মুখ থেকে পেষ্টের ফেনা ফেলে একটা মুচকি হাসি দিলো ফরহাদ। সে হাসি লাইলি হয়তো খেয়াল করেনি। খেয়াল করলে অবশ্যই লজ্জা পেতো। ভেজা চুল গামছায় পেঁচিয়ে খোঁপা করতে করতে রান্নাঘরে গেলো লাইলি। ও তাকাচ্ছে না দেখে ফরহাদও আর কিছু বললো না।
রান্না শেষ হবার আগেই ফরহাদ খাবারের জন্য তাগাদা দিয়ে গেলো একবার।
- হাসপাতালে যেতে হবে, খাবার নিয়ে আসো তাড়াতাড়ি।
- আপনে বহেন, আনতাছি। হইছে পরাই......
চৈত্রের দিনগুলোতে সকাল ৯ টা বাজতেই সূর্য প্রায় মাথার উপর উঠে আসে। বেশ গরম পড়ে। খাওয়া-দাওয়া শেষ করেই ফরহাদ বেরোবে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। তাই একটু তাড়াহুরো করছে। লাইলির গলায় পেঁচানো ওরনায় হাত মুছতে মুছতে স্টীলের টিফিন বাটিটা হাতে নিলো ফরহাদ। ওর এমন কান্ড দেখে লাইলি কিছুই বলে না। শুধু মিষ্টি করে হাসে। ফরহাদও হাসে ওর সাথে তাল মেলাতে গিয়ে।
টিফিনের বাটিটা হাতে করে একটা সিগারেটে টান দিয়েই বেড়িয়ে পড়লো ফরহাদ। পৌঁছাতে একঘন্টা লেগে যাবে। হাসপাতালে দর্শনার্থীদের জন্য গেট খুলে সকাল আটটার সময়। ফরহাদ পৌঁছাতে পৌছাতে ১০টা বেজে গেছে। গিয়ে দেখে ফরহাদের শ্বশুড় বাড়ির লোকজন এসেছে। তারা যে ফলগুলো এনেছিলো সেগুলো খাচ্ছিলো ফরহাদের বৌ। ওয়ার্ডে রোগীর সাথে কাওকে থাকতে দেয়া হয়নি বলে ফরহাদের বৌকে কেবিনে ভর্তি করানো হলো। সাথে থাকবে ফরহাদের শ্বাশুড়ি। মেয়ের এমন দূর্দিনে সে কি বাড়িতে বসে থাকতে পারে? হাজার হোক মেয়ে তো!
কয়েক দিনের চিকিৎসায় ফরহাদের বৌ অনেকটাই সুস্থ এখন। ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করতে পারে। হাঁটতেও পারে। সে এখন বাড়িতে যেতে চায়। কতদিন সে তার সাজানো সংসার দ্যাখেনা...! সন্তানদের জন্যও মন কেমন করছে। এর মধ্যে ছোট ছেলেটাকে একবার নিয়েও আসা হয়েছিলো। তারপরও, সে আর হাসপাতালে থাকতে চায় না। এখানে তো আর খরচ কম হচ্ছে না। সব যাচ্ছে তার বাবার বাড়ি থেকে। তার স্বামী তো আর খরচ করছেনা। আর কত আনবে ও বাড়ি থেকে!
হাসপাতাল থেকে ছাড়িয়ে বাড়িতে নিয়ে আসলো ফরহাদ তার বৌকে। কিন্তু তার মনে এখন অন্য চিন্তা। বৌয়ের অনুপস্থিতিতে লাইলির সাথে যেভাবে মিশেছে এখন আর তা সম্ভব হবে না। সে লাইলিকে ছাড়তেও চায় না। লাইলিকে সে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখিয়েছে। লাইলি যখন বলতো "এক বৌ রাইখ্যা আমারে বিয়ে করবেন ক্যামনে? সমাজে কি মাইনা নিবো?" ফরহাদ তখন নানা কথা বলে ভুলিয়ে রাখতো লাইলিকে।
একদিন ফরহাদের বৌয়ের চোখে ধরা পড়ে যায় ফরহাদ আর লাইলি। তাদেরই রান্নাঘরে। সেদিন থেকে লাইলিকে আর এ বাড়িতে আসতে দেয় না ফরহাদের বৌ। কিন্তু না আসতে দিলে কি হবে, তাদের প্রেম কি আর আটকানো যাবে! গ্রামে একটা কথা প্রচলন আছে "গাভী আর বাছুর এক থাকলে দুধ খাওয়াতে সমস্যা হয় না"। ফরহাদ আর লাইলির ক্ষেত্রে কথাটা একেবারেই ঠিক। এতোদিন তো বাড়ির ভিতরে করতো এখন বাইরে করে। গ্রামের জঙ্গলে। একদিন-দুইদিন করতে করতে গ্রামের মানুষের চোখে বাজে তাদের এমন মেলামেশা। চায়ের দোকানে রাজনীতির বদলে হট টপিক এখন ফরহাদ-লাইলির সম্পর্ক। ফরহাদ একটা দিক থেকে ভালো আছে যে বউকে কখনো মার-ধোর করেনা। তার এক কথা, "আমি লাইলিকে ভালোবাসি। ওকে বিয়ে করবো। দুই বৌ খাওয়াতে কোন অসুবিধা হবে না আমার।" কিন্তু সমস্যা তো আরেক জায়গায়। দুজনের জাত ভিন্ন! ফরহাদ খান বংশের আর লাইলি জোলা পরিবারের মেয়ে। সমাজ তো এ সম্পর্ক কিছুতেই মেনে নিবে না! সমাজের মাতাব্বররা বলে দিয়েছে, এই বিয়ে করলে ফরহাদকে সমাজে রাখবে না, এক ঘরে করে দিবে। আবার লাইলির সমাজ থেকে লাইলির বাবা ইলিমউদ্দিনের উপর চাপ! এমন চরিত্রের মেয়ে যে ঘরে আছে সে ঘরের কাউকে সমাজের কোন কাজে রাখা হবে না! ইলিমউদ্দিনের মেয়ের এমন চরিত্রের কারনে সব দোষ বাবার উপর এসে পড়লো। বাবা মেয়েকে শাষন করেনা, শাষন করলে কি আর এমন করতে পারতো! হুমকি-ধমকি আসতেই থাকে বাবা ইলিমউদ্দিনের উপর।
গ্রামে চৈত্রমাসে খাবারের তখন খুব অভাব। সবার ঘরে চাল থাকে না। তার উপর ইলিমউদ্দিন দিন আনে দিন খায়। একদিন কামলা না দিতে পারলে পরের দিন ঊপোষ থাকা ছাড়া উপায় নেই। এ ঘটনার পর থেকে এক প্রকার ইচ্ছা করেই ইলিমউদ্দিন কাজে যায় না। তাকেও কেউ ডাকতে আসে না। সে বছর রমজান মাসে তাদের সমাজে ফেতরা নিলো না। সমাজের ইমাম সাহেবকে মাতাব্বররা বলে দিয়েছে, ইলিমউদ্দিনের মেয়ে জেনা করেছে..., তাদের কারো ফেতরা যেন না নেয়া হয়! তাই করা হলো। ইলিমউদ্দিন অনেক আকুতি-মিনতি করেও কোন লাভ হয়নি। তাদেরকে অঘোষিত ভাবে একঘরে করে দেয়া হলো।
ইদানিং লাইলির শরীরে বেশ পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। যে মেয়েটা খাওয়ার জন্য পাগল ছিলো তার মুখের রুচি যেন হঠাৎ করে হারিয়ে গেলো। সব ধরনের খাবারই গন্ধ লাগে। বমিও হয় মাঝে মাঝে। পেটের নিচ দিকে ফোলা ফোলা মনে হয়। সেলোয়ার কামিছ পড়লে ফোলা ভাবটা আরো ফুঁটে উঠে। ওর মা বিষয়টা বুঝতে পেরেছে। মেয়েকে আর কি বলবে। ওর মা তো সবই জানে। যখন ফরহাদের বাড়ি থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে খাবার দিতো ফরহাদ তখন তো লাইলির মা-ই ফরহাদকে প্রশ্রয় দিয়েছে বেশি। মেয়েকে ওর সাথে মিশতে বাঁধা দিতো না। এখন আর কিইবা বলবে লাইলির মা?
চলবে......
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা এপ্রিল, ২০১৯ রাত ৯:২০