-"লাইলির হাতের রান্না যে স্বাদ, একবার খেলেই মুখে লেগে থাকে!"
বেশ শুদ্ধ বাংলায়ই কথাটা বলে মেয়েটার প্রশংসা করছিলো ফরহাদ। লাইলির সাথে ফরহাদের তেমন কোন সম্পর্কই নেই। কিন্তু এমন ভাবে হেসে হেসে কথা বলে, দেখলে মনে হবে যেন স্বামী-স্ত্রী সম্পর্ক। লাইলি সাধারণ একটা কাজের মেয়ে। ফরহাদের বাড়িতো টুকটাক কাজ করে দেয়। কাজের বিনিময়ে পেট ভরে খেতে পারে, এই যা।
গল্পের লাইলি-মজনু, শিরি-ফরহাদ জুটির প্রেম কাহিনীর মতো ঘটনা। ঘরে ফরহাদের বউ আছে, আছে তিন তিনটা বাচ্চা। বউটা একটু রোগাটে কিনা! আর সেকারনেই পাশের বাসার লাইলিকে রাখা হয়েছে কাজের জন্য। লাইলির বাবা ইলিমউদ্দিনের ঘরে লাইলিসহ সাতটা মুখ খাইয়ে। এতগুলো মুখের আহার জোগাতে ইলিমউদ্দিন একাই খেটে চলছেন। কোন সন্তানকেই স্কুলে পাঠাতে পারেনি। যে ঘরে সন্ধ্যাবেলা বাতি দেয়ার মতো কেরোসিন থাকে না, নুন জুটলে পান্তা জুটেনা আবার পান্তা জুটলে নুন আনতে পাশের বাড়িতে কর্জের জন্য ছুঁটতে হয় সেখানে লেখাপড়া এক প্রকার বিলাসিতা। বড় ছেলেটাও বিয়ে করে বউ নিয়ে আলাদা থাকে। তাইতো একটা মুখও যদি কমে, সে আশায়ই লাইলিকে ও' বাড়িতে কাজে যেতে বাঁধা দেয়না লাইলির বাবা ইলিমউদ্দিন।
সেদিন ফরহাদের ঘরের চারপাশে মাটির লেপ দিচ্ছিলো লাইলি। ফরহাদের বউই দিতে বলেছে। কতটা দিন হলো বিছানায় পড়ে আছে ফরহাদের বউটা...। নিজের হাতে গড়া ঘরগুলোরও যত্ন নিতে পারছে না। ফরহাদ লাইলির কাজগুলো তদারকির ছুঁতোয় তার সাথে মেশার চেষ্টা করে। ফরহাদের অসুস্থ বউ বিষয়টা না বুঝলেও লাইলি ঠিকই টের পায়। ভেজা মাটি ডান হাতের তর্জনীতে নিয়ে লাইলির গালে আলতো করে মেখে দিলো ফরহাদ। আর তাতে হেসেই কুটিকুটি লাইলি। সে হাসিতে মোমের মতো আরো যেন গলে পড়ছে ফরহাদের ভেতরটা।
গায়ের রঙটা ছোটবেলায় বেশ কালো ছিলো লাইলির। বয়স এখন সতেরো ছুঁই ছুঁই। এই বয়সে এসে লাইলির কালোবর্ণ যেন আর চোখে পড়েনা। গায়ের রঙ যেমনই থাক উজ্জল শ্যামলা রঙের মুখটাতে যেন হাসি সব সময় লেগেই থাকে। এ বাড়িতে কাজ করতে এসে তিন বেলা ঠিক মতো খাবার পেয়ে কচি লতার মতো শরীরটা তার তর তর করে বাড়ছে যেন। ফরহাদ ওকে মুখে লাগানোর একটা ক্রিমও দিয়েছে। আর সেই ক্রিম লাগিয়ে সকাল সন্ধ্যা ফরহাদের সামনে দিয়ে ঘুর ঘুর করে।
-আহ, কি মধুর গন্ধ........ মনটা যেন নেচে উঠে।
ফেয়ার অ্যান্ড লাভলির গন্ধ ভেসে আসছে লাইলির মুখ থেকে। আর তা দেখেই এমন করে কামনার সুরে বলছিলো ফরহাদ।
-আপনে যে কি কন না..... শরমই করে।
উড়নার এক কোনায় মুখ ডাকতে ডাকতে কথাটা বলছিলো লাইলি। এমন আরো অনেক কথা আর সাথে উড়নায় মুখচাপা হাসিতে ফরহাদ-লাইলির রসায়ন ভালোই জমে উঠলো। পাতানো গল্প যখন দধির মতো জমাট বাঁধবে বাঁধবে ভাব তখনি ফরহাদের ছোট ছেলে আব্বা আব্বা করতে করতে হাজির।
- আব্বা আব্বা ছুঁত কইরা আহো, মা জানি কেমুন করতাছে.....
কথাটা শুনেই দৌঁড়িয়ে যায় ফরহাদ-লাইলি দুজনেই। গায়ে ক'দিন থেকেই বেশ জ্বর ফরহাদের স্ত্রীর। সেদিকে যেন খেয়ালই নেই ফরহাদের। এক পাতা প্যারাসিটামল যে এনে দিবে তাও যেন ভুলে গেছে। অথচ কাজের মেয়ে লাইলির জন্য মুখেমাখার ক্রিম থেকে শুরু করে সব প্রসাধনিই আসে। এসবই দেয় বউকে লুকিয়ে।
- এবার মনে হচ্ছে আর বাঁচবেনা। কি করি বলতো লাইলি।
-একটা ভ্যান ডাহেন, ছুত কইরা হাসপাতালে নিতে অইবো।
লাইলির কথা শুনে ফরহাদ বেড়িয়ে পরলো। লাইলি এই ফাঁকে উঠানে থাকা বদনাতে করে পানি আনতে গেলো পাগাড় পাড়ে। পানিটুকু পরম যত্নে ফরহাদের বউটার মাথায় ঢালতে ছিলো লাইলি। কিছুক্ষণ পড়ে যেন চোখ মেলে তাকালো ফরহাদের বউটা.....
- লাইলি, মা আমার, আমি যদি মইরা যাই আমার বাচ্চাগুলানরে দেহিশ......
-কি কন এগুলা চাচিআম্মা, আপনের কিচ্ছু হইবোনা। ছুত কইরাই ভালো অইবেন।
লাইলির কথা শেষ হতে না হতেই ফরহাদ ভ্যান নিয়ে হাজির। এদিকে উঠান ভর্তি মানুষ জড়ো হয়ে গেছে ফরহাদের বাচ্চাদের কান্নাকাটিতে। ফরহাদ আর লাইলি ধরাধরি করি ভ্যানে উঠালো হাসপাতালে নেয়ার জন্য। মির্জাপুর কুমুদিনী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাবে। তখনো মেডিকেল কলেজ হয়নি। কখন আমরা কুমুদিনী হাসপাতাল বলেই চিনতাম। হাসপাতালে নিয়ে আসতে আসতে আসরের আযান দিয়ে দিলো। বেলাও পরে আসছে। জলদি করে ইমারজেন্সিতে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করানো হলো ফরহাদের বউকে। তিন তলার আট নাম্বার ওয়ার্ডে। এখানে ডাক্তার নার্স সবাই অনেক আন্তরিক। চিকিৎসার মানও ভালো। কিন্তু সমস্যা হলো ওয়ার্ডের কোন রোগীর সাথে কাউকেই রাতে থাকতে দেয়া হয় না। ফরহাদও তাই রাতে হাসপাতালে থাকতে পারবে না। চলে আসতে হবে বাড়িতে। কিন্তু বউটা যে ফরহাদের হাত ছাড়তেই চাইছিলো না। তবুও ফরহাদকে চলে আসতেই হলো।
বাড়িতে আসতে আসতে ফরহাদের একঘন্টা লেগে গেলো। রাত তখন আটটা বাজে। সিগারেটের আগুনে শেষটান টা দিয়েই ফরহাদ ঘরে আসলো। ছোট ছেলেটা ঘুমিয়ে পড়েছে। মেজো ছেলেকে লাইলি ভাত খাওয়াচ্ছিলো। এমনিতে লাইলি রাতের বেলা এ বাড়িতে থাকে না, তবে আজকে এমন অবস্থা আর তার মধ্যে মেজো ছেলেটা কিছুতেই লাইলিকে যেতে দিলো না বিধায় রাতে এ বাড়িতে থাকারই সিদ্ধান্ত নিলো।
বাড়িতে আসার সাথে সাথেই ছেলেটা দৌঁড়ে বাবার কোলে উঠে পড়লো। বড় মেয়ের বয়স আট কি নয় হবে। তাদের মা কেমন আছে জানতে চাইলো। "তোমাদের মা ভালো আছে, তোমরা চিন্তা করো না" বলে সান্ত্বনা দিলো সন্তানদেরকে। বললো কাল তোমাদেরকে মায়ের কাছে নিয়ে যাবো।
- "চাচিআম্মার কি হইলো? এহন কেমুন আছে?" লাইলি জিজ্ঞেস করলো।
সম্পর্কের দিক থেকে লাইলি আর ফরহাদ চাচা-ভাতিজি। ফরহাদের বউকে চাচিআম্মা বলে ডাকলেও ফরহাদকে চাচা বলে না লাইলি। ফরহাদই নিষেধ করেছে। চাচা বললে নাকি বৃদ্ধ বৃদ্ধ লাগে।
- জ্বি তোমার চাচিআম্মা ভালো আছেন। এখন রাখো তোমার চাচির খবর, এখন বলো তুমি কেমন আছো?
- "আমি ভালা আছি, নেন... কিছু খাইয়া লন, কত খাটাখাটনি গেল আপনার।" বলেই ভাতের থালাটা সামনে এগিয়ে ধরলো লাইলি।
ঘরে বাজার ছিলোনা, পালের মুরগির ডিম ছিলো আর পাগাড়ের পাড়ে কঁচুশাক শাকের খেত থেকে লতি এনেই রান্না করছে লাইলি। ডিম ভুনার পেয়াজে ভাত মাখিয়ে এক লোকমা মুখে দিয়েই প্রশংসায় ভাসিয়ে দিচ্ছিলো ফরহাদ।
-খুব তৃপ্তি করে খেলাম আজকে, কতদিন এমন রান্না খাইনি।
যদিও এ বাড়িতে কাজে আসার পর থেকেই লাইলিই রান্না করছে, তবুও এমন প্রশংসা এই প্রথম করছে। বউটা বাড়িতে ছিলো বলেই হয়তো প্রশংসা করতে পারেনি এতোদিন।
- আমি কি আইজ নতুন রান্ধি নিহি, পরতিই তো রানতাছি। আগে মজা লাগে নাই?
কিছুটা লাজুক লাজুক হাসি দিয়েই কথাগুলো বলছিলো লাইলি।
-তারপরেও, আজ বেশিই মজা লাগছে...।
কথাটা বলেই হা হা হা করে একটা হাসি দিলো ফরহাদ।
ফরহাদের মেয়েটে খাওয়া দাওয়া শেষ করে আলাদা ঘরে ঘুমাতে চলে গেলো। মেজো ছেলেটাও এতোক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে। ফরহাদের কথা শুনে মনে হচ্ছে না তার বউ অসুস্থ। প্রতিদিনের মতোই হাসি-তামাশা করে লাইলির সাথে কথা বলছে।
আজকে আমাবস্যার রাত না হলেও ঘুঁটঘুটে অন্ধকার, বাইরে দাঁড়ালে নিজের শরীর নিজেই দেখা যাচ্ছে না। আকাশে দু'-একটা তারা অবশ্য চোখে পড়ছে। প্রকৃতি কেমন যেন থম ধরে আছে। ঝিঁঝিপোকার ডাক ছাড়া আর কোন কিছুরই আওয়াজ সহজে কানে আসছে না। গ্রামে রাত ১০ টা বাজলেই যেন মাঝ রাত, সবাই ঘুমিয়ে পড়ে। বিদ্যুৎ নেই-টিভি নেই কেনই বা অযথা বসে থাকবে! এমন অন্ধকার রাতেই যে ফরহাদের বউটার কপালও অন্ধকার হয়ে যাবে তাই বা কে জানতো?
চলবে,.....