কবিতা কি?
ড. হুমায়ুন আজাদ তার -আমার অবিশ্বাস- গ্রন্থে কবিতাকে নির্ণয় করতে বর্ণনা করেছেন -- যা কিছু প্রিয় আমার, যা কিছুর জন্য নিরর্থক জীবনধারনকে তাৎপর্য মনে হয়, বেঁচে থাকাকে সুখকর মনে হয়, তা রাষ্ট্র নয় সংঘ নয় সুধীদের কর্মীদের রাজনীতিবীদদের বিবর্ণতা নয়, সেগুলো খুবই সামান্য ব্যাপার, আর সে শুরুতেই রয়েছে কবিতা। সমাজ, বিশেষ করে রাষ্ট্রের কবিতার দরকার নেই; কোন রাষ্ট্রই মনে করেনা যে তার সুষ্ঠু পরিচালনের জন্য কবিতা দরকার, দরকার কবি। ১০০০ মানুষের জন্য আমাদের ৫০ জন চিকিৎসক দরকার, এক জেলার জন্য দরকার ১০০ প্রকৌশলী, ৩০০ নির্বাহী কর্মকর্তা, ৪টি নির্বাচিত ১টি মনোনীত প্রতিনিধি এবং ১৫০০ পতিতা কিন্তু কোন কবির দরকার নেই। তবে ব্যক্তির দরকার কবিতা, সমাজের দরকার কবিতা, সভ্যতার দরকার কবিতা। মানুষ সৃষ্টিশীল, তার সম্ভাবনা অশেষ, কবিতা মানুষের সৃষ্টিশীলতার এক শ্রেষ্ঠ প্রকাশ।
কিভাবে সৃষ্টি হয় কবিতা? কি থাকে কবিতায়?
কবিতায় কি থাকে, তা খুঁজে বের করা অসম্ভব নয়, মানবিক-অমানবিক সব কিছুইতো থাকে কবিতায়, থাকে ভাষার ইন্দ্রজাল, অপরিসীম কল্পনা; কিন্তু কিভাবে সৃষ্টি হয় কবিতা, তা নিশ্চিতভাবে কেউ বলতে পারিনা। ... কবিতার কাঠামো, তার ছন্দ ও মিল বা অমিল সম্পর্কে কিছুটা শিক্ষা দেয়া সম্ভব কিন্তু প্রতিটি প্রকৃত কবিতাই অভূতপূর্ব, রচিত হওয়ার আগে তার রচয়িতাও সেটি সম্পর্কে জোর দিয়ে কিছু বলতে পারে না। কবিতা লেখা হয়ে যাওয়ার পরই শুধু উপলব্ধি বা অনুভব বা বিচার করে দেখা সম্ভব সেটা কবিতা হয়েছে কিনা, বা হয়েছে কতটা অসাধারণ।....
মানুষ তার আপন মনের ভাবনাকে প্রথমত শারিরীক অঙ্গ-ভঙ্গির মাধ্যমে অন্যজনকে প্রকাশ করে, অত:পর নানাবিধ ধ্বনির সাহায্যে। যেহেতু ধ্বনি একস্থান থেকে অন্যস্থানে প্রতিস্থাপিত হয় ইথারের স্পন্দনের মাধ্যমে তাই সেই ধ্বনিকে একটি নির্দিষ্ট গাথুনিতে বেধে দিয়ে তৈরি করা যায় একটা রিদম। ভাষার উৎপত্তির শুরু থেকে মানুষের সৃষ্টিশীল ভাবনা এই ধ্বনিগুচ্ছ নানাবিধ গাথুনিতে গেথে অন্যজনে পৌছে দিত। পৃথিবীর প্রতিটি ভাষায়ই তাই প্রথম উদ্ভব হতে দেখা যায় পদ্য বা গান। মানুষের মস্তিষ্ক অন্তঃস্থিত যে মেমোরি সেল রয়ে গেছে সেখানে শ্রুতি বা দৃশ্য দর্শনের মাধ্যমে যেসব তথ্য পাঠানো হয় তাকে দীর্ঘস্থায়ীভাবে স্মরণযোগ্য করে রাখার জন্য এবং প্রয়োজনীয় সময়ে প্রকাশ করার জন্য প্রয়োজন হয় একটি সুনির্দিষ্ট গাথুনি বা ঘটনার পরস্পরা। একটি ছন্দময় গাথুনি দিয়ে বেধে ধ্বনিপুঞ্জকে যদি মস্তিষ্কে প্রেরণ করা যায় তবে তা সহজেই স্মরণে রাখতে পারে।
ধ্বনিগুলোকে ক্রমাগত সাজিয়ে মানুষ তার মনের ভাব প্রকাশ করে, কথা বলে। কিন্তু কথ্য ভাষার সকল শব্দই একটি নির্দিষ্ট রিদমে ফেলা যায় না। যে সমস্ত ধ্বনি সমষ্টি একটি নির্দিষ্ট রিদমে গেথে মনের ভাবকে প্রকাশ করা যায় সেই সকল ধ্বনি সমষ্টিকে ক্রমাগত সাজিয়ে পদ্য রচিত হয় যা দ্বারা মনের আবেগকে অন্যের মাঝে সঞ্চারিত করা যায়। কিছু কিছু ভাব বিন্যাস শব্দের গাথুনিতে এতোটাই মাধুর্যমন্ডিত হয়ে উঠে যে, মস্তিষ্কে তা গেথে যায় এবং বারবার উচ্চারিত হয়ে আনন্দিত হয়।
মনের ভাবকে প্রকাশ করার জন্য বা মানুষের অভিজ্ঞতাকে অন্যের মাঝে বর্ণনা করার জন্য প্রয়োজন হয়ে উঠে রূপকের। একটি অজানা বস্তুকে বুঝাবার জন্য জানা বস্তুর সাথে বা অজানা ভাবকে বুঝাবার জন্য জানা ভাবকে রূপক হিসাবে ব্যবহার করা হয়। কখনো কখনো এই সকল রূপক শ্রুতিমধুর ধ্বনিপুঞ্জের সাহায্যে কেবল তথ্য বা খবরের সন্ধান দেয় না, তৈরী করে এক ধরনের অনির্বচনীয় আবেগ, আপ্লুত করে মানুষের সৃষ্টিশীলতাকে। নির্মল আনন্দে আপ্লুত হয়ে উঠে মানুষের মন।
মানুষের মস্তিষ্কের প্রকৃতিই এমন যে, প্রথম অভিজ্ঞতায় সে যে আনন্দে ভেসে যায় তার বহু ব্যবহারে সে বিরক্ত হয়ে উঠে। তার সৃষ্টিশীলতা নতুন অভিজ্ঞতাকে প্রয়োজনীয় করে তুলে। মানুষের মস্তিষ্ক একস্থানে স্থির অবস্থান নেয়না কখনো। তার পর্যবেক্ষণ তাকে ক্রমে ক্রমে সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে চলে। নানবিধ পর্যবেক্ষণে প্রকৃতির নানা রীতিনীতকে আত্মস্থ করে তার জ্ঞানের উন্মেষ ঘটতে থাকে। বদলে যেতে থাকে জীবন যাত্রার মান। জটিল থেকে জটিলতর সামাজিক কর্মকান্ডের মধ্যে দিয়ে এগুতে থাকে মানুষ। এই যে মানুষের সৃষ্টিশীলতা প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম পদ্য বা কবিতা তাও নানারূপ ছন্দের পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে এগুতে থাকে। রূপকে আসতে থাকে নানা বৈচিত্র্য। ভাবে চলে আসে সমৃদ্ধি। তৈরী হতে থাকে কাব্য চেতনা। তৈরী হয় অসাধারণ ভাবের প্রকাশ, শব্দের নানাবিধ বিন্যাসে। ছন্দগুলো সরলীকরণের পথ অতিক্রম করে জটিল থেকে জটিলতর হতে থাকে। চলে আসে মাত্রায় গাণিতিক প্রয়োগ।
বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার চেতনায় এনে দেয় বৈপ্লবিক পরিবর্তন। চলে আসে লিখিত অবয়ব। যে ছন্দগুলো ধ্বনিপুঞ্জের তালের সাহায্যে এগুতে ছিল তা-ই এক পর্যায়ে অক্ষর মাত্রায় রূপান্তরিত হয়।
অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, বৈজ্ঞানিক কর্মকান্ড পরিচালনা হতে জন্ম নেয় এক ধরনের ভাষা যাকে গদ্য বলা হয়। পরিবর্তিত পৃথিবী অনেক যুদ্ধ, প্রতিহিংসা, সামাজিক অনাচার আর বিপ্লবের মাধ্যমে এগুতে থাকে। কিন্তু মানুষের সৃষ্টিশীলতা থেমে থাকেনি। তার সৃষ্টিশীলতা প্রকাশের জন্য তৈরী হতে থাকে শক্তিশালী বাঁধন, গদ্যের বাঁধন। ভাব প্রকাশের যে মাধ্যমটি ছিলো নারীর মতো কোমল, স্নিগ্ধ, রিদমিক তা কঠিন প্রকৃতির মতো গদ্যে রূপান্তরিত হতে থাকে। তৈরী হতে থাকে এক পৌরুষদীপ্ত ফরমেট। জন্ম নেয় গল্প, ছোট গল্প, উপন্যাসের মতো শক্তিশালী মাধ্যম। পদ্যের একচ্ছত্র আধিপত্য খর্বিত হয়। কল্পনাপ্রবণ মানুষ সৃষ্টিশীলতাকে নিবেদন করতে থাকে নানামুখী ফরমেটে। পদ্যের শারিরীক কোমল গঠনের কারণে যেখানে সে স্থবির থাকে আর এগুতে পারেনা, সেখানে গদ্য তার ভূমিকায় অনন্য হয়ে উঠে। মানুষের জীবনে জটিলতাকে অত্যন্ত শক্তিশালী দীর্ঘমেয়াদী চিন্তা চেতনার সাহায্যে ব্যাখ্যা করতে থাকে।
মানবজাতির সূচনার সেই সহজ-সরল অভিব্যক্তি ছন্দের তালে তালে যে স্পন্দিত হতে ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী মাধ্যম হিসাবে সেও তার ফরমেটে পরিবর্তন নিয়ে আসে। কেননা সৌন্দর্য আর মননশীলতা প্রকাশের এই যে অনন্য মাধ্যম পদ্য বা কবিতা তার ভিতর রয়ে গেছে এক ধরনের মাদকতা যাকে কোন কালেই মানুষ হারাতে পারেনি। কবিতায় ক্রমে ক্রমে ভাষাগত ছন্দের আঁটা-আঁটির সমান্তরে ভাবগত ছন্দ উদ্ভাসিত হয়েছে। তার শ্রাব্য সীমারেখা ছাড়িয়ে হয়ে উঠে প্রধানত পাঠ্য। যে সুনিবিড় সুনিয়মিত ছন্দ আমাদের স্মৃতির সহায়তা করে তার অত্যাবশ্যকতা হারিয়ে গেছে। একদিন খনার বচনে চাষাবাদের পরামর্শ লেখা হয়েছিল ছন্দে। আজকালকার বাংলায় যে -কৃষ্টি- শব্দের উদ্ভব হয়েছে, খনার এই সমস্ত কৃষ্টির ছড়ায় তাকে নিশ্চিত এগিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু এই ধরনের কৃষ্টি প্রচারের ভার আজকাল গদ্য নিয়েছে। ছাপার অক্ষর তার বাহন, এই জন্য ছন্দের পুঁটুলিতে ঐ বচনগুলো মাথায় করে বয়ে বেড়াবার দরকার হয় না। কাব্য, বুদ্ধির সাথে এর বোঝাপড়া নয়, একে অনুভব করতে হয় রসবোধে। আর এই কাব্য রসবোধকে সুসমন্নত রেখে শুরু হয় গদ্যে কাব্য রচনা।
চলবে। আশা করি কবিতা প্রেমীদের সাথে পাব।