নিয়ম টা এমন, মতি চা বানিয়ে দেবে, হোসেনের হাতে কাপ আসা মাত্রই মা কুকুরের নির্দেশে ছানাগুলো লেজ নাড়তে নাড়তে হোসেনের সামনে এসে কুইকুই করবে। প্রতিদিন হয় বিস্কুট না হয় কেক না হয় রুটি ছানা গুলোর জন্য বরাদ্ধ। ছোট ছোট টুকরো করে হোসেন খেতে দেবে আর ছানাগুলো পড়িমরি করে এসে খাবে, দূর থেকে মা কুকুর টা যেন তৃপ্তির একটা চাউনি দেয় ছানা গুলো কে খেতে দেখে। মাঝে মাঝে দূপুরের ভাত আলাদা করে রেখে বক্সে করে নিয়ে আসে হোসেন, সেদিন মা কুকুর টাও খায়, খাওয়া শেষে হোসেনের পায়ের সামনে গুটি পাকিয়ে শুয়ে থাকে। চলে যেতে গেলে দাঁড়িয়ে খানিক আগিয়ে দিয়ে আবার গিয়ে শুয়ে থাকে। এরা ভালোবাসা, স্নেহ বোঝে। সামর্থ্যর শেষটুকু দিয়ে প্রতিদান দেয়। এই প্রানী আবেগের কি বোঝে তা বোঝা দায়।
মাসের শেষে টাকা পয়সার ব্যপক টানপোড়েন। নিজেকে নিয়ে চিন্তা নেই। বাকি তে মতির দোকানে খেলেও কোনো সমস্যা নেই কিন্তু বাকি রেখে না হয় নিজে চা খাওয়া যায়, এই অবলা প্রানীদের খাওয়ানো যায় না।
অর্থের টানপোড়েন মানুষ বুঝতে পারলে করুনার চাদরে ঢেকে নিতে চায়। এ যেন এক দূর্বলতা৷ এক ধরনের অসহায়ত্ত। মানুষকে অসহায়ের চোখে দেখা মানুষের গোপনে লালিত একধরনের সুখ। তাই অভাব দেখাতে নেই।
কুকুর গুলোকে খাওয়ানোর সামর্থ্য এখন শূন্যের কোঠায়। এরা কি আর এত কিছু বোঝে, আশা নিয়ে চলে আসবে, মুখের দিকে উপেক্ষা যেখানে হার মানে সেভাবে তাকিয়ে থাকবে আর হোসেন শুন্য হাতে বসে থাকবে এই দৃশ্য মেনে নিতে পারবে না। তাই এড়িয়ে চলা।
কয়েকদিন যাওয়া হয়নি দেখে মতি আজ নিজেই খবর নিতে চলে এসেছে। অসুস্থ কিনা আমি।
দিব্যি সুস্থ দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেসাবাদ করে গেছে এবং রাতে যেন চা খেতে যাই তার কড়া নির্দেশ ও দিয়ে গেছে। উভয় সংকট।
রাতে বের হতেই, মতি খপ করে ধরল
- জানতাম, আপনে আইবেন না। কি সমস্যা কন দেখি? টেকা পয়সা নিয়া কনদিন কিসু কইসি।দোকানদারী করি দেইখা পাত্তা দেন না এমন মানুষ ত আপ্নে না। চলেন। চা খাইয়া, যেদিক মন চায় জাইবেন।
এর পর আর কথা চলে না।
দোকানে কোন ঘেসে বসে আছি। কুকুর গুলো দেখা যাচ্ছে না। চা এল। মা কুকুর উকি দিল সাথে সাথেই। হোসেন চুমুক দিতে গিয়েও আটকে গেল। দুটি প্রানী চোখাচোখি। কি ভাষার আদান প্রদান হোলো তা বোঝা গেল না। মা কুকুর টি এল না কাছে। দূরে ছানা গূলো নিয়েই বসে আছে। ছানাগুলো একবার এদিক আসতে গিয়েও আসছে না।
ওরা কি বুঝতে পারছে?
ছানা গুলি হঠাত হোসেনের পায়ের সামনে চলে এলো। হোসেন কি করবে বুঝতে পারছে না। অনেকক্ষন ধরেই তাকিয়ে আছে। মতি মিয়া দূর দূর করে তাড়িয়ে দিচ্ছে তাও যাচ্ছে না।
হোসেন হঠাৎই বলে উঠল,
এই যাহ!!
ছানাগুলো তাকিয়ে আছে চুপ করে হোসেনের দিকে। মা কুকুর টাও।
খুব আপন করে আগলে রাখা মমতার বিষয়গুলো উপেক্ষা সহ্য করার ক্ষমতা সবার থাকে না। সামান্য টোকা কিন্তু তার ক্ষত কত খানি যে গভীর তা বুক চিড়ে দেখবার উপায় নেই দেখেই কেউ হয়ত পরিমাপ করতে পারে না।
ফিরিয়ে দিয়ে কতখানি দূরত্ত যে নিমিষেই তৈরী হতে পারে তা যদি মন গহীনে ঢুকে দেখা যেত তাহলে হয়ত নিকষ অন্ধকারে কিছুই দেখা যেত না।
ছানা গুলি ফিরে যাচ্ছে মায়ের কাছে। মা কুকুর টাও চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
অতকিছু সে বোঝে না। সে বোঝে শুধু স্নেহ। নি:সার্থ। এই অভাব, টান পোড়েনের জটিল সমীকরন তার কখনোই সমাধানের চিন্তা করতে হয় না।
হোসেন চা না খেয়েই উঠে পড়ল।
এগিয়ে যাচ্ছে, দোকান ছাড়িয়ে। মা কুকুর টা উঠে খানিক এগিয়ে এসে হোসেন কে সামনে এগিয়ে দিলো।
হোসেনের কি কৃতজ্ঞ হওয়া উচিৎ?
মধ্যরাতের এ শহরে একজন হোসেন রাস্তায় হেটে চলেছে চাওয়া পাওয়ার হিসেব আর খানিক কৃতজ্ঞতার বা অকৃতজ্ঞতার সমীকরন নিয়ে।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ রাত ১২:৪৪