somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মৈত্রেয়ী দেবী বললেন, বাংলাদেশ যেন মুসলমানী দেশ না হয়

০৫ ই এপ্রিল, ২০১০ সকাল ৭:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ব্যাপারে মৈত্রেয়ী দেবী অনেক বক্তৃতা করেছেন কলকাতায়। বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের তিনি যথাসম্ভব সাহায্য করার চেষ্টা করেছেন। রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্য হিসেবে কলকাতায় তাঁর একটা গ্রহণযোগ্যতা ছিলো। 'মংপুতে রবীন্দ্রনাথ' বইটি তাকে ব্যাপক খ্যাতি এনে দিয়েছিলো। মংপুতে একটি সিংকোনা ফ্যাক্টরীর ম্যানেজার ছিলেন মৈত্রেয়ী দেবীর স্বামী। সে স্থানটি স্বাস্থকর ছিলো বলে জীবনের শেষ পর্বে রবীন্দ্রনাথ সেখানে অবস্থান করেছিলেন। কবিগুরুর সেই দিনগুলোর কথা 'মংপুতে রবীন্দ্রনাথ' বইয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন মৈত্রেয়ী দেবী। 'ন হন্যাতে' তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস।
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর কলকাতা থেকে একে এক সবাই দেশে আসা শুরু করেন। এ সময় সৈয়দ আলী আহসান কলকাতায় যারা তাদেরকে সাহায্য করেছিলেন, তাদের সাথে বিদায়ী সাক্ষাৎকারে মিলিত হন। কলকাতার পাম এভিনিউয়ে থাকতেন মৈত্রেয়ী দেবী। তাঁর বাসায়ও যান সৈয়দ আহসান। তিনি মৈত্রেয়ী দেবীকে বলেন, 'আমি শিগগিরই ঢাকায় ফিরে যাব। আমার সঙ্গীরা প্রায় সবাই চলে গেছেন। আমি এখনো গুছিয়ে উঠতে পারিনি। আজ আপনার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে এসেছি। আপনি আমাদের জন্য অনেক করেছেন, বিশেষ করে আমার জন্য। বিভিন্ন জায়গায় আমাকে নিয়ে গেছেন, পরিচিত করিয়েছেন। আমার প্রতি মর্যাদা দেখিয়েছেন। আসলে তো আমার প্রতি নয়, বাংলাদেশের প্রতি। আপনার সাথে হয়তো আর দেখা হবেনা কখনো। তবে আপনার কথা চিরকাল মনে থাকবে।'
মৈত্রেয়ী দেবী বললেন, 'ভারতের কথা কখনো ভুলবেন না। ভারতের ঐকান্তিক চেষ্টা না থাকলে বাংলাদেশের পক্ষে স্বাধীন হওয়া সম্ভব ছিলোনা। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী আপনাদের জন্য যা করেছেন তা কখনো ভুলবার নয়।'
সৈয়দ আহসান বললেন, 'ভারতের কথা অবশ্যই মনে রাখবো। বিশেষ করে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর কথা। তবে একটি কথা কি জানেন, একটি স্বাধীনতার আন্দোলন যখন শুরু হয়, তখন শেষ পর্যন্ত তা বন্ধ করা যায় না। আমরা কোনো প্রকার সাহায্য না পেলেও সংগ্রাম করে যেতাম এবং একদিন না একদিন স্বাধীন হতাম। তবে সাহায্য করে কৃতজ্ঞতার দাবি করাটা বোধ হয় ঠিক নয়।'
এই বলে সৈয়দ আহসান হাসলেন। মৈত্রেয়ী দেবী বিব্রতবোধ করলেন।
বললেন, 'আমি সে অর্থে বলিনি। আমি আপনাদের কল্যাণ চাই। আপনাদের সঙ্গে এতদিন কাজ করলাম। তাতে বন্ধু হিসেবে কিছু বলবার অধিকার তো আমার আছে। প্রথম থেকে আপনাদের স্বাধীনতার সমর্থনে আমি ছিলাম, কোনো ব্যক্তি কোনো আদর্শকে যদি সমর্থন করে তাহলে সে আদর্শ কী করে বাস্তবায়িত হবে তা সে ভাবে।'
সৈয়দ আহসান প্রশ্ন করলেন, আপনি আমাদের সম্পর্কে কী ভাবছেন?
মৈত্রেয়ী দেবী বললেন, ' দেখুন, পাকিস্তান একটি ধর্মীয় রাষ্ট্র ছিল। তারা মৌলবাদের উপর ভিত্তি করে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছে। এর ফলে আপনারা বিক্ষুব্ধ হলেন। এবং মৌলবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হলেন। আপনারা ধর্মনিরপেক্ষতাকে আপনাদের রাষ্ট্রের একটি আদর্শ হিসেবে স্থির করেছেন। সেই আদর্শ যাতে অক্ষুন্ন থাকে, তাই আমি চাই। একটু হেসে বললেন, দেখুন দেশটা যেন মুসলমানী দেশ না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখবেন।'
সৈয়দ আলী আহসান লিখেছেন, মৈত্রেয়ী দেবীর শেষ কথায় আমি যেন চাবুকের মতো আঘাত পেলাম। আমি কখনো কল্পনা করতে পরিনি তাঁর মত হিতৈষী মহিলা যিনি একটি প্রজ্ঞ পরিবারের কন্যা এবং রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্য, তিনি এমন মন্তব্য করতে পারেন। আমি কিছুক্ষণ চুপ থাকলাম। আমার ক্রোধকে প্রশমনের প্রয়োজন ছিল। আমি ধীরে ধীরে বললাম, আপনার শেষ কথায় আমি দুঃখ পেলাম। বাংলাদেশের যে সমস্ত লোকদের সঙ্গে আপনার পরিচয় হয়েছে, যেমন আমি ও ড. মল্লিক, আমরা আধুনিক পৃথিবীর মানুষ, আমরা ধর্মকে মানব সত্তার বিরোধী মনে করিনা। বরঞ্চ বিশ্বাস করি যে মানুষের জীবনে একটি ধর্মীয় প্রজ্ঞার স্থিতি না থাকলে মানুষ বিপর্যস্ত হয়। আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি, ইসলাম মানুষে মানুষে বিরোধ শেখায় না, এবং ইসলাম ধর্মের যথার্থ তাৎপর্যের মধ্যে মৌলবাদ বলে কিছু। সুতরাং আমরা আমাদের দেশকে যথার্থ মানুষের দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে চাইবো, যে মানুষ বিশ্বাসী এবং অনুভূতিপরাণ। আপনাদের ভারত ঘোষণাপত্রে ধর্মনিরপেক্ষ দেশ, কিন্তু এখানে প্রতিবছর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়। এসব দাঙ্গায় যারা নির্যাতিত হয় তারা মুসলমান অথবা নিম্নবর্ণের হিন্দু। সুতরাং আপনারা ধর্মনিরপেক্ষতার গর্ব করতে পারেন না। আমি স্বীকার করি, এবং বিশ্বাসও করি যে, নেহেরু সাম্প্রদায়িক ছিলেন না, তাঁর কন্যা শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীও সাম্প্রদায়িক নন। কিন্তু ভারতের জনগণের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প আছে, যেটা বাংলাদেশে পাকিস্তন আমলেও ছিল না। পাকিস্তান আমলে অবাঙালীদের দ্বারা দাঙ্গার প্ররোচনা এসেছে দু'একটি বেধেছেও, কিন্তু বাংলা ভাষাভাষী মুসলমানদের চেষ্টায় এসব দাঙ্গা বন্ধ করাও গেছে। আপনি আমাদের শুভ কামনা করুন, আমাদের জন্য আপনার সহানুভূতি আছে, বিশ্বাস করি। সে সহানুভূতিটুকুই আমাদের জন্য যতেষ্ট। '
মৈত্রেয়ী দেবীর মুখ রক্তিম হলো। তিনি বোধ হয় এ ধরণের প্রতিবাদ শুনতে প্রস্তুত ছিলেন না। কিছুক্ষণ পর বললেন, 'আপনি আমাকে ভুল বুঝেছেন। আমি পাকিস্তান আমলের পরিপ্রেক্ষিতে নতুন বাংলাদেশ গড়ার কথা বলেছিলেম, তার বেশি কিছু না।'
আমি হেসে বললাম, ' আপনি মুসলমানী শব্দটি ব্যবহার করায় আমার মনে হয়েছিল আপনি হিন্দু হিসেবে কথা কলছেন, মানুষ হিসেবে নয়।' ( যখন সময় এল : সৈয়দ আলী আহসান )
সৈয়দ আলী আহসানের সঙ্গে এই সাম্প্রদায়িক বিতর্কে মৈত্রেয়ী দেবী তাঁর পরাজয়ের আত্মগ্লানির কথা মনে রেখেছিলেন। ১৯৮২ সালে সৈয়দ আহসানের ষাট বছর পূর্তি উপলক্ষে যে সংবর্ধনা-গ্রন্থ তৈরি হচ্ছিলো, তাতে মৈত্রেয়ী দেবীকেও লিখতে অনুরোধ করা হয়েছিল। কিন্তু অসুস্থতার অজুহাত দিয়ে তিনি লিখতে পারবেন না বলে জানিয়ে দেন।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই এপ্রিল, ২০১০ বিকাল ৫:১৭
২৩টি মন্তব্য ১৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×