গোল চত্বরের পাশেই পাওয়া গেল মেয়েটাকে। ইতিমধ্যেই চারপাশে ভিড় জমে গেছে। কেউ কেউ সহানুভূতি দেখিয়ে পানির পট এগিয়ে দিচ্ছে। কেউ বা উপযাজক হয়ে বাতাস করছে। মেয়েটার দু’চোখ দাউদাউ করে জ্বলছে। দূর থেকেও সেই ঝলসে ওঠা চোখের বিদ্যুৎস্ফুলিঙ্গ দেখতে পেল সায়েমা। তাড়া লাগালো জিসানকে।
‘জলদি পা চালাও। মিডিয়ার অন্যকেউ আসার আগেই কিন্তু আমাদের পৌঁছানো চাই!’
জিসান পড়িমড়ি করে ছুটলো সায়েমার পেছন পেছন। আজ প্রায় দু’সপ্তাহ ধরে তারা দেশের আনাচে কানাচে চষে ফেলছে। শুধু রাস্তাঘাট বা পাবলিক ট্রান্সপোর্টই না, অফিস আদালত স্কুল কলেজ এমনকি বাসাবাড়িও রয়েছে তাদের এই চষে ফেলা জায়গার আওতায়। যেখানেই দু’একটা এরকম ঘটনার সন্ধান পাচ্ছে সেখানেই হাজিরা দিচ্ছে। তারা এই প্রজেক্টের নাম দিয়েছে, ‘সার্চিং ফর পারভার্টস’। সায়েমার স্বপ্নের প্রজেক্ট। ইচ্ছে আছে চমৎকার একটা ডকুমেন্টারি তৈরি করবে ইন্টারভিউগুলো দিয়ে। ভার্সিটির দু’ব্যাচ জুনিয়র জিসানকে পাশে পাওয়াতে সুবিধা হয়েছে। জিসান চমৎকার ছবি তোলে। নিজের কাজটা ভালো বোঝে। ইন্টারভিউয়ের পাশে যুতসই ছবি জুড়ে দিয়ে দুর্দান্ত একটা ডকুমেন্টারি তৈরি করে ফেলবে ওরা। ওদের চ্যানেলের বেস্ট কাজ হবে এটা।
পারভার্শন এর শিকার হওয়া মেয়েগুলোর বক্তব্য শুনে গায়ের ভেতরটা কেমন চিড়বিড় করে ওঠে! কী অদ্ভুত একটা প্রজাতি এই পুরুষমানুষ! ভালোমানুষের ভেক ধরে রেখে কী কদর্য সব চিন্তাধারা একেকজনের! নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক অফিসগামী মেয়ে বলেছিল, তার বস একবার ওর কাছে মেয়েদের অন্তর্বাস কেনার ব্যাপারে আইডিয়া চাইছিল। স্ত্রীকে সেই মহার্ঘ্য বস্তু গিফট করার আগে তার নাকি ভালোভাবে জ্ঞান নিয়ে যাওয়াটা প্রয়োজন। আরেকজন বলেছিল, অফিসের আলাপ বাদ দিয়ে নিজের অতি ব্যক্তিগত বিষয় আলাপ করাটা নাকি তার বসের বিশেষ প্রিয় অভ্যাস। নারী সহকর্মীদের দেখলেই কেবল তার এই বিশেষ ইচ্ছেটা চাগাড় দেয়। পাবলিক বাসে ট্র্যাভেল করা মেয়েগুলোর অভিজ্ঞতার ঝুলি তো অসাধারণ! একটি মেয়ে একবার বাস থেকে নেমে খেয়াল করেছিল তার জামার পেছনে নীচের দিকে গোল করে কিছু অংশ কাটা। সেই কাটা অংশে স্কচটেপ দিয়ে লাগানো আছে একটা ছবি। কীসের ছবি জানতে চাইতেই মেয়েটা প্রায় কেঁদে ফেলার জোগাড়। সায়েমা আর প্রশ্ন করেনি। নিজেই বুঝে নিয়েছিল কীসের ছবি হতে পারে।
বাসাবাড়িতে ঠিকে ঝিয়ের কাজ করে এমন অনেক মেয়ের ইন্টারভিউ নিয়েছে সায়েমা। কারো অভিযোগ, ঘর মোছার সময়ে কাপড়চোপড় সরে গেলেই ঘরের কর্তার নজর সেদিকে উঁকিঝুকি মারে। কেউ কেউ এটা সেটা অযুহাতে যখন তখন গায়ে হাত বুলায়। গার্মেণ্টস কর্মীদের অভিযোগের ফর্দ তো আরো লম্বা। পুরুষ সহকর্মী থেকে মালিকের কর্মচারী কারো কাছেই তারা নিরাপদ নয়। গায়ে হাত দেওয়া তো তাদের কাছে একেবারে ডালভাত! শুনতে শুনতে অরুচি ধরে গেছে সায়েমার। তবু সবক’টা জানোয়ারের মুখোশ খুলে ফেলবে এমন একটা পণ করেছে সে। জিসানকে বলা আছে, ছবিগুলো এমনভাবে তুলতে হবে যাতে মেয়েগুলোর চেহারা বোঝা না যায়। কিন্তু তাদের বেশভূষা যাতে কোনোভাবেই মিস না হয়। এতে একটা জিনিস বোঝা যাবে যে, তারা নানাবিধ শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করে। আর তাদের ইন্টারভিউ গ্রহণরত সায়েমাকেও যেন মাঝে মাঝে বোঝা যায়। এতে ডকুমেন্টারিটার ওজন বাড়বে।
রাতে ছবিগুলো এডিট করে ফোল্ডারে গুছিয়ে রাখে জিসান। কিছু ছবিতে ইন্টারভিউ নেওয়ার সময়ে সায়েমার বুকের ওড়না সরে গেছে এদিক ওদিক। সেগুলো জুম করে অনেকটা সময় নিয়ে দেখে জিসান। ফটোশপে গিয়ে নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে আরো কিছু কারিকুরি চালায়। তারপর কিছু ছবি রেখে দেয় ওর আরেকটি বিশেষ ফোল্ডারে। ব্যাগের পকেট থেকে বের করে আনে সায়েমার পড়ে যাওয়া রুমালটা। শুঁকতে শুঁকতে গন্ধটা থিতিয়ে গেছে। তবু প্রতিরাতে এই গন্ধটাই নেশাতুর করে রাখে তাকে।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে মে, ২০২০ সকাল ১১:২৪