(হাল্কাফুল্কা লেখা। নিছক সময় কাটাতে চাইলে পড়তে পারেন।)
ভাদ্রের চিড়বিড়ানি রোদ মাথায় নিয়ে গাবতলী বাস স্ট্যান্ডে যখন এসে পৌঁছালাম, তখন বারোটা বেজে গেছে। আমার বাস সাড়ে বারোটায়। সকাল থেকেই আকাশে ঝলমলে রোদের বাহার। সূর্যের গনগনে তেজে মেজাজও সমান তেজে তেতিয়ে উঠছে।
গাবতলীতে নামতেই আশপাশ থেকে জনা চারেক ছেলে ছোকরা আমার হাতের ব্যাগ ধরে টানাটানি শুরু করে দিলো। একজনের সাথে তো প্রায় আমার হাতাহাতি হবার জোগাড় হয়ে গেল। আরে কী মুশকিল! আমার টিকিট কাটা আছে, সব আছে। খালি বাস খুঁজে নিয়ে তাতে চড়ে বসবো। এত টানাটানি কী জন্য বাপু! শেষমেষ নির্ধারিত বাসের হেল্পার বিজয়ীর ভঙ্গিতে এগিয়ে এসে আমাকে বিপদমুক্ত করলো।
যাচ্ছি বগুড়া। অফিসের কাজের চাপে অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধুর বিয়েতে হাজিরা দিতে পারি নাই বলে বন্ধু বেজায় চটেছে। তার মান ভাঙ্গাতে দু’দিনের ছুটি নিয়ে মোটাসোটা এক গিফটের প্যাকেট হাতে নিয়ে তার দেশের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছি। সে এখনো বিয়ের আমেজ কাটিয়ে ঢাকায় ফিরতে পারেনি। তাই সেখানে গিয়েই তাকে চমকে দেওয়ার ইচ্ছা।
সিটে গা হেলিয়ে দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। যাক, আপাতত কয়েক ঘণ্টা আর চিন্তা ভাবনা নাই। আরাম করে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নেওয়া যাবে। বাসা থেকে খেয়েদেয়ে বাসে উঠেছি। ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। তারমধ্যে আবার এসি বাসের টিকিট কেটেছি। অতএব গরমটাও বেশ ভুলে থাকা যাবে। সিটটাকে সামান্য পিছিয়ে নিয়ে শরীরকে ছেড়ে দিয়ে সবে চোখটা বুজেছি, এমন সময় কে যেন কথা বলে উঠলো,
‘জনাব, এই যে...শুনছেন? কিছু মনে করবেন না। জানালার পাশের সিটটা মনে হয় আপনার। একটু দেখবেন দয়া করে?’
আমি মনের বিরক্তি চেপে রেখে অনিচ্ছাসহকারে চোখ মেলে তাকালাম।
আমার সামনে চকচকে টাক মাথার বেশ দশাসই একখানা ভুড়ির মালিক দাঁড়িয়ে আছেন। ভদ্রলোকের বয়স পঞ্চাশের এদিক সেদিক। তার দিকে তাকালে প্রথমেই এই দুইটি জিনিসই চোখে পরে। চকচকে তেল যুক্ত টাক এবং গোলগাল বেশ একখানা নধরকান্তি ভুড়ি। ভদ্রলোক দুটোরই বেশ যত্ন আত্তি করেন বোঝা যাচ্ছে।
ভদ্রলোক আমার দৃষ্টির ভাষা বিলক্ষণ পড়ে ফেললেন। আমাকে চরম অস্বস্তির মধ্যে ফেলে দিয়ে বলে বসলেন,
‘জনাব বুঝি আমার ভুড়ি দেখছেন? হে হে...কী করবো বলুন? একে কষ্টে রাখতে মন চায় না। নিজে কষ্টে থেকেও একে আরামে রাখি।’
আমি যুগপৎ লজ্জা এবং মজায় হেসে ফেললাম। এ তো দেখি বেজায় রসিক লোক!
ব্যাগ থেকে টিকিট বের করে দেখি জানালার পাশের সিটটাই আমার। তাড়াহুড়োতে আর সিট নাম্বার খেয়াল না করেই বসে পড়েছিলাম। কিন্তু ব্যাপক অবাক হলাম। কেউ জানালার পাশের সিট মুফতে পেয়েও অন্যের জন্য ছেড়ে দেয়, তা এই প্রথম দেখলাম।
‘জনাব বুঝি বগুড়া যাচ্ছেন?’
‘জী, এই বাস তো বগুড়াতেই যায় তাই না?’
‘জী না, এই বাসের দৌঁড় রংপুর পর্যন্ত। তবে বগুড়ার যাত্রীই বেশি।’
আমি আমার হাতের বিশালকায় গিফটের প্যাকেটখানাকে নিয়ে ঝামেলায় ছিলাম। ঊপরে রাখতে পারছি না ভেঙ্গে যাবার ভয়ে। কারণ ভেতরে কাঁচের জিনিস। বন্ধুর বিয়েতে কী ঊপহার দেবো, ভেবে ভেবে দিশাহারা হয়েছি কিছুদিন। অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাকে সামান্য কিছু দেওয়া যায় না। কিন্তু মহামূল্যবান সোনা কেনার সামর্থ এখনো হয়ে ওঠেনি। আমার বাজেট বড়জোর পাঁচ ছয় হাজার। তা দিয়ে যেটুকু সোনা পাওয়া যায়, তা কাউকে দিলে চোখেই ঠিকমতো চোখেই পরবে কী না সন্দেহ। শেষমেষ ভাবনা চিন্তা বাদ দিয়ে মুন্নু সিরামিকের ডিনার সেট কিনে ফেলেছি। নতুন সংসার। কাজে লাগবে। ঢাকায় আসলে বাকি টাকা দিয়ে আরো কিছু কিনে দেওয়া যাবে।
এতো দূর থেকে কাঁচের জিনিস বহন করে নিয়ে যাওয়াও বোকামী। কিন্তু কী আর করা! কিনে ফেলেছি যখন! নীচে রাখতে গিয়েও বাসের দুলুনিতে সরে গিয়ে ভেঙ্গে পড়তে পারে। তাই হাতের ব্যাগটাকে সীটের নীচে ঢুকিয়ে দিয়ে গিফটের ঢাউস বাক্স কোলে নিয়ে বসে রইলাম।
পাশের ভদ্রলোক সীটে সাইজ মতো বসে নিয়ে আমার দিকে মনোযোগ দিলেন। হাতের বাক্স নিয়ে কিছু একটা যে বলবেনই তা তো বুঝতেই পারছিলাম। ঠিক তাই! প্রথমেই বাক্সের দিকে নজর দিয়ে বললেন,
‘জনাব কি পুরো যাত্রায় একে কোলে নিয়ে বসে থাকবেন? এতো আদর করে ধরে রেখেছেন! আহা রে! খুব আদরের বুঝি? নীচে রাখুন। সে ব্যথা পাবে না।’
আমি হেল্পারকে ডেকে আগে বাক্সের ব্যবস্থা করলাম। একে পুরো যাত্রা পথে কোলে নিয়ে বসে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাহলে ঘুমাবো কখন? বাসের লং জার্নিতে ঘুম বড় আনন্দের জিনিস। হেল্পার সীটের নীচে দড়ি দিয়ে বেঁধে বাক্সের শক্ত হয়ে লেগে থাকার একটা ব্যবস্থা করে দিলো। সেদিকে তাকিয়ে নিশ্চিত হলাম। যাক, বাক্স নিয়ে আর চিন্তা নাই। আমি সীটে আবার গা এলিয়ে দিলাম। কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই আবার পাশ থেকে ডাক,
‘ভাই কি ঘুমিয়ে গেলেন? আমার আবার যাত্রাপথে ঘুম আসতে চায় না। বলুন দেখি, কী সমস্যা! আশেপাশে সবাই কত আরাম করে ঘুমিয়ে থাকে! আর আমি কান খাড়া করে তাদের নাক ডাকার ঘড় ঘড় আওয়াজ শুনি। একবার কী হয়েছে শোনেন...’
আমি অতি দুঃখে দীর্ঘশ্বাস গোপন করলাম। আমার সাধের ঘুমের যবনিকাপাত ঘটে গেল। এই লোক যদি পুরো রাস্তায় এমন মলম বিক্রেতার মতো মুখ চালাতে থাকে, আমার ঘুম তবে হয়েছে আর কী!
দুহাতে মশলার মতো কী যেন পিষতে পিষতে ভদ্রলোক বিরামহীন বলে যেতে লাগলেন,
‘একবার দূরের এক জেলায় যাচ্ছি। আমার বাড়ি থেকে প্রায় একশো কিলোমিটারের মতো তো হবেই! রাতের যাত্রা। শীতকাল, সেই বছর শীতও পড়েছে বেশ জাঁকিয়ে। সোয়েটার দিয়ে শীত মানে না। কান টুপি, হাত মোজা সব পরে বসে থাকতে হয়। আমি সবকিছু গায়ে চাপিয়ে বাসে উঠেছি। আমার পাশের সিটে বসেছেন এক ভদ্রলোক। তার স্ত্রী তাদের দু’বাচ্চা নিয়ে সামনের সীটে বসেছে...’
আমি ক্রমাগত হাই তুলতে লাগলাম। ভদ্রলোকের গল্প তো সবে শুরু হলো। শেষ কখন হবে কে জানে! আমি তাকে থামিয়ে দেবার আশায় বললাম,
‘কী মশলা পিষে চলেছেন তখন থেকে? বেশ মজাদার মনে হচ্ছে!’
‘পান মশলা, ভাই। সবসময় সাথে রাখি। অবসরে বসে বসে চিবুই। ঘুম তো আর আসে না। কী করবো! আপনি চিবুবেন নাকি?’
আমি হাত বাড়িয়ে খানিকটা মশলা নিলাম। লাল-সবুজ নানা রঙের সমাহার। দেখতে খাসা। ভদ্রলোক বললেন।
‘আস্তে আস্তে চিবান। আরাম পাবেন। আমার গল্পটা শোনেন। আমার পাশের সীটের ভদ্রলোক তো বাসে উঠেই দিয়েছেন ঘুম। একেবারে রাত কাবারি ঘুম যাকে বলে! আর তার স্ত্রী বেচারা দুই বাচ্চা সামলিয়ে যাকে বলে একেবারে দিশেহারা। বাচ্চারা শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়তেই সেও ঘুমে কাদা। বাসের সবাই তখন ঘুমাচ্ছে। বাতি নিভানো। একমাত্র পুরো বাসে আমি জেগে বসে আছি। আমি ভদ্রলোকের নাক ডাকার আওয়াজ শুনছি। এমন সময় দেখি, এক লোক হেল্পারকে ডেকে বাস থামাতে বলছে। হেল্পার কারণ জিজ্ঞেস করতেই বলে, তার নাকি খুব চেপেছে। বাস না থামালে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। অগত্যা হেল্পার ড্রাইভার কে বলে বাস থামালো। সেই লোক যেতে যেতে এক ফাঁকে ফুরুৎ করে আমার পাশের সীটের ভদ্রলোকের ব্যাগ কে বেশ গছিয়ে নিয়ে সবে নামতে যাবে, এমন সময় আমি চেঁচিয়ে উঠলাম...’
......................................................
‘এই যে, মিয়া ভাই ...নামবেন না? আপনার বগুড়া তো আইসা গেছে...’
হেল্পারের চেঁচামেচিতে পিটপিট করে চোখ খুলে তাকিয়ে দেখি, বাস অনেক ফাঁকা। আমার পাশের সীটের ভদ্রলোকও কখন যেন নেমে গেছেন। তার সীটের উপর পরে আছে গতকালের সেই পান মশলা, যা তিনি হাতে নিয়ে পিষছিলেন।
আমি এই দীর্ঘপথ ঘুমেই কাটিয়ে দিলাম! মাথা কেমন যেন ভোঁ ভোঁ করছিলো। সীটের নীচে তাকিয়ে দেখি, আমার গিফটের বাক্স এখনো সযত্নে বাঁধা আছে। একটুও হেলে পড়েনি। তবে তার পাশে রাখা আমার ব্যাগটা নেই। চকিতে প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে বুঝলাম, মানিব্যাগও হাওয়া!
গিফট বক্সের গায়ে কস্টেপ দিয়ে একটা কাগজ সেঁটে দেওয়া। চোখ লাগিয়ে দেখি তাতে লেখা রয়েছে,
‘ক্ষনিকের চেনা জনের কাছ থেকে পানমশলা চিবুতে নেই।’
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই আগস্ট, ২০২১ দুপুর ১২:৪১