কী অদ্ভুত টগবগে রকমের প্রাণবন্ত এই শহর, ঢাকা!
পথে যখনই নামতে হয় তখনই এরকমটা মনে হয় আমার। পায়ে পায়ে লোক, একটু থুথু ফেলবেন- সতর্ক না হলে কারো না কারো গায়ে পড়বেই! এতো লোক, এতো রিক্সা, এতো সিএনজি-বাস-লরী, এতো ঠেলাগাড়ী-ভ্যান, প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস আর মটর সাইকেল সারা শহরটা জুড়ে! সব মিলে গমগম সারাক্ষন। প্রাণবন্ত বলবো না তো কি ?
প্রাণের আবেগে ভেসে, মানুষ থেকে যানবাহন সবই যে যার খুশিমতো চলছে। কোন আইন নেই, কানুন নেই (কাগজে কলমে আছে বটে তবে তা অকার্য্যকর), কোন বিবেচনাবোধ নেই, কোন সহিষ্ণুতা নেই! কোনদিকেই কারো বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপও নেই। যে যার মতো চলছে। ঠেলাঠেলি - গুঁতোগুঁতি , বেপরোয়া বাস- মটর সাইকেলের তীক্ষ্ণ হর্ণ, গাড়ীর প্যা-পো, এ্যাম্বুলেন্সের কান ফাঁটানো সাইরেন সব মিলে যেন অনন্য এক প্রাণের মিলন মেলা। তারপরেও মানুষ আসছে বানের লাহান। এতো অনিয়ম আর বিশৃঙ্খলার মাঝে্ও এমন প্রানবন্ত শহর তার জঠরে ঠাইঁ দিয়ে রেখেছে প্রায় আড়াই কোটি আদম সন্তানকে।
এই শহর প্রাণবন্ত মনে হলেও এর বিপরীতে পথে পথে জটলা, মোড়ে মোড়ে হাট-বাজার, গাড়ী আর মানুষের জট, কোনা-কাঞ্চিতে – ফুটপাত আটকে চা-সিগ্রেট আর সস্তায় ডাল-ভাতের দোকানের বাহার,
ছবি –১. বেদখল ফুটপাথ......
ছবি – নিজের তোলা
ছবি –২. কী নির্বিকার! পথের পাঁচালী.........
ছবি – নিজের তোলা
হাত তুলে চলতি যানবাহন থামিয়ে পায়ে হাঁটা লোকদের যখন তখন রাস্তা পারাপার, পকেট মারা, হানাহানি, ছিনতাই, দখল সবই যেন এই মহাবেকুবের চোখে দান্তের “দ্যা ডিভাইন কমেডি”র প্রথম পর্ব ‘ইনফার্নো’র সাক্ষাৎ চিত্ররূপ বলে মনে হয়!
ছবি –৩. চলন্ত গাড়ীর ফাঁক ফোকড়ে.......
ছবি - নিজের তোলা
ছবি – ৪. আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে......
ছবি – নিজের তোলা
দান্তে তার কবি বন্ধু ভার্জিলের সাথে একটা কল্পিত ভ্রমনে যাত্রা শুরু করে প্রথমে নরকে গিয়ে পড়েছিলেন। আপনাকে অবশ্য কল্পিত ভ্রমনে যেতে হবেনা, ঢাকা শহরে বাস্তব ভ্রমনেই “দ্যা ডিভাইন কমেডি”র প্রথম পর্ব ‘ইনফার্নো’র স্বাদ পেয়ে যাবেন।
দান্তে তার এই পর্বে নরকের নয়টি কক্ষের কথা বলেছেন। এই বেকুবের কাছে মনে হয় সবগুলোই এই শহরেও আছে! মহাবেকুবের বেকুবী ভাবনায় মনে হয়, আগের জন্মে যারা পাপ করেছেন তাদের শাস্তি স্বরূপ নরকের শহর ঢাকায় পাঠানো হয়েছে! বলবেন, ভাগ্য! কপালের লিখন! হয়তো।
ছবি -৫. সুরম্য ভবন আর জরাজীর্ণ হা-ভাতে টিনের আবাস, হাত ধরে পাশাপাশি........
ছবির কৃতজ্ঞতা – আজকের বাজার পত্রিকা
এ শহরের ইট-পাথরে গাঁথা সুরম্য ভবনগুলো, জরাজীর্ণ হা-ভাতে দালান বা টিনের আবাসগুলো আর বস্তিগুলোকে নরকের এক একটা কুঠরী বলেই আপনার মনে হবে। তবে প্রকার ভেদে এইসব কুঠরীর চরিত্রও ভিন্ন। সুরম্য ভবনগুলো কামলিপ্সা , লোলুপতা আর পেটুকবৃত্তির ঘেরাটোপে অবরূদ্ধ এক একটি সুরম্য কারাগার। জরাজীর্ণ হা-ভাতে দালান বা টিনের আবাসগুলো তেমন কারাগার যেখানে জুলুম, জোচ্চুরি, হীনমন্য প্রতিযোগিতা আর বিশ্বাসঘাতকতায় আটকা পড়ে আছে সবাই। আর বস্তি ? সে এক অদ্ভুত কারাগার! এখানের অধিবাসীরা অযোগ্য- অসমর্থ- অক্ষম একটি প্রজাতি, সবদিক থেকেই পরাজিত।! এখানের দেয়ালে দেয়ালে কামলিপ্সা আছে , লোলুপতা আছে , জুলুম, জোচ্চুরি আর বিশ্বাসঘাতকতায়ও আছে । তার চেয়েও বেশী আছে দারিদ্র! আছে পেটের ধান্ধায় আলোহীন, নিয়মহীন, বিপদজনক সব কাজকারবার।
এই সব নিয়েই কিন্তু প্রাণবন্ত এই ঢাকা শহর। মাঝে মাঝে যখন ৩২ সীটের আমার বড় গাড়ীটিতে বের হই তখন চারপাশের দৃশ্য দেখে মনে হয় আসলেই এই শহরটা সম্পূর্ণ আলাদা একটা শহর – পথহীন, গাঁথুনিহীন, আলোহীন, নিয়মহীন, বন্য, বিপদজনক এক শহর; যেখানে বাস, ট্রাক, রিকসা, সাইকেল , ভ্যান , ঠেলাগাড়ী আর পথচারীরা টিকে থাকার জন্যে গুতোগুতি করছে দিনরাত ।
ছবি –৬. স্বাধীনতা, তুমি কি যেমন খুশি ?
ছবি – নিজের তোলা
নিয়মহীন, বন্য আর বিপদজনক এই কারনে যে, আমার বড় গাড়ীটির যাত্রীগুলো যেখানে সেখানে চলন্ত গাড়ীঘোড়ার চিপাচাপায় রাস্তার মধ্যিখানেই নেমে যাচ্ছে নির্বিকার। আমার ড্রাইভারটিও আরেক কাঠি সরেস। যাত্রীর আশায় সেও যেখানে সেখানে হাত দেখানো যাত্রী বা পথে জটলা করে দাঁড়ানো মানুষ দেখে অবলীলায় থেমে যাচ্ছে চলমান ট্রাফিক কে কাঁচকলা দেখিয়ে। মহাবেকুবের মতো আপনিও বেকুব হয়ে যাবেন এটা দেখে যে, পেছনে যে ট্রাফিক জ্যাম লেগে গেছে সে ব্যাপারে কারো শীত-গ্রীষ্ণ নেই। না যাত্রীর, না চালকের! চলন্ত গাড়ীর স্রোতের তোয়াক্কা না করে ঝট করে জীবনটা হাতে নিয়ে তার মধ্যেই নেমে যা্ওয়ার ঝুঁকিটা্ও মনে হয় তাদের জানা নেই! সকল যন্ত্রনা-অপ্রাপ্তি-কষ্ট-অক্ষমতা-হাহাকার নিয়ে তবুও প্রাণের তাগিদে চলছে শহরটি, থেমে নেই সেই ভোর রাত থেকে সকাল-দুপুর-বিকেল পেড়িয়ে গভীর রাত অবধি। এতো অনিয়ম, এতো শঠতা, এতো যে জীবন যন্ত্রনা; তবু যেন ঢাকার সব কিছু মধুতে মাখা।
ছবি –৭. হাতের মুঠোয় প্রান নিয়ে......
ছবির কৃতজ্ঞতা – বিডি নিউজ ২৪.কম
ছবি –৮. খেয়াল খুশির পাবলিক................
ছবি – নিজের তোলা
তাই প্রানের মেলা যেন চারিদিকে থৈ-থৈ!
স্বাধীনতার স্বাদ নিরঙ্কুশ ভাবে চুটিয়ে উপভোগ করতে পারার সব আয়োজন আছে এখানে। ফি মাসে যেখানে খুশি সেখানের রাস্তা খুঁড়তে কোন বাঁধা নেই নাগরিক সুবিধা প্রদানকারী যে কোন বিভাগের! পথে ঘাটে, উন্মুক্ত রাস্তায় ইট-বালু-রড-সিমেন্ট ফেলে রাস্তা আটকে নিজস্ব দালান-কোঠা-মাল্টিস্টোরিড বানানোতে আপনি পুরোই স্বাধীন। কেউ আপনাকে বাঁধা দেয়ার নেই। বিশেষ আশীর্বাদে ফুটপাথ দখল করে বাজার-হাট বসাতে পারেন ইচ্ছে করলেই! শুধু ফুটপাত থেকেই চাঁদা তুলতে পারেন দৈনিক কয়েক কোটি টাকা। চাই কি সমিতি-সংগঠনের কয়েকটা অফিস্ও বসাতে পারেন ফুটপাতে চাঁদা তোলার জন্যে ! এক্সপ্রেস্ওয়ে বানাতে দুই- চার বছরের কথা বলে স্বাধীন ভাবেই জনগণের দূর্ভোগ বাড়িয়ে সব পথঘাট আটকে দশবছর কিম্বা একযুগ্ও লাগিয়ে দিতে পারেন। পথ আটকে মিটিং-মিছিল করতে পারেন ইচ্ছে হলেই।
ছবি – ৯. ঢাকার নিয়তি......
ছবির কৃতজ্ঞতা – ঢাকা টাইমস ২৪
নো ওয়ান ইজ গোইং টু আস্ক য়্যু এনি কোয়েশ্চেন!
স্বাধীন ভাবেই আপনি যখন খুশি তখন উল্টোপথে গাড়ী-রিক্সা-বাইক-ঠেলা-ট্রাক-বাস চালিয়ে যেতে পারেন। এমনকি পুলিশের গাড়ী যেতে্ও বাঁধা নেই। যত্রতত্র ময়লা ফেলে শহরটাকে পুঁতিগন্ধময় ভাগাড় বানিয়ে ফেলতে পারবেন। আবার নাকে কাপড় চাপা দিয়ে্ও হাঁটতে পারবেন। চাইলেই রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে হিসু্ও করে দিতে পারেন। অকারণে দূর্বল রিক্সা্ওয়ালাকে থাপ্পড়ও মারতে পারেন। কেউ কিছুই বলবেনা আপনাকে, এমন আপ্যায়ন পাবেন এই অদ্ভুত শহরটিতে। ভালো না লেগে উপায় নেই!
ছবি – ১০ – ১১. নরক......
ছবির কৃতজ্ঞতা – আগামী নিউজ পত্রিকা
ছবি – ১২. বিসর্জন.......
ছবির কৃতজ্ঞতা – ঢাকা মেইল
রূপ-রস-শব্দ-গন্ধ-স্পর্শের স্বাদ হারিয়ে ফেলা এ শহরটাতে মানুষ কিন্তু তবু্ও রোবট হয়ে যায়নি! শত দুঃখ-কস্ট-বেদনা নিয়েও তারা আছেন তাদেরই মতোন। নিজেদের জগতে নিজেরাই!
নীচে বিষাক্ত বাতাসে আচ্ছন্ন ধুলো ধুসরিত পথ, উপরে ধুলো আর কালো বাষ্প নিয়ে ঘোলাটে আকাশের মাঝে ধুঁকতে থাকা এমন একটা ডাষ্টবিন শহরে তবু্ও বাতাস টেনে জীবনযুদ্ধে মাতামাতি করছে মানুষ। এর চেয়ে জীবন্ত শহর আর একটি্ও নেই। অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণকাজ, তীব্র যানজট, মেয়াদোত্তীর্ণ মোটরযান আর শিল্পকারখানা থেকে নির্গত বিষাক্ত ভারি ধাতু্ ধুলার সঙ্গে যোগ হয়ে বায়ু দূষণের মাত্রা বাড়িয়ে ঢাকাকে পৃথিবীর সবচেয়ে “বসবাসের অযোগ্য” শহরের তালিকায় ৩ নম্বরের সার্টিফিকেট দেয়া হলে্ও ঢাকাবাসীকে দেখলেই মনে হবে , কী চনমনে এক একটা জীবন্ত মানুষ, ছুটছে আর ছুটছে! এখানে নাকি টাকা ওড়ে। টাকা ওড়ে কিনা জানিনে তবে ঢাকার মানুষগুলো নিরন্তর ছুটছে এই টাকার পেছনে।
আপনারা যে যাই-ই বলুন না কেন, আমি বলি- ভালো মন্দ সব মিলিয়ে ঢাকা যেন একটি তৃপ্ত-তুষ্ট-হৃষ্ট প্রানের মেলা।
পেটের জ্বালা, বড় জ্বালা! সে জ্বালা মেটাতে এই এতোটুকু শহরের অযাচিত আমন্ত্রনে মানুষ আসছে তো আসছেই। আমরা তাদের এই আসাটাকেই দেখি, পেছনের গল্প জানিনে!
এই জনাকীর্ণ নরকের শহরের চলমান ছবিতে অমনোযোগী দর্শক দেখতে পাবেন শুধু একদঙ্গল মানুষের শব্দপ্রপাত, আমি দেখি বেঁচে থাকার নিখুঁত সংজ্ঞার্থ ।
উৎসর্গ- বিজ্ঞানের কাঠখোট্টা মানুষ হলেও যার মনের ভেতরে কিছু কবিতা আছে, আছে দেশের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার সতত প্রবাহমান এক নদী; যিনি সে তাড়না থেকেই সম্প্রতি “ডিজিটাল সনেট: ঢাকা” নামে ঢাকার প্রতি তার নাড়ীর টান নিয়ে একটি কবিতা পোস্ট দিয়েছেন, যার রেশ ধরে সেই প্রবাসী সহ ব্লগার “কলাবাগান১” কে উৎসর্গিত।
শুরুর ছবির কৃতজ্ঞতা - The New Republic
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে ডিসেম্বর, ২০২২ সকাল ৯:১১