লাখ লাখ প্রতিযোগীকে পেছনে ফেলে যারা শেষ পর্যন্ত পাবলিকে পড়ার সুযোগ পায়, ঐ বিশাল প্রতিযোগীতায় জিততে পারাটাই অহংবোধের শুরু। এই অহং খুব একটা অন্যায় না! কিন্তু প্রতিযোগীতা এত তীব্র কেন হয়? শুধুই কি মান? যদি প্রাইভেট আর পাবলিকের খরচ কাছাকাছি চলে যায় আর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ এখনকার মত থাকে তাহলে কি এই তীব্র প্রতিযোগীতা থাকবে পাবলিকে ভর্তি হওয়ার জন্য?
পাবলিকের অহংবোধের আর একটা বড় কারণ এই যে এখানে কোন টিচারের ঠেকা নেই বেশি বেশি মার্ক দেয়ার। কিন্তু পাবলিকে হরহামেশা টিচারকে বকা খেতে হয় ব্যাচ ভাল গ্রেড না পেলে। সুতরাং এখান থেকে সাধারণ একটা ধারণা জন্মে যে প্রাইভেটে বোধহয় কম-সম পড়িয়ে ভাল গ্রেড পাইয়ে দেবার একটা প্রবণতা থাকে। প্রাইভেট ইউনিতে পাবলিকের পাশ করাদের টিচার হিসেবে পাওয়ার চাহিদা কিন্তু এমন ধারণার-ই জন্ম দেয় যে পাবলিকে বেশি বেশি শেখানো হয় প্রাইভেটের তুলনায়!
পাবলিকের অহংবোধের আরও একটা কারণ ঐতিহ্য। প্রাইভেট আর কতদিনই বা হলো এসেছে! এতকাল ধরে তো পাবলিক-ই শেষ কথা। এখনকার দিকপালেরা তো সবাই পাবলিকেরই। আর একটা ব্যাপার মোটা দাগে কিন্তু সত্যি যে পাবলিকে পছন্দসই কিছু না পেলে তখনই অনেকে প্রাইভেটে যায় ( আবারও বলছি – কথাটা মোটা দাগে সত্যি)। স্বাভাবিকভাবেই যারা পাবলিকে টিকে যায় তাদের ভেতর তো একটু অহং হবেই!
অন্যদিকে নূন্যতম বৈভবের মধ্যে বেড়ে ওঠা মানুষেরাই প্রাইভেটে আসে। যে পরিবারে একটা কালার টিভি নেই ফ্রিজ নেই, সেই পরিবারের কেউ কি প্রাইভেটে আসার কথা ভাবে? ভাবেনা। কারো যদি মনে হয়ও যে কেউ কেউ জমি বেঁচে প্রাইভেটে পড়ে, তাহলেও এটা সত্যি যে বিক্রির মত জমি তাদের আছে। সুতরাং ঐ আর্থিক অবস্থা ( মূলত মধ্যবিত্ত থেকে উপরের দিকে) থেকে আসা ছেলেমেয়েরা যে জীবনধারা, রুচি, চিন্তায় অভ্যস্ত, পাবলিকে তা অনুপস্থিত থাকারই কথা। প্রাইভেটের নাক উঁচু ব্যাপারটার প্রাথমিক কারণটা এটাই।
আর একটা কথা বলবো, হয়তো একটু পক্ষপাতমূলক হয়ে যাবে – পাবলিকে যারা থাকে তাদের উপর দ্বায়িত্ব খুব দ্রুত চলে আসে। নিজে দাঁড়াতে হবে, বিয়ে করতে হবে, পরিবারের দ্বায়িত্ব নিতে, ছোট ভাই বোনদের সাপোর্ট দিতে হবে ইত্যাকার বিষয়গুলো প্রাইভেটে এত তীব্র বলে মনে হয়না। ফোর্থ ইয়ারে উঠতে না উঠতেই হাতে হাতে সবার বিসিএস গাইড উঠে যায়। প্রাইভেটে কি এই তাড়না এত তীব্র? কি জানি!
শেষ পর্যন্ত কেন জানি মনে হয় যে ঠিক পড়াশোনার মান বা বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রেষ্ঠত্বের অহং এটা না। কে.এফ.সিতে নিয়মিত খেতে পারা না পারা, চকচকে গার্লফ্রেন্ড মেইনটেইন করতে পারা না পারা, দুটো-তিনটা টিউশনি করে নিজের খরচ চালানোতে বাধ্য হওয়া না হওয়া, ইংলিশ বলিয়ে কইয়ে হওয়ার পাওয়ার নিয়ে ভাল বেতনের একটা চাকরি পাওয়া না পাওয়ার সম্ভাবনা-শংকা, যাপিত জীবনের ইত্যাকার বিষয়ের ভিন্নতা থেকেই অহংবোধের এই প্রবাহমানতা।
শেষ করার আগে একটা মজার কথা জানাই – ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রফেসর এম. এম. আকাশ প্রতি বছর তাঁর ক্লাসের শিক্ষার্থীদের ভেতর একটা আনঅফিসিয়াল জরিপ চালান। জরিপের বিষয়বস্তু হচ্ছে যে প্রতি বছর শিক্ষার্থীদের ভেতর ভিন্ন ভিন্ন আর্থ-সামাজিক অবস্থানে থাকা মানুষদের কম্পোজিশন কেমনভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে!!!