(একটি খুব সাধারণ স্কেচ টাইপ লেখা এটি। আমার ফেসবুক পেজে পোস্ট করেছিলাম। আজ সামুতে দিচ্ছি। হয়ত আমরা যারা সমসাময়িক বয়সের অনেকের জীবনের গল্পের সাথে মিলে যাবে।)
প্রতিদিনই তো গল্প দিই!
মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে অন্য ধরনের প্যাঁচাল পাড়তে। এই যেমন আজ ইচ্ছে করছে।
আমরা যারা সমসাময়িক বয়সের, আমাদের লেখালেখির প্রতি ভালোবাসা জন্মানোর গল্পটা আমরা সবাই জানি। কিন্তু এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা কীসের তাড়নায় উদ্দীপ্ত হয়ে গল্প লিখছে সেই গল্পটা জানতে ইচ্ছে করে।
আমরা যখন কৈশোরে, তখন আমাদের আনন্দ বিনোদনের মাধ্যমগুলো ছিল সীমিত। সেটা ছিল নব্বইয়ের দশক। আমরা খুব বই পড়তাম। বইই ছিল আমাদের প্রধান আনন্দ। এখন আমাদের বাচ্চারা কিছু চাইলেই কিনে দিতে পারি। সেই সময় আমাদের ছেলেবেলার ছবিটা এরকম ছিল না। মনে পড়ে একবার একশো টাকা দামের একটি বই নেড়েচেড়ে রেখে দিয়েছিলাম। মা সঙ্গে ছিল। আমার মনের ভাবনাটা হয়ত মায়ের কাছেও অজানা ছিল না। ফেরার পথে বলেছিল,
'এই মাসে থাক, পরের মাসে কিনে দিব।'
হাতখরচের টাকা পেতাম বাবার কাছ থেকে। প্রাইভেট পড়তে যেতাম বান্ধবীদের সাথে। কিছু জায়গায় রিক্সায় যেতে হতো। হয়ত এক রিক্সায় তিনজন। ভাড়াটাও তিনজন ভাগে ভাগে দিতাম। এই টাকা থেকে এদিক সেদিক করে যা বেঁচে যেত, তা দিয়ে কিনতাম সেবা প্রকাশনীর বই। কত ছিল সেইসব বইয়ের দাম? শুনলে অবাক লাগে এখন।
বড়জোর পনের-বিশ টাকা! সেসব বইয়ের ছত্রে ছত্রে খুঁজে পেতাম আনন্দ। আমি বেশি পড়তাম কিশোর ক্লাসিক। অনলাইনে সেসব বইয়ের পুরনো প্রচ্ছদ্গুলো খুঁজলাম। কিন্তু পেলাম না। প্রথম পড়েছিলাম 'দ্য কাউন্ট অফ মন্টিক্রিস্টো'। আলেকজান্দার দ্যুমার বই। সেবার অনুবাদ ছিল অনবদ্য। বইয়ের ভাঁজে ঢুকে পড়তে সময় লাগতো না। তারপর একে একে দুঃসাহসী টম সয়্যার, দ্য এডভেঞ্চার অফ হাকলবেরি ফিন, বাউন্টিতে বিদ্রোহ, এ টেল অফ টু সিটিজ, অলিভার টুইস্ট...। যত্ন করে সংগ্রহ করতাম বইগুলো।
বান্ধবীদের মধ্যে বই আদানপ্রদান চলতো। একবার দুষ্ট বান্ধবীর দল বইগুলো ফেরত দেওয়ার সময় লিখে দিল,
'বিপুকে শুভেচ্ছাসহ...মলি,সবাতী, লুবনা...'
অর্থাৎ আমারই বই তারা আমাকেই গছিয়ে দিল নিজেদের নাম দিয়ে!
স্কুলে আমরা এই বইগুলো নিয়ে তুমুল গল্প করতাম। কার কোন অংশ বেশি ভালো লেগেছে সেগুলো পুনঃপাঠ চলতো। মাসুদরানার রাফ এণ্ড টাফ ব্যক্তিত্বে মনে মনে ক্রাশ খেতাম। যদিও বন্ধুমহলে তা কেউ কারো কাছে স্বীকার করতাম না। মাসুদরানার নায়িকা সোহানাটাকে মনে মনে বেশ হিংসা হতো। 'তিন গোয়েন্দা'র তিন কিশোরের মধ্যে কার কাকে বেশি ভালো লাগতো সেই আলোচনাও চলতো।
মুসার 'খাইছে' বলার স্বভাবটা আমরা কেউ কেউ হুবহু অনুকরণ করতাম। কিশোরের মাথায় কেন এত বুদ্ধি সেটা ঘেঁটে দেখতে গিয়ে বুঝতাম সে বাংলাদেশী। তাই রকিব হাসান এই বুদ্ধিটা এঁটেছেন যে, তাকেই বেশি বুদ্ধিমান বানাতে হবে!
সেই তিনকিশোরের আর বয়স বাড়লো না, মাসুদ রানাও বুঝি আশ্চর্য বটিকা খেয়ে এখনো দিব্যি ইয়ং! শুধু আমরাই কীভাবে কীভাবে যেন মাঝবয়সী হয়ে গেলাম! এর কোনো মানে হয়?
সেবা প্রকাশনীর পাশাপাশি অন্য সব ধরনের বইই আমরা সাগ্রহে পড়তাম। গল্পের বই হলেই হলো। পড়তে ভালো লাগলে সেটা হতো অমৃত। আজ অবাক হয়ে ভাবি, সেই সর্বগ্রাসী বইয়ের ক্ষুধাটা কোথায় হারিয়ে গেল! আজ কত বই বুকশেলফে! প্রতি বইমেলায় ইচ্ছেমত বই কিনি। কেউ নেই বাধা দেওয়ার, 'পরে কিনে দিব' একথা বলার... শুধু পড়ার ইচ্ছেটাই কোথায় যেন হারিয়ে গেছে!
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব গুহ, সমরেশ মজুমদার, শীর্ষেন্দু,...এঁদের বইও প্রচুর পড়তাম। সুনীল আর শীর্ষেন্দুর লেখা সেই বয়স থেকেই ভালো লাগতো বেশি। হয়ত সহজবোধ্যতার জন্য। বুদ্ধদেবের লেখাতে প্রচুর ইয়ে টাইপ ব্যাপার স্যাপার থাকতো। পড়তে ছাড়তাম না। আবার নিষিদ্ধ কিছু পড়ে ফেলেছি এই বোধটাতেও অল্প অল্প দাহ হতাম। বিশেষ করে 'সবিনয় নিবেদন' পড়ে ফেলে মনে মনে তওবা করে ফেলেছিলাম আপাতত আর বুদ্ধদেব গুহ পড়া যাবে না। হায় হায়! এসব কী লেখে?
হুমায়ুন আহমেদের ক্রেজ তখন সবে একটু একটু করে শুরু হচ্ছে। আমরা এই নতুন জনপ্রিয় লেখকের লেখা বেশ আগ্রহ আর আনন্দ নিয়ে পড়তে আরম্ভ করলাম। ১৪ বছর বয়সে তার লেখার সাথে আমার প্রথম পরিচয়, 'শঙ্খনীল কারাগার' বইটা দিয়ে। অসাধারণ অনুভূতিতে মাখামাখি অথচ সাধারণ ভাষাতে লেখা সেই উপন্যাস পড়ে প্রবল নেশায় আচ্ছন্ন হলাম। ইচ্ছে হলো সাথে সাথে আরেকবার পড়ি। তারপর আরেকবার...আরেকবার! এ কী যাদুময় ভাষা! এভাবেও কাঁদানো যায়? এভাবেও মুহ্যমান করে ফেলা সম্ভব লেখনী দিয়ে?
ঝুনু, রুনু, রাবেয়া...প্রতিটি চরিত্র যেন আত্মার আত্মীয় হয়ে গেল আমার। তারা কেউ আমার সমবয়সী, কেউ বা বড়বোন। পাশের বাসার বড় আপা। এদের প্রত্যেকের সাথেই বুঝি নিয়মিত আমার দেখা হয়, কথা হয়। আগে না হলেও এখন থেকে বুঝি প্রতিদিনই হবে।
বিশেষ করে উপন্যাসের শেষ লাইনটা যেন বুকের মধ্যে গেঁথে গেল,
'জানালার ওপাশের অন্ধকার থেকে আমার সঙ্গীরা আমাকে ডাকে। একদিন যাদের সঙ্গ পেয়ে আজ নিঃসঙ্গতায় ভুগছি!'
আমি বিশ্বাস করি, এভাবে এর আগে অন্যকেউ লেখেনি। শুধু তিনি যদি নিজের প্রতিভার সাথে সঠিক ব্যবহারটা করে যেতেন! এই আফসোস মনের কোণে প্রায়ই উঁকি দেয়! এত আশ্চর্য ক্ষমতা নিয়ে খুব কম মানুষই পৃথিবীতে আসে।
আমার খালাতো বোন নীরা উনাকে চিঠি লিখেছিল। সেই চিঠির উনি আবার উত্তরও দিয়েছিলেন। নীরা সেই চিঠি আমাকে দেখিয়েছিল। মনে একটু দুঃখও জন্মেছিল। ইস! আমি যদি চিঠিটা লিখতাম!
আমাদের সেই সময়ে বাসায় নিয়মিত একটা পত্রিকা রাখা হতো। হয়ত বিনোদনের মাধ্যমের অভাব ছিল বলে অথবা পড়ার নেশাটা তখন সবার মধ্যেই ছিল বলেই পত্রিকা রাখাটাও আবশ্যক ছিল। 'বিচিত্রা' আর 'বেগম' এই দুটো পত্রিকা রাখা হতো আমাদের বাসায়। দুটো পত্রিকাই খুটিয়ে খুটিয়ে পড়তাম। বিচিত্রার শেষ দুটি পাতায় কিছু সিনেমার দৃশ্য থাকতো। নীচে লেখা থাকতো ছবির নাম ও অভিনেতা অভিনেত্রীর নাম। তার আগের পাতায় থাকতো বিদেশী চলচ্চিত্র ও তাদের নায়ক নায়িকার খবরাখবর।
বিচিত্রা সেই সময়ে বেশ রিচ একটা পত্রিকা ছিল। এতে যে প্রতিবেদনগুলো প্রকাশিত হতো তা অত্যন্ত মানসম্পন্ন। ওত ভারী ভারী লেখা সেই বয়সে সব না বুঝলেও সময় কাটাতে পড়ে ফেলতাম সবকিছুই। বেগম পত্রিকাটার দিকে আমাদের বাসার বেগমদের বেজায় নজর ছিল। প্রত্যেকেই আশায় থাকতাম কে আগে পাবো পত্রিকাটা। পেলে আর ছাড়াছাড়ি নাই। যার হাতে পড়তো একবার, সে আদ্যোপান্ত শেষ করেই আরেকজনকে পড়ার সুযোগ দিত। এর গল্পগুলো খুব যে উন্নতমানের ছিল তা বলতে পারছি না। বরং সেই বয়সেও আমার কাছে মনে হতো, মেয়েদের লেখনী তুলনামূলকভাবে কাঁচা। আজ মেয়েরা যেসব গল্প লিখছে, সেই তুলনায় তখনকার নারী লেখকদের লেখনীর ভাষা যথেষ্টই অপরিণত ছিল।
বলতে বলতে কত লম্বা বক্তৃতা দিয়ে ফেললাম। তবু মনে হচ্ছে কত কিছু বলা হলো না! আরো কত কথা বলার আছে! শুধু নিজের লেখালেখির সুপ্ত ইচ্ছে দিয়ে এই লেখাটা শেষ করি।
আমার সেই বয়স থেকেই অল্প অল্প ইচ্ছে হতো কিছুমিছু লেখার। কী লিখবো কীভাবে লিখবো...সেই গাইডলাইনটা পেতাম না কোথাও থেকে। আমার পরিবারে কোনো লেখক নেই। মা প্রচুর গল্প উপন্যাস পড়তেন। কিন্তু লেখালেখি তো আর করতেন না! শুধু আমার মেজবোনের কিছুটা লেখালেখির প্রতিভা ছিল। সে বাংলা নিয়ে রাজশাহী ইউনিভার্সিটীতে পড়তো। পত্র পত্রিকাতে দু'এক্টা কবিতাও ছাপা হয়েছে তার। কিন্তু অধ্যবসায় বলে একটা বস্তু আছে। সেটাকে অস্বীকার করার উপায় নেই। সেই দুর্লভ বস্তুর অভাবে তার সেই প্রতিভার ভরাডুবি ঘটতে সময় লাগেনি!
আমি পত্রিকার পাতার পেছন থেকে ঠিকানা বের করে আমার ডায়েরিতে টুকে রাখতাম। মনে মনে স্বপ্ন দেখতাম, একদিন লেখা পাঠাবো। কী লেখা সেই নিয়ে চিন্তা নেই। পত্রিকার পাতায় আমার লেখা আসবে ...এই স্বপ্নই আমাকে ঘুমাতে দিতো না। একদিন সত্যি সত্যি অনেক আশা নিয়ে 'শিশু' পত্রিকার 'কচি হাতের কলম থেকে' কলামে একটা কবিতা (নাকি ছড়া) পাঠিয়ে দিলাম। জবাব পেলাম একেবারে হাতে নাতে, পত্রিকা হাতে পেয়ে। নাহ! লেখা ছাপা হয়নি। সম্পাদক চিঠিপত্রের উত্তর বিভাগে আমার চিঠির জবাব দিয়েছেন,
'ফাহ্মিদা বারী, তোমার লেখা আরেকটু ভালো হতে হবে। মোটামুটি তাল ছন্দ ইত্যাদি থাকা চাই!'
আমি সেই চিঠির অংশটুকু সযত্নে আন্ডারলাইন করে রেখে দিলাম। আমার দু'বোন এটা নিয়ে আমাকে দুদিন খুঁচালো।
'লেখা তো ছাপায়নি। তাও দাগিয়ে রাখলি?'
আমি রাগ দেখালাম। তবু সেই সংখ্যাটাকে হাতছাড়া করলাম না।
এপিজে আবদুল কালাম আজাদের উক্তিটা পরে পড়েছিলাম। খুব মনে ধরেছিল কথাটা।
'স্বপ্ন সেটা নয় যা তুমি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দেখ। স্বপ্ন তাই যা তোমাকে ঘুমাতে দেয় না!'
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই মে, ২০২১ বিকাল ৩:৪৮