ইদানীং ভীষণ এক সমস্যায় জর্জরিত আমি । সপ্তাহের শেষের ছুটির দিনগুলোয় আনন্দে কাটানোর পর রাতগুলো বিষাদে পরিপূর্ণ হয়ে উঠে কোন কারন ছাড়াই । প্রচণ্ড ক্লান্তিও এই বিষাদ থেকে উদ্ধার করতে পারে না আমাকে । এই যেমন এই মুহূর্তে আমার মন ভাল নেই । শাহেদ কে বলার পর মহা এক ফিলসফি শুনতে হল।
" বুঝলে মেয়ে, মন খারাপের বহিঃপ্রকাশ মেয়েরা যত সহজে প্রকাশ করতে পারে ছেলেদের জন্য তা ততটাই কঠিন । আমার মনেহয় মন খারাপের অনুভূতি প্রকাশ না করে বরং মন খারাপের দিকে মনোযোগ দেয়া উচিত না । এতে হৃদয়ে অভিমান সৃষ্টি হয় । অভিমান আর মন খারাপ যখন মিলিত হয় তখন মাইনাসে মাইনাসে প্লাস হয়ে মন ভালো হয়ে যায় ।"
শুনে এমন বিরক্ত লাগলো যে বলেই ফেললাম,
--- তুমি এত বাজে কথা বল কেন শাহেদ ???
--- আচ্ছা আর বলব না । বুঝেছি, আজ নীরার মন ভালো নেই। চল এর চেয়ে বরং তোমাকে গান শোনাই ।
মূলত গান শোনার জন্যই এই মুহূর্তে শাহেদ কে কল করা । শাহেদের গানের গলা যেমন ভীষণ চমৎকার তেমনি গানের সিলেকশন জঘন্য রকমের ভয়ঙ্কর ! থার্ড গ্রেডের বাংলা ছায়াছবির গানগুলি আমাকে শোনাবে । ছায়ানটের এতভালো একজন গায়কের এই ধরনের গান সিকেলশনের মুখ্য উদ্দেশ্যই হল আমাকে বিরক্ত করা । বিশেষ করে চলন্ত রিক্সায় বসে জোরে জোরে কি সব অদ্ভুত বাংলা গান গায় । মেজাজ এত খারাপ হয় আমার যে "ধাক্কা মেরে ফেলে দিলাম কিন্তু" এই টাইপের থ্রেড দিয়ে চুপ করাতে হয় । কিন্তু সেটা মাত্র মিনিট খানেকের জন্য । একটু পরেই আবারো বিচিত্র গানের সমাহার শুরু হয় । আমার যতটা মেজাজ খারাপ হয় আশেপাশের মানুষের ততটাই মনোরঞ্জন হয় বৈকি ! অবশ্য মাঝে মাঝে শুনতে খারাপ লাগে না । এই ধরনের পাগলামির জন্যই বিখ্যাত আমার বন্ধু শাহেদ। আমার নিরবতা কে সম্মতি মনে করেই কিনা জানি না, নিজে থেকেই গান ধরল ।
অতীতের ছবি আঁকা হয়ে গেলে
চারিদিকে এই চোখ দুটি মেলে !!
পলাতক আমি কোথা যেন যাই
আঁধারের রিদন শুনে
কবিতা পড়ার প্রহর এসেছে রাতের নির্জনে
কবিতা পড়ার প্রহর এসেছে রাতের নির্জনে
জোনাকির আলো নেভে আর জ্বলে শাল মহুয়ার বনে !!!
শুনছিলাম । ভালো লাগছিলো !! রেষটুকু থাকতেই আরেকটা গান শুরু করলো।
প্লীজ ঘুম হয়ে যাও চোখে
আমার মন খারাপের রাতে
আমার রাত জাগা তারা
তোমার আকাশ ছোয়া বাড়ী
আমি পাইনা ছুতে তোমায়
আমার একলা লাগে ভারী !!
ভীষণ প্রিয় গান হলেও এই মুহূর্তে আরও মন খারাপ হয়ে গেলো । নীরবে ফোন রেখে দিলাম। ভাবলাম একটা বই পড়ি । "জোছনা ও জননীর গল্প" নিয়ে বসলাম । নতুন বইয়ের পাতার স্নিগ্ধতা ভাল লাগার মতই । বেশিরভাগ বইয়ের পিডিএফ আছে আমার কাছে । ল্যাপটপে পড়া হয়ে যায় বলে বইগুলো নতুনই থাকে । তবে আমার বই কিনতে হয় প্রচুর । আশেপাশের প্রিয় মানুষগুলোর উপহার হিসেবে প্রথম পছন্দ হল বই । তাদের জন্য বই কিনতে গেলে নিজের জন্যও কেনা হয়ে যায় । এই বইটা অবশ্য আমি কিনি নি । উপহার পেয়েছিলাম । হুমায়ূন আহমেদের লেখনিতে রবি ঠাকুরের কবিতার কিছু লাইন উপহার কে আরও সমৃদ্ধ করে তুলেছে হৃদয়ে ।
"থমকে গেল আমার সমস্ত মনটা;
চেনা লোককে দেখলেম অচেনার গাম্ভীর্যে।
সে রইল জানলার বাইরের দিকে চেয়ে
যেন কাছের-দিনের-ছোঁয়াচ-পার-হওয়া চাহনিতে। "
বিড়বিড় করে লাইনগুলোতে শব্দ প্রয়োগ করতে ভাল লাগছিল । মন খারাপের মুহূর্তে ভালোলাগাটাও দীর্ঘশ্বাসে পরিণত হয় । তাই বইটা সযতনে বুকশেলফে তুলে রাখছিলাম তখনই আরেকটা কবিতার বই চোখে পড়ল । এবারের বইমেলায় উপহার পেয়েছিলাম । বুদ্ধদেব বসুর শ্রেষ্ঠ কবিতার বই । বইমেলা থেকে বই কিনে বাড়ি ফেরার পথে হটাত মনে পড়ল উপহার পাওয়া বইয়ে কিছুই তো লেখা হল না। তখন প্রায় দোয়েল চত্বরের কাছাকাছি পৌঁছে গেছি আমরা। যেই মনে পড়ল ওমনি বসে গেলাম দোয়েল চত্বরের মুখোমুখি ফুটপাতে । রাস্তার নিয়ন আলোয় বসে উৎসর্গপত্র লিখেছিলাম । আমি কি লিখেছিলাম তা আজ আর মনে নেই । তবে উপহার পাওয়া এই বইটিতে লেখা ছিল "তোমাকেই দেবী বলে মানি, এমন কিছু নেই যা তোমার নয়" । বইটি আজও পড়া হয় নি । প্রথম পৃষ্ঠার এই লেখনির পর অদৃশ্য কোন শৃঙ্খল হৃদয় কে আবদ্দ করে ফেলে। কোন কবিতা আর হৃদয়কে স্পর্শ করে না ।
বুকসেলফের সামনে থেকে সরে এলাম । এখানে সাজানো প্রতিটা বই আমার একান্ত মুহূর্তগুলোর স্মৃতিস্তম্ভ । এভাবেই সাজানো থাক ।
ঘুম আসছিলো না। বসেছিলাম একা । মধ্যরাতের ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মৃদু গুঞ্জন শোনার চেয়ে ধীরে ধীরে কিন্তু এক নাগাড়ে ঝরে পরা বৃষ্টি দেখে সেদিন বিকেলের স্মৃতি মনে পড়ে গেলো । ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পথ হয়ে ঢাকায় ফেরার পথেও এমন মৃদু মৃদু বৃষ্টি হচ্ছিল । সারাদিনের বিষণ্ণতা প্রতিটা ফোঁটার সাথে সাথে বিলীন হয়ে গিয়েছিল। সব রাগ আর ঘৃণা রূপান্তরিত হয়ে কষ্টে রূপ নিয়েছিল। তারপরও জানি না কেন, বৃষ্টি সবসময়ের মত সেদিনও আমার মন ভালো করে দিয়েছিল ।
মুঠোফোনের ভাইব্রেশনে ভাবনায় ছেদ পড়ল। তাকিয়ে দেখি শাহেদের কল । অবাক হই নি । শাহেদটাই এমন । মাঝে মধ্যে মধ্যরাতে আমাকে গভীর ঘুম থেকে তুলে বলবে "চল, তোমাকে একটা গান শোনাই" । আমার মত ঘুমকুমারীর ঘুম নষ্ট করে গান শোনানোর জন্য কম ঝাড়ি খায় না । তারপরও এই যন্ত্রণা করতেই থাকে । আর আজকেতো একেবারেই একা থাকতে দেবে না । ধুর ! বলাটাই ভুল হয়েছে দেখছি । কি আর করা !!
মুঠোফোনের সাড়া দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
--- কি ব্যাপার ?? ঘুমাও নাই ?
-- আরে ! ঘুমিয়েছিলামতো । স্বপ্ন দেখে জেগে উঠলাম ।
---(আমিতো অবাক ) । বললাম, তুমিতো ফোন রাখলেই একটায় । এখন বাজে আড়াইটা । এর মদ্ধেই স্বপ্ন দেখা হয়ে গেলো ??
--- হ্যাঁ ! বিশাল রোমান্টিক স্বপ্ন । স্বপ্ন দেখেই মনেহল তোমাকে শোনাই । শোন, দেখলাম কি .......................................
---অফ যাও ! কি দরকার স্বপ্ন বলার। তাহলে সেটা আর পূরণ হবে না ।
--ধুর ! তুমি একটা কঠিন মাইয়া । মুডের বারোটা বাজানোর জন্য তোমার ইশারাই কাফি । যাক, এত রাতে কি কর, কাল অফিস নাই। ঘুমাও ।
--হুম ! এইতো শুয়ে পড়ব। শাহেদ শোন, কাল অফিসের পর আমরা হাতিরঝিলের ফুটপাতের আইল্যান্ডে বসে তোমার জন্মদিন উদযাপন করবো । কাল সন্ধ্যা পূর্ণিমা, জানো তো ?? আইল্যান্ড ধরে তুমি আর আমি হেটে যেতে থাকবো । চাঁদটা ঈর্ষায় জ্বলে পুড়ে আরও উজ্জ্বল রুদ্র রূপ ধারন করবে আর আমাদের অনুসরণ করবে । আমি মিটিমিটি হাসবো আর তুমি গুনগুন করে গান ধরবে ----
"চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে, উছলে পড়ে আলো।
ও রজনীগন্ধা, তোমার গন্ধসুধা ঢালো ॥
পাগল হাওয়া বুঝতে নারে ডাক পড়েছে কোথায় তারে--
ফুলের বনে যার পাশে যায় তারেই লাগে ভালো ॥"
ঘুমিয়ে পড় শাহেদ। শুভ রাত্রি !
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৩ রাত ১০:২২