somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ছোটগল্পঃ নিদাঘ [১৮+]

০৮ ই এপ্রিল, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:০৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১.

নাক-মুখ থেকে একগাদা রক্ত ছিটকে পড়ল। ভীষণভাবে কেঁপে উঠল নাইনা। এভাবে কেউ কখনও মারেনি ওকে আগে। ছিটকে মেঝেতে পড়ে গেছে। মুখ থেকে অস্ফূট গোঙানি বের হয়ে আসছে।

ওড়না চেপে ধরে আবার দাঁড় করিয়ে দিল রাশেদ। আবার মারল, এবার পেটে। গোঁ-গোঁ করতে করতে ছিটকে বিছানাতে ফিরে গেল মেয়েটা, মুখ থেকে আরেক দফা রক্ত বেরিয়ে মেখে গেল বিছানার চাদরে।

নাইনার মুখ থেকে দুর্বোধ্য সব শব্দ বের হয়ে আসছে। সাহায্যের জন্য চিৎকার করতে চাইছে সে, এটুকু বোঝা গেল। অযথাই। আশে পাশে আর কোন বাড়ি নেই। রাশেদ বিরক্ত হল খুব।

‘মাগীর গলা তো না, যেন হ্যামিলিয়নের বাঁশি!’ বিরক্তি মাখা একদলা থুতু ছিটিয়ে দিল সে নাইনার শরীরে।

নাইনার সামনের পাটির দাঁত পড়ে গেছে চারটা। জিভ কেটে গেছে কয়েক জায়গাতে। কথাই বলতে পারছে না এখন ঠিকমত। বিছানাতে উঠে তাকে চেপে ধরল রাশেদ।

‘কোন হারামজাদার সাথে মারাতে গেছিলি রে? ছেলে দেখলে আর হুঁশ থাকে না? টেনে নিয়ে সরাসরি বেডে চলে যাওয়া লাগে?’ নাইনার গলা চেপে ধরে ওর মুখে জোরে মারল রাশেদ, ‘সুন্দর একটা মুখ পেয়েছিস বলে যা মনে চাই তাই করবি?’

দুই চোখ দিয়ে অবিরত পানি পড়ছে। সে পানিতে ধুয়ে যাচ্ছে রক্ত। পিটপিট করে তাকাল ও, ‘বিশ্বাস কর...’
এতটুকু বলতে গিয়েই হাঁপিয়ে গেল মেয়েটা। অনেক মেরেছে ওকে রাশেদ। ও জানে, উন্মাদটা আরও মারবে তাকে। ফটোশপে পারফেক্ট এডিটেড একটা ছবি দেখে এরকম ব্যবহার করছে সে, এ নাইনার বিশ্বাসই হতে চায় না! তিন বছর ধরে এই ছেলের সাথে প্রেম করছিল ও? ব্যাথার সাথে সারা শরীর জুড়ে বয়ে গেল ঘৃণার হল্কা।

‘বিশ্বাস করব?’ চিবিয়ে চিবিয়ে বলল রাশেদ, ‘তোর মত একটা মাগীকে?’
ব্যস্ত হাতে প্যান্ট খুলতে শুরু করল সে। যন্ত্রণার পাশাপাশি এবার নাইনার চোখে ফিরে এল আতংক। প্যান্ট খোলার প্রায় সাথে সাথে উঠে বসার চেষ্টা করল নাইনা। পারল না।

মেয়েটার দুই পায়ে লোহার একটা রড দিয়ে পিটিয়েছে রাশেদ। ভেঙ্গেই গেছে মনে হয়। সাড়া পাচ্ছে না ও পায়ে।
রাশেদ ক্ষুধার্ত বাঘের মত ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। টেনে ছিঁড়ে আলাদা করে ফেলছে কাপড়। মুখ দিয়ে অশ্রাব্য গালি দিয়ে যাচ্ছে সেই সাথে, ছুটতে পারল না নাইনা।

বিছানার এক কোণে টেনে এনে ওর ওপর চড়াও হল রাশেদ। মুখে ক্রোধের পাশে নোংরা হাসি।
‘মাগীদের সাথে কেমন ব্যবহার করতে হয়, তা আমার জানা আছে, সুন্দরী।’ আরেকদফা থুতু মেয়েটার মুখে ছিটিয়ে দিয়ে বলল রাশেদ।

কতক্ষণ ওকে ধর্ষণ করেছে ছেলেটা, জানে না নাইনা। রাশেদ নয় শুধু, তাকে একবার যে দেখেছে, চোখ ফেরাতে পারেনি। এলাকার ছেলে-বুড়োরা তো আছেই, শিক্ষকশ্রেণি থেকে বন্ধুরা পর্যন্ত তাকিয়ে থেকেছে। খারাপ কোন দৃষ্টি দিয়ে নয়, যদিও অসামান্য দেহসৌষ্ঠব তার ছিল।

নিজেকে যত্ন করে শালীনতার চাদরে ঢেকে রাখত নাইনা। তবুও ওর গোলাপের মত নির্মল মুখটা দেখলেই ব্যস্ত হয়ে উঠত আশেপাশের মানুষ। সেই মুখ এখন বিকৃত হয়ে আছে। দুধে আলতা চামড়া আতংকে আর যন্ত্রণাতে নীল হয়ে আছে।

নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে ও বিছানাতে। রাশেদ তার শালীনতার কোন মর্যাদা দেয়নি। একটা দেহের সাথে যেমন ব্যবহার করা হয়, তাই করছে সে। আঁচড়ে কামড়ে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলেছে নাইনার কোমল বুক আর পেট।
ভাঙ্গা পায়ের যন্ত্রণা দাঁতে দাঁতে সহ্য করছে নাইনা। জানে, শব্দ করলে আরও ব্যাথা দেবে ওকে রাশেদ।

নিস্তার দিল না ওকে ছেলেটা, যার সাথে এককালে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখত নাইনা। প্রায় অচেতন শরীরটা দুই হাতে তুলে এনে ঘরের একমাত্র টেবিলটার ওপর ছুঁড়ে ফেলল সে। ক্যালকুলেটর, বই-খাতা, কল্ম, স্ট্যাপলার সব ছিটকে গেল একেকদিকে।
ধর্ষণ চালিয়ে গেল রাশেদ।

বেকায়দা ভাবে পড়ে আছে নাইনা। ঘাড়ে খুব লাগছে ওর। রাশেদ সরে না কেন? একবার নাইনার পেটব্যাথা হয়েছিল শুনে কি অস্থির হয়েই না উঠেছিল সে! সব মেকি?
এখন যে বড় ব্যাথা পাচ্ছে ও। রাশেদ কি বোঝে না? আলতো করে মাথা নাড়ল নাইনা। রাশেদ কি করে বুঝবে?
ও তো ছেলে, একজন ছেলে কি করে বুঝবে এই কষ্ট?

ধীরে ধীরে আঙুল নাড়িয়ে একটা কলম স্পর্শ করল নাইনা। জানোয়ারটা এখন চরম শারীরিক সুখে গোঙ্গাচ্ছে। জানোয়ারটার চোখে গেঁথে দিতে হবে কলম। মুঠোতে ধরার চেষ্টা করল নাইনা ওটাকে। হাতে জোর পাচ্ছে না কেন?

শরীরের শেষ বিন্দুর শক্তি একত্র করে কলমটা তুলল নাইনা। তারপর গেঁথে দেওয়ার চেষ্টা করল রাশেদের চোখে। বাতাস কেটে এগিয়ে যাচ্ছে কলমের খোলা নিব, রাশেদের দিকে ছুটে গেল সরাসরি।
বিদ্যুতবেগে নড়েছে রাশেদ। মেয়েটাকে ধর্ষণ থেকে রেহাই না দিয়েই আটকে ধরল হাত।

‘কি হল এইটা?’ বিস্ময়ে গর্জে উঠল রাশেদ, ‘লোটির মাইয়া, তোমার নাগরের কথা মনে পড়ছে, তাই না? শালী কুত্তির-’
রাগের চোটে কথাই শেষ করতে পারল না রাশেদ, অন্য হাত দিয়ে কেড়ে নিয়েছে নাইনার কলম। আরও জোরে চেপে ধরল নাইনাকে।

তলপেটের নিচটা অসার হয়ে আসছে মেয়েটার। ঝাপসা দেখছে সিলিং। তার মধ্যেই মুখে প্রচণ্ড ব্যথার অনুভূতি নতুন করে জাগিয়ে তুলল যেন ওকে।

পরের ব্যাথাটা এল আরও ভয়ংকরভাবে। চোখের সামনে থেকে রক্ত আর মাংসের ছিটকে যাওয়া দেখতে পেল নাইনা।
রাশেদ গর্জন করছে এখনও, তীব্র ক্রোধ সে কণ্ঠে, ‘কোন চিন্তা করিস না, মাতারি ... চোখে মারব না তোর। আয়নাতে দেখবি নিজেকে, চোখে মারলে তো মজাই শেষ!’

শক্ত করে ডান হাতে কলমটা ধরে একের পর এক আঘাতে নাইনার সুন্দর মুখটায় অসংখ্য গর্ত করে ফেলেছে রাশেদ।
সেই সাথে চালিয়ে যাচ্ছে দানবীয় সঙ্গম।

নাইনার চোখের পাতা লেগে আসছে একটার সাথে আরেকটা। আলো জ্বলছে ঘরে? না নেভানো? ঠাণ্ডা বাতাস তো একটু আগে ছিল না!
ঠিক বুঝে ওঠে না ও, এই জগতে কি আর থাকা হল না তার? অন্ধকার হয়ে আসছে কেন চারপাশটা? অন্ধকার কোন জগতে টেনে নেবে ওকে কেউ? কেন ও এই জগতে থাকতে পারবে না?
রাশেদ নামক এক মানুষের চেহারার পশুর সন্দেহপ্রবণ মনের জন্য?

আলো একেবারেই নিভে যাওয়ার আগ মুহূর্তে প্রচণ্ড শব্দে দরজা ভেঙ্গে পড়ার শব্দ শুনল নাইনা।
তারপর বাজ পড়ল যেন ঘরের ভেতর।

২.
‘সব তো ফেটেফুটে বের হয়ে যাবে রে ভাই। সামলায় রাখ তোর বইখাতা।’

নোংরা হাসিতে মুখ ভরিয়ে বলল রাস্তার পাশের ছেলেটা। চমৎকার টি-শার্ট গায়ে দেওয়া মেয়েটা জানে, কথাটা এই ছেলে তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বন্ধুকে বলেনি। বলেছে তাকে।
অথচ, প্রশ্ন করলে কোন ধরণের জবাব সে দেবে না। সবগুলো দাঁত বের করে হাসতে থাকবে।

এ শহরের পথে ঘাটে এ দৃশ্য মোটেও পুরোনো নয়। এরকম পরিস্থিতি সামনে আসবে জেনেই ঘর থেকে বের হয় সুন্দরী মেয়েরা। চেহারার ছিঁরিছাদ নেই, এমন চমৎকার দেহগড়নের মেয়েদেরও একই সমস্যা। চেহারা এবং শরীর – দুটোই আছে যাদের, তাদের মধ্যেই পড়ে অনিতা। তবে এটা আশীর্বাদ নয়, অভিশাপ হয়ে এসেছে তার জন্য।
মাথা নিচু করে হেঁটে বখাটে ছেলে দুটোকে এড়িয়ে গেল সে।

সুমন চমৎকৃত। এরকম ‘খাসা মাল’কে টিজ করলে তারা সাধারণতঃ প্রতিবাদ করে ওঠে। বেশিরভাগ সময় প্রতিবাদ হয়ে ওঠে নীরব। কোন শব্দ না করেই তাচ্ছিল্যের এমন একটা দৃষ্টি দেয় তারা, সুমনের ভেতরটা জ্বলে পুড়ে যায়।

এই মেয়ে দেয়নি। মাথা নিচু করে চলে গেছে নোংরা মন্তব্যটা হজম করে।
সুমনের পাশে দাঁড়ানো হাসান অবশ্য হাসছে না। বন্ধুর এসব নোংরা আচরণ তার ভাল লাগে না। কিন্তু কিছু বলাও যায় না। আট বছরের পুরোনো সম্পর্ক।

‘শালা মাগীবাজ!’ মনে মনে মুখখিস্তি না করে পারল না হাসান।

আকাশে অদ্ভুতভাবে মেঘ জমেছে খুব অল্প সময়ে। সেদিকে একবার তাকাল সুমন। মেইন রোডে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভেজার কোন মানে হয় না। হাসানের পিঠে চাপড় দিল ও, ‘আজাইদ্যার বাসায় চল। বিড়ি টানতে টানতে টোয়েন্টি নাইন চোদানো যাবে।’

গোমড়া মুখেই তাকে অনুসরণ করল হাসান। ভাল লাগছে না তার। বাড়ি যেতে পারলে হত। যাওয়ার উপায় অবশ্য নেই। সুমনের জেদের সাথে পারা যাবে না। সে এখন বৃষ্টি ভেজা আবহাওয়াতে সিগারেট ধরিয়ে মহানন্দে টোয়েন্টি নাইন খেলবে।

গলিতে ঢুকে পড়তে পড়তে হাসান তবুও একবার চেষ্টা করল, ‘শোন, বাসাতে দুধ নাই। কিনে দিয়ে আসি আগে। তুই আজাদের বাসার দিকে যা।’
হাহাহা করে হাসল সুমন, ‘দুধ কি আর বাজারে পাওয়া যায় রে? ওসব বাদ দিয়ে আমার লগে চল। খেলুম আগে। পরে দুধ খুঁজিস।’
লাল হল হাসান, ‘আরে, আম্মু চা বানাবে সেই দুধ। কিছু সময় তো মুখে লাগাম দিবি?’
দুইপাশে মাথা নাড়ল সুমন, ‘তারপর? আমি আর আজাদ ডাক দিয়ে শফিউলকে আনতে পারুম বড়জোড়। তিনজম মিলে কি আঙুল চুষব?’

‘তুমি তো পারলে আর কিছু চুষতে শুরু কর!’ তিক্ততার সাথে ভাবল হাসান। মুখে বলল না। পাগল ক্ষেপিয়ে লাভ নেই। আরেকটা মোড় নিয়ে কিছুদূর আগালেই আজাদের বাড়ি। একবার ঢুকে পড়লে আর বের হওয়া যাবে না সহজে।
এদিক ওদিক তাকাল হাসান। বৃষ্টি একফোঁটা দু’ফোঁটা করে পড়তে শুরু করেছে।

তড়িঘড়ি এক বিশ গজ দূরে দাঁড়ানো বাড়িটা থেকে বের হয়ে আসল সুন্দরী এক তরুণী। কোকড়া চুল সরাচ্ছে রাজ্যের বিতৃষ্ণা নিয়ে। নিশ্চয় বয়ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলার সময় টাকা শেষ হয়ে গেছে ফোনে? সম্ভবতঃ দুইজনেরই।
হাসানের ধারণা সম্পূর্ণ সত্য প্রমাণিত করে ফ্লেক্সিলোডের দোকানে ছুটল তরুণী। বৃষ্টির সময় মেকআপ সুন্দরীদের বাসা থেকে বের হতে দেখা বিরল ঘটনা। বিরল ঘটনা দেখার সৌভাগ্য এই ফ্লেক্সি-কারণেই ঘটেছে।

‘পাছাটা দ্যাখ, দোস্ত! জাস্ট পাছাটা দ্যাখ!’ শক্ত গলাতে মনোযোগ আকর্ষণ করল সুমন।

মেকআপ সুন্দরী দেখে ফেলার সৌভাগ্য হলেও ‘পাছাটা’ দেখার সৌভাগ্য হাসানের হল না। খুব কাছ থেকে বাজ পড়ার মত শব্দ হয়েছে।

চোখের কোণ দিয়ে বন্ধু সুমনকে রাস্তার বুকে ছিটকে পড়তে দেখল হাসান। কাঁধের কাছে টকটকে লাল হয়ে গেছে রক্তে।
‘বাবা গো!’ চেঁচিয়ে উড়েছে সুমন। হাসান জমে গেছে নিজের অবস্থানে, একটা পা তোলার শক্তি নেই।
আরেকটু ঘুরতেই আততায়ীকে দেখতে পেল হাসান। কালো রঙের পিস্তলটা ছোট ওই হাতে মানাচ্ছে না।

শান্ত অথচ অবিচল পায়ে এগিয়ে আসছে মানুষটা, হাত লম্বা করে দিয়েছে সামনে। গুলির ধাক্কাতে ছিটকে পড়লেও এখন উঠে দাঁড়াচ্ছে সুমন, সেদিকেই লক্ষ্য তার। ছুটন্ত সুমনের পিঠের ঠিক মাঝখানে ঢুকল দ্বিতীয় গুলিটা। স্রেফ সামনে চার হাত পা মেলে দিয়ে আছড়ে পড়ল ও দ্বিতীয়বারের মত।

‘ওহ... ওফ...’ আর কিছু বলতে পারল না সুমন, পড়ে আছে রাস্তার ঠিক মাঝখানে।

শান্ত পায়ে এগিয়ে গিয়ে তার কাছে দাঁড়াল আততায়ী। একটার পর একটা গুলি করল তার মাথায়।
রক্তের সাথে ছিটকে রাস্তাতে ছড়িয়ে পড়ল মগজ। হাড়ের ছোট এক টুকরো এসে লাগল হাসানের পায়েও।
বন্ধুকে রক্ষা করতে এক পাও নড়তে পারেনি সে। ভয়ে ভেতরটা জমে যাচ্ছে।

দুস্বপ্ন!
নিশ্চয় কোন বড় ধরণের দুঃস্বপ্নের মধ্যে আছে সে!

খুনী শান্তভঙ্গিতে ম্যাগাজিন লোড করছে। পা আটকে গেছে হাসানের। এক পাও পেছাতে পারছে না সে, পারছে না আগাতে। নিঃসন্দেহে স্বপ্ন এটা!

পিস্তলের নলটা তার দিকে ঘুরে যেতেই একুশ বছরের ছেলেটা বুঝতে পারল, এটা কোন দুঃস্বপ্ন ছিল না।
পেছনের দিকে উড়ে যাওয়া আগে তিনবার মাজল ফ্ল্যাশ দেখতে পেয়েছিল বেচারা।

৩.
‘ড্যাম ইট!’

ঝুম বৃষ্টির মধ্যে রাস্তাতে নেমে এসে বলল তরুণ অফিসার লিওন। ভালো নাম আফসার উজ জামান খান চৌধুরী।
ও নামটি মোটেও পছন্দ ছিল না তার, দাদীর দেওয়া লিওন নামেই নিজেকে পরিচয় দেয় সব সময়। আগে পুলিশের চাকরি করেছে সে, এখনও তাই করছে। বৃষ্টিতে রাস্তাতে নামাটা কোনরকম ‘ড্যাম ইট’ বলার মত ঘটনা হওয়ার কথা না তার জন্য।

২০১২ সাল থেকে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে পুলিশ ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন। সব ধরণের ক্রাইমের তদন্তের জন্য কাজ করছে এই ডিপার্টমেন্ট। দারুণভাবে শুরুটা হয়েছে, যোগ্য লোক নেওয়া হয়েছে পুলিশের বিভিন্ন বিভাগ থেকে। আর কোন যায়গার প্রার্থী গ্রহণ করা হয়নি। দুর্ধর্ষ একজন সদস্য লিওন, তবুও সব সময় অদ্ভুত রকমের বীভৎস ক্রাইম সীনে দাঁড়িয়ে থাকতে ভাল লাগে না তার।

‘স্যার?’ দ্বিতীয়বারের মত বলল জুনিয়র ছেলেটা। চেহারাতে অসহায়ত্ব। ‘খুবই বাজে অবস্থা এখানে।’
‘হুঁ, বুঝতেই পারছি।’ মাথা দোলাল লিওন, ‘বৃষ্টির পানিতে কোন ধরণের ফাইবার পাওয়া তো সম্ভব হবে না। তার মধ্যেই যতটা করা যায় কর।’

ক্রাইম সীন ইউনিট ছেঁকে ধরেছে লাশ দুটোকে। এ শহরে জোড়া খুন দুর্লভ। লাশের রাস্তাতে পড়ে থাকা আরও দুর্লভ। আর দুষ্প্রাপ্য জিনিস হল সবার সামনে দাঁড়িয়ে খুনীর গুলি করা।

‘প্রত্যক্ষ্য...’ জুনিয়র অফিসার শাহীন বলা শুরু করতেই কাছে কোথাও বাজ পড়ল খুব জোরে। শোনা গেল না কথাটা।
আবার জানতে চাইল লিওন, ‘কি?’
‘প্রত্যক্ষদর্শীদের কয়েকজনকে পাওয়া গেছে। স্টেটমেন্ট দেবেন তাঁরা, তবে আপনি এখন কথা বলতে পারেন চাইলে।’

লিওন জানে, ও ছাড়া আর কোন উপায়ও নেই। খুনীকে পাওয়া যাবে না সহজে। ক্লু ট্রেস করে তো একেবারেই নয়। ক্রাইম সাঈন ইউনিটের জন্য পানির চেয়ে খারাপ শত্রু আর নেই। একেবারে ধুয়ে মুছে দেয় এভিডেন্স। সেখানে সামান্য পানি না, জোরালো বর্ষণ হয়েছে এ এলাকাতে, হচ্ছেও। দুই বছরের পুরোনো সহকর্মীকে পাশে রেখে সাক্ষীদের দিকে এগিয়ে গেল সে।

একপাশে অস্থায়ী ক্যাম্প বানিয়েছে পিবিআই। তেমন কিছু নয়, একটা বড় ভ্যান ছিল। তার মধ্যেই তিনজনকে বসতে দেওয়া হয়েছে। এরা ভলান্টিয়ার প্রত্যক্ষদর্শী। যারা ভলান্টিয়ার করেনি নিজেকে, তাদের খুঁজে পাওয়া যাবে না। গুলি করা দেখেও কেটে পড়েছে তারা। ঝামেলাতে জড়াতে একদম নারাজ। দুই দিন পর ফেসবুকে হয়ত এ ঘটনাকে পুঁজি করে কোন এক গল্প লেখে পোস্ট করে দেবে। কিন্তু, প্রকৃত খুনীকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য পুলিশের সাহায্যে আসতে নারাজ।

ক্রাইম সীন ইউনিটকে নিজেদের কাজ করতে দিয়ে ভ্যানের দিকে এগিয়ে গেল লিওন। কথা বলে সূত্র খোঁজ ছাড়া আর কোন উপায় রাখেনি প্রকৃতি।

ভ্যানের ভেতরটা চমৎকারভাবে সাজানো। পেছনে বড় দরজার এক পাল্লার সাথে ছোট স্লাইডিং ডোর আছে। ওটা ঠেলে সরিয়ে ভেতরে ঢুকতে হয়। চমৎকার উষ্ণ পরিবেশ ভেতরে। বাইরে তের ডিগ্রী সেলসিয়াসের বৃষ্টিবহুল পরিবেশের সাথে কোন মিল নেই। এদিক ওদিক হাজারো যন্ত্রাংশ। সিএসইউ এমন এক ভ্যান নিয়ে এখন ছোটাছোটি করে, শার্লক হোমস পেলে বর্তে যেত!

তিনজনের মধ্যে দু’জন পুরুষ, একজন নারী। পুরুষ দুইজনের মধ্যে আছেন একজন দাঁড়ি-টুপি পরা সুফি সাধকের মত দেখতে ভদ্রলোক ও একজন কলেজ ছাত্র। তার পাশে বসে থাকা মেয়েটির শরীরের সাথে জামা কাপড় ভিজে লেপ্টে গেছে। সব দেখা যাচ্ছে। মেয়েটার সে খেয়ালও নেই। ঠোঁট কাঁপছে তার হাল্কা হাল্কা।

‘আমার নাম লিওন, সিনিয়র ইনভেস্টিগেটর।’ নিজের পরিচয় দিল ও, ‘আপনাদের কাছ থেকে একবার ঘটনার বিবরণ শুনতে চাইছি।’

মাত্রই একজন অ্যাসিস্ট্যন্ট রেকর্ডার-ফেকর্ডার নিয়ে এগিয়ে আসছিল, স্টেটমেন্ট নেবে। লিওনকে দেখে পিছিয়ে গেল সে। স্যার স্টেটমেন্ট নেন পার্সোনালি, কোন রেকর্ডারের বালাই তিনি করেন না, জানা আছে তার।

‘ছুটকা দাড়ি না রাখাই ভালো, বাবা।’ ফট করে বলে দিলেন মুরুব্বি।
পাত্তাই দিল না লিওন, ‘কিছু মনে না করলে কাজের কথা আসি। কি দেখেছিলেন, আমাকে জানাবেন একবার, প্লিজ?’
‘ভয়ংকর এক খুনী, বুঝলেন!’ বুড়ো কিছু বলার আগেই তড়পে উঠল কলেজ ছাত্র, ‘দারুণ চালু পিস্তলে, পঞ্চাশ মিটার দূর থেকে চোখের পলকে ড্র করল পিস্তল, তারপর ধাঁই-ধাঁই গুলি। খুলি উড়ে গেল আপনার ভিক্টিমের, সেই সাথে রাস্তাতে খোসা পড়লও না। ডিডাকশন করার উপায় থাকল না আপনার, দারুণ পিস্তল, বুঝলেন? দারুণ চালু এই লোকের হাত। শহরের মধ্যে সবচেয়ে চালু, আমি বলব।’

বিরক্তিতে সিগারেট ধরিয়ে ফেলল লিওন, এই ছোকরা দেখা যাচ্ছে রীতিমত ওয়েস্টার্ন সিরিজের ভক্ত। সুযোগ পেলেই ডিটেকটিভ উপন্যাস নিয়ে বসে সম্ভবতঃ। যতদূর মনে হচ্ছে, শার্লক হোমস তার প্রিয়। এই বয়েসের ছেলেপুলে সাক্ষ্য না, রীতিমত উপন্যাস রিডিং পড়া শুরু করে।

সিগারেট ধরিয়ে লিওন শুধু বলল, ‘মুখের ফুটাটা বন্ধ কর তুমি। আমি যাওয়ার আগ পর্যন্ত আরেকটা শব্দ উচ্চারণ করলে তোমার পেছনে লাগাব আগুন।’

সব ধরণের ফুটা বন্ধ হয়ে গেল ছেলের। প্রায় সাথে সাথেই। মুরুব্বি ঋষিদের মত করে তাকালেন। এর অর্থ পরিষ্কার। প্রধান প্রতিপক্ষ কলেজ পড়ুয়া ছাত্র ফ্লোর থেকে বিদেয় হতেই সেটি বাগিয়েছেন তিনি। চারুকলার ছাত্রীদের মত চমৎকারভাবে হাসলেন তিনি।

‘লোক দুইটা হাঁটতেছিল, বাবা।’ মুচকি হাসলেন তিনি এই কথা বলে, যেন দুইজন লোক হেঁটে হেঁটে কোন মহাভারত শুদ্ধ করে ফেলেছে।
‘তারপর?’ জানতে চাইতেই হল লিওনকে।
‘তারপর কোথা থেকে শালার পুত এসে গুলি করে দিল।’ হাসি উধাও হয়ে গেল বুড়োর মুখ থেকে।
‘দেখতে কেমন ছিল?’ শালার পুতের চেহারার বর্ণনা জানতে চেয়ে প্রশ্ন করল লিওন।
‘ওই শালার পুত? কইবার পারুম না।’ চট করে নিজের মুখের ফুটাও বন্ধ করে ফেললেন ভদ্রলোক।
অধৈর্য্য হয়ে উঠল লিওন, ‘কেন কইবার পারতেন না?’
‘শালার পুতের মাথা ঢাকা ছিল। বৃষ্টি পড়তাছিল তো, রেইন কোট নিয়ে বাইর হইছিল হালায়।’
‘চমৎকার!’ তিক্ততার সাথে বলল লিওন।

বৃষ্টি, সাথে হুডওয়ালা রেইনকোট। আর কিছু লাগে?

‘গুলি করতেই ছিল।’ বলল ভেজা মেয়ে।
তার দিকে তাকাতেই লিওনের চোখ মেয়েটার মুখ ছাড়া সব দিকে পিছলে যেতে শুরু করে। দোষ তার না, দোষ বয়েসেররও না। দোষ বাতাসের। এই মেয়ের ওড়না ঝড়ো বাতাসেই উড়ে গেছে নাকি? সম্ভবতঃ।
‘মানে, এলোপাথারি?’ আরেকটু খোলাসা করতে চেয়ে ঢোক গিলল লিওন।
‘না। একজনের দিকে। ম্যাগাজিন খালি করে তারপর আরেকজনকে গুলি করেছিল সে।’

‘গড! নট দিস ওয়ান, প্লিজ!’ বিড়বিড় করে প্রার্থনা জানাল লিওন এবার। যদিও অজায়গায় চোখ রেখে করা প্রার্থনা কবুল হবে কি না তা নিয়ে মনের ভেতরে ছোট একটা খটকা থেকেই গেল।

‘আরেকজন কি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছিল?’ চোখ বাঁকাল লিওন।
‘না। ভয়। ঠক ঠক ঠক।’

ঠক ঠক ঠক তরুণীর গলা দিয়ে বের হয়নি। মুখ দিয়ে বের হয়েছে। শব্দটা দাঁতের। তীব্র আতংকে, না ভেজা মেয়ের সহজাত ঠাণ্ডায়, তা জানে না লিওন। মেয়েটাকে নিজের মত করে বলার সুযোগ দিতে আর কোন চাপ দিল না এবার।

‘ভয়ে জমে গেছিল ছেলেটা। ঠক ঠক ঠক।’ বলল মেয়ে, ‘বন্ধু ছিল প্রথম লোকটা। ঠক ঠক ঠক। তার বন্ধু।’
‘স্বাভাবিক। আপনিও জমে গেছিলেন যতদূর মনে হচ্ছে।’ না বলে পারল না লিওন, ‘তারপর?’
‘তারপর, খুনী লোকটা ঠক ঠক ঠক।’
তাকিয়ে থাকল লিওন।
‘-ম্যাগাজিন চেঞ্জ করল। তারপর – ঠক ঠক ঠক-’

বাম হাতটাকে অনেক কষ্টে নিয়ন্ত্রণ করল লিওন। চটাং করে এই মেয়ের গালে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দেওয়া থেকে পরের বার নিজেকে সামলাতে পারবে কি না জানে না!

‘-তাকেও গুলি করল।’ চোখ বুজল মেয়ে, ‘বেচারার দোষ ছিল না। বাজে কমেন্ট করছিল না সে।’
পিঠ সোজা হয়ে গেল লিওনের, ‘প্রথমজন আপনাকে দেখে বাজে কমেন্ট করেছিল?’
বলল মেয়েটা।

হতাশায় মাথা বুকের কাছে ঝুলিয়ে রেখে ভ্যান থেকে বের হয়ে গেল ইনভেস্টিগেটর লিওন।
ব্যালিস্টিকের রিপোর্ট করাতে পারলেই ষোলকলা পূর্ণ হবে।
অজায়গায় চোখ রেখে করা প্রার্থনা কবুল হয়নি।

৪.
এফবিআই আমেরিকার গর্ব হতে পারে, বাংলাদেশের গর্ব হতে যাচ্ছে পিবিআই। ২০১২ তে এর যাত্রা শুরু হওয়ার পর পরই দারুণভাবে অপরাধের হার কমিয়ে এনেছে এই ডিপার্টমেন্ট। চিকণ বুদ্ধি যোগ করা হয়েছে কাজে, এরকম ফলাফল আসাতে তাই অবাক হননি প্রথমদিকের কর্মকর্তা বদরুদ্দোজা আলম।

সবচেয়ে আয়রনিক ব্যাপার হল, বাংলাদেশের ক্রাইম তাঁর বিভাগ ঠেকিয়ে দিলেও নিজের মেয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেননি তিনি। বিভাগের সফলতা তুঙ্গে যখন, তখনই অঘটন ঘটে গেল। এক বছর পেরুনোর আগেই চাকরি থেকে রিজাইন দিয়েছিলেন দক্ষ পুলিশ অফিসার বদরুদ্দোজা আলম।

কলিং বেলটা বেজে উঠতে বুড়ো পায়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। এক বছর আগেই এই মানুষটা দারুণভাবে ঝাঁপাঝাঁপি করতেন ক্রাইম সীনে। এই একবছরের মধ্যেই বয়েস যেন বেড়ে গেছে দশটি।

দরজা খুলতে পুরোনো একটা মুখ দেখে ভেতরটা খুশি হয়ে উঠল তাঁর। অনেকদিন পর হাসলেন, ‘আরে, লিওন যে! কি খবর তোমার? এসো, এসো!’
হাসির জবাবে লিওন হাসল না, আস্তে করে ভেতরে পা রাখল ও।

‘স্যার, আপনার সাথে এটা একটা ক্যাজুয়াল মিটিং হলেই খুশি হতাম, কিন্তু আসলে একটা কাজ নিয়ে কথা বলতে এসেছি।’
হাসি মিইয়ে গেল বদরুদ্দোজা আলমের মুখ থেকে, ‘তো স্টাডিরুমে বসা যাক?’

একমত হল লিওন। বদরুদ্দোজা সাহেব কাজের ব্যাপারে সিরিয়াস, মিনিট তিনেকের মধ্যেই স্টাডিরুমে জাঁকিয়ে বসে কাজের কথা পাড়লেন তিনি।

‘বলে ফেল, কি হয়েছে?’
‘ইয়ে, স্যার, নাইনা কেমন আছে?’ একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক কথাতে চলে গেল লিওন।
‘তুমি তো জানোই।’ মেঘ জমল বদরুদ্দোজার মুখে, ‘ও ঘটনার পর আর কেমন থাকা সম্ভব বল? প্রতিদিন ভয়ে থাকি মেয়ের মাথাতে কবে আত্মহত্যার ভূত যে ঢোকে! সেদিন আমাকে এসে বলল, “বাবা, সুইসাইডের ওপর দারুণ একটা জাপানীজ মুভি আছে। দেখবে তুমি?” কি যে ভয়টা পেয়েছিলাম, বাবা!’
একটু কাশল লিওন। অভদ্রের মত কিছু কথা বলতে হবে তাকে, বিষয়টা এখনই তুলবে কি না বুঝতে পারছে না।

‘সবসময় ওকে নজরে রাখবেন।’ পরামর্শ দিল লিওন, আসলে একটা তথ্য নিশ্চিত হতে চাচ্ছে।
‘ওকে নজরে রাখা যায় নাকি? ঘর থেকে বের হয়ে যায় মাঝে মাঝেই। কোন চুলোতে যে যায় আল্লাহ জানেন।’
মুখের ভাব শান্ত রাখতে বেগ পেতে হল লিওনকে। নাইনা কোন চুলোতে যায় সে ব্যাপারে তার ধারণা আছে।

টুং টাং শব্দ করে এসময় ঘরে ঢুকে পড়ল মেয়েটা। হাতে একটা ট্রে, দুইকাপ চা আর হাল্কা নাস্তা রাখা তাতে। অসম্ভব পাতলা ঠোঁট নাইনার, যে কোন পুরুষের আরাধ্য হতে পারত ও দুটো ঠোঁটের সামান্য বেঁকে যাওয়া, একটু হাসি।

এই মুহূর্তে লিওনের দিকে তেমন একটা হাসিই ছুঁড়ে দিল নাইনা, আগের মত জড়তা নেই তার আচরণে। সেরাতে বাবার সাথে কাজ করত তৎকালীন এই জুনিয়র ইনভেস্টিগেটর আফসার উজ জামান চৌধুরী। ডাকনামটা পছন্দ হয়েছিল নাইনার। লিওন। তবে প্রায় চারটি মাস ছেলেটার দিকে ঠিকমত তাকাতে পারেনি ও লজ্জাতে।

সব দেখে ফেলেছিল লিওন সেরাতে। সব।
এরপর আর তাকানো চলে?
লিওনের পিস্তল থেকে বের হওয়া বুলেট মাথায় নিয়েই মারা যায় রাশেদ। বাড়ির আশেপাশে কেউ আসে না, কথাটা সেদিন সৌভাগ্যক্রমে সঠিক ছিল না। ভবঘুরে শ্রেণির এক লোক প্রাচীরের পাশেই ঘুমানোর বন্দোবস্ত করছিল। নাইনার চিৎকার তার কানে এসেছিল।

ভবঘুরের সিদ্ধান্ত প্রাণে বাঁচেনি নাইনা, বরং ভাগ্য আরও একটু সহায়তা করেছিল তাকে। পিবিআইয়ের গাড়িতে করে ফিরছিল লিওন বাড়িতে। ছোট একটা লিফট দিতে বলতেই ড্রাইভার কুদ্দুস রাজি হয়ে গেছিল। ভবঘুরের কাছে ‘বাতিওয়ালা গাড়ি’ই পুলিশের গাড়ি, আর লিওনদের গাড়িতে প্রায় হামলে পড়েছিল মানুষটা।

দরজা ভেঙ্গে শিউরে ওঠার মত দৃশ্যটা দেখে দেরী করেনি লিওন। একটা বুলেট পাঠিয়ে দিয়েই ছুটেছে হাসপাতালে। নাইনার লেগেছে প্রায় সাত মাস। তারপর রিকভার করেছে প্রায় পুরোপুরি। বাড়ি ফেরার সময় একবার এসেছিল লিওন, তখন তার দিকে তাকাতেও পারেনি মেয়েটা। কিভাবে তাকাবে? সব জানে এই ছেলে, তবুও তাচ্ছিল্যের হাসি তো দেয় না!

এই মুহূর্তে নাইনার হাসিটা কোন পুরুষের রাতের ঘুম হারাম করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। স্বপ্নের সুখে দোষযুক্ত স্বপ্ন দেখার জন্য না, কয়েক মাসের ঘুম হারাম করে দেওয়ার জন্য।

নাইনার মুখের মোট বারো জায়গায় গর্ত। পাঁচটা গর্ত পার্মানেন্ট, তার দুটোর ভেতর দিয়ে মাড়ি পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। সাবধানে পানি না খেলে মেয়েটার মুখের ফুটো দিয়েই পানি সব বের হয়ে যাবে। বাকি সাতটা গর্ত বুজিয়ে দেওয়া গেছে, তবে ডাইনি বুড়ির মত জঘন্য ধরণের বিকৃত হয়ে গেছে মেয়েটার চেহারা। প্লাস্টিক সার্জারির অযোগ্য ওর মুখ। কলমের নিব একেবারে গভীর পর্যন্ত গেঁথে গেছিল। ইনফেকশন থেকে বাঁচাতে পেরেই ডাক্তার বৃন্দ নিজেদের এবং পেশেন্টের ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিয়েছেন।

হাসি দিয়েই আবার বের হয়ে গেল নাইনা। একটা কথাও বলল না কারও উদ্দেশ্যে। তার চলে যাওয়া দেখতে দেখতেই এক কাপ চা তুলে নিল লিওন। শান্ত ভঙ্গিতে মুখে ছোঁয়াল।
‘বের হয় কি করে ও?’ আগের কথার খেই ধরল কোন রকম বাগধারা ব্যবহার না করে।
চায়ের কাপ তুলে নিলেন বদরুদ্দোজা আলম, ‘বোরখা পরে তো এখন। চোখ ঠিক আছে তার। কাজেই ওভাবে বের হলে কেউ বিব্রত করে না ওকে।’
‘তা বটে।’ আরেক চুমুক দিল লিওন, ‘ভিক্টিম এখানে শারীরিকভাবে প্রচণ্ড ক্ষতিগ্রস্থ হয়, পাশাপাশি ক্ষতি হয় মানসিকভাবে। সব সময় নার্ভাস ব্রেক ডাউনে ভোগে বেচারা রোগী। নাইনাকে সাইকিয়াট্রিস্ট দেখিয়েছিলেন?’

অবাক হয়ে গেলেন প্রৌঢ়, ‘তা কেন নেব?’
‘ভয়ংকর অভিজ্ঞতার পর সাইকিয়াট্রিস্টের সাথে কথা বলা উচিত। মেন্টাল ট্রমা মানসিক ভারসাম্যের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।’
‘নাইনা তেমন মেয়েই নয়। প্রচণ্ড শক্ত ধাতে গড়া ও। জীবন তো একটাই, তাই না? প্লাস্টিক সার্জারির আরেকটা চেষ্টা করব তখন আমরা।’
কানেই গেল না যেন কথাটা, বলে যাচ্ছে লিওন, ‘ভিক্টিম এরকম সমস্যা থেকে বের হয়ে এসে তিন ধরণের জীবন যাপন করতে পারে। প্রথমতঃ মেন্টাল ডিস্টার্বেন্স। ভিক্টিম প্রতিরাতে জেগে ওঠে ভয়ংকর স্বপ্ন দেখে। এরা ছায়া দেখে ভয় পায়, ছায়া না দেখলেও ভয় পায়। আতংক তাদের বাকি জীবন তাড়া করে ফেরে। বাইরে বাইরে খুব সাহসী দেখায় তারা নিজেকে। তবে আসলে, ঘটনা তা না।’
‘আচ্ছা!’ চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন বদরুদ্দোজা।
‘দ্বিতীয়তঃ ভিক্টিম আত্মধ্বংসের মধ্যে চলে যায়। ধূমপান বা পানদোষের দিকে ঝুঁকে যায় সে, নিজেকে ধ্বংস করার মাঝে তৃপ্তি পায়। শুধু এটুকুই নয়, মৃত্যুপ্রীতি দেখা যায় ভিক্টিমের মধ্যে। আত্মহনণের দিকে তার বিশেষ আগ্রহ দেখা যেতে পারে। এদের আপনি দেখবেন ছাতের রেইলিংয়ে বসে বানরের মত পা দোলাতে।’
‘নাইনা কোনদিনও রেইলিংয়ে বসে পা দোলায়নি।’ আত্মবিশ্বাস ঝড়ল বদরুদ্দোজার কণ্ঠ থেকে।

‘তৃতীয়তঃ পাশবিক যৌন আক্রমণের ভিক্টিম পরবর্তীতে পুরুষজাতির প্রতি বিতৃষ্ণাতে ভোগে। এই বিতৃষ্ণা শুধু মানসিক নয়, শারীরিকভাবে প্রতিশোধ নেওয়ার আকাঙ্খা কাজ করে ভিক্টিমের মধ্যে। বড় একটা অংশই ব্রুটাল সেক্সুয়াল অ্যাসল্টের পর বেঁচে ফেরে না, যারা ফেরে, তারা একটা মার্ডারার সত্ত্বা চামড়ার নিচে নিয়েই ফেরে। মানুষ খুন করাটা তাদের কাছে কঠিন কোন ব্যাপার থাকে না।’ একটু বিরতি দিল লিওন, ‘ভুল বললাম, মানুষ নয়, পুরুষ খুন করাটা।’

ঝট করে উঠে দাঁড়ালেন বদরুদ্দোজা, ‘যথেষ্ট সহ্য করেছি তোমাকে, লিওন। যা তা বলতে আমার বাড়ি বয়ে এসেছ তুমি? আমার মেয়ের পাস্ট আমি জানি, তুমি আমার থেকেও ভাল জানো। তাকে উদ্ধার করার জন্য আমি কৃতজ্ঞ তোমার কাছে। তবে, এটা ভাবার কোন কারণ নেই তুমি তার পরিস্থিতিকে ফানি মনে করলে আমি সেটা গায়ে মাখব না!’
‘স্যার, আমি একটা জরুরী আলোচনা করতে এসেছি, আপনি আগেই উত্তেজিত হবেন না-’
‘মাত্র চারমাস হল মেডিকেল থেকে ফিরেছে ও, আর চারমাস গেলে দেখবে আরও স্থির হয়ে আসবে মন!’ প্রায় ধমক দিয়ে উঠলেন অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র অফিসার।

‘এই চারমাসে ইভ টিজারদের নির্মম ভাবে হত্যা করেছে পাঁচ জায়গাতে।’ চট করে বলল লিওন, ‘প্রথমে ধরে নিয়েছিলাম কোন অদ্ভুত সিরিয়াল কিলারের আগমন ঘটেছে শহরে। নাইনার কথা মাথাতে আসেনি। চতুর্থ কিলিংয়ের সময় একটা বিষয় লক্ষ্য করি আমি।’

কোন বিষয়, তা জানতে চাইলেন না বদরুদ্দোজা। সাবধানে আবারও বসে পড়লেন।
উৎকর্ণ।

৫.
‘আইলীনের নাম শুনেছেন? আইলীন উওরলস।’ ঠাণ্ডা হয়ে আসা চায়ে আবারও চুমুক দিল লিওন।
‘না।’ শুকনো গলাতে স্বীকার করলেন ভদ্রলোক।
‘জীবনে অনেক কিছুই করেছে এ মহিলা, তবে প্রায় পুরোটা সময় নানা পেশার মধ্যে রেখেছে প্রস্টিটিউশন। যখন তার বয়স মাত্র দশ-বারো, সিগারেটের বিনিময়ে সেক্স প্রথা চালু করেছিল ছেমরি। নিজের স্কুলে। ভাইয়ের সাথে বিছানাতে যেত সে নিয়মিত। যাক গে সেসব কথা, ঘটনা হল, আইলীন উওরলসের প্রকৃত পরিচয়, সে একজন সিরিয়াল কিলার।’

খুক করে কাশলেন বদরুদ্দোজা। আলোচনা কোনদিকে যাচ্ছে তা বোঝার চেষ্টাতে আছেন।

‘আইলীন খুন করেছিল সাতজন মানুষকে। সাতজন পুরুষকে।’
কিছু বললেন না বদরুদ্দোজা।
‘আইলীনের প্রথম শিকার, রিচার্ড ম্যালরি। ফ্লোরিডার ক্লিয়ারওয়াটারে ইলেকট্রনিক্সের দোকান ছিল তার। মরে পড়ে থাকতে দেখা গেল ভোলিউশিয়াতে। বন থেকে কয়েক মাইল দূরে। পুলিশকে আইলীন বলল, ওটা ছিল সেলফ ডিফেন্স। লোকটা তাকে ধর্ষণ করতে এসেছিল, দিয়েছে ছোট পিস্তল দিয়ে ফুটো করে। রিচার্ডের মৃত্যু হয়েছিল ফুসফুসে লাগা দুটো বুলেটের কারণে। নভেম্বরের ৩০ তারিখের কাহিনী এটা, ১৯৮৯।’

চায়ের কাপটা নামিয়ে রাখল লিওন, ‘দ্বিতীয় ভিক্টিম মারা গেছিল ফ্লোরিডার প্যাসকো কাউন্টিতে। মে মাসের ৩১ তারিখে, ১৯৯০ সালে। চার্লস কারস্কান, নয় বার গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল তাকে। আইলীন সম্ভবতঃ একবার ম্যাগাজিন ফাঁকা করে আবারও সেটা রিলোড করে ফাঁকা করেছিল। মানুষ ঝাঁঝরার আনন্দ আর কিসে আছে, বলুন?’
‘তারপর?’ কম্পিত কণ্ঠে জানতে চাইলেন বদরুদ্দোজা। নাইনার সাথে সম্পর্ক খুঁজছেন হয়ত।
‘তৃতীয় ভিক্টিম, মারা গেল বুকের খাঁচাতে ছয়টা বুলেট নিয়ে। আগের খুনের মাত্র একদিন পর, নব্বই সালের পয়লা জুনে ফ্লোরিডার উইন্টার গার্ডেনে পড়ল এই লাশ। আইলীন বেয়াদবটাকে পুলিশ প্রথম খুনের পর ভালোমত বিচারের মুখে আনলে হয়ত এদের মারা যেতে হত না।’
‘চতুর্থ ভিক্টিম কি তারপরের দিনই-’
‘না, জুলাই ৪ এ উধাও হলেন তিনি। আমেরিকার স্বাধীনতা দিবসে। লাশ পাওয়াই যায়নি তাঁর, তবে আইলীনকে তার পরিত্যাক্ত গাড়িকে দূরে ফেলে আসতে দেখা গেছে। পঞ্চম ভিক্টিমও সে মাসের ৩১ তারিখে উধাও হয়ে গেছিলেন, অগাস্টের ৪ তারিখ আর সবার মতই নগ্ন লাশ মিলিল তার। দুইবার গুলি করেছে এবার আততায়ী। তারপরের কাহিনীটা ইন্টারেস্টিং।’

চায়ের কাপ নামিয়ে রাখলেন বদরুদ্দোজাও। শেষ করতে পারেননি কাপের চা।

‘এবার মারা গেলেন ইউনাইটেড স্টেটস এয়ারফোর্সের মেজর। চার্লস হামফ্রেসের বয়েস ছাপ্পান্ন, চাইল্ড অ্যাবিউজের তদন্ত করতেন তিনি। মারা গেলেন অবশ্য জামাকাপড় পড়েই, তবে ছয়বার গুলি করা হয়েছিল তার মাথা আর কাঁধে। লাশটা পড়ল সেপ্টেম্বরের ১২ তারিখে। এর সাতদিন পরে ১৯ তারিখে শেষ লাশ ফেলে আইলীন। অ্যান্টনিও, ট্রাক ড্রাইভার। চারবার গুলি করা হয়েছিল তাকে। প্রতিটা খুন সে করেছিল ফ্লোরিডাতে, এটাও।’

‘আইলীনের সাথে আমার নাইনার সম্পর্কটা কোথায়?’ ঢোক গিললেন বদরুদ্দোজা আবারও।
‘আইলীনের এরকম খুনে হয়ে ওঠার পেছনে আছে তার ইতিহাস। এই এক মহিলা একবছরেরও কম সময়ে সাতটা লাশ ফেলেছে, যেগুলো তাও পাওয়া গেছে। আরও অনেক খুন সে করে থাকতে পারে, সেগুলো হয়ত কেউ জানেও না! লিথাল ইঞ্জেকশন দিয়ে আইলীনকে পরাপারে পাঠানো হয়।’
‘ইতিহাসটা কি ছিল এই মহিলার?’
‘জন্মের পর আইলীনের বাবা ছিল কারাগারে। এই লোক আরেক লেভেলের হারামী ছিল। বাচ্চাদের সাথে যৌন সংস্রবে যেত সে, সেই সাথে ছিল সিজোফ্রেনিয়া। বলা যায়, আইলীনের জন্মের সময় একদম ঠিক জায়গাতেই ছিল সে। কাজেই, দাদার কাছে মানুষ হল আইলীন। এই দাদাজান আরেক কাঠি সরেস। কারণে অকারণে মারধর করত লোকটা পিচ্চি আইলীনকে। কাপড় খোলাতো ইচ্ছেমত।’
‘এখান থেকেই মেয়েটা সেক্সের বিনিময়ে সিগারেট প্রথা চালু করেছিল স্কুলে। তাই তো? এসব তার জন্য ব্যাপারই ছিল না।’
মাথা দোলাল লিওন, ‘এসব তার জন্য ব্যাপারই ছিল না। ভাইকে বানিয়েছিল সেক্স পার্টনার। বয়েস তখন মাত্র এগারো তার। ১৯৭০ সালে আইলীনের বয়েস ১৪। দাদাজানের বন্ধুর সাথে অনিরাপদ যৌন মিলনে প্রেগন্যান্ট হয়ে গেছিল সে।’

দুইপাশে মাথা নাড়লেন বদরুদ্দোজা, ‘নাইনার সাথে কোন হোম অ্যাবিউজ করা হয়নি। অ্যাসল্ট দূরে থাকুক।’
লিওন একটু হাসল, সে হাসিতে ব্যথা, ‘আইলীনের ট্রমা ছিল একদম ছেলেবেলাতে। পরবর্তীতে প্রকাশ পেয়েছে সেটা। নাইনার ট্রমা ইন্সিডেন্স একবছর আগের কথা।’
‘রাশেদের আচরণে-’
‘মানসিক ধাক্কাটা বড় ছিল।’
‘তুমি বলতে চাইছ-’
‘প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে উঠেছিল মেয়েটা।’
‘কিন্তু-’
‘আপনার সার্ভিস পিস্তলটা এখনও জায়গামতই আছে তো?’

দ্রুত উঠে যেতে চাইছিলেন বদরুদ্দোজা, বাঁধা দিল লিওন, ‘আপনার কাছে নেই ও জিনিস। গতকাল আপনি আর আপনার মেয়ে দুইজনই বাইরে ছিলেন দুপুর এগারোটার দিকে। তখনই পিস্তলটা সরিয়ে ফেলেছি আমরা।’
‘হোয়াট!’ গর্জে উঠলেন বদরুদ্দোজা, ‘আপনারা আমার অনুমতি ছাড়াই আমার বাড়িতে ঢুকেন কি করে?’
‘রেয়ার ক্যালিবার বুলেট স্যার। পয়েন্ট ফাইভ। পয়েন্ট ফাইভ ক্যালিবার। চতুর্থ খুনের পরই লক্ষ্য করলাম বুলেটগুলো যথেষ্ট পুরাতন। বিদ্যুতচমকের মত মনে পড়েছিল ব্যাপারটা, দুই বছর আগে আমরা ছাড়া আর তেমন কেউ ব্যবহার করত না ও জিনিস। ব্যলিস্টিক ম্যাচ করেছে, স্যার। আপনার পিস্তল দিয়েই প্রতিটা খুন করা হয়েছিল। গত পাঁচ দফা খুনের ছয়টা লাশের শরীরেই পেয়েছি আমাদের ক্যালিবারের বুলেট।’
‘হোয়াট দ্য-’
শেষ ধাক্কাটা দিয়ে ফেলল লিওন, ‘কথা হল, খুনগুলো করেছিলেন কে? আপনি না আপনার মেয়ে?’
৬.

‘অ্যাবসার্ড!’ ধমকে ওঠার ভঙ্গিতে বললেন বদরুদ্দোজা, ‘আইনের বাইরে এক পাও ফেলিনি আমি আমার চাকরিজীবনে। অবসর নেওয়ার পর তো আরও না!’

নাইনার ঘটনার পরই অবসর নিয়েছিলেন তিনি। লিওন এসব জানে। মাথা দোলাল ও একবার।

‘আপনার পিস্তল থেকে গুলি করা হয়েছে, স্যার। অবসর নেওয়ার নাম করে কি প্রতিশোধের নেশাতে নেমেছিলেন নাকি? মেয়েকে দেখাশোনা করেছেন। মেয়ে সুস্থ হওয়ার সাথে সাথে ম্যানহান্টে নেমেছেন। রাশেদ শ্রেণির যে কাওকে রাস্তাঘাটে পেয়ে গেলেই মেরে ফেলেছেন তাকে। আপনার কাছে এটা হয়ত ন্যায়ের যুদ্ধ, তবে আইন একমত হবে না।’
‘আমি অবসর নেওয়ার ঢঙ করিনি, ছেলে!’ রীতিমত অসম্মানিত বোধ করছেন বদরুদ্দোজা, ‘ও ঘটনার পর আমার আর মানসিক শক্তি ছিল না-’
‘মানসিক শক্তির একরকম অভাব আরেকধরণের শক্তিও হতে পারে, স্যার। আইনের পথে সোজাভাবে লড়ার শক্তি হারিয়েছিলেন বলেই কি ব্যাটম্যান হতে গেছিলেন? সাইলেন্ট গার্ডিয়ান?’
‘শাট আপ!’ কড়া পুলিশী ধমক দিলেন বদরুদ্দোজা, ‘আমি ব্যলিস্টিক রিপোর্ট দেখব।’

‘রিপোর্ট দেখলেন নাহয়, তবে আলাদা কিছু পাবেন না।’ হতাশায় মাথা নাড়ল লিওন, এ পরিবারটাকে তার ভাল লেগেছিল, ‘এখন স্যার, আমার সাথে আপনাদের দুইজনকেই থানাতে যেতে হবে। আপনাদের সাথে এতদিনের পরিচয়, তাই একটা সামান্য অবদান রাখতে চাইছিলাম। যদি, খুনটা কে করেছেন সেটা আমাকে এখানে নিশ্চিত করে দিতেন, তাহলে শুধু থাকেই নিয়ে কাস্টোডিতে যেতাম আমি। একজনকে হ্যারাসমেন্টের শিকার হতে হত না।’

কিছু বলছেন না বদরুদ্দোজা।
এক মুহূর্তের জন্য দ্বন্দ্বে পড়ে গেল লিওন। খুনগুলো বাবা-মেয়ের যৌথ অংশগ্রহণে হয়নি তো?
অস্বাভাবিক তো নয়। বাবা-মেয়ে দু’জনেরই ঘৃণা ছিল রাশেদ-শ্রেণিয় মানুষের ওপর। সে ঘৃণা চরিতার্থ করার জন্য দুইজনেরই নাগালে ছিল অস্ত্র। যথেচ্ছ ব্যবহার করেছে তারা সেটার।

পরমুহূর্তেই সত্যটা দেখতে পেল ও। বাবাটি নিজের অপরাধ স্বীকার করতে দ্বিধাতে নেই। তিনি ধরেই নিয়েছেন, অকাজটা করেছে তাঁর মেয়ে। এই মুহূর্তে নিজেকে অপরাধী ঘোষণা দিতে চাইছেন তিনি। রক্ষা করতে চাইছেন মেয়েকে।
মুখের ভাঁজগুলো খুঁটিয়ে দেখতে নিশ্চিত হল লিওন, এ লোক অপরাধী নয়। তবে সে ভূমিকাতে নিজেকে দাবী করল বলে!

‘লিওন-’ দুই হাত সামনে বাড়িয়ে দিলেন বদরুদ্দোজা, ‘-আমিই-’

রান্নাঘরের দিক থেকে তীব্র শব্দ ভেসে এল এ সময়। বর্জ্র্যপাতের মত। পরক্ষণেই কিছু একটা হুড়মুড় করে পড়ে গেল যেন।
অজান্তেই লাফিয়ে উঠল লিওন, কেউ একজন গুলি করছে রান্নাঘর থেকে! কোমরের পেছন থেকে নিমেষে তুলে আনল ও নিজের পিস্তল।

বাসাটা ছোট, ডাইনিং রুম পেরিয়ে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে আড়াল নিল দেওয়ালের পাশে। সতর্ক হয়ে আছে প্রতিটা পেশি। আলতো করে মাথা বের করতে গিয়েও করল না। অবচেতন মন নিষেধ করছে কাজটা করতে।

সাবধানে নিজেকে আরও নিচু করে ফেলল লিওন। তারপর উঁকি দিল দেওয়ালের আড়াল থেকে। রান্নাঘরে কারও ছায়া দুলছে। কুঁজো হয়েই আড়াল থেকে বের হয়ে আসল ও। পা টিপে টিপে এগিয়ে চলল রান্নাঘরের দিকে। সামনে বাড়িয়ে ধরেছে উদ্যত পিস্তল।

ভেতরে পা রেখেই থমকে গেল ও। অপ্রত্যাশিত ছিল না ঘটনাটা, তবুও।
রান্নাঘর পেরিয়ে স্টোররুম। তার জানালা দিয়ে আসছে আলো। সামনে দুলছে আধ-ময়লা, কালিযুক্ত একটা পর্দা।
সেটা থেকেই ছায়ার দুলুনী মনে হয়েছিল ওর চোখে।

রান্নাঘরের মেঝেতে পড়ে আছে নাইনা। মুখ চেনার উপায় নেই তার, কমপক্ষে চারবার গুলি করা হয়েছে।
পঞ্চম গুলিটা করা হয়েছে গলাতে। বিশাল ফোকড়।
একনজর দেখেই বুঝতে পারল লিওন, পয়েন্ট ফিফটি ক্যালিবারের বুলেট হোল ওটা।

আশেপাশে তাকিয়ে পিস্তলটা দেখা গেল না।

_ পরিশিষ্ট _
দরজাতে নক করতে ছোট একটা ছেলে দরজা খুলে দিল। তার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসল জুনিয়র অফিসার শাহীন।
‘কি চান?’ বিরক্ত মুখে বলল ছোট ছেলেটা। হাতে লাটিম। এ বাড়ির কেয়ারটেকারের ছেলে নিশ্চয়!

হাসিটা মুছে গেল না শাহীনের মুখ থেকে, ‘বাড়িটা বিক্রি হবে শুনলাম। দেখতে এসেছি।’

‘কার সাথে কথা বলিস রে?’ বলতে বলতে বের হয়ে এলেন কেয়ারটেকার। শাহীন জানে, এর নাম মঞ্জুর মিয়া। রাশেদের মৃত্যুর পর বাড়িটার ব্যাপারে খোঁজ রেখেছিল ও। উত্তরিধারের অভাবে মালিকানা পেয়েছিল দূর সম্পর্কের এক চাচাত ভাই। বিদেশে থাকেন তিনি, এ বাড়ি বিক্রি করে দিচ্ছেন তিনি। অসম্মানের সাথে মারা যাওয়া ভাইয়ের স্মৃতি রাখার প্রশ্নই আসে না।

এই মুহূর্তে কেয়ারটেকার চমৎকার হাসিটা ফিরিয়ে দিল তাকে ক্রেতা ভেবেই। সেভাবেই কথা বলছে শাহীন। কেয়ারটেকার আপত্তি করার কোন কারণ দেখল না।

এই পথ দিয়েই সেরাতে ছুটে এসেছিল ওরা। ও আর লিওন স্যার।
সদর দরজা খুলে কেয়ারটেকার তাকে পথ দেখাচ্ছে, শাহীন বার বার ফিরে যাচ্ছে সেই ভয়ংকর রাতে।
গোঙ্গানীর শব্দ আসছিল ওপর থেকে, পাগলের মত ছুটেছিল ওরা। ব্যাকআপ ডাকার জন্য এক সেকেন্ডও নষ্ট করেনি।

দরজা খোলার পর রাশেদের অবস্থান আর নাইনার করুণ পরিণতি সে দেখেছে। জীবনে খুব বেশিদিন এই ক্যারিয়ারে ব্যয় করেনি শাহীন, তবে ও জানে, এরকম বীভৎস দৃশ্য সে আর কোনদিনও দেখবে না।

দোতলাতে দাঁড়িয়ে দরজাতে একটু থেমে যায় শাহীন। কেয়ারটেকার ওকে বাড়ি ঘুরে দেখার জন্য একা একা ছেড়ে চলে গেছে। নিচেই দাঁড়িয়ে থাকবে। প্রয়োজন হলে আবার আসবে।

ঠিক এই অবস্থানে দাঁড়িয়েই সিদ্ধান্তটা নিয়েছিল সে।
একজনকে, একজন নারীত্বের অবমাননাকারীকেও ছেড়ে দেওয়া চলবে না।
প্রত্যেকে মারা যাবে। প্রত্যেককে মারা যেতে হবেই।

প্রথম সমস্যা ছিল অস্ত্র। নিজের পিস্তল দিয়ে গুলি করতে পারবে না সে, রিপোর্ট করতে হয় প্রতিটা বুলেটের জন্য। ধরা পড়ে যাবে। নাইনার বাবার অবসরগ্রহণ সুযোগটা এনে দিল তাকে।

নাইনার বাবার সার্ভিস পিস্তল তাঁকে রাখতে দেওয়া হয়েছিল। সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তা কিছু ফরমালিটিজ সেরে কাজটা করতে পারেন। পুলিশের চাকরি ছেড়ে দিলেই শত্রুমুক্ত হয়ে যান না কোন পুলিশ। অনেক শত্রু তাঁদের ক্যারিয়ারের সময়টাতে গড়ে উঠতে পারে।

নাইনাদের বাড়ির উইকপয়েন্ট ছিল একটা। জানতে পেরেছে নাইনার সাথে প্রেমের সম্পর্ক শুরু করার পর থেকে। হাসপাতালে জ্ঞান ফেরার পর প্রথম মুখ নাইনা দেখেছিল শাহীনের। চার মাস হাসপাতালে অচেতন নাইনাকে দেখতে দেখতে কবে যে প্রেমে পড়ে গেছে, সেটা ও নিজেও জানত কি না সন্দেহ!
পরবর্তীতে মুখের নয়, মনের সৌন্দর্য্যে গলেছিল ও। মেয়েটা ভালবাসতে জানত!
গোপনে রাতে মিলিত হত শাহীন আর নাইনা। স্টোররুমের জানালা দিয়ে অনায়াসে রিচ করা যেত মেয়েটার বেডরুমে।

পিস্তলের অ্যাকসেস পাওয়ার পর আর দেরী করেনি ও, ইভটিজার থেকে নারীবিরোধী প্রত্যেককে টার্গেট করেছে। সবাইকে খুন করা সম্ভব নয়, যেখানে যখন সুযোগ পেয়েছে খুন করেছে ও।

ও জানত লিওন স্যার কখনও ওকে সন্দেহ করবেন না। তবে, সন্দেহের তীর যে নাইনার দিকে ঘুরে যাবে তা বুঝতেও পারেনি ও।
মেয়েটা বলেছিল, জাপানিজ সুইসাইডের মুভি দেখাবে একটা। মুভিটা কখনও দেখা হয়নি। আত্মহত্যার ইচ্ছে উস্কে দিতে চায়নি ও তার মধ্যে।

কিন্তু, তার দুঃখ আরও বাড়ানোর উদ্দেশ্যও ছিল না শাহীনের। লিওন স্যার সে কাজটাই করতে যাচ্ছিলেন অবশ্য। আজীবন জেলে পঁচে মরতে হত মেয়েটাকে। এভিডেন্স কখনও নিজের কাছে রাখেনি শাহীন, রেখে দিত নাইনাদের বাড়িতেই। কে ভেবেছিল সেখানে হানা দিয়ে ব্যালিস্টিক ম্যাচ করাবেন স্যার?

সময় ছিল না, দ্রুত পেছনের জানালা দিয়ে নাইনাদের বাড়িতে ফিরে এসেছিল ও। এভিডেন্স বক্স থেকে তার আগে সরিয়েছে বদরুদ্দোজার পিস্তল।
তার চোখে ন্যায্য কিছু খুন করার অপরাধে ফাঁসীতে ঝুলতে পারত না ও। তাছাড়া, অপরাধ স্বীকার করলে ফাঁসীতে ঝুলতেই হত ওকে, তার পতনের সাথে সাথে নাইনার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বনও যেত হারিয়ে।

যেদিক থেকেই চিন্তা করেছেন, নাইনার জন্য আর কিছু করার ছিল না ওর।
চারটা বুলেট তার মাথাতে ঢুকিয়ে দেওয়া ছাড়া।
কষ্ট তো কমেছে মেয়েটার!
অবশেষে!

দরজাতে দাঁড়িয়ে আরও একটা সিদ্ধান্ত নিল শাহীন।
এ ঘরেই পা ভাঙ্গা হয়েছিল নাইনার। ছয় মাস লেগেছিল রিকভার করতে।
ঘরের মাঝখানে এগিয়ে গেল ও। কোমর থেকে বের করে এনেছে বদরুদ্দোজার পিস্তল।

নিজের তলপেটে ঠেকিয়ে টেনে দিল ট্রিগার।

ফোয়ারার মত রক্ত ছিটাতে ছিটাতে পড়ে গেল মেঝেতে।
অনেক সময় নিয়ে মরবে, ছেলেটা জানে।
প্রেয়সী-হন্তারকের এটুকু শাস্তি তো পাওয়া উচিত।

--- ০ ---

উৎসর্গঃ Leon A. Intasar​ ভাইকে।
কোনরকম রক্তের সম্পর্ক না থাকার পরও যাকে তেমন কাছের কেউই মনে হয়।
ভাইয়া, যেখানেই যাবেন, ভাল থাকবেন। :(
২টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

নারী একা কেন হবে চরিত্রহীন।পুরুষ তুমি কেন নিবি না এই বোজার ঋন।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১২:৫৪



আমাদের সমাজে সারাজীবন ধরে মেয়েদেরকেই কেনও ভালো মেয়ে হিসাবে প্রমান করতে হবে! মেয়ে বোলে কি ? নাকি মেয়েরা এই সমাজে অন্য কোন গ্রহ থেকে ভাড়া এসেছে । সব... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুসলিম কি সাহাবায়ে কেরামের (রা.) অনুরূপ মতভেদে লিপ্ত হয়ে পরস্পর যুদ্ধ করবে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৯




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৫। তোমরা তাদের মত হবে না যারা তাদের নিকট সুস্পষ্ট প্রমাণ আসার পর বিচ্ছিন্ন হয়েছে ও নিজেদের মাঝে মতভেদ সৃষ্টি করেছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদে মসজিদে মোল্লা,ও কমিটি নতুন আইনে চালাচ্ছে সমাজ.

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

গত সপ্তাহে ভোলার জাহানপুর ইউনিয়নের চরফ্যাশন ওমরাবাজ গ্রামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। লোকটি নিয়মিত মসজিদে যেত না, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েনি, জানা গেল সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ছিল, স্বীকারোক্তিতে সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

=সকল বিষাদ পিছনে রেখে হাঁটো পথ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৮



©কাজী ফাতেমা ছবি

বিতৃষ্ণায় যদি মন ছেয়ে যায় তোমার কখনো
অথবা রোদ্দুর পুড়া সময়ের আক্রমণে তুমি নাজেহাল
বিষাদ মনে পুষো কখনো অথবা,
বাস্তবতার পেরেশানী মাথায় নিয়ে কখনো পথ চলো,
কিংবা বিরহ ব্যথায় কাতর তুমি, চুপসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×