পুরনো কোনো নগর অথবা শহর কিংবা কোনো ফেলে আসা সভ্যতা যারা আবিষ্কার করেন...তাদের কাছে এই অনুভূতিটা কী অসাধারণ তাই না?
এমন কোনো ভূতত্ত্ববিদ বা অনুসন্ধানকারী না হয়েও আমার কাছেও ভালো লাগে, প্রাচীন কোনো সভ্যতার অতীত হয়ে যাওয়া নিদর্শনগুলো দেখতে। জাদুঘরে সাজানো সেই নিদর্শনগুলো আধুনিক সুসজ্জিত কক্ষে দেখে ঠিক সেই অনুভূতিটা জাগে না...যে অনুভূতিটা একজন অনুসন্ধানকারী খুঁজে পায় সেটাকে সস্থানে আবিষ্কার করে।
কথাগুলো হেঁয়ালি মনে হচ্ছে তো? আচ্ছা তাহলে খুলেই বলি।
ইউকে বেজড একটি ওয়েবপেজের আর্টিকেলগুলোতে চোখ বুলাতে গিয়ে একদিন একটি পরিত্যক্ত বাড়ি সম্পর্কে জানলাম, যে বাড়িটি ১৯৫০ এর দশক থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। বাড়িটি একজন নগর অনুসন্ধানকারী আবিষ্কার করেছে এই ২০২১ সালে এসে। ঠিক যেন টাইমমেশিনে চেপে সেই সময়টাতে চলে যাওয়া যায় বাড়িটিতে প্রবেশ করলে। কানাডার অন্টারিও প্রদেশে অবস্থিত এই বাড়িটি এমন অবস্থায় আবিষ্কৃত হয়েছে যে দেখে মনে হয়, বাড়ির সদস্যরা কোনো একটা কাজ শেষ করার জন্য একটু বাইরে বেরিয়েছিল...কিন্তু তাদের আর কোনো কারণে ফিরে আসা হয়নি! বাড়িটির অন্দরসজ্জা দেখে মনে হয় এই একটু আগেই গ্রামোফোনে কেউ একজন গান বাজাচ্ছিল...রেকর্ডটা পাল্টে দিতে হয়ত উঠতে যাচ্ছিলো...কিন্তু তার আগেই জরুরি কোনো কাজে বাইরে বেরিয়ে যেতে হয়েছে। ফিরে গিয়ে রেকর্ডটা আর পাল্টে দেওয়া হয়নি।
বাড়ির গৃহিণী হয়ত চুলায় কিছু একটা বসিয়েছিল...রান্নার উচ্ছিষ্টাংশ এখনো লেগে রয়েছে এখানে ওখানে। কিংবা বাড়ির কর্তা হয়ত শেভ করতে করতে রেজরটা একপাশে রেখেই একটু উঠে গিয়েছিল। কিন্তু তারও আর ফিরে এসে শেভটা শেষ করা হয়নি।
এমন একটি বাড়ি দিনের পর দিন এভাবে অক্ষত অবস্থায় পড়ে থাকাটা সত্যিই একটা বিস্ময়! আমাদের দেশ হলে তো কস্মিনকালেও এমনটা ঘটতো না। কবেই দখলদাররা এসে সব ভেঙ্গেচুরে প্রতিটা ইঞ্চি সুই সুঁতো দিয়ে মেপে নিয়ে দখল করে ছেড়ে দিত!
কিন্তু ওসব দেশের কথা আলাদা। মাইলকে মাইল জুড়ে হয়ত জনবসতির দেখা মেলে না। বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ফসলের ক্ষেত। অনেকটা পথ পাড়ি দেওয়ার পরে হয়ত একটি বা দুটি নিঃসঙ্গ একাকী বাড়ির সন্ধান মেলে। তবে এসব জায়গায় যারা বাস করে তারা কিন্তু ব্যাপারটা কম এনজয় করে না! এই একাকীত্বের মধ্যেই হয়ত তারা নিজেদের রাজাধিরাজ রূপে কল্পনা করে!
আচ্ছা এসব অনুমান থাক। বাড়িটির অন্দরমহলে একবার ঢুঁ মেরে আসা যাক!
ছবিতে একটা মেডিসিন ক্যাবিনেট দেখতে পাচ্ছি। মেডিসিন ক্যাবিনেটের বেশিরভাগ ব্রাণ্ড এখনও বাজারে চালু আছে। ভ্যাজলিনের ডিব্বাটাকে দেখে তো মনে হচ্ছে, হয়ত গতকালই কেনা হয়েছে। অল্প একটু ব্যবহার করা হয়েছে মাত্র। ঠাসাঠাসি করে রাখা ঔষধের ডিব্বাগুলোতে এখনও হয়ত ব্যবহারকারীর হাতের স্পর্শ লেগে আছে।
নীচের ড্রয়ারের বক্সটার এই দুর্দশা কীভাবে হয়েছে কে জানে! হয়ত ইঁদুরের কারসাজিই হবে!
কিন্তু কিছু বোতল বা কৌটার ভেতরের দ্রব্যাদি এখনো প্রায় পুরোটাই অক্ষত রয়ে গিয়েছে। মাঝখানে চলে গেছে অনেকগুলো দশক। এই এতগুলো দশকে এগুলো কোনো মানুষের হাতের ছোঁয়া পায়নি!
নিচে শেভিং ক্যাবিনেটের অবস্থা দেখুন। দেখে মনে হচ্ছে না...বাড়ির কর্তা এই একটু আগেই দাড়ি কামিয়ে উঠে গেছেন? রেজরটাকে গুছিয়ে রাখারও ফুরসত পাননি? পাশের বাদ বাকি জিনিসপাতি একেবারে টিপটপ জায়গামত সাজানো। জুতার পলিশটা দিয়ে বুঝি এখনো ঝাঁ চকচকে জুতার পলিশ করে ফেলা সম্ভব! শুধু রেজরটাই সময়ের ভারে জরাজীর্ণ। সেটাকে আবার ব্যবহার করা হয়ত ঠিক বুদ্ধিমানের কাজ হবে না! মাইন্ড দ্য টাইম গ্যাপ!
বাড়ির নারী সদস্যের ব্যবহৃত অনেক পুরনো পারফিউমের শিশিগুলোও এখনো একেবারে জায়গামত আসীন।
মাঝের বিশাল সময়ের ব্যবধানে এই যুগের মানুষ শুধু সেই পারফিউমের সুবাসটাই বেমালুম ভুলে গেছে!
ড্রয়ার ভর্তি হাতে লেখা চিঠি! সেই যুগের মানুষের কাছে চিঠিই ছিল আবেগ প্রকাশের চুড়ান্ত মাধ্যম। সুন্দর হস্তাক্ষরে লেখা সেই চিঠিগুলো কাকে উদ্দেশ্য করে লেখা...কীই বা তাদের ভেতরের বক্তব্য, আজ এতদিন পরে তা আর জানতে পারার কোনো উপায়ই নেই!
বাড়ির বাসিন্দারা নিঃসন্দেহে খুব পড়ুয়া স্বভাবের ছিলেন! অন্তত বইয়ে ঠাঁসা এই বেডরুমটি সেইরকম সাক্ষ্যই দিচ্ছে!
অবশ্য বিছানাটা যে খুব আরামদায়ক, তা অস্বীকার করার উপায় নেই! ফটোগ্রাফারের ভাষ্যমতে, বইয়ের প্রাচুর্যে এই ঘরের ছবি তোলাই ছিল এক ভারি দুষ্কর কাজ! স্মার্টফোন কিংবা অন্য কোনো প্রযুক্তির কাছে দাসত্বের সুযোগটা তখনো সেভাবে আসেনি, বইয়ে ভরা এই সাম্রাজ্য যেন সেই কথাই বলছে!
মন খারাপ করে বসে থাকা পিয়ানোটাকে দেখে মনে হচ্ছে না, সেও তার বাজিয়ে মালিককে খুব মিস করছে?
আচ্ছা এমন একটা সাজানোগোছানো বাড়ি ছেড়ে কেন চলে গিয়েছিল এই বাড়ির বাসিন্দারা? কী হয়েছিল তাদের? এসব অজানা প্রশ্নের উত্তর জানার আজ আর কোনোই উপায় নেই! তাদের ফেলে রাখা জিনিসগুলো হয়ত এখনো বেঁচে আছে! কিন্তু তাদের মালিকেরা কি আজো বেঁচে আছে এই পৃথিবীর বুকে?
চায়না সামগ্রীতে সুন্দর করে সাজানো এই ডিসপ্লে ক্যাবিনেটটা দেখে মনে হচ্ছে না, বাড়ির কত্রী বুঝি এখনই সবকিছু সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছেন?
কোথাও এতটুকু অসামঞ্জস্য বা তাড়াহুড়ো নেই। চায়না পুতুলগুলো নির্বাক চোখে অপেক্ষা করে আছে তাদের মালকিনের হাতের পরিচর্যার আশায়। কিন্তু সেই হাত আর এতগুলো দশকে ফিরে আসেনি!
গ্রামোফোনের রেকর্ডটা যেন এখনো বেজে চলেছে! পাশে পড়ে আছে সব সরঞ্জাম।
রান্নাঘরের সাজানো সরঞ্জাম দেখে অবাক না হয়ে উপায় নেই। চুলার পাশে কি সেই পঞ্চাশ দশকের রান্নার অবশিষ্টাংশ পড়ে আছে? কী সর্বনাশ! কিন্তু অন্যান্য সবকিছু দেখে তো এমনটা মনে হওয়াকে ঠেকানো যাচ্ছে না!
বাথরুমের সাজপোষাক দেখে বেশ ভালোই বোঝা যায়, রুদ্ধ হয়ে থাকা সময়টা যথেষ্ট পুরনো। বাথটাবের পাশে ড্রেসিংটেবিলের উপস্থিতিটা বর্তমান সময়ে একেবারেই বেমানান। হ্যাঙ্গারে ঝোলানো কাপড়গুলো দেখে মনের মধ্যে কৌতুহল জাগে, কেমন ছিল এর ব্যবহারকারীরা?
অতীত যেন স্তব্ধ হয়ে অপেক্ষা করে বসে আছে কালের গর্ভে বিলীন হওয়ার জন্য! (ছবি ও তথ্যসূত্রঃ হাঊজ এন্ড গার্ডেন ডট কো)