সম্প্রতি সমাপ্ত নির্বাচনে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের শপথ গ্রহন এবং সদ্য নিযুক্ত মন্ত্রী পরিষদের কার্যভার গ্রহন দেখিয়া মনে সংশয় জাগিতেছে, আমাদের সংবিধান কি গরুর রচনা লিখিবার অভিপ্রায়ে রচিত হইয়াছিলো কিনা!
ঐ বিষয়ে সরকারী দলের মহারথিদের বক্তব্য শুনিয়া আমার লিলিপুটিয়ান মস্তিষ্ক গোলক ধাঁধায় ঘুরপাক খাইতেছে। কোনটি ঠিক আর কোনটি বেঠিক তাহা নির্ণয় করা এই বেকুবের পক্ষে সম্ভপর হইয়া ওঠে নাই। ইহা লইয়া ব্লগেও কোন প্রকার হৈচৈ না দেখিয়া হতাশ হইয়া নিজেই রচনা করিতে বসিলাম।
এযাবৎ কাল ব্লগে পোস্ট-মন্তব্য- প্রতিমন্তব্যে যাহা পাইয়াছি তাহার বেশীর ভাগই ভোট চাহিয়া আর অল্পাংশ পাইয়াছি ভোট বর্জনের ডাক দেওয়া। সবারই নিজস্ব মতামত থাকিবে , এমত ভাবনা আহাম্মকী কিছু নয় বরং সিদ্ধ। কিন্তু রাজনীতির মাঠে সংবিধান কার্যকর করা লইয়া মুখে ফেনা তুলিয়া ফেলা কাহাকেও দেখি নাই যে বলিয়াছেন , নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের শপথ গ্রহন এবং সদ্য নিযুক্ত মন্ত্রী পরিষদের কার্যভার গ্রহন আদতে সংবিধান সম্মত বা সংবিধান লঙ্ঘিত! কিম্বা দেখি নাই এই বিষয়ে কোনও ব্লগার কিছু কহিয়াছেন!
এইতো গত বুধবার বঙ্গবন্ধু এ্যাভেনিউ এর দলীয় কার্যালয়ে একসভায় দলের সাধারণ সম্পাদক ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলিয়াছেন “শপথের মধ্যে দিয়ে আগের সংসদ বহালের সুযোগ নেই। আগের সংসদ স্বয়ংক্রীয় ভাবেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে।“
মহাবেকুব ভাবিয়া পায়না - সংসদ তো ভাঙিয়া দেয়া হয় নাই এমনকি বিলুপ্ত করাও হয় নাই, তাহা হইলে মন্ত্রী মহোদয় এই কথা কিরূপে কহিলেন ? সংসদ স্বয়ংক্রীয় ভাবে বিলুপ্ত হইবে কি করিয়া?
আবার যাহার রাষ্ট্রীয় আইন জানিবার কথা, সংবিধানের প্রতিটি শব্দ- লাইন মুখস্ত থাকিবার কথা রাষ্ট্রের সেই প্রধান আইন কর্মকর্তা (এ্যাটর্ণী জেনারেল) এম আমিনুদ্দিনও আগের দিন বলিয়াছেন , “সংবিধান অনুসারেই সংসদ সদস্যদের শপথ এবং মন্ত্রীসভা গঠিত হইয়াছে” এবং তিনি আরও বলিয়াছেন, “সংসদ সদস্যদের শপথ নিতে হয় আইনের বাধ্যবাধকতার জন্য্ । শপথ গ্রহন হইলেও যেহেতু একাদশ সংসদের মেয়াদ ২৯শে জানুয়ারী’২০২৪ তারিখ পর্যন্ত রহিয়াছে তাই নতুন সদস্যরা কেবলমাত্র ৩০শে জানুয়ারী’২০২৪ তারিখে সংসদে বসিতে পারিবেন।”
তাই সংবিধান বাহির করিয়া বসিতে হইলো। দেখিলাম -
সংবিধানের পঞ্চম ভাগের আইনসভা অংশের ৭২ এর ৩ দফায় বলা হইয়াছে -
(৩) রাষ্ট্রপতি পূর্বে ভাঙ্গিয়া না দিয়া থাকিলে প্রথম বৈঠকের তারিখ হইতে পাঁচ বৎসর অতিবাহিত হইলে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবে:।
অর্থাৎ মাত্র ২ ভাবেই সংসদ বিলুপ্ত হইতে পারিবে -
১) রাষ্ট্রপতিকে সংসদ বিলুপ্ত করিতে হইবে।অথবা-
২) একটি সংসদের প্রথম বৈঠকের তারিখ হইতে পাঁচ বৎসর অতিবাহিত হইলে সংসদ বিলুপ্ত হইবে।
ইহার অর্থ, একাদশ সংসদ এখনও চালু রহিয়াছে। একটি সংসদ চালু থাকিলে আর একটি নতুন সংসদের শপথ গ্রহন সংবিধান সম্মত হইবে কি ? একটি নতুন মন্ত্রীসভা এমতাবস্থায় কার্যভার গ্রহন করিতে পারেন কি ? একটি বউ থাকিলে কি আর একটি বউ আইনত গ্রহন করা যায় ? আগের বউটাকে তো হয় আগে তালাক দিতে হইবে নতুবা তাহার অনুমতি গ্রহন করিতে হইবে !
কিন্তু সংবিধানের সপ্তম ভাগে নির্বাচন সংক্রান্ত অনুচ্ছেদের ১২৩ ধারায় নির্বাচনের সময় এবং কখন নির্বাচন হইবে এবং কখন হইতে নির্বাচিত সদস্যগন কার্যভার গ্রহন করিবেন তাহা লইয়া বলা হইয়াছে –
2[(৩) সংসদ-সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে
(ক) মেয়াদ-অবসানের কারণে সংসদ ভাংগিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাংগিয়া যাইবার পূর্ববর্তী নববই দিনের মধ্যে; এবং
(খ) মেয়াদ-অবসান ব্যতীত অন্য কোন কারণে সংসদ ভাংগিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাংগিয়া যাইবার পরবর্তী নববই দিনের মধ্যে:
তবে শর্ত থাকে যে, এই দফার (ক) উপ-দফা অনুযায়ী অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত ব্যক্তিগণ, উক্ত উপ-দফায় উল্লিখিত মেয়াদ সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত, সংসদ সদস্যরূপে কার্যভার গ্রহণ করিবেন না।]
এ ব্যাপারে আইনমন্ত্রী মহোদয় সংবিধানের দোহাই দিয়া বিষয়টিকে হালাল করিতে চেষ্টা করিয়াছেন। এটিএন টিভিতে দেখিলাম ৬৪৮ জন সংসদ সদস্য লইয়া বিরূদ্ধবাদীদের তোলা প্রশ্নের ব্যাখ্যায় তিনি সংবিধান খুলিয়া কিছু অনুচ্ছেদ পাঠ করিয়া এইরূপ বোঝাইলেন – “ সংসদ সদস্য সংখ্যা ৬৪৮ জন নহে। আর সংসদ সদস্যগন শপথ গ্রহন করিলেই যে সংসদ সদস্যরূপে কার্যভার গ্রহন করিয়াছেন তাহাও ঠিক নহে। শপথ গ্রহন করিলেই যে সদস্যগন কার্যভার গ্রহন করিয়াছেন তাহা বোঝায় না। ৩০ শে জানুয়ারী’২৪ তারিখে যখন তাহারা সংসদে বসিবেন সেদিনই তাহারা কার্যভার গ্রহন করিবেন।”
অথচ সংবিধানের একাদশ ভাগের অনুচ্ছেদ ১৪৮ এর (৩) ধারায় পরিষ্কার বলা হইয়াছে - এই সংবিধানের অধীন যে ক্ষেত্রে কোন ব্যক্তির পক্ষে কার্যভার গ্রহণের পূর্বে শপথগ্রহণ আবশ্যক, সেই ক্ষেত্রে শপথগ্রহণের অব্যবহিত পর তিনি কার্যভার গ্রহণ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে।
আইন মন্ত্রীর কথাই যদি ঠিক হয় তবে চলতি স্পীকারের পক্ষে সংসদ সদস্যদের ১০ই জানুয়ারী’২৪ তারিখে শপথ পড়ানো কি হালাল হইয়াছে? কারন মন্ত্রীর কথামতো চলতি স্পীকার তো এখনও কার্যভার গ্রহন করিতে পারেন নাই, তিনি তাহা পারিবেন ৩০শে জানুয়ারী । তাহা হইলে এই ২০ দিন আগে তিনি কোন সংবিধান মতে শপথ গ্রহন অনুষ্ঠান পরিচালনা করিলেন?
সংবিধান মতে শপথ গ্রহন অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন সংসদের স্পীকার। কিন্তু একাদশ সংসদের ( যাহা এখনও মেয়াদ উত্তীর্ণ হয় নাই) স্পীকারও ( শিরিন শরমিন চৌধুরী) নিজে আগে সংসদ সদস্য হিসাবে শপথ গ্রহন করিয়াছেন। সেই তিনিই আবার দ্বাদশ সংসদের সদস্যদের শপথ গ্রহন করাইয়াছেন, যিনি আইন মন্ত্রীর বয়ান মোতাবেক সংসদে বসিবার আগেই স্পীকারের কার্যভার গ্রহন করিতে পারেন না।
এই মহাবেকুবের বুদ্ধিতে এখানেই গিট্টু লাগিয়া গিয়াছে।নতুন সংসদে বসিবার পূর্বেই মাননীয়া শিরিন শরমিন চৌধুরী কি করিয়া নতুন স্পীকার হইলেন? তাহা হইলে পৃরানো সংসদের স্পীকার কর্তৃক নতুন সংসদ সদস্যদের শপথ গ্রহন করানো কি জায়েজ হইয়াছে?
আইন মন্ত্রী যিনি আইন প্রনেতাদের হোতা, সেতুমন্ত্রী যিনিও একজন আইন প্রনেতা আর এ্যাটর্নী জেনারেল যিনি রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা তাহলে কি আইন জানেন না ?
তাহারা কি সবাই প্রশ্নফাঁস জেনারেশান ? নাকি সব পাবলিকের মস্তিস্ক লিলিপুটিয়ান ধরিয়া তাহারা কি এই ফতোয়া দিতেছেন ?
শপথ লইয়া এই মহাবেকুবের ধন্ধ লাগিয়াছে আবার অন্য জায়গায়। সংবিধানের একাদশ ভাগের অনুচ্ছেদ ১৪৮ এর ২ এর (ক) ধারায় আবার বলা হইয়াছে -
3[২(ক) ১২৩ অনুচ্ছেদের (৩) দফার অধীন অনুষ্ঠিত সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল সরকারী গেজেটে প্রজ্ঞাপিত হইবার তারিখ হইতে পরবর্তী তিন দিনের মধ্যে এই সংবিধানের অধীন এতদুদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা তদুদ্দেশ্যে অনুরূপ ব্যক্তি কর্তৃক নির্ধারিত অন্য কোন ব্যক্তি যে কোন কারণে নির্বাচিত সদস্যদের শপথ পাঠ পরিচালনা করিতে ব্যর্থ হইলে বা না করিলে, প্রধান নির্বাচন কমিশনার উহার পরবর্তী তিন দিনের মধ্যে উক্ত শপথ পাঠ পরিচালনা করিবেন, যেন এই সংবিধানের অধীন তিনিই ইহার জন্য নির্দিষ্ট ব্যক্তি।]
অর্থাৎ সংবিধান যাহা বলিতেছে তাহা এই –
নির্বাচনের তিন দিনের মধ্যেই শপথ করাইতে হইবে।
শপথ করিলেই সদস্যগন কার্যভার গ্রহণ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে।
পূর্ববর্তী সংসদের মেয়াদ সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত, সদস্যগন সংসদ সদস্যরূপে কার্যভার গ্রহণ করিবেন না।( বর্তমান সংসদের মেয়াদ ২৯শে জানুয়ারী’২৪ পর্যন্ত)
আমাদের ব্লগার “ সোনাগাজী” যেমন কোন পোস্টের লেখা বেতাল হইলেই বলিয়া থাকেন- “গরুর রচনা” তেমনি আইনজ্ঞদের এই সব বয়ান আর সংবিধানের অস্পষ্ট নির্দেশনা শুনিয়া ও পড়িয়া এই মহাবেকুবেরও মনে হইলো - সবই কি তাহা হইলে গরুর রচনা????????
ছবি - অন্তর্জাল হইতে সংগৃহীত এবং সম্পাদিত।