somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ঘোর

২৭ শে জানুয়ারি, ২০২৪ দুপুর ২:৪২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ঘুম ভাঙতেই মনটা কেমন হু হু করে উঠলো আদিবা চৌধুরির। ঘামে লেপ ভিজে জবজব। বয়স হয়েছে তা মানতেই হয় আজকাল। রোগ-শোকে এখন শরীর আর নিজের বশে থাকে না। কাল রাতে দফায় দফায় চিৎকার করে জেগে উঠেছেন। তিন বছর ধরে পার্কিনসন্সের কারনে হাত কাঁপে তার। তারপর থেকে অবস্থার তেমন উন্নতি হয়নি। কেবল ছেলে সায়েমের অতিরিক্ত তদারকিতে ডাক্তার দেখানো সার হয়েছে। এমন হেন স্পেশালিস্ট নেই ঢাকায় যাকে চেষ্টা করা হয়নি। এক এক ডাক্তার এক এক পথ্য লিখে দেন। কিছু ওষুধ হাত কাঁপা কমায় তো ভুলো মন, অ্যাংজাইটি বাড়িয়ে দেয়। তার রোগ যে আসলে কি তা নিজে বুঝতে পারেন না। আর ডাক্তাররা বোঝে কিনা তাও সন্দেহ থেকে যায় - একেকবার একেকজন নতুন অসুখের নাম বলে সাথে উপহার দেয় এক গাদা ওষুধের ভার! পার্কিনসন্স, আল্ঝাইমার্স ঘুরে শেষমেষ স্কিৎসোফ্রেনিয়া মানে পাগল বানিয়ে ছাড়লো তাকে। এত শত ওষুধেও তাকে ধরলো না। তার হাত কাঁপাকাঁপি তো আর থামেনি।

সতের বছর হলো আবিদা রিটায়ার্ড করেছেন। শহরের নামকরা মেয়েদের স্কুলের হেড মিস্ট্রেস ছিলেন। এককালের জাঁদরেল শিক্ষিকা এখন নিজের কাছেই কাবু হয়ে বেঁচে আছেন। এক ছেলে এক মেয়ের মাঝে বড় ছেলে এক ফার্মাসিউটিক্যালে ডিরেক্টর। মেয়ে তামান্না শাহজালালে পড়ায়। গেলো ডিসেম্বরের শুরুতে তামান্না সিলেট থেকে ছুটি কাটাতে এসেছিলো নাতনি তনিমাকে নিয়ে। মেয়ে জামাই নাসের গত বছর কার অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে। কিন্তু তিনি পরিস্কার দেখলেন মেয়ে আর নাতনির সাথে জামাইও ঘরে ঢুকলো। এমনিতে গত কয়েক মাস হলো ভুলভাল দেখছেন। হ্যালুসিনেশনে তিনি সব ভুল দেখছেন যাকেই বলেন সে-ই একই কথা বলছে। তিনি দিব্যি জলজ্যান্ত কালো বিড়াল দেখেছেন তার ঘরের জানালা দিয়ে ঢুকতে। একবার না বেশ কয়েকবার। একবার হলে নাহয় ভুল দেখছেন মানতেন কিন্তু বার বার কিভাবে ভুল দেখবেন তিনি। হ্যালুসিনেশনের বাড়াবাড়ির তারতম্য হয় সময়ে সময়ে। প্রথম প্রথম ছেলে - ছেলের বউকে অকপটে সব বলতেন। তারা শোনে মানে কানে নিতো ব্যাপারগুলো যার ফল টের পেতেন নতুন ডাক্তারের সাক্ষাতে। এরপর এসব বলা ছেড়ে দিয়েছেন। তো মেয়ের জামাইকে দেখে তিনি দাঁত কপাটি দিয়ে বেহুশ। জ্ঞান ফিরলো হাসপাতালে। কাউকে বলতেই পারছেন না তিনি কি দেখেছেন আবার নিজেও বিশ্বাস করতে পারছেন না যা দেখেছেন তা ভুল। এমন ভুলভাল দেখেন হরহামেশা - অপরিচিত মানুষ চেয়ে থাকে জামরুলের গাছের ডাল থেকে তার ঘরের জানালা গলে। সেদিন কাবার্ড খুলতেই দেখলেন উসকো-খুসকো চুলের দুই বুড়ো মতো লোক তাকিয়ে আছে তার দিকে করুণ দৃষ্টিতে। কিন্তু মরা মানুষ তো এর আগে দেখেননি। সায়েমের বাবাও তো আট বছর হলো মারা গেছেন। কই তাকে তো আদিবা দেখেননি ফিরে আসতে।

কাজের মধ্যে কাজ হয়েছে ডিসেম্বরেই ব্যাংকক ঘুরে আসতে হয়েছে। সেখানকার ডাক্তার আরো এক কাঠি সরেস। তারা আদিবার অসুখের নতুন নাম দিয়েছে লুই বডি ডিজিজ। সব মিলিয়ে তার অবস্থা বিতিকিচ্ছিরি হয়ে গেছে। নাওয়া-খাওয়া, ঘুম দিনের চব্বিশ ঘন্টাই খ্যাপাটে লাগে। প্রাইমারি স্কুলের দূরন্ত দিন গুলো তার আজও মনে পড়ে। জায়েদা, মমতা, ফাতিহাসহ সবার কথা মনে আছে তার। পঞ্চান্ন বছরেরও আগের বিয়ের দিনে সেই ঝড়-বৃষ্টি মনে হয় যেন এই সেদিনের কাহিনী। কিন্তু এখন নিজের চশমা ঠাহর করতে পারেন না কই রেখেছেন। বইয়ের ভাঁজে গুছিয়ে রাখা টাকা খুঁজে পেতে হুলস্থুল বাধিঁয়ে দেন। এই সেদিনও মাঝরাতে টাকার কথা মনে হতে খুঁজে না পেয়ে ছেলে সুদ্ধ পুরো বাড়ি জাগালেন। ছেলে একদিকে ডাক্তার দেখিয়ে দেয়ার দায় শোধ করে মাকে বকা ঝকা করে। আদিবা ঠিক বেঠিক হিসেব গুলিয়ে ফেলেন প্রায়ই। একদিন ভালো কাটে তো পরদিন ঘুম ভাঙে কোমর ব্যথা নিয়ে, নাহয় অকারনে দুশ্চিন্তা করে ব্লাড প্রেশার বাড়ে। হাত কাঁপার ওষুধ খেলে হ্যালুসিনেশন বাড়ে, হ্যালুসিনেশনের নেক্রোলেপ্টিক ওষুধ তার পায়ে পানি আনে, হাটতে গিয়ে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। সেদিনও দুপুরের খাবার খেতে গিয়ে চেয়ার থেকে পড়ে পিঠে-মাথায় ব্যথা পেলেন। তবে ব্যাংকক থেকে ফিরে ভালোই চলছিলো।

গতরাতে খুব অদ্ভুদ ঘটনা ঘটলো। হ্যালুসিনেশনের অত্যাচার শুরু হবার পর থেকে তিনি আর ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখতেন না। কারণ তার দিনরাত চব্বিশ ঘন্টাই কেমন ঘোরের মধ্যে কাটে। জেগে থেকে চোখ খোলা অবস্থায়ও আশেপাশে অপরিচিত লোকের আনাগোনা দেখেন। মাঝে মধ্যে হাঁক ডাক চেঁচামেচি করে তাড়াতে চান এই অবাস্তব শরীরীদের। ঘুমের ঘোরে সেই একইরকম অশরীরীদের আনাগোনা। এরা বিভিন্ন বয়সের কিন্তু সবাই অপরিচিত। তারা কেউ কখনও তার কোনো কথার জবাব দেয় না। কাল রাতে তার ঘরে যেনো এই অপরিচিতদের পল্টন ময়দানের সমাবেশ হয়ে গেলো। দফায় দফায় তাদের তাড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টার পর ভোর রাতে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে অনেকদিন পর শান্তিমতো ঘুমের আয়োজনে শ্রান্ত আদিবা। দেখলেন ভীড় ঠেলে হাত ছোঁয়া ব্যবধানে সামনে হাজির খুব পরিচিত একটি চেহারা। সেই স্বপ্ন ছোঁয়া চোখ, বাবরি দোলানো চুল ভেদ করা উন্নত গ্রীবা। আদিবা চিৎকার করে বললেন: 'এত বছর পর তুমি কোন সাহসে?'
ভরাট পুরুষ কন্ঠে জবাব এলো, 'এতো ঘেন্না দিয়ে আমাকে কেন বাঁচিয়ে রেখেছো দিবা?'
সতের বছরের কিশোরী আদিবা ঝাপিয়ে পড়লো আসুরিক জিঘাংসায়।

ঘুম ভাঙার পর থেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করছেন আদিবা। তার বামপাশে কাঠের বাটওয়ালা ছুরিটা পড়ে আছে। হালকা নীল ফুলের নকশায় ছাপা লেপের কভারে কয়েক জায়গায় হালকা রক্তের ছোপ। হাত আর কাঁপছে না তার।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জানুয়ারি, ২০২৪ দুপুর ২:৪৪
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৪



মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৪


সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন

যেকোন বাংগালীর ইন্টারভিউর সময়, 'লাই-ডিটেক্টটর' যোগ করে ইন্টারভিউ নেয়ার দরকার।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৫ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



আপনার এনলাকার এমপি, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী কামাল সাহেব, যেকোন সেক্রেটারী, যেকোন মেয়র, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান, বিএনপি'র রিজভী, আওয়ামী লীগের ওয়ায়দুল কাদের, আপনার থানার ওসি, সীমান্তের একজন বিজিবি সদস্য, ঢাকার... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×