somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পেটার্সব্যার্গ

০২ রা জুন, ২০১০ বিকাল ৪:৪৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ডয়চে ভেলে থেকে কাজ শেষ করে রোজ ট্রামে চড়ে বাড়ি ফিরি আমি৷ ঘরের ফেরার পথে ট্রাম থেকে আমি রোজ দেখতে পাই সাত পাহাড়ের উপর এক বিশাল প্রাসাদ৷ প্রাসাদ, মহল না ভবন জানিনা আমি৷ এক অজানা আকর্ষণ শুধু টানে আমায়।

একদিন আমার অদমনীয় আকর্ষণ টেনে নিয়ে গেল আমায়৷ অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ছুটি নিয়ে আমি ট্রামে চড়ে ‍পৌঁছালাম ক্যোনিগসভিন্টারের রাইন নদীর পাশে৷ রাইন নদীর পূর্বদিকে সাত পাহাড়ের মাঝে জাজ্বল্যমান সেই ভবনটি শুধু টানছে আমায়৷ আজ জানতেই হবে পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা মহলটিকে৷

কিন্তু ক্যোনিগসভিন্টারে এসে দেখি সেখানে থেকে সাত পাহাড়ে পৌঁছাতে হলে আমাকে ট্যাক্সি নিতে হবে৷ কারণ ট্রাম বা বাস সেখানে পৌঁছায় না৷ পায়ে হেঁটে এত দূর পাহাড়ে চড়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়৷ কিন্তু দূর পাহাড়ের ধারে দিগন্তের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা প্রাসাদের রহস্য যে জানতে হবে আমাকে৷ অগত্যা ট্যাক্সি ভাড়া করে পৌঁছালাম সাত পাহাড়ের শীর্ষে৷ ঐ ট্যাক্সি চালকের কাছ থেকে জানতে পারলাম যে ভবনটিকে আমি প্রাসাদ ভেবে ছুটে চলছি তা আসলে প্রাসাদ নয়৷ ভবনটি একটি হোটেল৷

সাত পাহাড়ের শীর্ষে পৌঁছানোর পর প্রথমেই চোখে পড়ল পুরানো দেয়ালের ধ্বংসাবশেষ৷ তারপরই চোখে পড়লো অপূর্ব সুন্দর অতিথিশালা বা হোটেল৷

হোটেলটির চারপাশে ঘুরে দেখছি৷ হোটেলটির নাম পেটার্সব্যার্গ৷ এর ফলকে লেখা গ্র্যান্ড হোটেল পেটার্সব্যার্গ৷

সাহস করে হোটেলটিতে ঢুকে গেলাম আমি৷ হোটেলটিতে ঢোকার পর পরিচয় হলো সেখানে কর্তব্যরত একজন মহিলার সাথে৷ ভদ্রমহিলার নাম রাইসা৷ তাঁর কাছ থেকে হোটেলটির ইতিহাস সম্বন্ধে জানতে পারলাম আমি৷ তাঁর কাছ থেকে জানতে পারলাম, নৃবিজ্ঞানীদের মতে সাত পাহাড়ের মাঝে ৩৫০০ বছর পূর্বে ''কেল্ট'' নামক আদিবাসীর বসবাস ছিল৷ যে ভবনটিকে আমি প্রাসাদ ভেবে ছুটে চলছি তা আসলে প্রাসাদ নয়৷ ভবনটি একটি হোটেল৷ দ্বাদশ শতাব্দীতে সাত পাহাড়ের উপরে ভাল্টার রিটার নামের একজন বীরযোদ্ধা একটি ছোট কুটির নির্মাণ করে বসবাস করছিলেন৷ পরবর্তীতে ক্যাথলিক পাদ্রীরা তাঁকে অনুসরণ করে সেখানে একটি গির্জা স্থাপন করেন – যা অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত টিকে ছিল৷ তারপর ক্যাথলিক পাদ্রীরা ১৭৬৩ সালে একই স্থানে আরেকটি গির্জা বা উপাসনালয় স্থাপন করে৷ যার নাম রাখা হয়েছিল পেটার্স উপাসনালয় – যা থেকে পরবর্তীতে পাহাড়টির নামকরণ করা হয় পেটার্সব্যার্গ৷ ১৮৩৪ সালে ইয়োসেফ লুডভিশ মার্টিন নামে একজন ব্যক্তি পুরো পেটার্সব্যার্গ কিনে নেন৷ তাঁর স্ত্রী সিবিলে মার্টিন সেখানকার গির্জাকে কেন্দ্র করে একটি গ্রীষ্মকালীন অবকাশকেন্দ্র স্থাপন করেন৷ সিবিলে মার্টিন ছিলেন একজন ব্যাঙ্কারের কন্যা, সেই সাথে তিনি পরিচিত ছিলেন রাইনের রাণী হিসেবে৷ বিখ্যাত রোমান্টিক লেখক ভিলহেল্ম শ্লেগেল এবং এ্যার্নস্ট মোরিস আর্ন্ট'' সেখানে প্রায়ই বেড়াতে যেতেন৷

তারপর আমি ফ্রাউ রাইসাকে প্রশ্ন করলাম, কখন পেটার্সব্যার্গের এই ভবনটি হোটেলে পরিণত হয়৷ তিনি জানালেন, পরবর্তীতে নেলেস পরিবারের দুই ভাই এই জায়গাটি কিনে নেন এবং ১৮৯২ সালে সেখানে একটি হোটেল স্থাপন করেন৷ কিন্তু হোটেলটি সফলতা লাভ করেননি৷ তারপর ফ্যার্দিনান্দ ম্যুলেন্স নামে এক ব্যক্তি ঐ জায়গাটি কিনে নেন৷ তিনি ৪৭১১ নামের বিখ্যাত পারফিউম কোম্পানীর মালিক ছিলেন – যে পারফিউমকে গোটা বিশ্ব ‘ওডিকোলোন' নামে চেনে৷ তিনিই বর্তমান পেটার্সব্যার্গ হোটেলটি তৈরী করেন৷ ১৯৩০ সালে হোটেলের সঙ্গে একটি রেষ্টুরেন্ট নির্মাণ করা হয়৷ তাঁর সাথে কথা বলতে বলতে হোটেলের অপরদিকের দেওয়ালের কাছে দাঁড়াতেই দেখতে পেলাম এক অপূর্ব দৃশ্য৷ সেই দেয়ালের পাশে না দাঁড়ালে, নিজের চোখে না দেখলে সত্যিই বোঝা যাবেনা কত অপূর্ব মনোরম সেই দৃশ্য৷ সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে পেলাম দূরে দাঁড়ানো পাহাড়গুলো৷ মেঘেরা মিশে গেছে পাহাড়ের সাথে৷ যেন মেঘের ওপর চেপে বসলে এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে চলে যাওয়া যাবে‌৷ ইস্, কি মজাই না হতো যদি মেঘগুলোকে বাহন বানানো যেত৷ আর সেই পাহাড়ের পাশ ঘেঁষে রাইন নদী বয়ে চলছে৷ রাইন নদীর অপর পাড়েই ক্যোনিগসভিন্টার৷ এমনকি সেখানে দাঁড়িয়ে ‘দ্রাখেনফেল্স' বা ড্রাগনের টিলার চমৎকার দৃশ্য দেখা যায়৷ অপূর্ব নৈসর্গিক স্থানের সামনে দাঁড়িয়ে আমি নির্বাক হয়ে গেলাম৷

ফ্রাউ রাইসে আরো বললেন এই হোটেলটি সম্পর্কে৷ জানলাম, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই হোটে‌লটি বিখ্যাত হয়ে যায়৷ কারণ এটি ''অ্যালায়েড হাই কমিশন'' হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে – যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ী মিত্রবাহিনীর দাপ্তরিক কাজের জন্য ব্যবহৃত হতে থাকে৷ এ ব্যাপারে তারা জার্মান সরকারের সঙ্গে লিখিত চুক্তি করে বিষয়টি পাকাপোক্ত করে নেন৷ ১৯৫২ সাল পর্যন্ত ভবনটি ‘অ্যালায়েড হাই কমিশন' মা মিত্রবাহিনীর দূতাবাস হিসেবে ব্যবহৃত হয়৷ এর অনেক পরে, ১৯৭৮ সালে জার্মান সরকার ১৮.৫ মিলিয়ন ডয়চে মার্ক দিয়ে ম্যুলেন্স পরিবারের কাছ থেকে জায়গাটি কিনে নেন৷ তারপর ১০০.৩৭ মিলিয়ন মার্ক দিয়ে হোটে‍লটিকে পুণঃ নির্মাণ করেন৷ এটি ১৯৫৫ সাল থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত হোটেল হিসেবে ব্যবহৃত হতো৷ মাঝে এটি রাষ্ট্রীয় অতিথিশালা হিসেবেও ব্যবহৃত হয়৷ সেখানে রাষ্ট্রীয় অতিথিগণ হেলিকপ্টার নিয়ে চলে আসতেন৷ ১৯৯০ সালে যখন হোটেলটি পুণঃ নির্মিত হয়, সেখানে ধনী ব্যক্তিদের জন্য স্টাইনগেনব্যার্গার নামের বিখ্যাত হোটেল কোম্পানির একটি রেষ্টুরেন্ট তৈরী করা হয়৷ নাইন-ইলেভেনের পর আফগানিস্তানে তালেবানদের উৎখাত করার পর সেদেশে নতুন সরকার গড়ার লক্ষ্যে ২০০১ সালে পেটার্সব্যার্গে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল৷ আবারও ২রা ডিসেম্বর ২০০২ সালে আরও একটি আফগানিস্তান সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়৷ পুরো এলাকাটি বৈদ্যুতিক তার এবং নিরাপত্তা বেষ্টনী দিয়ে ঘেরা৷ এই হোটেলটিতে অনেক বিখ্যাত মানুষ বিয়ের অনুষ্ঠান পালন করেন৷ যেমন ১৯৯৫ সালে বিশ্ববিখ্যাত ফর্মুলা ওয়ান মোটর চালক মিশায়েল শুমাখার এখানে করিনাকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেন৷

এরপর আমি মিসেস রাইসকে এত চমৎকার তথ্যপূর্ণ ইতিহাসের জন্য অনেক ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তার কা‍ছ থেকে বিদায় নিলাম৷ আরেকবার সেই মেঘের সাথে মিশে যাওয়া পাহাড়ের দিকে তাকালাম৷ বিদায় জানালাম পাহাড়শৃঙ্গদের৷ ট্যাক্সিতে যখন বাড়ি ফিরছি তখন গোধূলি নেমেছে ধরনীতে৷



ফারজানা কবীর খান

সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জুলাই, ২০১০ রাত ১১:১৮
৫টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বিজয়ের আগে রাজাকারের গুলিতে নিহত আফজাল

লিখেছেন প্রামানিক, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:১৩


ঘটনা স্থল গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি থানার উড়িয়া ইউনিয়নের গুণভরি ওয়াপদা বাঁধ।

১৯৭১সালের ১৬ই ডিসেম্বরের কয়েক দিন আগের ঘটনা। আফজাল নামের ভদ্রলোক এসেছিলেন শ্বশুর বাড়ি বেড়াতে। আমাদের পাশের গ্রামেই তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫৫ বছর আগে কি ঘটেছে, উহা কি ইডিয়টদের মনে থাকে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:৫৮




ব্লগের অনেক প্রশ্নফাঁস ( Gen-F ) ১ দিন আগে পড়া নিউটনের ২য় সুত্রের প্রমাণ মনে করতে পারে না বলেই ফাঁসকরা প্রশ্নপত্র কিনে, বইয়ের পাতা কেটে পরীক্ষার হলে নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিজামী, মুজাহিদ, বেগম জিয়াও বিজয় দিবস পালন করেছিলো!!

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৭:২০



মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বেগম জিয়ার মুরগী মগজে এই যুদ্ধ সম্পর্কে কোন ধারণা ছিলো না; বেগম জিয়া বিশ্বাস করতো না যে, বাংগালীরা পাকীদের মতো শক্তিশালী সেনাবাহিনীকে পরাজিত করতে পারে;... ...বাকিটুকু পড়ুন

১৯৭১ সালে পাক ভারত যুদ্ধে ভারত বিজয়ী!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯


দীর্ঘ ২৫ বছরের নানা লাঞ্ছনা গঞ্জনা বঞ্চনা সহ্য করে যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বীর বাঙালী অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে দেশ প্রায় স্বাধীন করে ফেলবে এমন সময় বাংলাদেশী ভারতীয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা গান্ধীর চোখে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক: ওরিয়ানা ফলাচির সাক্ষাৎকার থেকে

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৫


১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইতালীয় সাংবাদিক ওরিয়ানা ফলাচি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎকার নেন। এই সাক্ষাৎকারে মুক্তিযুদ্ধ, শরনার্থী সমস্যা, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক, আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী পররাষ্ট্রনীতি এবং পাকিস্তানে তাদের সামরিক... ...বাকিটুকু পড়ুন

×