সিংগাপুর প্রবাসী বাংলাদেশীরা দুঃশ্চিন্তায় আছেন-শুনে গত ক’দিন ধরে মনটা খুব ভারক্রান্ত হয়ে আছে। আইএস সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে বেশ কয়েকজন বাংলাদেশীর ছবিসহ নাম পরিচয় সিংগাপুরের জাতীয় দৈনিকগুলোতে প্রকাশের পর থেকেই সেদেশে কর্মরত বাংলাদেশীদের মধ্যে যে উদ্বেগের জন্ম নেয়, তা’ দিনকে দিন সেদেশের নাগরিকদের আচারণ ও সন্দিগ্নতার কারনে আরও বেড়ে গেছে। দৈনিক প্রথম আলোয় গত ২৩ জানুয়ারি একটি প্রতিবেদন থেকে জানতে পারলাম আইএস বিষয়ক আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঐ সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর সিংগাপুরের নাগরিকরা বিশেষ করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিদের অনেকে বাংলাদেশী কর্মীদের ব্যাপারে তাদের সন্দেহ প্রকাশ করে সতর্কতামূলকভাবে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছেন। এটা তাদের রাষ্ট্রীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থ বিবেচনায় সঠিক হলেও প্রায় দু’লাখ প্রবাসী বাংলাদেশী কর্মীদের জন্য মোটেও সুখকর-স্বস্তিদায়ক নয়। তারা তাদের ভবিষ্যৎ রুটি-রুজির নিরাপদ একটি স্থান হারানোর আশংকায় চিন্তিত। তাই নিরীহ সিংগাপুর প্রবাসীরা ইতোমধ্যে ধর্মীয় লেবাসধারী এসব জগণ্য ব্যক্তিদের খুঁজে বের করে কঠিন আইনী ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছেন। এই দাবির সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে বলতে চাই, কোন বাংলাদেশী বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যাতে কোনোভাবে মৌলবাদীদের মাধ্যমে মগজ ধোলাইয়ের শিকার হতে না পারে সেই ব্যাপারে শিক্ষা কারিকুলামসহ বিভিন্ন মাধ্যমে জনসচেতনতামূলক দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচি নেওয়া এখন সময়ের দাবি।
সিংগাপুর-মাত্র ৬৯২ দশমিক ৭ বর্গকিলোমিটার (ল্যান্ড এরিয়া ৬২৪ বর্গ কিলোমিটার) আয়তনের ছোট একটি ভূখন্ড হলেও এটি এশিয়ার ব্যবসা-বানিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে পরিচিত সমৃদ্ধ একটি জনপদ। প্রতিবেশী অনেকগুলো দেশের বৈদেশিক বানিজ্য সিংগাপুরকে ঘিরে আবর্তিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। সিংগাপুরের গভীর সমূদ্রবন্দর ব্যবহার করেই আমাদের মত দেশগুলোর আমদানি-রফতানি বানিজ্য চলে আসছে। ২০০৩ সালে মাত্র তিন দিনের ভ্রমণে সিংগাপুর যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। দেখেছি, নানা ভাষা-নানা সংস্কৃতির মানুষের মিশেলে চমৎকার পরিপাটি একটি নগর রাষ্ট্র সিংগাপুর। সেখানে মানবতাবোধ ও কাজের মূল্যই সবার কাছে প্রধান বিবেচ্য। ধর্মীয় কিংবা সম্প্রদায়গত সামান্যতম কোনো ভেদাভেদ নেই। তাইতো ১৯৬৫ সালে স্বাধীন হওয়া দেশটি সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে কিভাবে অতিদ্রুত বিশ্বের নজরকাড়া রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে-তা নিজ চোখে না দেখলে কেউ বিশ্বাস করতে পারবে না। ২০১৪ সালের পরিসংখান অনুযায়ী ৫৫ লাখ ৬৭ হাজার ৩০১ জন স্থায়ী নাগরিকের মধ্যে বুদ্ধিস্ট ৩৩ দশমিক ৯ ভাগ, মুসলিম ১৪ দশমিক ৩, খ্রিশ্চিয়ান ১৮ দশমিক ১, হিন্দু ৫ দশমিক ২ ভাগ। জাতিগতভাবে ৭৪ দশমিক ২ ভাগ চাইনিজ, ১৩ দশমিক ৩ ভাগ মালয়, ৯ দশমিক ২ ভাগ ইন্ডিয়ান ও অন্যান্য ৩ দশমিক ৩ ভাগ। মান্ডারিন, ইংলিশ ও মালয়-এ তিন ভাষার প্রচলন সেখানে খুব বেশী অধিকাংশ সিংগাপুরবাসীর কমন ভাষা ইংলিশ।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও জাহাজ চলাচলের ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে সুখ্যাত এমন একটি সদা কর্মব্যস্ত আধুনিক নগর রাষ্ট্রে আইএস-এর হামলার পরিকল্পনা পুরো এশিয়ার জন্য হুমকি। এটাকে কঠোরহস্তে দমন করাই উচিত। নতুবা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার জন্য তা’ সামনের দিনগুলোতে সমূহ বিপদ ডেকে আনবে। মধ্যপ্রাচ্যে কয়েকবছর আগে আবির্ভূত আইএস নামে চরম মৌলবাদী ও মানবতাবিরোধী সংগঠনটি কি করে এতো দ্রুত বিভিন্ন দেশে তাদের মতবাদের বিস্তার ঘটাচ্ছে। পবিত্র ইসলাম-একটি শান্তির ধর্ম। এখানে চরমপন্থার কোনো স্থান নেই। মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সঃ) তার বিদায় হজ্বের ভাষণে পরিষ্কারভাবে তাঁর অনুসারীদেরকে বলেছেন, ‘তোমরাধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করো না। অতীতে বহু সম্প্রদায় ধর্ম নিয়ে বাড়া-বাড়ির কারণে ধ্বংস হয়ে গেছে।’ যে কোন ধর্মই মানুষকে সদাচারী হতে শিক্ষা দেয়। পবিত্র ধর্ম ইসলামও মানুষকে দয়াবান, পররোকারী ও মার্জিত ব্যবহারের অধিকারী হওয়ার শিক্ষা দেয়। এখন প্রশ্ন হলো নিরীহ মানুষকে বিনা কারণে হত্যা করে অথবা ভয়ংকর হত্যাকান্ড-ধ্বংসলীলা চালানোর জগণ্য পরিকল্পনা করে এইএস নামের চরমপন্থী সংগঠনটি নিজেদের মুসলিম হিসেবে পরিচয় দেয় কি করে ? পবিত্র ইসলামের নামে মানবতার বিরুদ্ধে ভয়াবহ অপরাধের সামিল এসব চরমপন্থী কি আমাদের ধর্মকে অবমাননা করছে না ? মুষ্ঠিমেয় কিছু সংখ্যক মৌলবাদীর এসব ঘৃণ্য আচরণ সারা বিশ্বের মুসলিম সম্প্রদায়ের ভাবমূর্তিতে দিনকে দিন কালিমা লেপন করে যাচ্ছে। তাই এখন আত্মউপলব্ধির সময় এসেছে, ঘৃণা ছড়ানো এসব অপকর্ম প্রতিহত করা কি একজন সাচ্চা মুসলমান হিসেবে আমাদের দায়িত্ব নয়?