতের বেলা পাহাড়ের উপর বসে আতশবাজি দেখে৷

রাত সাড়ে নটায় আমিও অন্যদের মতো কোয়িনিগ্সভিন্টারে রাইনের পাড়ে বসি এই আতশবাজি দেখতে৷ আতশবাজি শুরু হওয়ার কথা রাত ১০টা থেকে৷ অপেক্ষার প্রহর যেন কাটেনা৷ রাত ১০টার দিকে দেখতে পেলাম সাত পাহাড়ের অদূরে বিশাল আলোর ছটা৷ অর্থ্যাৎ লিনৎস-এ শুরু হয়ে গিয়েছে আতশবাজি৷ লিনৎস-এর বাঁক পার হয়ে জাহাজগুলো এগিয়ে আসছে কোয়িনিগ্সভিন্টারের দিকে৷ কোয়িনিগ্সভিন্টারে জাহাজ আসার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হলো আতশবাজির খেলা৷ উন্নয়নশীল বাংলাদেশের মেয়ে আমি৷ এত সুন্দর আর এত বড় আকারের আতশবাজি আমি কখনো দেখিনি৷ সাফ গেমসের প্রথম আসরে বাংলাদেশে আতশবাজি দেখানো হয়েছিলো৷ আবছা মনে পড়ে আমার৷ কিন্তু এই আতশবাজির কাছে তা নস্যি মাত্র৷ আধ ঘন্টা ধরে প্রমোদতরীগুলো কোয়িনিগ্সভিন্টারের রাইন এলাকা পাড়ি দেয় এবং ঝরতে থাকে আগুনের ফুলকি ধারা৷ মনটা একটু খারাপ হয়ে যায় আশেপাশের মানুষের কথা শুনে৷ এক একটা আতশবাজির যে দাম শুনলাম তাতে বাংলাদেশের একটা সাধারণ পরিবারের খাবার খরচ অনায়াসে উঠে যায়৷

এত আনন্দে নিজের মন খারাপ ভাবটা কখন যেন হারিয়ে যায়৷ জাহাজগুলো চলে যাওয়ার পর দেখি লোকজন দৌড়ে গিয়ে ট্রামে উঠছে৷ শুনলাম এরপর নাকি রাইনাউ পার্কে ঝরবে আতশবাজির বৃষ্টি৷ প্রমোদতরীগুলো সেখানেই যাচ্ছে৷ মানুষজনের পিছে পিছে আমিও দৌড়ে উঠি ট্রামে৷ গিয়ে দেখি লাখো মানুষ দাড়িয়ে আছে রাইনাউ পার্কের কাছে ব্রীজে৷ ব্রীজে দাঁড়াবার স্থান নেই৷ ছুটলাম পার্কের দিকে৷ আমাকে আর কষ্ট করতে হলোনা৷ মানুষের ভীড়ের ধাক্কায় পৌঁছে গেলাম পার্কের ভিতর রাইন নদীর পাড়ে৷ পৌঁছে অপেক্ষা করতে হলোনা৷ শুরু হয়ে গেল আতশের ভেলকিবাজি৷ আমি বাকরুদ্ধ হয়ে ঘাড় বাঁকা করে এই সৌন্দর্য উপভোগ করছি৷ একসময় ঘাড় ব্যাথা হয়ে গেল তবু আতশবাজি থামেনা৷ কখনো হৃদয় হয়ে ভাসে, কখনো বা নক্ষত্রের মেলা৷ যখন থামলো আতশবাজি, ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত ১২টা৷


আতশবাজি শেষ হয়ে গেলেও শেষ হয়না উৎসব৷ রাইনাউ পার্কের একটু উপরে উঠলেই দেখা যায় বিশাল মেলা বসেছে৷ নগর কর্তৃপক্ষের আয়োজিত মেলা৷ মেলায় বিভিন্ন ধরনের স্টল বসেছে, বসেছে নাগর দোলা, ঝুলন্ত বিমান আর খাবার দোকান৷ জার্মানির লোকজন পান করছে বিভিন্ন ধরনের পানীয়৷ এতো বোতল মাঠে জমেছে যে মনে হচ্ছিল মাটিতে কেউ বোতলের চাষ করছে৷ কিছু লোকজনকে দেখলাম প্রতিযোগিতা করে বোতল কুড়াচ্ছে কারণ বোতল জমা দিলে পাওয়া যাবে আটটি সেন্ট৷ একশ বোতল কুড়ালে নাকি পাওয়া যাবে একটু বেশি অর্থাৎ একশো ইউরো৷ মেলার একপাশে বসেছে কনসার্ট৷ তরুণ-তরুণীরা গানের সঙ্গে উত্তাল নৃত্যে মত্ত৷

এত কিছু দেখতে দেখতে ক্লান্ত আমি একসময় ঘরে ফিরতে শুরু করলাম৷ ফিরতে চাইলেই সহজে ফেরা যায়না সেখান থেকে৷ বের হতে হয় লাইন ধরে৷ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারীরা সবাইকে লাইন ধরিয়ে ধীরে ধীরে বের করছে৷ এক ঘন্টা ধরে লাইন ধরে বের হই মেলার বাইরে, পৌঁছাই ট্রামস্টপের ধারে৷ আধ ঘন্টা পর যখন ট্রামে চড়তে পারি তখন বাজে রাত আড়াইটা৷ আমি ঘরে ফিরছি তাই বলে ভাটা ধরেনি মেলায়৷ রাইনাউ পার্কের মেলা চলে সারা রাত ধরে৷ চোখ বুজলেই বৃষ্টির ধারার মতো আতশবাজির ফুলকি দেখতে পাই৷ সত্যি এরই নাম ‘রাইন ইন ফ্লামেন'৷
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বিজয়ের আগে রাজাকারের গুলিতে নিহত আফজাল

লিখেছেন প্রামানিক, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:১৩


ঘটনা স্থল গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি থানার উড়িয়া ইউনিয়নের গুণভরি ওয়াপদা বাঁধ।

১৯৭১সালের ১৬ই ডিসেম্বরের কয়েক দিন আগের ঘটনা। আফজাল নামের ভদ্রলোক এসেছিলেন শ্বশুর বাড়ি বেড়াতে। আমাদের পাশের গ্রামেই তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫৫ বছর আগে কি ঘটেছে, উহা কি ইডিয়টদের মনে থাকে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:৫৮




ব্লগের অনেক প্রশ্নফাঁস ( Gen-F ) ১ দিন আগে পড়া নিউটনের ২য় সুত্রের প্রমাণ মনে করতে পারে না বলেই ফাঁসকরা প্রশ্নপত্র কিনে, বইয়ের পাতা কেটে পরীক্ষার হলে নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিজামী, মুজাহিদ, বেগম জিয়াও বিজয় দিবস পালন করেছিলো!!

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৭:২০



মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বেগম জিয়ার মুরগী মগজে এই যুদ্ধ সম্পর্কে কোন ধারণা ছিলো না; বেগম জিয়া বিশ্বাস করতো না যে, বাংগালীরা পাকীদের মতো শক্তিশালী সেনাবাহিনীকে পরাজিত করতে পারে;... ...বাকিটুকু পড়ুন

১৯৭১ সালে পাক ভারত যুদ্ধে ভারত বিজয়ী!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯


দীর্ঘ ২৫ বছরের নানা লাঞ্ছনা গঞ্জনা বঞ্চনা সহ্য করে যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বীর বাঙালী অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে দেশ প্রায় স্বাধীন করে ফেলবে এমন সময় বাংলাদেশী ভারতীয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা গান্ধীর চোখে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক: ওরিয়ানা ফলাচির সাক্ষাৎকার থেকে

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৫


১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইতালীয় সাংবাদিক ওরিয়ানা ফলাচি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎকার নেন। এই সাক্ষাৎকারে মুক্তিযুদ্ধ, শরনার্থী সমস্যা, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক, আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী পররাষ্ট্রনীতি এবং পাকিস্তানে তাদের সামরিক... ...বাকিটুকু পড়ুন

×