বিয়েতে ফরহাদের প্রত্যক্ষ মত এবং লাইলির পরোক্ষ সম্মতিতে মাতাব্বররা অনেকেই সম্মত হলেন ঠিকই কিন্তু বংশীয় দ্বন্দ্বটা রয়েই গেলো। অনেকেই শালিসের দিনই বিয়েতে তোড়জোড় শুরু করলো। পাশ থেকে একজন বলে উঠলো "ওরা যে পাপকাজ করেছে তার জন্য তো শাস্তি পেতে হবে, আশিটি করে দুররা মারো আগে। তারপর বিয়ে।" অনেকেই এই মতের সাথে সাঁই দিলো। কিন্তু লাইলির এমন অবস্থায় আশিটি দুররা মারবে কি করে! ফরহাদকে না হয় মারা গেলো। গ্রামের মানুষের অদ্ভুত সব ফতোয়া। আইন তৈরি এবং প্রয়োগের বিভিন্ন কৌশল তাদের জানা আছে। আইন প্রণেতা নিজেই বললো, "আশিটি বাঁশের কঞ্চি আনো। আমরা আমাদের কাজ করে যাই। পরকালে ঠেকা থাকতে পারবো না!" সে সময় এই আইনের প্রতিবাদ করার মতো কেউ ছিলো না। তার কথা মতো আশিটি বাঁশের কঞ্চি একত্র করে দু'জনের শরীরেই একবার করে ছোঁয়ানো হলো মাত্র! ভাব দেখে মনে হলো যেন আদর করছে।
বিয়ে করে লাইলিকে সেদিনই বাড়িতে নিয়ে গেলো ফরহাদ। কিন্তু ফরহাদের বৌ তেমন কোন উচ্চ বাক্য ব্যয় করলো না। রান্নাঘর দেখিয়ে দিয়ে সেখানে থাকতে বললো। নিজের বাসর ঘর এমন হবে তা কি কোনদিন কল্পনা করেছিলো লাইলি? যে ঘরে থাকবে না কোন ফুলের চিহ্ন, থাকবে না কোন নরম বিছানা এমন বাসর কি কোন মেয়ের কাম্য হতে পারে?
বিয়ে করে বাড়িতে আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। বাড়িতে মানুষের কোন অভাব নেই। এতো মানুষ একসাথে হয়েছে যে, মনে হচ্ছে কোন রাজ পরিবারের বিয়ে। লাইলি সবার পরিচিত, তবু সবাই এক নজর তাকেই দেখার জন্য ফুচকি দিচ্ছে রান্না ঘরের ফাঁক দিয়ে। নিজেকে চিড়িয়াখানার প্রাণীর মতো মনে হচ্ছে লাইলির। সবার সাথে তখনও বেশ হাসি মুখেই কথা বলছিলো সে। হয়তো অনাগত সন্তানের একটা পরিচয় হবে এই ভেবে!
রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষজনের ভীরও কমতে থাকে। একসময় একা হয়ে যায় লাইলি। যার সাথে কথা বলার জন্য ফরহাদ নানান বাহানা খুঁজতো আর সেই মেয়ে একা বসে আছে, অথচ ফরহাদের দেখা নেই। বসে থাকতে থাকতে একসময় লাইলির চোখ দু'টি বন্ধ হয়ে আসে। ঘুমের জন্য নয়, ক্লান্তিতে। অনাগত সন্তানের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে।
আরেকটা দিন শুরু হলো। সূর্য কিরন প্রখর হয়নি কখনো। বেশি রাত করে ঘুমানোর কারনে আজ লাইলির আগেই সূর্য ওঠে গেছে। রান্নাঘরের ফাঁক গলে সূর্যের সোনালী হলুদ রোদের কিরন যখন লাইলির মুখের উপর পরলো, তখনই তরিঘড়ি করে উঠলো লাইলি। কিন্তু সারা বাড়িতে ফরহাদের পরিবারের কাউকেই দেখছেনা লাইলি। ঘুম থেকে উঠে বাইরে বেরুলো লাইলি। বড় ঘরটাতে তখন চাইনিজ তালা ঝুলছে। খিদেয় পেট চু চু করছে। সেই কাল রাতে এ বাড়িতে এসে ঠান্ডা ভাত আর বাসি আলু ভর্তা কপালে জুটেছিলো তার। সকাল বেলা কি তাহলে উপোষ থাকতে হবে?
- "এই নাও, চাল আর আলু আছে এখানে। রান্না করে খাইয়ো। আমি দু'দিন বাড়িতে থাকবো না। ও গেছে বাপের বাড়ি।"
ফরহাদকে দেখে যতটা খুশি হয়েছিলো তার মুখের কথাটা শেষ হতে ততটাই হতাশ হলো। এমন দিনেই তো ফরহাদ তাকে নিজের করে নিয়েছিলো। তখনো তো বাড়িটা ফাঁকা ছিলো। আর এখন! ফরহাদকে যেন লাইলি চিনতেই পারছে না। ক' মাস আগের সেই মানুষটা যেন ফরহাদ নয়! তাহলে কিসের আশায় পড়ে থাকবে এখানে? বেঁচে থেকেই বা কি লাভ! এ জীবন থাকার চেয়ে না থাকাই তো ভালো!
ফরহাদের কথার কোন প্রতি উত্তর করলো না লাইলি। লাইলির নিরবতা দেখে বাজারগুলো রান্না ঘরে রেখেই চলে গেল ফরহাদ। আসলে ফরহাদ ভেবেছিলো যদি লাইলিকে বিয়ে করে তবে তো কোন টাকা দিতে হবে না। আর লাইলিকে এ বাড়িতে কষ্ট দিলে একা একাই বিদায় নিবে। তখন সাপও মরবে লাঠিও থাকবে অক্ষত!
সাত দিন পরের কথা। ফরহাদ দুইদিনের কথা বলে সাত দিনেও ফিরলো না বাড়িতে। লাইলি একবার রান্না করে সারা দিন খায়। আলু ভর্তা আর ক'বেলায় বা খাওয়া যায়। শরীরটাও ক'দিন ধরে খারাপ যাচ্ছে লাইলির। মাঝে মধ্যে এ ও এসে দেখে যায়। সেদিন সন্ধ্যা বেলা লাইলির মাও এসেছে লাইলিকে দেখতে। কে যেন ক'টা মুড়ি দিয়েছিলো, তাই আঁচলে করে এনেছে মেয়ের জন্য। এসে দ্যাখে মেয়ে ব্যাথায় কাতরাচ্ছে। মনে হচ্ছে আজকেই বাচ্চা হবে।
রাত দশটা অবধি তেমনই ব্যাথা। লাইলির মা ছাড়া আর কেউ নেই সে ঘরে। অবশেষে কষ্টের অবসান হলো। সেই ভাঙ্গা ঘরেই জন্ম নিলো লাইলির সন্তান। লাইলি পুত্র সন্তানের মা হলো। নেই কোন আজান কিংবা মিষ্টির বাড়াবাড়ি। কারো মুখে হাসি নেই লাইলির সন্তানকে নিয়ে। লাইলিও চিন্তিত এই সন্তানের ভবিষ্যত নিয়ে? খুব একটা খুশি হতে পারেনি লাইলিও। যে রাতে লাইলির সন্তান হবে তার আগের রাতে রান্নাঘরে লাইলির পাশে একটা কুকুরও সন্তান প্রসব করেছিলো। একবার ভেবেছিলো কুকুরটিকে তাড়াবে কিন্তু কি মনে করে যেন তাড়িয়ে দেয়নি। কুকুরটিওতো তার মতোই অসহায়। আজ মনে হচ্ছে তার সাথে কুকুরটির কিইবা তফাৎ! দুইপ্রাণীরই তো সন্তান প্রসবের জায়গা এক! কুকুর কোনদিন মানুষ হবে না ঠিকই তবে আজকাল অনেক মানুষই তো কুকুর হয়ে যাচ্ছে! কিংবা তার চাইতেও নিকৃষ্ট!
লাইলির মামা লাইলির সাথে দেখা করতে এসেছিলো সেদিন। তিন-চারদিন পর। লাইলিকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে থানায় মামলা করতে বলছে। লাইলিও ভাবছে মামলা এবার করবেই। নিজের সন্তানের জন্য হলেও। কতদিন আর পড়ে থাকবে এভাবে? সন্তান জন্মের সমস্ত ধকল সামলে নিয়ে শক্ত হবার সিদ্ধান্ত নেয়। তাকে যে নতুন করে বাঁচতে হবে। বেঁচে থাকাকে স্বার্থক করতে হবে!
থানায় মামলা করলো লাইলি। প্রধান আসামী করা হলো ফরহাদকে। ক্ষতিপূরণ বাবদ দুইলক্ষ টাকার মামলা। ওর মামাই সব ব্যবস্থা করেছে। লোক মারফত ফরহাদের কাছে মামলার খবরও পৌঁছে দিয়েছে। এমনকি সমঝোতার প্রস্তাবও রাখেছে গোপনে। অবস্থা বেগতিক দেখে সে প্রস্তাবে ফরহাদ একটা সমঝোতাও করে ফেললো। থানা থেকে মামলা উঠানো হলো। লাইলি অবশ্য প্রথমে রাজি হতে চাইনি। কিন্তু মামার পরামর্শে পরে আর অমত করেনি। শেষমেশ আবার গ্রাম্য সালিশের আয়োজন। পঞ্চাশ হাজার টাকা আগেই নিয়েছে লাইলির মামা, ফরহাদের কাছ থেকে। সে টাকায় অবশ্য অনেকেই ভাগ বসিয়েছিলো। থানার ওসি থেকে শুরু করে গাঁয়ের মাতাব্বর, কেউ বাদ যায়নি। ফরহাদের সাথে চুক্তি অনুযায়ী সালিশে সবার সামনে লাইলিকে পঞ্চাশ হাজার টাকায় তালাক দেয়া হলো। কিন্তু সে টাকাও কি লাইলির ভাগ্য আছে? কিংবা তার সন্তানের!
লাইলির বাবাকে কুপরামর্শ দিয়ে পঞ্চাশ হাজার টাকার পুরোটাই লাইলির মামা হাতিয়ে নিলো। লাইলির মামা বললো, '' এই টাকা আমার ব্যবসায় খাটাবো। যা লাভ হবে তার একটা অংশ পাবি। আর বছর শেষে আসল তো থাকবেই।" মামার কথা শুনে লাইলিও আর অমত করে নি।
সন্তানের বয়স ছয়মাস হতে চললো। কিন্তু এখনো কোন নামই কেউ রাখলো না। লাইলির মা কোলে নিয়ে যখন এবাড়ি ও বাড়ি যায় সবায় "ফরহাদের পোলা" "ফরহাদের পোলা" বলে। এটা দেখে লাইলির মা মেয়ের সন্তানের নাম রাখলো "চানু"। সেই নাম ধরেই সবাই ডাকে এখন।
তিন-চার মাস লাইলির মামা লাইলিকে দু'হাজার করে টাকা দিয়েছে। তাতে ভালোই চলছিলো ওদের জীবন। কিন্তু হঠাৎ করেই টাকা দেয়া বন্ধ করে দেয়। টাকা চাইলে বলে, "ব্যবসায় লস হইছে। আর টাকা নাই! পঞ্চাশ হাজার টাকা কয়দিন থাকে?"
লাইলির হাত এখন ফাঁকা। চানুর জন্য যে দুধ কিনবে সে টাকাও নাই। বুকের দুধতো আসেই নি। অভাবের সংসারে না খেতে পেয়ে হাড্ডিসার শরীর, বুকে দুধ আসবে কোত্থেকে? কি করবে লাইলি, ভেবে পায় না!
লাইলিদের সমবয়সী অনেক মেয়েই তখন গার্মেন্টসে কাজ করে। অনেক মেয়ের বিয়েও হয়েছে গার্মেন্টসে কাজ করতে গিয়ে। তাদের সাথে পরামর্শ করে একদিন কাজে যাবার সিদ্ধান্ত নেই ও। সমবয়সীরা তাকে সাহায্যও করলো। তাদের কারখানায় একটা কাজও পাইয়ে দিলো। কিন্তু তা হলে কি হবে, নিজের সন্তানকে রেখে দূরে যাবার কথা ভাবতেই যে লাইলির বুকটা হু হু করে কেঁদে উঠে। চানুই বা থাকবে কি করে একা!
একদিন ভোরবেলা। চানু তখনও ঘুমে। লাইলি একাই বেড়িয়ে পড়ে কাজের উদ্দেশ্যে। পায়ের নিচের মাটি শক্ত করার জন্য। তাকে যে বাঁচতেই হবে। লাইলির মতো মেয়েদের জীবন থমকে যেতে পারে না! কষ্টের আঁধার শেষে সুখের সূর্যোদয়ের অপেক্ষায় শহরের পথে পা বাড়ায় লাইলি!
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই এপ্রিল, ২০১৯ রাত ১০:১০