somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

টাইম আউট

১৯ শে আগস্ট, ২০১৫ দুপুর ১২:৩২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১.

ছোট্ট একটা মেয়ের পাশে গত আধঘণ্টা ধরে বসে আছি। মেয়েটি তার বাবা-মাকে খুঁজে পাচ্ছে না। সোজা বাংলাতে বললে, মেয়ে শিশুটি হারিয়ে গেছে।
  মেয়েটার নাম কুহেলী।
  সামনের পাটির দুটো দাঁত নেই। খরগোশ অধিপতি মিস্টার খর্‌রের মত দেখাচ্ছে তাকে। মিস্টার খর্‌রে চরিত্রটি ঠিক কি জিনিস, তা আমার এতক্ষণেও বোঝা হয়ে ওঠেনি। খরগোশদের নৃপতির নামটিও আমি কুহেলীর মুখ থেকে উদ্ধার করেছি।
  মেয়েটির দুই গাল সামান্য লালচে হয়ে আছে। অতিরিক্ত ফর্সা মানুষদের গাল সামান্য অনুভূতিতেই লাল হয়ে যায়। রেগে গেলে লাল হয়ে যায়, খুশিতে লাল হয়ে যায়, লজ্জা পেলে তো কথাই নেই। অতিরিক্ত ফর্সা মানুষদের এজন্য ‘লাল্লু’ নামে ডাকার স্বাভাবিক প্রচলন বাংলাদেশে আছে।
  অনুভূতি চেগিয়ে উঠলে লাল হবে - এই নীতি শুধুমাত্র প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য প্রযোজ্য। শিশুদের ক্ষেত্রে, ভীষণ ফর্সা চামড়া থাকলে গাল সব সময়ই লাল হয়ে থাকে। সাবধানে পরীক্ষা করে দেখলাম, পাতলা ত্বকের নীচে রক্তপ্রবাহ টের পাওয়া যাচ্ছে। এই মেয়েটার বাবা-মাকে দেখতে হঠাৎ করেই খুব ইচ্ছে করল। চমৎকার একটা প্রোডাক্ট দেখার পর প্রোডাকশন হাউজের নাম জানতে চায় মানুষ।
  কাজেই, কুহেলীকে প্রশ্ন করলাম, ‘তোমার আব্বু-আম্মুর নাম কি?’
  বাচ্চাটা আমার দিকে তাকিয়ে দাঁতের ফাঁক দিয়ে জিহ্বা বের করে দেখাল।
  আমি আবারও জানতে চাইলাম, ‘আব্বুর নাম মনে নাই তোমার?’
  কুহেলী ঝলমলে চুলগুলো নাড়িয়ে বলল, ‘না।’
  ‘আম্মুর নাম?’
  ‘বু-উ-উ-উ।’ আবারও আমাকে দাঁতের ফাঁক দিয়ে জিহ্বা বের করে দেখানো হল।
  ‘কুহেলী শব্দের অর্থ জানো?’
  বিরক্ত মুখে আমার দিকে তাকাল এবার ও, ‘জানি। কুয়াশা। ইংরেজীতে বলে ফগ।’
  এবার আমার বিরক্ত হওয়ার পালা। ছয় বছর হবে এই বাচ্চার। নিঃসন্দেহে গড় গড় করে রিডিং পড়তে পারে বইপত্র। কাগজ কলম হাতে ধরিয়ে দিলে রীতিমত উৎসাহের সাথে বাংলাদেশের ওপর রচনা লিখে দিতে পারবে। কুহেলী মানে কুয়াশা এটা সে জানে। ইংরেজীটাও জানে। ফগ।
  অথচ, বাবা-মার নাম জানে না? এর চেয়ে বাজে যুক্তি আর হয় না।
  কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে অনেকদিন পর এসেছিলাম। ইদানিং বাংলাদেশের ট্রেনের মত সময়ানূবর্তী জিনিস আর নেই। বারোটার ট্রেন ছাড়ে একদম ঠিক বারোটাতেই। আগেও তাই ছাড়ত, তবে দুপুর বারোটারটা রাত বারোটায়, এই হল পার্থক্য!
  ট্রেনের সাথে পাল্লা দিয়ে সময় ধরে চলতে হল আমাকে। ভদ্রলোকের মত এগারোটাতে এসে গেছিলাম স্টেশনে। ট্রেন তখন প্ল্যাটফর্মে ছিল না। এই ছোট্ট মেয়েটা ছিল। একা একা বসেছিল।
  চোখে পড়ার মত সুন্দর চেহারা শিশুটার। আমার চোখে পড়ল সেজন্যই। প্রায় পনের মিনিট ধরে পর্যবেক্ষণ করে বুঝলাম, তার সাথে কেউ আসেনি।
  অথবা, এসেছে। কিন্তু আবারও চলে গেছে।
  সবচেয়ে ভয়ংকর সম্ভাবনা, হারিয়ে গেছে বাচ্চাটি। প্রথমে যখন ওকে প্রশ্ন করলাম, আব্বু-আম্মু কোথায় তার - সুন্দর করে হাত নাড়িয়ে একটা ভঙ্গি করল। যেটার অর্থ সবার জানা। “কে জানে কোনদিকে গেল!”
  এখন আমাকে আধঘণ্টা ধরে বাচ্চা সামলাতে হচ্ছে। এর মধ্যে ট্রেন এসে লোড নিতে শুরু করেছে। ওয়াটার ট্যাংক ভরে গেলেই ছুটবে এটা। সোজা সিলেটের পথে। আর মাত্র পনের মিনিট পরই মিস্টার খর্‌রের মত ছুটতে শুরু করবে ট্রেন মহাশয়।
  আমাকে বাচ্চাটা একটা ভাল সমস্যাতে ফেলে দিয়েছে। ট্রেন ছাড়ার সময় সমস্যাটা প্রকটরূপ ধারণ করবে। আমার যে অবস্থাটা হবে, সেটাকে বাংলাতে খুব সুন্দর শব্দগুচ্ছ দিয়ে প্রকাশ করা হয়।
  উভয় সংকট।
  একটু পরে আমি উভয় সংকটে পড়ব।
  কুহেলী জানতে চাইল, ‘তোমাকে এত অস্থির দেখাচ্ছে কেন?’
  আমি ব্যাঙের মত করে হাসলাম। যার অর্থ, ‘না, তেমন কিছু না!’
  মুখে শেষবারের মত চেষ্টা করলাম। কুহেলীর দিকে গভীর দৃষ্টি দিয়ে জানতে চাইলাম, ‘তোমার আব্বু-আম্মু কোথায়? এখানে কার সাথে এসেছ?’
  কুহেলী বলল, ‘মিস্টার খর্‌রের সাথে।’
  রাগ উঠতে থাকল আমার। ট্রেন হুইসল দিচ্ছে। শক্ত গলাতে বললাম, ‘মিস্টার খর্‌রে কোন দিকে গেছে?’
  কুহেলী বলল, ‘ওদিকে।’
  ছোট্ট গর্তটার দিকে আঙুল তুলে দেখাচ্ছে সে। আসলেই প্রচণ্ড রাগ হল এবার। ‘অতটুকু গর্ত গলে বের হয়ে যাওয়া কোন মানুষের পক্ষেই সম্ভব না।’
  সবগুলো দাঁত বের করে হাসল কুহেলী। আমি যেন কোন বোকার মত কথা বলে ফেলেছি! কথাটায় সামান্য একটু ভুল আছে। সবগুলো নয়, সামনের দুটো দাঁত না দেখিয়েই হাসল ছোট্ট মেয়েটা। থাকলে তো দেখাবে!
  বলল, ‘মিস্টার খর্‌রে তো মানুষ না। একটা খরগোশ।’
  ট্রেনের চাকা ততক্ষণে গড়াতে শুরু করেছে। আমার সিদ্ধান্ত আমি নিয়ে ফেলেছি। সিলেট যাত্রা আপাতত চুলোতে যেতে পারে। মেয়েটাকে একটা পুলিশ স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে আসলেই আমার কাজ শেষ। এর বাবা-মা যদি খুব বেশি দুশ্চিন্তা করে (করবে বলে মনে হচ্ছে না। যে বেখেয়ালী বাপ-মা, আগামী দুই-তিন মাসের মধ্যে মেয়ে হারানোর ব্যাপারটাই টের পাবে কি না সন্দেহ!) থাকে, তবে পুলিশ স্টেশনের দিকেই দৌড়াবে তারা। একদম আসল জিনিস, মানে, মেয়েকে ওখানেই পেয়ে যাচ্ছে তখন। খেল খতম, পরের ট্রেনে করে সিলেট যাওয়া নিশ্চিতকরণ।
  ভাবনাটা কাজে লাগানোর সময় পাওয়া গেল না। আচমকা উঠে দৌড় দিয়েছে কুহেলী। আমাকে অবাক করে দিয়ে চলন্ত ট্রেনের দিকে ছুটল সে। প্রতিক্রিয়া দেখানোর জন্য মূল্যবান এক সেকেন্ড নষ্ট করে ফেলেছি, তার মধ্যেই অনেকটা সামনে চলে গেছে ছোট্ট মেয়েটা। তার পেছনে পেছনে তীরের মত ছুটলাম।
  চলন্ত ট্রেনের সাথে ছোট্ট শরীরটা সেঁটে গেল। প্রাণপনে ছুটছি, তারমধ্যেই ইচ্ছে করল চোখ বন্ধ করে ফেলতে।
  মেয়েটার করুণ মৃত্যু দেখতে সায় দিল না মন।
২.
 ‘মাইয়াটাকে জমের মুখে ফালায়া ছুটতাছেন!’ ঘেউ ঘেউ করে উঠল টাক মাথার মানুষটা। ‘কি পাষাণ বাপ রে বাবা। আপনে কি মনে করেন নিজেকে? জন্ম দিলেই বাপ হওয়া যায়না, এটা কি কেউ কইছে আপনার কানের ফুটার পাশে?’
  বিব্রত মুখে একবার বললাম, ‘এর মধ্যে আবার ফুটা-টুটা টানার কি দরকার ভাই।’
মুখটা বিব্রত করার চেয়ে বেশি কিছু করাও গেল না। এই লোকই কুহেলীর পিছলে যাওয়া হাত ধরে সময়মত ট্রেনে তুলে নিয়েছে। প্রায় ছুটন্ত একটা ট্রেনে উঠতে গিয়ে পা হড়কাচ্ছিল আমারও। এই লোকই সেই হাত ধরে আমাকে ওপরে উঠিয়ে এনেছে।
  এরকম পরোপকারী মানুষজন গলার রগ ফুলিয়ে চিল্লাতে পছন্দ করেন। ইনিও তার ব্যতিক্রম নন।
  কানের পোকা দশ বারোটা পড়ে যাওয়ার আগেই কুহেলীর হাত ধরে ফেললাম। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম ফ্যাক ফ্যাক করে হাসছে দুষ্টুটা। নাম-না-জানা লোকটার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘আপনাকে ধন্যবাদ ভাই। এটা কোন বগি?’
  আমার আপাদমস্তক দেখে নিল মানুষটা। তারপর উত্তর দিল, ‘চামচিকার চ।’
  ‘ও।’ বললাম।
  ‘আপনাদের বগি কোনটায়?’
  ‘টাক্কুর ট।’ আয়নার মত চকচক করতে থাকা মাথাটার দিকে তাকিয়ে বললাম।
  তারপর কুহেলীর হাত ধরে আমাদের বগি বরাবর হাঁটতে শুরু করলাম। ফালতু লোকজনের সাথে সময় নষ্ট করে কাজ নেই।
  ‘তোমার বাবা-মা কি এ ট্রেনেই আছে?’ কুহেলীকে প্রশ্ন করলাম।
  ‘না তো!’ আমার মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকাল মেয়েটা, ‘আমি কি তাই বলেছি নাকি?’
  ‘তাহলে উঠে পড়লে কেন এখানে?’
  আবারও গরম চোখে তাকালাম তার দিকে। জরুরী কাজ আছে সিলেটে। আর এই মেয়েটা এখানে আমার সাথে মজা করছে। সিলেট অভিযানের আগে অন্তত ছয় ঘণ্টার বিশ্রাম দরকার ছিল। ভেবেছিলাম ট্রেনে ঘুমিয়ে পুষিয়ে নেব। কাঁধের ওপর সিন্দাবাদের ভূত এসে চাপবে সেটা আমার জানা ছিল নাকি?
  আমার গরম চোখের জবাবে কিছুই বলল না কুহেলী। বরং একদম চুপ হয়ে গেল। বিষয়টা আমাকে আরও রাগিয়ে দিতে থাকে। ঠিক করলাম, এই মেয়েকে সামনের স্টেশনে নামাবোই না। এত ঝামেলা করতে গেলে ওদিকে আরেকটা সর্বনাশ হয়ে যাবে। এর চেয়ে আমার সাথে সিলেটে যাক। সেখান থেকে কর্ম-উদ্ধার করে এসে একে ঢাকাতে বাবা-মার কাছে পৌঁছে দেওয়া যাবে।
  ট-বগিতে এসে আমার টিকেট অনুযায়ী সীটটা পাওয়া গেল। জানালার দিকের সীটটাই আমার। অন্যপাশের সীটে বসে আছে একটা সাধারণ চেহারার মেয়ে। ঠেলেঠুলে কুহেলীকে নিয়ে ঢুকে পড়লাম ভেতরে। সহযাত্রিণী মেয়েটা পা একটু সরিয়ে আমাদের ঢোকার জায়গা করে দিল।
  যা ফিনফিনে ওড়না পরেছে, সবই দেখা যাচ্ছে। ও ব্যাপারে মাথা ঘামালাম না। যার সম্পদ সে বের করে রেখেছে। আমার কি তাতে?
  এমনিতেই কম সমস্যার মধ্যে নেই আমি। কুহেলীর দিকে আরও একবার তাকালাম।
৩.
 মাথাটা বের করে দেখলাম। ব্রাহ্মণবাড়িয়া চলে এসেছি। ট্রেন ছাড়ার পর সময় গেছে এক ঘণ্টার সামান্য বেশি।
  পুরোটা সময় আমি আর কুহেলী তর্ক করেছি। বার বার প্রশ্ন করেছি, সে কিভাবে স্টেশনে এল। বার বারই মিস্টার খর্‌রে যুক্ত উত্তর দিয়েছে সে। শেষে আর সহ্য করতে না পেরে ধমক দিয়েছি। জবাবে ও আমাকে বলেছে, ‘বো-ও-ও-উপ!’
  এতটা যুক্তিযুক্ত ঝগড়ার পর আর কথা চলে না। দুইজন দুইদিকে তাকিয়ে গাল ফুলিয়ে বসে থাকলাম। তাকাবে আর কোথায়? বসেই আছে আমার কোলে। কোনমতে জানালার বাইরে চোখ ফিরিয়ে রাখল পিচ্চিটা।
  আজমপুর রেইলওয়ে স্টেশনে ট্রেন পৌঁছানোর আগেই ঘুমিয়ে কাঁদা হয়ে গেল। আমার ডান হাতের ওপর মুখ রেখে ঘুমাচ্ছে কুহেলী, ভীষণ মায়া হল একটু আগে ওকে বকার জন্য। পরমুহূর্তেই নিজেকে চোখ রাঙালাম। মানুষের বাচ্চা না শুধু, মায় কুকুরের বাচ্চা পর্যন্ত সুন্দর হয়ে দেখতে। তাই বলে ‘আপদ’কে আপদ হিসেবে চিনতে পারা হল বুদ্ধিমানের কাজ।
  কয়েক বছর আগেও আজমপুর রেলস্টেশনটা জং পড়া টিন দিয়ে ঢাকা একটা ছোট্ট রেলওয়ে স্টেশন ছিল। এখনও টিন টিনের জায়গাতেই আছে। তবে আগের মত জীর্ণ দেখা গেল না তাদের। শেষ এখান দিয়ে গেছিলাম অধরার সাথে ল্যাপ্টালেপ্টি করে বসে।
  সিলেট শহরটা খুব কনজারভেটিভ মাইন্ডের মানুষজনের শহর। প্রেম-ট্রেম করে ওখানে শান্তি পাবেন না কেউ। হা হা করে উঠবে এলাকাবাসী। চুমু খেতে গেলে আপনাকে শত দোররা মেরে শহর থেকে বের করেও দেওয়া হতে পারে। হাত ধরে ঘুরলে শাস্তি কম হলেও হতে পারে। পঞ্চাশ দোররা।
  কাজেই আমরা প্রেম যা করার ট্রেনেই করতাম। মানে ল্যাপ্টালেপ্টি আর কি। পাবলিক প্লেসেই বা কতটুকু করা যায়? গতবার অবশ্য একটা সুবিধে ছিল। শীতকাল চলছিল। শীতকালে মানুষ শরীরে চাদর চাপায়, আমরা চাপিয়েছিলাম কম্বল। তারপর কম্বলের নিচে আমাদের হাত চারটা...
  ‘তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে অনেকদিন ঘুমাও না। একটু ঘুমিয়ে নাও তো।’
  কানের কাছ থেকে আচমকা এই শব্দটা ভেসে আসলে যে কেউ চমকে উঠবে। আমিও উঠলাম। ভাবনার সূতো ছিঁড়ে গেল। কুহেলী এখনও ঘুমাচ্ছে, আমার উদ্দেশ্যে বাক্যদুটো ছূঁড়ে দিয়েছে পাশে বসা সহযাত্রিণী মেয়েটি।
  ‘আমাকে কিছু বললেন?’ মেয়েটার কানের ফুটোয় ইয়ারফোন খুঁজতে খুঁজতে জানতে চাইলাম।
  ‘কি আশ্চর্য! আজ আমাকে আপনি করে বলছ কেন?’ চোখ কপালে তুলে ফেলল অদ্ভুত মেয়েটা।
  আমি হা করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। ট্রেনে ওঠার সময় মনে হয়েছিল এই মেয়েটা খুবই সাধারণ চেহারার কেউ। এখন সেরকমটা লাগছে না। হাল্কা গোলাপী চামড়া তার, কেমন যেন পিকসআর্ট অ্যাপ দিয়ে ফেস কারেকশন করে আনার মত। তবে দেখাচ্ছে বেশ।
  সরু চোখদুটোর মধ্যে মণিটা পরিষ্কার। নাকটা মোটামুটি খাড়া, সেই সাথে টসটসে ঠোঁটদুটোতে রাজ্যের কামুক পুরুষ না তাকিয়ে পারবে না। সব কিছু ছাড়িয়ে গেল মেয়েটির চুল। অদ্ভুত কোকড়া। প্লাস বাদামী বাদামী একটা ভাব আছে।
  মেয়েটির টসটসে ঠোঁট বাঁকা হতে শুরু করেছে। হাসল। তারপর আমাকে আরেকদফা চমকে দিয়ে কপালে, গালে হাত বুলিয়ে দিল ট্রেন ভর্তি মানুষের সামনে।
  ‘কি হল তোমার? শরীর খারাপ করছে? দাও, কুহেলীকে আমার কোলে দাও।’
  বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম। ‘কুহেলী আপনার কে হয়?’
  ‘কি হল তোমার? নিজের মেয়েকে চিনতে পারছ না? তাকাও তো, আমার দিকে তাকাও।’
  আমার কান ততক্ষণে গরম হতে শুরু করেছে। ‘কুহেলী আমার মেয়ে না।’
  ‘আর আমিও নিশ্চয় তোমার বউ না?’ মুখ টিপে হাসল মেয়েটা, ‘মেয়ে একটু জেদ করেছে তাই এত রেগে গেছ? আমার কোলে দাও ওকে।’
  এবার ট্রেনের আর সবার প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করলাম। আমার আর কুহেলীর বাদ-অনুবাদের কথা তাদের কানে যাচ্ছিল। ভ্রু অনেকগুলোই কুঞ্ছিত হয়েছে। এখন কুঞ্চিত ভ্রুর সংখ্যা আরও বেশি। মোটাসোটা পেশিবহুল এক লোক দূর থেকেই মেয়েটাকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘কি ব্যাপার ম্যাডাম? কোন সমস্যা?’
  এটা হল বাংলাদেশেরই সমস্যা। ‘ম্যাডাম’দের সমস্যা দেখার জন্য একশ’ একটা লোক থাকে। ‘ম্যাডাম’ সুন্দরী হলে তো কথাই নেই। আর বলতেই হচ্ছে, এই মেয়েটির মধ্যে অন্যরকম একটা রূপ আছে। তবে আমার জন্য সৌভাগ্য, ম্যাডাম ঝলমলে একটা হাসি উপহার দিয়েছে।
  ‘না, ভাই। কোন সমস্যা না।’
  আমি মুখ গোমড়া করে বসে থাকলাম। জীবনে বিয়ে করেছি বলে মনে করতে পারি না। বরং বিয়ে ঠেকাতে যাচ্ছি। অধরা আমার প্রেমিকা। ঘরের মধ্যে উথলানো প্রেম করে ফেলা প্রেমিকা। তাকে রেখে এই বদমাশ মহিলাকে আমি কোনদিনও বিয়ে করিনি। আমার স্মৃতিশক্তি আর যতই খারাপ হোক, এতটা না।
  তাছাড়া, এমন কোন কাণ্ড আমি কোন মেয়ের সাথে করব যাতে কুহেলীর মত একটা মেয়ে পয়দা হয়ে যাবে। আর সেই স্মৃতি আমার মনে থাকবে না? তা কি করে সম্ভব?
  আমার গলাটা যথাসম্ভব সিরিয়াস হয়ে গেল, ‘আমি সত্যিই আপনাকে চিনি না। কুহেলীকে কি আপনি চেনেন? চিনলে আমাকে মেয়েটার একটা গতি করতে সাহায্য করবেন, প্লিজ। আপনি ওর বাবা-মাকে চেনেন?’
  মেয়েটা কোন কথা না বলে কুহেলীকে জড়িয়ে ধরে নিজের কোলে নিয়ে বসালো। ঘুমের ঘোরে মেয়েটা একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলল মাত্র। ভাল করে দেখলাম ওদের। কুহেলীর চেহারার সাথে মেয়েটার কোন মিলই নেই। মিল নেই আমার সাথেও। জিনতত্ত্ব এখন মনে হয় জ্বিনতত্ত্বে রূপান্তরিত হতে যাচ্ছে।
  আমার মনের কথা টের পেয়ে গেল মনে হয় অচেনা মেয়েটি। নিচু গলাতে আমাকে বলল, ‘মেয়েটার সাথে আপনার সব কথা বার্তাই আমি শুনেছি। এই মেয়ের বাবা আপনি না। ট্রেনের লোকজন কথাটা জানলে মেরে শেষ করে দেবে আপনাকে। বিশ্বাস না হলে পরীক্ষা করে দেখতে পারেন।’
  আমার বিশ্বাস হল। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলাম অদ্ভুত এই মেয়েটার দিকে। শেষ পর্যন্ত একটা কন-গার্লের পাল্লাতে পড়লাম? এত থাকতে একটা কন-গার্লের পাল্লায়?
  মেয়েটার ভ্রুক্ষেপই নেই আমার দিকে। নিচু গলাতে বলে যাচ্ছে, ‘সিলেটে আপনি এই বাচ্চাকে বর্ডার ক্রস করে চালান করে দিতেই যাচ্ছেন কি না জানি না। আমার জানার ইচ্ছেও নেই। যদি মাঝপথে পুলিশের ধরা খেতে না চান তাহলে আমার কথা মত চলুন। একটা আদেশ অমান্য করবেন তো চেঁচিয়ে পৃথিবীবাসীকে জানিয়ে দিচ্ছি এই বাচ্চা আপনার না!’
  আমি কিছু না বলে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকলাম।
  প্রথমবারের মত সিলেটে যাচ্ছি। সাথে দুই দুটো অনাকাঙ্খিত ‘মেয়েলোক’।
  এক বাবা-মা হারানো বাচ্চা। আরেক কন-গার্ল।
  ফাক!
৪.
 সীট থেকে বের হতে যাচ্ছি, অদ্ভুত মেয়েটা মুচকি হেসে পা সরিয়ে আমাকে জায়গা করে দিল। ওর দিকে একবারও না তাকিয়ে দরজার দিকে হেঁটে গেলাম।
  সিগারেট খেতে হবে। এরকম একটা গ্যাড়াকলে পড়ে যাওয়ার পরও সিগারেট যে খাবে না সে আসলেই মহাপুরুষ। আমি মহাপুরুষ ছিলাম না। দরজার কাছে এসে একটা সিগারেট ধরালাম।
  বাইরে সাঁ সাঁ করে ছুটে যাচ্ছে মাঠঘাট প্রান্তর। দরজার কাছে চার পাঁচজন মানুষ বসে আছে। এদের সম্ভবতঃ টিকেট নেই। একজনকে দেখা গেল লুঙির ওপর দিয়েই যত্রতত্র চুলকাতে। চুলকানি দেখতে দেখতে সিগারেট টানতে থাকলাম। পরিস্থিতি বিবেচনা করছি।
  আমি এখন চাইলেই পালিয়ে যেতে পারি। পরের স্টপেজেই লাফিয়ে নেমে একদিকে ভোঁদৌড় দিতে পারি আমি। কাঁধের একটা ব্যাগ নিয়ে উঠেছিলাম। ওটা আছে আমার সীটের ওপরের র‍্যাকে। উদ্ধার করা কোন ব্যাপারই না। চুলকানি বিশারদ লোকটাকে একশ’টা টাকা ধরিয়ে একটা বানোয়াট কাহিনী শুনিয়ে পাঠালেই ব্যাগ এনে দেবে।
  কিন্তু আমি পালাতে পারলাম না। দুটো কারণে।
এক. কুহেলী এখনও প্রতারক মহিলাটার কাছে আছে। আমি এদিক দিয়ে পালিয়ে গেলে মেয়েটাকে স্রেফ পথে ছুঁড়ে ফেলে দেবে মহিলা। কপাল আরও খারাপ হলে, বর্ডারের কাছে কোন পরিচিত দালালের কাছে বিক্রি করেও দিতে পারে।
দুই. আমাকে আজকেই সিলেটে পৌঁছাতে হবে। তানাহলে অধরা পানিতে পড়বে। গভীর পানিতে পড়ার পর আর ওর ওঠা লাগবে না। সুফী পরিবারের ছেলের সাথে বিয়ে হয়ে যাবে মেয়েটার।
  বাটপার মহিলা মনে হয় না দ্বিতীয় কারণটা জানে। সে শুধু কুহেলীকে ধরে থেকেই নিশ্চিন্ত হয়ে আছে, আমি ফিরব। সীটে ফিরে যেতেই হবে আমাকে। তানাহলে আটকে রাখত সীটে। আসলে, কুহেলীর সাথে সীটে বসে বাবা-মার পরিচয় জানার চেষ্টা করাই উচিত হয়নি।
  আরেকটা প্রশ্ন এবার আমাকে ঠাণ্ডা করে দিল।
  মহিলা আমার কাছে চায়টা কি?
  সিলেটে নামার পর আমাকে ছেড়ে দেবে না এই মেয়ে। আমাকে আর কুহেলীকে আটকে রেখে কি উদ্ধার করতে চাচ্ছে মেয়েটা?
  ‘টাক্কুকে একটা টান দিতে দ্যান, বস, গুরুদেব!’
  বিনীত কণ্ঠটা শোনা গেল পাশ থেকে। তাকিয়ে টাক্কুকে দেখতে পেলাম। ওই বগি থেকে এই বগিতে এসে জুটেছে এখন। এজাতীয় লোকজনের পকেটে টিকেট থাকে না। সম্ভবতঃ টিকেট চেকারের তাড়া খেয়ে ট্রেনময় ঘুরে বেড়াচ্ছে। খোলা দরজার দক্ষিণা বাতাসে বসে বসে পা দোলাচ্ছে বাইরের দিকে। ট্রেনে ওঠার সময় এই লোকই আমাকে আর কুহেলীকে তুলে নিয়েছিল। অর্থাৎ আকামটা এই ভদ্রমহোদয়েরই করা। আমাদের ট্রেনে না তুলে আনলেই দিব্যি কমলাপুর স্টেশনে থেকে যেতাম। পুলিশের কাছে বাচ্চাটাকে ফিরিয়ে দেওয়া যেত। এখন আর উপায় কি?
  অন্য কোন সময় হলে শালাকে ধাক্কা দিয়ে ট্রেন থেকে ফেলে দিতাম। একে তো ফেলেছে মহা গাড্ডায়, তায় আবার সিগারেটে একটা টান চাচ্ছে! তবে, বিপদে পড়লে মানুষের মধ্যে দানশীল ভাব প্রবল হয়ে ওঠে। সিগারেটটা ওকে দিলাম না। বরং প্যাকেট থেকে একটা বের করে ধরিয়ে দিলাম। ‘
  ‘ধইন্যবাদ।’ ফস করে আগুন ধরিয়ে ফেলল লোকটা।
  ‘নাম কি আপনার ভাই?’ জানতে চাইলাম।
  ‘সুরুয মিয়া। আপনের?’
  ‘জোসেফ ক্রাইস্ট।’
  হাত থেকে বিড়ি পড়ে যাওয়ার যোগাড় হল সুরুয মিয়ার, ‘আপনে খিরিসটান?’
  ঠোঁট বাঁকালাম, ‘কেন? খ্রিস্টানের দেওয়া সিগারেট খান না নাকি?’
  ‘সেরকম কিছু না, সার। সেরকম কিছু না। খিরিসটান মানুষ আগে দেখি নাই তো, তাই।’
  ‘এখন দেখলেন।’ চাপা গলাতে বললাম, ‘শুনুন, আপনাকে টাকা দিলে একটা লাশ নামায় দিতে পারবেন?’
  সুরুয মিয়ার কুঁতকুঁতে চোখ আরও কুঁতকুঁতে হয়ে গেল। হঠাৎ করেই সমস্ত আগ্রহ চলে গেল যেন তার মধ্য থেকে। শক্ত মুখে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকল মানুষটা।
  ‘পারবেন কি না বলেন? দশ হাজার টাকা পাবেন।’
  ‘আমাকে দেইখা কি আপনের ভাড়াটে খুনী লাগে?’ চাপা গলাতেই উত্তর দিল লোকটা।
  ‘না হলে কি? হবেন। আচ্ছা যান, বিশ হাজার টাকা দিবো। খুনটা করে দিতে হবে।’
  চোখ মুখ কুঁচকে গেছে সুরুয মিয়ার। আমার চোখে চোখ রেখে বলল, ‘আর কাওকে দেখেন। আমি এসব কাজ করি না।’
  বুঝলাম, আমাকেই পুলিশ মনে করছে সে। ভয়ে চিমসে আছে। তবে তার ‘না’ বলার মধ্যে তেমন জোর করলাম না। আমার ধারণা হয়ত সত্য, আগেও দু একটা লাশ ফেলার অভিজ্ঞতা এই লোকের আছে। চোখের দৃষ্টিই তেমনটা বলে দিচ্ছে।
  কুহেলীর কাছে ফিরে গিয়ে দেখলাম জেগে গেছে মেয়েটা। শয়তানীটার সাথে খেলছে। গোলাপী গালের সুন্দরী মেয়েটা দারুণ পটিয়ে ফেলেছে কুহেলীকে। আমাকে আসতে দেখে একটু সরে বসল ও। ভেতরে ঢুকে গেলাম সুন্দর করে।
  ‘আব্বাজি এসে গেছে। আব্বাজির কোলে যাবে তুমি?’ ঠগটা জানতে চাইল বাচ্চা মেয়েটার কাছে।
  কি আশ্চর্য! কুহেলী মাথা দোলাচ্ছে। আমার কোলে চলে এল তারপর। অবলীলায়!
  শয়তানি হাসিতে ভরে আছে ঠগটার মুখ। ওর চালটা স্পষ্ট বুঝতে পারলাম। এরকম ঝাঁ চকচকে পোশাক পরে থাকা মেয়েটা তার বাবা-মাকে ‘ড্যাডি-মাম্মি’ বলেই ডাকে হয়ত। খুব বেশি হলে ‘বাবা-মা’ পর্যন্ত বোঝে সে। ‘আব্বাজি-আম্মাজি’ বলে বাবা-মাকে ছোট্ট মেয়েটা ডাকে না।
  এই সুযোগটা নিয়ে শয়তান মহিলা আমার আর তার পরিচয়টা ওরকম দিয়ে দিয়েছে। কুহেলীও মেনে নিয়েছে।
  আমাকে বলল, ‘আম্মাজি বলেছে, তুমি শুধু সবকিছু ভুলে যাও। তুমি কি ক্যারোট খাও?’
  আম্মাজি! রাগে আমার সারা শরীর পিল পিল করে উঠল। বললাম, ‘না।’
  ‘খাবে তুমি। বেশি করে ক্যারোট খেলে সবকিছু মনে থাকে। মিস্টার খর্‌রে খায়।’
  কিছু বললাম না। ট্রেন হুরমুর করে সিলেটের দিকে ছুটে চলেছে। তারপর আমার আর কুহেলীর কপালে কি আছে খোদা ছাড়া আর কেউ জানে না।
  ‘আব্বাজি?’
  বিরক্তিতে আমার ভ্রু কুঁচকে গেল।
  কুহেলী আবারও ডাকছে, ‘ও আব্বাজি!’
  ফাক!
৫.
 ট্রেন থেকে নামার পর থেকেই খুব গা ঘেঁষে হাঁটা শুরু করেছে রহস্যময়ী মেয়েটা। আমার এক হাত ধরে হাঁটছে কুহেলী। বাম হাতে মাঝে মাঝেই প্রতারক মেয়েটার বুকের ছোঁয়া পাচ্ছি। রীতিমত নির্লজ্জ একটা ভঙ্গিতে হাঁটছে মেয়ে। সাথে একটা বাচ্চা থাকায় বাঁচোয়া। নাহলে সিলেটী লোকজন এসব নিয়ে যা সেনসিটিভ, একেবারে লাশ ফেলে দিত!
  ‘আমার নাম কণিকা।’ কানের কাছে ফিসফিস করে বলল মেয়েটা, ‘তোমার?’
  ‘কণিকা নিশ্চয় আপনার আসল নাম না?’
  ‘তাতে কিছু আসে যায় না। তোমার নামটা বল।’
  ‘জোসেফ। জোসেফ ক্রিস্টোফার।’
  ‘সেক্সি।’
  কণিকা হোক আর যাই হোক, শালীর গালে একটা রাম-থাপ্পর হাঁকড়ে দেওয়ার জন্য আমার হাত নিশপিশ করতে থাকে। চোখ গরম করে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হাঁটছি, কেউ একজন পেছনের পকেট স্পর্শ করল ভীরের মধ্যে। অসামান্য রিফ্লেক্সের বশে হাত দিলাম ব্যাকপকেটে। মানিব্যাগ উধাও হয়ে যাওয়ার জন্য রেইলওয়ে স্টেশনের চেয়ে নিখুঁততম জায়গা আর হয় না।
  না, মানিব্যাগ ঠিক আছে। সেই সাথে খচ খচ করে উঠল। একটা কাগজ ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে কেউ।
  বের করে আনলাম। কুহেলীর হাত ছেড়ে দিয়েছি। ছোট্ট একটা কাগজ। মেসেজটা স্পষ্ট।
  লাশ ফালানো লাগলে এই নাম্বারে ফোন দেবেন।
  
  ট-বগি।
  হারামজাদা দেখছি আসলেই ভাড়ায় খুন করে দেখছি। আড়চোখে কণিকার দিকে তাকালাম। সিন্দাবাদের ভূত এমনি কাঁধ থেকে নামে না। প্রয়োজনে পা ধরে টেনে নামাতে হবে তাকে।
৬.
 এয়ারপোর্টের কাছাকাছি একটা হোটেলে উঠেছি আমরা। সুন্দর 'ফ্যামিলি-হাসি' মুখে ধরে হোটেল ডেস্কে গিয়ে দাঁড়াতে দায়িত্বরত কর্মচারীদের একজন আমাদের দিকে তাকিয়েছিল। তারপর সুন্দর করে হেসেছিল সে-ও। কিছুটা সন্দেহের আভা তার চোখে ঠিকই ফুটে ছিল তখনও। তিনজনের চেহারা তিনরকম হলে এরকম ভাবে যে কেউ তাকাবে!
  ঠিক তখনই কুহেলী আমার কোলে লাফিয়ে উঠে বলেছিল, ‘আব্বাজি, ওই তো মিস্টার খর্‌রে!’
  হোটেল লবিতে ঝোলানো প্রমাণ সাইজের খরগোশটাকে দেখে মুচকি হেসেছিলাম আমরা। মুচকি হেসেছিল কর্মচারীও। রুম দিয়ে দিল।
  হোটেলের ঘরগুলো চমৎকার। বারান্দা দিয়ে দূরের প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখা যায়। বাথরুমগুলো আরব শেখের জন্য বানানো হয়েছিল মনে হচ্ছে। কুহেলী হাতমুখ ধুতে চলে গেল ওদিকে। কণিকা টেলিভিশন ছেড়েছে। আমার দিকে ঘুরে বলল, ‘দশ হাজার টাকা দাও তো।’
  শার্ট পাল্টাচ্ছিলাম আমি, তাকালামও না তার দিকে। সিন্দাবাদের ভূত ঘাড়ে নিয়ে চলা যায়, সেটার মুখে একটু পর পর টাকা গুঁজে দেওয়া যায় না। হোটেল ভাড়া করতে প্রচুর খরচ হচ্ছে, এটা আমি করতামও। তবে অধরা আর আমার থাকার জন্য। কোন কণিকা বা কুহেলীর জায়গা সেখানে থাকার কথা ছিল না।
  ‘কথা কানে যাচ্ছে তোমার? দশ হাজার টাকা দাও। শপিংয়ে যাব। সিলেট ঘুরব।’
  ‘নিজের টাকায়-’ সোজাসুজি বলতে চাইছিলাম, তবে কথাটা গলার মাঝে আটকে গেল। টিভিতে চোখ পড়েছে। ওখানে ফুটে উঠেছে কুহেলীর মুখ। টুকটুকে লাল জামা পরে আছে মেয়েটা, বুকে চেপে রেখেছে একটা স্টাফড খরগোশ। মিস্টার খর্‌রে।
  ‘কোটিপতির মেয়ে। টর্চ লাগিয়ে খুঁজছে।’ সাউন্ড মিউট করে দিয়ে বলল কণিকা, টিভিতে এখন কুহেলীর বাবাকে দেখা যাচ্ছে। আবেগী গলাতে কিছু একটা বলছেন তিনি। কি বলছেন শুনতে গেলে বাথরুমে থাকা মেয়েটার কানে ‘ড্যাডি’র গলা চলে যেতে পারে।
  ‘পুলিশ হন্যে হয়ে আছে মেয়েটাকে বের করার জন্য। আর তুমি-’ ধীরে ধীরে আমার কাছে এসে দাঁড়াল কণিকা, ‘তুমি, মাই ডিয়ার জোসেফ, বাচ্চাটাকে নিয়ে সিলেটে কেটে পড়েছ। বর্ডার খুব একটা দূরে না এখান থেকে। কিডন্যাপারদের কয়েকটা পকেট আছে সীমান্তের কাছে। বাচ্চাটাসহ ধরা পড়লে কি হবে তা কি বুঝতে পারছ?’
  আমি এখনও কিছু বলছি না। প্রচণ্ড ভয় স্নায়ুগুলোকে দুর্বল করে দিয়েছে।
  বাথরুম থেকে কুহেলী বের হয়ে আসছে, চট করে চ্যানেলটা পাল্টে দিল কণিকা।
  আরও কাছে আসল আমার, ‘কই? দশ হাজার টাকা দাও? হোটেলের নিচে এটিএম বুথ আছে বেশ কয়েকটা। চাইলে ব্যবহার করতে পারো। আমি আর কুহেলী আজ সারা শহর ঘুরে দেখব।’
  ঢোক গেলার চেষ্টা করলাম। ফেঁসে গেছি। বড় ধরণের একটা ঝামেলাতে ফেঁসে গেছি। কেউ এখন আর বিশ্বাস করবে না আমার কথা। সবার প্রশ্ন একটাই থাকবে। এত সাধু মতলবই যদি আমার থাকবে তো কুহেলীকে নিয়ে আমি সিলেটে কি করছি?
  ‘আব্বাজি আমাদের সাথে ঘুরবে না?’
  ভেজা মুখ নিয়ে চোখ পিটপিট করছে ছোট্ট মেয়েটা। এক হাতে গাল ঘষছে। কালো চুলগুলো কি সুন্দর করে যে ভিজিয়েছে, একটু ভেজা একটু শুকনো। কুহেলীর দিকে তাকিয়ে আমার রাগ আর আতঙ্ক পড়ে যায়।
  ‘না। আব্বাজির কাজ আছে। আমি আর তুমি ঘুরব শুধু।’ আমার কাঁধে টোকা দিল কণিকা।
  ফোনটা বাজছে। টেবিলের ওপর থেকে তুলে নিলাম ওটা।
  অধরা।
  কানে ঠেকালাম, ‘হ্যালো।’
  ‘জোসেফ, কোথায় তুমি? সন্ধ্যার পর আমাকে আর বের হতে দেবে না ওরা। সারাদিনে কতবার ফোন করেছি! কোথায়   থাকো তুমি? আশ্চর্য!’
  কোথায় দেখা করব সেটা ঠিক করলাম। সিলেটে আমি ডাঙুলি খেলতে আসিনি।
  পুরোটা সময় কণিকা আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। তারপর কুহেলীর জামাকাপড় ঠিক করে দিল যতদূর করা যায়। নিজের ব্যাগ থেকে গোলাপী রঙের একটা শাড়ি বের করে বাথরুমে ঢুকে গেল। একটু পর আমরা সবাই একসাথে নেমে যাবো। বুথ থেকে টাকা তুলে দশ হাজার দিতে হবে কণিকাকে। তারপর আমরা দুই বাহিনী দুইদিকে ছুটব।
  বাথরুম থেকে গোলাপী শাড়ি পরে বের হয়ে আসল কণিকা। ওর ওপর থেকে চোখ সরাতে বেশ কষ্ট করতে হল। শরীরে কি সম্পদ নিয়ে যে ঘুরছে মেয়েটা! পুরোটা ব্যবহার করছে সম্ভবতঃ মানুষকে ঠকিয়ে পেট চালানোর জন্য।
  ‘তোমার মোবাইল নম্বরটা আমাকে দাও তো।’ কণিকাকে বললাম।
৭.
 কুহেলীকে মেয়ে-শয়তানটার সাথে ছেড়ে দিতে আমার দুশ্চিন্তা খুব একটা হল না। বড়লোক বাবার একমাত্র ছেলে আমি, নিজের আয়-ইনকামও ভাল - এসব বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা না কণিকার। কুহেলীকে বিক্রি করে দিয়ে যত টাকা পেতে পারে, তার চেয়ে বেশি পাবে আমাকে ব্ল্যাকমেইল করে। কুহেলীকে সাথে করে কেন নিয়ে গেছে তাও আমার জানা আছে। বাচ্চা মেয়েটাই ওর ইন্সুরেন্স।
  ছোট মেয়েটার প্রতি আমার একটা সফট কর্নার জন্মেছে। সেটা দেখতে না পাওয়ার মত বোকা এই মেয়েটা নয়। ওকে জিম্মি করেছে ডাইনীটা, আমাকে যাতে ফিরে আসতেই হয়। রাগে আমার শরীর থরথর করে কাঁপতে থাকল। রাস্তাতেই একটা সিগারেট ধরালাম।
  শাইনিং বার্ড রেস্তোঁরার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। আনকমন নাম নাকি এর লো প্রোফাইলের কারণে, কে জানে, অধরা আমাকে এখানেই আসতে বলেছে। আমিও লাফাতে লাফাতে চলে এসেছি। অধরাকে আজ অনেকদিন পরে দেখব। মনটা খুশি হয়ে থাকা উচিত ছিল, কিন্তু হয়েছে উল্টোটা। উৎকট দুই আপদ কাঁধে নিয়ে হাসিমুখে প্রেম করা যায় না।
  রিকশাটা এসে থেমে গেল আমার সামনে। বোরখা পরা একটা মেয়ে নেমে আসল। ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসে অধরা, ‘কতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছো তুমি?’
  ‘বেশিক্ষণ না। চলো ঢুকি।’
  ভেতরে নিচতলাটা সুন্দর। বিশটার মত টেবিল আছে। প্রতিটাতেই লোক আছে। কোণের একটা টেবিল খালি পাওয়া গেল। সেদিকে চললাম আমরা। একেবারে টেবিলে বসার আগ পর্যন্ত মুখের নেকাব সরালো না অধরা। বসল রেস্তোঁরার দরজার দিকে পিঠ দিয়ে। তারপর নেকাব সরিয়ে আমার চোখে চোখে তাকাল।
  তিন মাস পরে অধরার গোলাপফুলের মত সুন্দর মুখটা দেখতে পেলাম। আলতো করে ওর হাত নিজের হাতে তুলে নিলাম টেবিলের ওপর দিয়ে। এ কয়দিনে আরও সুন্দর হয়েছে মেয়েটা। স্বাস্থ্য ভাল হয়েছে।
  ‘তোমাকে পাগলের মত মিস করেছি আমি।’ নিচু কণ্ঠে বলল অধরা, ‘শুকিয়ে গেছ আগের চেয়ে।’
  মুচকি হাসলাম। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে নতুন জয়েন করার পর গলদঘর্ম সবাই-ই কমে বেশি হয়। ও আর নতুন কোন কথা না। আলতো চাপ দিলাম ওর হাতে।
  ‘তোমাকেও। বাসার খবর বল। বিয়ের আয়োজন কি করে করে ফেলল ওরা এত দ্রুত?’
  বিষণ্নতায় ছেয়ে গেল অধরার সুন্দর মুখে, ‘দ্রুত আর কোথায়। দুই মাস ধরেই নাকি কথা বার্তা চলছে। দরগাহ কমিটির মেম্বারদের মেয়ের বিয়ে এত হুটহাট করে হয় না। তবে আমাকে জানিয়েছে মোটে গতপরশু।’
  ‘তারমানে, তোমাকে প্রশ্ন করার দরকারও মনে করেনি ওরা?’
  ‘না। দরগাহ কমিটির মেম্বাররা মেয়েদের বিয়ের মতামত নেওয়ার ধার ধারে না। কখনও ধারেনি। এমনটাই চলে এসেছে সব সময়।’
  অসহায় লাগল নিজেকে, ‘কাম অন! তুমি ঢাকা মেডিকেল কলেজের একজন স্টুডেন্ট। একজন এমবিবিএস হয়েও যদি এমন কথা বল তাহলে কিভাবে হবে? তোমার নিজের কোন সিদ্ধান্ত নেই নাকি?’
  চারপাশে তাকাল অধরা, ‘এটা সিলেট। আমার সিদ্ধান্তের মূল্য এখানে নেই। তাছাড়া বিয়ের কথা বার্তা চূড়ান্ত করেই আমাকে জানিয়েছে ওরা। আমার কিছু করার ছিল না। ভয়ঙ্কর লোক আমার বাবা। তোমার কোন ধারণাই নেই আমি প্রেম করছিলাম জানতে পারলে তিনি কি করবেন!’
  ওয়েইটার আসল। দ্রুত মেনুতে চোখ বোলালাম আমরা। তারপর দায়সারা ভাবে কিছু একটা আনতে বলে দিলাম। কত নম্বর আইটেম বা তার মধ্যে কি ছিল খুব একটা খেয়াল করার প্রয়োজন মনে করলাম না কেউ। এখন ওসবের খুব একটা গুরুত্ব নেই।
  ‘পালাতে পারবে কি না বল?’ মরিয়া শোনাল এবার আমার গলা।
  ‘তা পারব। তবে এক দফাতে পালাতে হবে। কোন কারণে যদি একবার সন্দেহ করে ফেলে, আর পালানোর প্রশ্নই আসবে না।’
  একটু চিন্তা করলাম। তারপর বললাম, ‘একটা কাজ কর। এখনই পালাও আমার সাথে। গিয়ে কোন হোটেলে উঠে পড়ব। তারপর এখান থেকে সোজা ঢাকা। আবারও তুমি ও বাড়িতে ঢুকলে আর বের হতে পারবে কি না কে জানে।’
  মুচকি হাসল অধরা, ‘পারব। তুমি ভেবো না তো। আগামীকাল সিলেটেই আছো না? তাহলেই চলবে।’
  ‘আজকে পালাতে তোমার কি সমস্যা?’ কঠোর শোনাল কি আমার গলা?
  হাসিটা মিইয়ে গেল অধরার মুখ থেকে, ‘আমি আসলে মেন্টালি প্রিপেয়ারড না। পালানোর ব্যাপারটা নিয়ে বলছি না। পালাব বলেই তোমাকে ডেকে এনেছি আমি। কিন্তু আজকেই পালাব তা তো জানতাম না। আম্মুকে শেষবারের মত দেখব না একবার?’
  প্রথমবারের মত মেয়েটার কষ্ট আমাকে ছুঁয়ে গেল। আমার সাথে থাকার জন্য পরিবারকে সম্পূর্ণ ত্যাগ করতে হচ্ছে ওকে। ভাই বোনগুলোকে আর কোনদিনও দেখতে পারবে না ও। মা-বাবাকেও না। এ যেন অন্য কোন জগতে অনির্দিষ্ট কালের জন্য যাত্রা করা।
  আরও একবার ওর হাতে চাপ দিলাম, ‘বেশ। আগামীকালই পালাচ্ছি আমরা। আজকে না।’
৮.
 খেয়েদেয়ে বের হয়ে আসতেই শীতল হাওয়া আমাদের শরীর জুড়িয়ে দিল। একটু দূরত্ব রেখে হাঁটছে অধরা। আপাদমস্তক বোরখাতে ঢাকা। বাবার প্রচণ্ড প্রভাব এখানে। কেউ চেহারা দেখে ফেললে আমাদের খবর হয়ে যাবে। বিশেষ করে আমার।
  আড়চোখে ওর দিকে কয়েকবার তাকালাম। ঢাকাতে আমাদের একসাথে কাটানো সময়গুলো মনে পড়ে যাচ্ছে। মনে পড়ে যাচ্ছে আগের সব ‘ল্যাপ্টালেপ্টি’র কথা। মেয়েটাকে এতদিন পর দেখতে পেলাম, তারপর আবারও ছেড়ে দিতে হবে বাঘের গুহাতে? মন মেনে নিতে চাইছে না। সাময়িকভাবে কুহেলী-কণিকার কথা মাথা থেকে মুছেই গেছে আমার।
  ‘অধরা।’ ডাকলাম।
  ‘হুঁ?’
  ‘বাড়ি ফিরে যাওয়ার তাড়া আছে তোমার?’
  হাত একটু বের করে এনে হাত ঘড়ি দেখল ও, ‘আরও এক ঘণ্টা তো থাকতে পারব। কেন?’
  ‘আমার হোটেলে চল।’
  কালো কাপড়ে ঢাকা মাথাটা আমার দিকে ঘুরে গেল, ‘গিয়ে?’
  ‘মানে, দারুণ একটা ঘর ওটা। চমৎকার অ্যাটাচড বাথরুম। আর একটা তুলতুলে নরম ডাবল বেড।’
  কাঁচ ভাঙ্গা শব্দ করে হাসল অধরা, ‘ওটাতে আমাকে নিয়ে উঠতে চাইছ তো?’
  ‘বুদ্ধিমতী মেয়েদের ওপর একটু ইয়ে ছিল বলেই না তোমার প্রেমে পড়েছি।’ চোখ টিপলাম, ‘যাওয়ার সময় কোন একটা ফার্মেসীতে থেমে যাব। প্রিপারেশন আমিও নিয়ে আসিনি।’
  আরেকবার হাতঘড়ি দেখল ও, তারপর সরে এল আমার দিকে। লাজুক কণ্ঠে বলল, ‘চল।’
  মেডিকেল কলেজে ও পড়ত, আমি পড়তাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রেমের সূত্রপাত সেখানেই। একবার আমাদের দুই হলে ঝামেলা বেঁধে গেল। বন্ধু হামিদ মাথাতে ছোট কিন্তু গভীর একটা ফুটো নিয়ে মাঝরাতে আমার রুমে নক করল। দরজা খুলতেই হুড়মুড় করে আমার গায়ে পড়ে গেল সে। অজ্ঞান।
  বাতাসের আগে আগে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছুটলাম। টানা তিনদিন ওখানেই বসে ছিলাম। চতুর্থদিন সকালের নাস্তা করার জন্য বের হচ্ছিলাম, খালি পেটে মাথা ঘুরছিল। রাস্তার মাঝখান দিয়ে ছুটে আসা রিকশাটার ওপর পড়ে গেলাম। রিকশার ধাক্কাতে ছিটকে পড়ার পরই আরোহী মেয়েটা নেমে এল। ওই রিকশাতে তুলেই আমাকে আবারও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসা হল। ইউ টার্ন।
  কিভাবে জানি আমার গোড়ালিতেও ছোট কিছু গভীর একটা ক্ষত হয়ে গেছিল। দুই দিন আমিও হাসপাতালে থাকলাম। অধরা নামের মেয়েটার সাথে পরিচয়টা হল সেভাবে। পরিচয়ের তিন সপ্তাহের মাথাতে আমাদের ঝোপঝাড়ের আড়ালে চুম্বনরত অবস্থাতে ডিএমসির আরেক প্রেমিকবন্ধু আবিষ্কার করে।
  প্রেমিক বন্ধু গৌরব আমাকে শুধু প্রশ্ন করেছিল, ‘বরফ কন্যাকে পটালি কি করে? ওর সাথে লাইন মারার জন্য ক্লাসের অর্ধেক পোলা ঘুরেও এই চারবছর শুধু ভ্যারেন্ডাই ভাজল। আর তুই-’
  সমস্যাটা ছিল গুরুতর। আমি একজন খ্রিস্টান ছেলে। অধরার বাবা দরগাহ কমিটির মেম্বার। কাফেরের সাথে মেয়ে ঘুরছে জানতে পারলে প্রথমে তিনি আমাকে খুন করবেন। তারপর খুন করবেন তাঁর মেয়েকে। কথাটা যে শুধু কথার কথা নয়, বাস্তব, সেটা বিশ্বাস করানোর জন্য কম বাক্য বিনিময় করেনি অধরা।
  অদ্ভুত ব্যাপারটা হল, এখনও টিকে গেছে আমাদের প্রেমটা। আমরা আগামীকালই পালাচ্ছি এখান থেকে। আর আজকে হোটেলে গিয়ে ... যাকে বলে কাবাডি খেলা হবে আমাদের। আমাদের সম্পর্কটা এতদূর আসবে তা শুরুর দিকে আমিও বিশ্বাস করতে চাইনি। ঠিক যেমন এখন আমার বিশ্বাস হচ্ছে না ছিপছিপে দীর্ঘতনু মেয়েটি আমার পাশে হাঁটছে।
  ‘শোন। আমরা ঢাকাতে গিয়ে কোথায় থাকব? তোমার বাবা-মাকে জানিয়েছ?’ জানতে চাইল ও।
  ‘জানাব। পরে। আগে ঢাকাতে ফিরে যাই। পরেরটা পরে দেখা যাবে। কি বল?’
  অধরা কিছু বলতে পারল না। পেছন থেকে আচমকা গতি বাড়িয়ে সামনে চলে এল একটা গাড়ি। চকচকে কালো শরীর ওটার, টিন্টেড ব্ল্যাক গ্লাস। আমাদের ঠিক পাশে এসে ব্রেক কষল জোরে। ধুপধাপ শব্দে দরজা খুলে গেল। লাফিয়ে নামল তিনজন মানুষ।
  ঘুরে তাকানোর আগেই আমার নাকে প্রচণ্ড এক ঘুষি মেরে দিল তাদের একজন। মাপা দুই পাক খেয়ে ফুটপাথে ছিটকে পড়লাম। পুরোপুরি পড়ার আগেই শক্ত বুট জোড়া দিয়ে দড়াম করে আরেকটা লাথি মারল লোকটা, আমার মাথায়। কিভাবে কি হল তা জানি না, তবে হড়হড় করে একদলা রক্ত ছিটকে বের হয়ে এল আমার মুখ থেকে।
  বিদ্যুতবেগে দুইজন ধরে আমাকে গাড়িতে তুলে নিচ্ছে, টের পেলাম। অধরাও ওদের একজনের হাতে বন্দী। তাকেও গাড়িতে তোলা হচ্ছে, বুঝতে পারলাম।
  তারপরই অন্ধকার হয়ে এল পৃথিবী।
৯.
 ‘যোসেফ হোলি ক্রাইস্ট, অ্যাঁ?’ কানের কাছে ঘেউ ঘেউ করে উঠল কেউ একজন।
  বহু কষ্টে একটা চোখ মেললাম। এখনও কোন এক গাড়ির ভেতরে বসে আছি। সম্ভবতঃ আগের গাড়িটাতেই। রাস্তার পাশে পার্ক করে আছে ওরা।
  নিজের অবস্থা সম্পর্কে সচেতন হলাম প্রথমে। নাক মুখে রক্ত শুকিয়ে শক্ত হয়ে লেগে আছে। মুখের চামড়া টেনে ধরেছে খুব। জিভ কেমন যেন ফোলা ফোলা লাগল। রাস্তাতে আছড়ে পড়ার সময় রাস্তাতে কামড় লেগেছিল নাকি? হতে পারে। দুই হাত শক্ত করে আটকে রাখা হয়েছে স্টিলের হাতকড়াতে।
  এতক্ষণে খেয়াল করলাম গাড়িতে অধরা নেই।
  ‘অধরা কোথায়?’ অনেক কষ্টে উচ্চারণ করলাম।
  ফ্যাক ফ্যাক করে হাসল লোকটা, ‘আব্দুল্লাহ জাফর আল নেজাম-এ-শরাফত সাহেবের মেয়ের সাথে ফস্টিনষ্টি করতেছিলা, তোমার কি হাল হবে তাই ভাবো, ছেলে। হুজুরের মেয়েকে নিয়ে তোমার না ভাবলেও চলবে। নিরাপদেই আছে ও।’
  আরেকটা চোখও খুললাম এবার, ‘আমাকে ধরে রেখেছেন কেন?’
  গাড়িতে বসে থাকা দুইজনই এবার হাহা করে হাসতে শুরু করল। আমি সম্ভবতঃ উঁচুদরের কোন রসিকতা করে ফেলেছি নিজের অজান্তে।
  আবার বললাম, ‘আমাকে ধরে রাখার অধিকার আপনাদের নেই। বেআইনী কাজ করছেন আপনারা।’
  ‘পরের বউকে নিয়ে যে টানাহ্যাচরা করতেছিলা সেটা তো আইনী ছিল খুব।’ হাসি থামিয়ে বলল তাদের একজন, ‘ভুল জায়গায় ঢুকে পড়ছ তুমি, বোঝা গেল?’
  মাথা ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে আসছে। নড়ার চেষ্টা করে অবশ্য দেখলাম সুবিধে করতে পারলাম না হাতকড়া পরা হাত দিয়ে। ‘আমাদের খুঁজে পেলেন কি করে?’
  ‘এত কিছু জেনে কাজ কি তোমার?’ বিরক্তিতে নাক কুঁচকে ফেলল দ্বিতীয়জন।
  প্রথমজন অবশ্য আমাকে উৎসাহই দিল, ‘ভাল প্রশ্ন। তোমার কি মনে হয় আমরা দরগাহর সেবা করি বলে মাথাতে ছাগলের লাদা নিয়ে ঘুরে বেড়াই? ঘর থেকে বের হওয়ার পর থেকেই ওকে ফলো করছিলাম। হুজুরের আদেশ। বিয়ের আগে মেয়েদের সিক্রেট লাভাররা টুপটাপ বের হয়ে আসতে থাকে। এসব সময় পড়াশোনা জানা মেয়েছেলেদের একটা ফুটা পয়সা দিয়েও বিশ্বাস করা যায় না। ফুটা পয়সাও ওরা হাপিস করে দিতে পারে।’
  টিন্টেড গ্লাস। বাইরে থেকে কেউ দেখতে পাবে না ভেতরে কি চলছে। দুটো কাজ করার জন্য এই গাড়িগুলো খুব উপকারী। আই মীন, পার্ক করা অবস্থাতে।
১. সেক্স
২. খুন
সমকামী না হলে প্রথম উদ্দেশ্যে আমাকে টিন্টেড গ্লাসের গাড়িতে আটকে রাখবে না দুইজন শক্তিশালী পুরুষ। দরগাহ কমিটির মেম্বাররা প্রয়োজনে ভায়োলেন্ট হলেও এরা সমকামী হয়ে থাকে না। অর্থাৎ এখানে তারা আমাকে আটকেছে খুন করে ফেলার জন্য।
  চারপাশে তাকালাম, ‘মুখ বাঁধবেন না আমার? মারা যাওয়ার পরও ত্রিশ সেকেন্ড মত বিকট শব্দ করতে পারে মানুষ।’
‘ভাল কথা মনে করিয়েছ।’ আমার পিঠ চাপড়ে দিল প্রথমজন।
  দ্বিতীয়জন দ্রুত একটা ডাক্ট টেপ বের করে আনল। চড়াৎ শব্দ করে অনেকটা খুলে ফেলল ওটা। তারপর ঝটপট আমার মুখে শক্ত করে পেঁচিয়ে ফেলল ওটা। এতক্ষণ দুইজন আমার দুইপাশে বসে ছিল। এখন একজন কসরত করে সামনের ড্রাইভিং সীটে চলে গেল।
  ইঙ্গিতটা সুস্পষ্ট।
  হাত নড়ানোর চেষ্টা করে দেখলাম, কাজ দিল না। স্টিলের পুলিশ হ্যান্ডকাফ। কোথা থেকে জোগাড় করেছে কে জানে! তবে হাতুড়ি আর বাটালি দিয়ে কেটে আলাদা করার মত জিনিস এটা না।
  যেন বহুদিনের পুরোনো সম্পর্ক, এমনভাবে আমার কাছে চলে এল পাশে বসে থাকা লোকটা। একটা ছয় ইঞ্চি ফলার ছুরি বের হয়ে এসেছে তার হাতে।
  ‘গুড নিউজ, জোসেফ। আ’ল গিভ ইউ আ সেভেন্টি-থার্টি চান্স। সেভেন্টি টু ডাই, থার্টি টু লিভ।’ বিড়বিড় করল সে, ‘হার্টে মারব না, এটা বলে দিচ্ছি। খুব বেশি রক্ত বের হয়। গাড়ি ধুতে ঝামেলা বেশি।’
  একবার-দুইবার-তিনবার আমার বুকে চাকু মারল মানুষটা, চারনম্বর চাকুটা মারল পেটের কাছে।
  চট করে দরজা খুলে আমাকে একটা ধাক্কা দিয়ে রাস্তাতে ফেলে দিল সে।
  ‘গো ব্যাক টু জেসাস ক্রাইস্ট, জোসেফ ক্রাইস্ট!’
১০.
 পিচঢালা রাস্তাতে কালচে দেখাচ্ছে আমার রক্ত। শার্টটা ভিজে গেছে, রক্ত পড়ছে চুঁইয়ে চুঁইয়ে। দুর্বল পা দুটো দিয়ে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলাম। হাত দুটো বাঁধা, বিশেষ সুবিধে করতে পারছিলাম না। তাও দুইপায়ে ভর করে দাঁড়ানো গেল। টলোমলো পায়ে হাঁটছি, বুক বেয়ে দর দর করে রক্ত গড়াচ্ছে।
  গাড়িটা আমাকে ফেলেই চলে গেছে। ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছে যন্ত্রণাতে। চিড়িক-চিড়িক জাতীয় একটা অনুভূতি ভেতরে। ভাষাতে প্রকাশ করাটা কঠিন। টলে উঠলাম দুইবার। দূর থেকে কেউ কি আমার নাম ধরে ডাকল?
  আমার মনে হল বাবার কণ্ঠ শুনতে পাচ্ছি। ডাকছে আমাকে, ‘যোসেফ! যোসেফ!’
  কণ্ঠটা পাল্টে গেল মায়ের কণ্ঠে, ‘যোসে-ই-ফ!’
  হাঁটুর নিচে একটা কিছু লাগল। তারপর লক্ষ্য করলাম, কিছু লাগেনি ওখানে। হঠাৎ-ই রাস্তার ওপর আছড়ে পড়েছে আমার হাঁটু। দেহ কথা শুনছে না। ছিটকে পড়ে যেতে চাইছে।
  কেন কথা শুনছে না? আগে তো শুনত!
  এক গাল ঘষটে ঘষটে স্পর্শ করল শক্ত কঠিন রাস্তা। এখনও গরম। সারাদিনের রোদ শুষে নিয়েছে অকাতরে।
  কেউ আমাকে ধরল শক্ত করে।
  ‘জোসে-ই-ফ!’ কানের কাছে তীব্র গলায় বলল কণিকা।
১১.
 চারপাশটা সাদা। হাসপাতালের বিছানা হবে নিশ্চয়। তাকালাম। পিটপিট করে তাকালাম কয়েকবার।
  প্রচণ্ড দুর্বল লাগছে শরীর। আলোগুলো এত উজ্জ্বল কেন? চোখে লাগে তো। কেউ বন্ধ করে দেয় না কেন লাইট?
  ‘পাঞ্চ কোড কি তোমার এটিএম কার্ডের?’ খুব কাছ থেকে নিচু কণ্ঠে জানতে চাইল কেউ।
  ঘাড় ঘোরাতে কষ্ট হচ্ছিল। তাও ঘোরালাম। সারা শরীরে কি সব টিউব লাগিয়ে রেখেছে ওরা।
  আমার পাশে একটা ফতুয়া আর জিনস পরে বসে আছে কণিকা। অসম্ভব সুন্দর লাগছে তাকে। সুন্দর আর কুটিল! দুই চোখে যা ফুটে আছে তা কোন মৃত্যূর মুখ থেকে ফিরে আসা মানুষ দেখতে চাইবে না। লোভ।
  ‘গো-’ ঠোঁট নড়ালাম আমি, ‘-টু হেল।’
  ‘কার্ডের পাঞ্চ কোড বল। সরে যাচ্ছি।’ চাপা গলাতে আবারও বলল কণিকা, ‘তোমার কি মনে হয় তোমার চেহারা দেখার জন্য রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে এসেছি? এমনিতেই পুলিশ হাজারটা সন্দেহ করছে তোমাকে ওভাবে পেয়ে। এখনও হাতে হাতকড়া নেই তোমার হাতে। খেয়াল করেছ?’
  কাশলাম একটু।
  ‘কুহেলীর ব্যাপারটা যদি রটিয়ে দেই, চটপট তোমার হাতে হাতকড়া পড়ে যাবে। কিডন্যাপিং ডীলিং নিয়ে ঝামেলা হওয়াতে বুকের খাঁচাতে ছুরি খেয়েছ- সবাই জানবে সেটা। বাচ্চাটাকে বিক্রি করতে চেয়েছিলে কোন গ্রুপের কাছে, এটা শোনার জন্য পুলিশও ছেঁকে ধরবে। কেমন হবে সেটা?’
  বমি বমি লাগছে আমার। স্যালাইন দিয়ে রেখেছে, তাও বমি কেন লাগছে?
  ‘জোসেফ! তোমার অবস্থানটা বুঝতে পারছ তুমি? একটা আঙুল নাড়ানোর ক্ষমতাও তোমার নাই। আক্ষরিক অর্থেও অবশ্য। পাঞ্চ কোডের নাম্বারটা দাও।’
  ‘ফা ...’
  ‘ফাইভ?’ আগ্রহের সাথে মোবাইলে নাম্বারটা তুলতে শুরু করল ডাইনীটা।
  ‘ফাক ইউ।’ এবার কথাটা শেষ করতে পারলাম। আমার ওই অ্যাকাউন্টে সাত লাখ টাকা আছে।
  হতে পারে আমি মারা যাচ্ছি, তাই বলে এই কন-গার্লের হাতে সাত লাখ টাকা মুফতে তুলে দিয়ে মারা যাওয়ার ইচ্ছে আমার নেই।
  ‘তোমার কি মনে হয় তোমাকে ফাঁসিয়েই আমি থেমে যাব?’ চিবিয়ে চিবিয়ে বলল কণিকা, ‘রাস্তা থেকে এতদূর টেনে আনতে কম ঝামেলা পোহাতে হয়নি। কিছুটা তুলতে হবে না আমাকে? কুহেলীকে বেচে দেব কোন এক পার্টির কাছে। তোমার মত চাকু খেতে হবে না আমার। এত কাঁচা কাজ আমি করি না।’
  কুহেলীর কথা মনে পড়তে মন খারাপ হয়ে গেল। মেয়েটা নিষ্পাপ। কেন এল এই পার্থিব ঝামেলার জগতে? ঝলমলে চুল দুলিয়ে মিস্টার খর্‌রের সাথে খেলত নিশ্চয় বাড়িতে বসে? হারিয়ে গেল কি করে ও? আচমকা ট্রেনে উঠে পড়তে যে কেন গেল বাচ্চাটা! নাহলে এতক্ষণে তার বাবার কাছে পৌঁছে দেওয়া যেত তাকে। ট্রেন থেকে নেমেও কাজটা করা যেত, যদি না এই হতচ্ছাড়া কন-গার্লের পাল্লাতে পড়তাম!
  ট্রেনে আমাকে শক্ত করে ধরে ঘুমাচ্ছিল বাচ্চাটা। আমাকে বিশ্বাস করেছিল ও। ভেবেছিল আমাকে বিশ্বাস করা যায়। আমি তার বিশ্বাসের মর্যাদা রাখিনি। একটা প্রতারক মহিলার হাতে ছেড়ে দিয়ে লাফাতে লাফাতে গেছি প্রেমিকার সাথে দেখা করতে।
  কেন জানি মনে হল একদম উচিত পরিণতিই ভোগ করছি এখন।
  তবে আমার জন্য কুহেলীকে আর কোন ক্ষতির শিকার হতে দেব না আমি। রাস্তাতে পড়ে থেকেই যখন মারা যাইনি, ঈশ্বর আমাকে কোন একটা উদ্দেশ্যে অবশ্যই বাঁচিয়ে রেখেছেন। মেয়েটাকে তার বাবা-মার কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হতে পারে সেই উদ্দেশ্য।
  বিড়বিড় করে পাঞ্চ কোড বলে দিলাম কণিকাকে।
  উজ্জ্বল মুখে মোবাইলে সেভ করে ফেলল ও নাম্বারটা। আমার শরীরের যে অবস্থা, কার্ডটা আর কারও হাতে আছে সেটা জানানোর আগেই অ্যাকাউন্ট খালি করে দেবে মেয়েটা।।
১২.
 পরের বার যখন চোখ মেললাম, অপরিচিত এক ভদ্রলোককে চোখে পড়ল। বিছানার পাশে বসে আছেন, চেহারাতে ব্যক্তিত্বের ছাপ। তাঁকে দেখে না, বরং কোলে বসে থাকা ছোট্ট মেয়েটাকে দেখে লাফিয়ে উঠতে গেলাম। পারলাম না, বুকের কোথায় কোথায় জানি টান পড়ল, ভেতরে।
  ধীরে ধীরে আবারও শুয়ে পড়তে হল। ভদ্রলোকের ভ্রু কুঁচকে গেছে।
  ‘ভাল আছ, কুহেলী?’
  ‘হ্যাঁ-আ-আ।’ ঘাড় বাঁকা করে টেনে বলল মিষ্টি মেয়েটা, তারপর ভদ্রলোকের দিকে ঘুরে গেল, ‘ড্যাডি, দেখ। আব্বাজি কথা বলছে। আব্বাজি?’
  ফাক!
১৩.
 ‘চার দিন ধরে অচেতন হয়ে আছো তুমি, ছেলে।’ ভদ্রলোক বললেন, ‘আমার মেয়ে যে এখনও আসলেই হারিয়ে যায়নি, আমার মনে হয় তোমার ভূমিকা আছে। সেজন্য কৃতজ্ঞতা অনুভব করছি। কিন্তু আমার প্রশ্ন হল, কুহেলীকে নিয়ে সিলেটে এসেছিলে কেন তুমি?’
  কুহেলীর বাবাকে পুরো ঘটনাটা খুলে বললাম। মনে হল না ভদ্রলোক বিশ্বাস করবেন, তবুও। কণিকার মত কন-গার্লরা অসম্ভব অবিশ্বাস্য কাজই করে থাকে। ভিক্টিমরা যখন সত্য ঘটনাটা কাওকে বলে, শ্রোতার চেহারাতে ফুটে ওঠে একটা বিশেষ ভাব। ‘শালার মাথা গেছে।’
  কিভাবে মেয়েটার হাতে আটকে গেছিলাম, ট্রেনে উঠে পড়ার পর কিভাবে নিজের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল সে, তারপর সিলেটের হোটেলে উঠেও আমার কাছ থেকে দশ হাজার টাকা নিয়ে কুহেলীকে জিম্মি করে সরে গেছিল, তারপর আমার প্রেম কাহিনীর অংশবিশেষ, রাস্তাতে পড়ে থাকা থেকে শুরু করে পাঞ্চ কোড বলতে বাধ্য হওয়া - সবকিছুই খুলে বললাম ভদ্রলোককে।
  ‘তোমার বিজনেস কার্ডটা চোখে না পড়লে তোমাকেই কিডন্যাপার ভেবে বসাটা আশ্চর্যের কিছু ছিল না।’ ইঙ্গিতে মানিব্যাগটা দেখালেন উনি, ‘তবে তোমার ব্যাকগ্রাউন্ড দেখে বুঝতে পেরেছি ভেতরে আরও ঘাপলা আছে। তাহলে, কন-গার্লের পাল্লাতে পড়েছিলে তুমি। সর্বস্ব খুইয়েছ তার কাছে?’
  বহু কষ্টে একটু নড়লাম, ‘একরকম।’
  ‘মেয়েটার সাহস আছে বলতেই হবে। তোমার কার্ডটা আবারও ফিরিয়ে দিতে এসেছিল হাসপাতালে।’
  ‘মানে?’
  মানিব্যাগ থেকে আমার কার্ড বের করে দেখালেন কুহেলীর বাবা।
  ‘বুঝলাম না ব্যাপারটা।’ দ্বিধান্বিত কণ্ঠে বললাম, ‘আপনি কুহেলীকে পেলেন কি করে?’
  দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি, ‘একটা মেয়ে ফোন করে বলল কুহেলী এই হাসপাতালে আছে। আমাকে একা আসতে হবে। নাহলে ওকে ফিরে পাবো না। রুম নম্বর বলে দিয়ে ফোন রেখে দিল সে। আমি প্রাইভেট হেলিকপ্টারে করে সাথে সাথে ছুটে এসেছি। একা ঢুকলেও বাইরে সাদা পোশাকে অন্তত পঞ্চাশজন আইনের লোক আছে।’
  প্রমাদ গুণলাম। আমি এখনও হাতকড়া ছাড়া বসে আছি কি করে?
  আমার মনের কথাই যেন পড়তে পারলেন ভদ্রলোক। বললেন, ‘কিডন্যাপড হয়ে যাওয়া মেয়েকে হাসপাতালে ছয় প্যাঁচে মোড়ানো কোন রোগীর পাশে আবিষ্কার করবেন না আপনি। আই মীন, মেয়েটা যখন সেই রোগীকে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে ... আপনাকে বুঝতে হবে কিছু একটাতে সমস্যা আছে।’
  কুহেলীর দিকে তাকালাম। ছোট্ট মুখটায় বেদনার ছাপ। আমার দিকে তাকিয়ে আছে সে দুঃখী একটা দৃষ্টি দিয়ে। বিছানাতে বন্দী অবস্থাতে দেখতে চায় না হয়ত আমাকে।
  কুহেলীর বাবার বিচক্ষণতায় মুগ্ধ হলাম। আর কেউ হলে আমাকে এতক্ষণে পুলিশী প্রহরাতে চিকিৎসা নিতে হত।
  ‘ও হারিয়ে গেছিল কি করে?’ জানতে চাইলাম।
  ‘গাড়ির বুটে করে। বাগানে খেলছিল, তার মাঝেই গাড়ির বুটে উঠে ঢুকে পড়ে। আমিই ছিলাম গাড়িতে, মেইন গেটের দাড়োয়ান দরজা খুলে দিয়েছে, আমরা বের হয়ে গেছি। মতিঝিলের কাছে একবার গাড়ি থেমে ছিল, তার মধ্যেই মনে হয় বের হয়ে গেছিল ও। হেঁটে হেঁটে কমলাপুর চলে গেছে।’
  কী সর্বনাশ!
  কুহেলীর দিকে তাকালাম, ‘তুমি ওখানে ঢুকেছিলে কেন?’
  মুচকি হাসল মেয়েটা। ‘ড্যাডিকে ভয় দিতে।’
  ‘অন্ধকারে একা একা ঢুকে বসেছিলে, ভয় তো তোমার পাওয়ার কথা। আর ড্যাডিকে ভয় দেখাতে ঢুকেছ তুমি?’
  ‘একা কোথায়?’ সরল জবাব পিচ্চির, ‘আমার সাথে মিস্টার খর্‌রে ছিল তো!’
১৪.
 আটদিন পর হোটেলে ফিরে এলাম। চেক আউট করা হয়নি। ফিরে আমাকে আসতেই হত। এর মধ্যে কণিকার কোন পাত্তা পাওয়া যায়নি। ফোন দিয়েছিলাম ওর নাম্বারে, বন্ধ। কণিকা আমাকে রাস্তাতে উদ্ধার করেছিল দেখে মোবাইল মানিব্যাগ আমার পকেটেই আছে। ‘মামুলী’ জিনিসপত্র নেয়নি সে।
  মেয়েটাকে পাওয়া যাবে এমনটা আশা করাটা ভুল ছিল। সাত লাখ টাকা তিন দিনে কামিয়ে ফেলাটা একজন প্রথম শ্রেণির কন-গার্লের জন্যও ওভার-ইনকাম। এরপর আমার আশেপাশে থাকার কোন কারণ তার ছিল না। প্রথমতঃ আমি তার ভাতার নই, দ্বিত্বীয়তঃ আমার কাছ থেকে হাতানোর মত আর কিছু অবশিষ্ট ছিল না তার জন্য।
  হোটেলের ফাঁকা ঘরটার খাটে সাবধানে বসলাম। শরীর প্রচুর দুর্বল। ভাগ্যিস কোন ভারী লাগেজ নিয়ে আসিনি।
  কুহেলীর বাবা আশফাকুর রহমান তাঁর ক্ষমতা প্রয়োগ করেছেন। আমাকে ছুরি মারা মানুষগুলোকে পাওয়া যায়নি কোথাও। সবকিছুর সাথে আব্দুল্লাহ জাফর আল নেজাম-এ-শরাফত ‘সাহেব’কে কোনভাবেই রিলেট করা যায়নি। অধরা ভুল কিছু বলেনি। আসলেই প্রচণ্ড ক্ষমতা তার বাবার।
  আশফাকুর রহমান খবর এনেছেন, আমার ওপর অ্যাটেম্পট টু মার্ডারের ব্যাপারে কোন অগ্রগতি না হলেও আব্দুল্লাহ আল নেজামের ছোট মেয়ে সুমাইয়া ইসলাম অধরর বিয়ে হয়ে গেছে ছয়দিন আগে। আমাকে চাকু মারার পর খুব একটা দেরী করতে সয়নি মনে হয় উনাদের।
  অধরাকে হারিয়ে বুকের ভেতরটা জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে - বলতাম আমি। তবে বুকের ভেতরের জ্বালাপোড়াটা চাকুর ক্ষতের প্রতিক্রিয়াও হতে পারে। হতাশায় চোখে জল এসেছিল যখন অধরার খবরটা শুনেছিলাম। তারপর আশফাকুর রহমানের পরামর্শ অনুযায়ী ‘বেঁচে আছি’, সেজন্য সন্তুষ্ট থেকেছি।
  হোটেলের রুম থেকে খুব বেশি কিছু নেওয়ার ছিল না। ব্যাগটা একটু গুছালাম। এটিএম কার্ড সাফ করে দিয়েছে কণিকা। টাকার ব্যাপারটা সামলাতে বাবার কাছে ফোন করেছিলাম। বাবা থাকেন সিঙ্গাপুরে। ব্যবসাপাতি সব ওখানেই। ছুরি খাওয়ার ঘটনা তাঁকে জানিয়ে অস্থির করে তুলতে গেলাম না। শুধু বললাম কার্ড হারিয়ে ঝামেলাতে পড়ে গেছি। হোটেল ম্যানেজমেন্টের সাথে কথা বলে কোন মাধ্যমে তিনি টাকা পাঠিয়ে দিয়েছেন কে জানে! তবে আর হাউমাউ করছে না তারা।
  ইন্টারকম বেজে উঠতে রিসিভ করলাম। ওরা জানাল, আমার সাথে দেখা করতে এসেছে একজন। লবিতে অপেক্ষা করছে। নামতে পারব নাকি বিদেয় করে দেবে?
  অবাক হলেও বললাম, ‘আসছি আমি।’
১৫.
 কণিকা একটু হাসল। জানতে চাইল, ‘কেমন আছ?’
  দুই পা এগিয়ে ওর কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম, ‘তোমার সাহস দেখে রীতিমত অবাক হচ্ছি। আবারও আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছ কোন সাহসে?’
  পাত্তাই দিল না ও, হাত বাড়িয়ে একটা খাম দিল।
  নিয়ে খুললাম। ভেতরে একটা টিকেট। গ্রীনলাইন বাসের টিকেট। দুইজনের। দ্বিতীয় সারি। এসি বাস।
  ‘শুনলাম আজকেই চেক আউট করবে। চলো, একসাথে ফেরা যাক।’
  অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকালাম। কিছুই বুঝতে পারছি না আমি।
  চোখ বড় বড় হয়ে গেল ওর। তারপর হেসে ফেলল, ‘তোমার পাঞ্চ কোড জেনে ফেলেছি দেখে ক্ষেপে আছো? ক্ষতি কি? কার্ড তো তোমার কাছেই আছে।’
  ‘আমার সাত লাখ টাকা-’
  ‘ওমা! এত ছিল নাকি তোমার অ্যাকাউন্টে? জানলে ঠিক মেরে দিতাম।’ মুচকি হাসল কণিকা, ‘গোটা বিশেক এটিএম বুথ ঘুরলেই তুলে ফেলতে পারতাম।’
  দ্বিধাতে পড়লাম, ‘তারমানে, টাকাটা মারোনি তুমি?’
  ‘স্যার, আপনি কি একবারও কার্ডটা ঢুকিয়ে ব্যালান্স চেক করেছিলেন?’ সকৌতুকে বলল কণিকা, ‘তোমার পাঞ্চ কোড জানাটা আমার দরকার ছিল। প্রথম তিন দিন হাসপাতালে কত খরচ হয়েছে জানো? সত্তর হাজার। প্রাণে বেঁচে আছো এই না কত! তবে, তোমার জন্য সুখবর, কুহেলীর বাবাকে ফোন দেওয়ার পর থেকে খরচের ব্যাপারটা উনিই দেখেছেন। দেখবেন, তা জানতাম।’
  বাচাল মেয়েটার সাথে কথা না বলে এটিএম বুথের দিকে এগিয়ে গেলাম। ব্যালান্স দেখে সন্তুষ্ট হতেই হল। ঠিক সত্তর হাজারই কমেছে অ্যাকাউন্ট থেকে।
  ‘সেক্ষেত্রে-’ কণিকার দিকে তাকালাম, ‘তোমার সাথে যেতে আমার কোন আপত্তি নেই।’
  আমাকে জড়িয়ে ধরল মেয়েটা। ওর গা থেকে মিষ্টি একটা গন্ধ আসছে। কোন পারফিউমের তা ঠিক চিনতে পারলাম না।
  ‘গুড টু হ্যাভ ইউ ব্যাক, জোসেফ।’
১৬.
 বাসের জন্য অপেক্ষা করছি। আমার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে কণিকা। প্রেমের গন্ধ খুঁজে কাজ নেই, এই দাঁড়িয়ে থাকার কারণ আমার শরীর খুব দুর্বল। পড়ে-টরে গেলে খপ করে ধরে ফেলবে কণিকা। মেয়েটা নিজেকে আমার অবস্থার জন্য অনেকাংশে দায়ী করছে বলে মনে হল। একেবারেই অযৌক্তিক অবশ্য কাজটা।
  কণিকার বান্ধবী বিন্দু আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিট হাসছে।
  ‘এক ঢিলে দুই পাখি মেরে দিবে পাগলি নীরা, তা কে জানত।’ কৃত্রিম বিস্ময়ে বলল মেয়েটা।
  চোখ বাঁকালাম, ‘বুঝলাম না।’
  ‘কিছুই বলিসনি তুই বেচারাকে? এখনও না?’ চোখ কপালে উঠিয়ে ফেলল বিন্দু।
  অসম্ভব মিষ্টি হাসি কণিকার। কান পেতে শুনতে ইচ্ছে করে এমন একটা হাসি হাসল ও। আর কিছু বলল না।
  ‘এখানে নীরা এসেছিল সাস্টের গেট টুগেদারে আমাদের সাথে যোগ দিতে।’ বিন্দুও হাসছে। মেয়েটার সাথে আমার মোটে দশ মিনিটের পরিচয়, ‘মাঝখানে আপনাকে পেয়ে গেল ট্রেনে। বাচ্চা মেয়েটাকে নিয়ে টেনসড ছিল। তবে স্বভাব কি আর মরলেও যায়!’
  ‘কোন স্বভাব?’
  ‘শুধু শুধু ওকে পাগলি নীরা ডাকছি ভেবেছেন? নীরার মত পাগল মেয়ে আপনি জীবনে দুটো পাবেন না।’ কণিকার আসল নাম তাহলে নীরা! ‘সাস্টে থাকতে একবার আমাদের কোর্স টীচারের পকেট থেকে যে কিভাবে একমাসের বেতন খসিয়েছিল, তা আরেক কাহিনী। বাজি ধরে বলতে পারি কন-গার্ল হলে আর কোন পেশার দিকে তাকাতে হত না ওকে। কিন্তু সিরিয়াসলি কোন বাটপারি সে করে না।’
  ‘ফান?’ ঠোঁট বাঁকালাম, ‘আরেকটু হলে আমার জানটাই চলে গেছিল ওর ফানে।’
  ‘ভুল বললে,’ আমার আরেকটু কাছে এসে দাঁড়াল কণিকা, ‘আমি এই ফানটা না করলে তোমার-কুহেলীর মাঝে আমি এসে পড়তাম না। তুমি চাকু খেয়ে মরে পড়ে থাকতে রাস্তাতে। কুহেলীর ভবিষ্যত কি হত কেউ জানে না। মেনে নাও, জোসেফ ক্রাইস্ট, তুমি জেসাস ক্রাইস্ট না।’
  কথা সত্য। আর কিছু বলতে পারলাম না। বিন্দু আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে যেন আরও মজা পেল।
  ‘এত হাইক্লাস ফ্যামিলির ছেলে হয়েও ট্রেনের সেকেন্ড ক্লাসে চড়েন কেন আপনি, বলুন তো?’
  ‘খুব গরিব ছিলাম আমরা একসময়।’ মন খারাপ হয়ে গেল অতীতের কথা মনে পড়তে, ‘সেকেন্ড ক্লাস ছাড়া ছেলেবেলাতে আর কিছু চড়িনি। এখনও সুযোগ পেলেই ট্রেনে চড়ি আমি। সেকেন্ড ক্লাসে।’
  মাথা দোলাল বিন্দু, নীরাকে ইঙ্গিত করল, ‘আপনার দশ হাজার টাকা মেরে কিন্তু একা খায়নি ও। আমাদের সব বান্ধবীদের খাইয়েছে। আশা করি ওটা ক্ষমা করবেন। তবে, আমাদের কাছে যাওয়ার কারণ টাকা উড়ানো ছিল না। মেয়েটাকে তার বাবার কাছে কিভাবে আইনী ঝামেলা ছাড়া ফিরিয়ে দেওয়া যায় তা নিয়ে ভাবছিলাম আমরা।’
  মনে পড়ল কণিকার গোলাপী শাড়ি পরে বের হয়ে যাওয়া। একহাতে কুহেলীর হাত ধরে বের হয়েছিল ও। আসলে ফ্রেন্ড-সাপোর্ট খুঁজছিল তখন?
  ‘মনে করার কি আছে?’ তাড়াতাড়ি বললাম, ‘এরপরের গেট টুগেদারে আমাকেও আমন্ত্রণ জানাতে পারেন। শুনেছি, হোস্টকে ডিনারের সময় উপস্থিত থাকতে হয়। প্রথমবার তো হোস্টকে বাদ দিয়েই করে ফেললেন।’
  হেসে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল বিন্দু, বাসটাকে দেখতে পেলাম আমরা। ধীরে ধীরে কাউন্টারের সামনে থামছে। বিন্দু ছাড়া আর সব বান্ধবীই সিলেটের বাইরে থাকে। একজনই এসেছে নীরাকে সী অফ করতে।
  বিন্দুর সাথে হাত মেলালাম। তারপর ওকে বিদায়বাণী শুনিয়ে আমরা উঠে বসলাম বাসে। নীরা অবশ্য বিন্দুকে জড়িয়ে ধরে আর ছাড়তেই চাইছিল না।
  বাস ছেড়ে দিল একেবারে ঠিক সময়ে। পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে ছিঁড়ে ফেলে দিলাম জানালার বাইরে। ট-বগির টাক্কু যাত্রীর এই নাম্বার আমার আর কোন কাজে আসবে না অদূর ভবিষ্যতে।
  কুহেলীকে মনে পড়ছিল খুব। ওর বাবা আর আমার কথাবার্তা রীতিমত কাঠখোট্টা লাগছিল ওর। আমাদের দুইবার একহাতে আরেকহাত টি-র মত করে ধরে দেখিয়েছিল। জানতে চেয়েছিলাম, ‘এটা কি?’
  পরিষ্কার ইংরেজীতে ও বলেছিল, ‘ওহ, গিভ মি আ ব্রেক! টাইম আউট! টাইম আউট!!’
  গত কয়েকদিনে যথেষ্ট বাজে অভিজ্ঞতা হয়েছে। আমারও একটা ব্রেক দরকার। দরকার একটা টাইম আউট।
  পাশাপাশি সীটে বসে একে অন্যের দিকে তাকালাম আমি আর নীরা। একসাথে আরেকটা যাত্রা শুরু হল আমাদের। জানি না, এর শেষ কোথায়।
  জানি না, এই যাত্রা কোথায় নিয়ে যাবে আমাদের।
  শুধু জানি, নতুন এই ফিরে পাওয়া জীবন নিয়ে, অসম্ভব পাগলী এই মেয়েটার সাথে যে কোন জায়গায় যেতে আমার আপত্তি নেই!
--- ০ ---
উৎসর্গঃ Abrar Faiyaz ভাইকে।

লেখা: ২০মে ২০১৫
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে আগস্ট, ২০১৫ দুপুর ১২:৩২
৩টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মুসলিম কি সাহাবায়ে কেরামের (রা.) অনুরূপ মতভেদে লিপ্ত হয়ে পরস্পর যুদ্ধ করবে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৯




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৫। তোমরা তাদের মত হবে না যারা তাদের নিকট সুস্পষ্ট প্রমাণ আসার পর বিচ্ছিন্ন হয়েছে ও নিজেদের মাঝে মতভেদ সৃষ্টি করেছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদে মসজিদে মোল্লা,ও কমিটি নতুন আইনে চালাচ্ছে সমাজ.

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

গত সপ্তাহে ভোলার জাহানপুর ইউনিয়নের চরফ্যাশন ওমরাবাজ গ্রামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। লোকটি নিয়মিত মসজিদে যেত না, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েনি, জানা গেল সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ছিল, স্বীকারোক্তিতে সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গল্পঃ অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি

লিখেছেন ইসিয়াক, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১২

(১)
মাছ বাজারে ঢোকার মুখে "মায়া" মাছগুলোর উপর আমার  চোখ আটকে গেল।বেশ তাজা মাছ। মনে পড়লো আব্বা "মায়া" মাছ চচ্চড়ি দারুণ পছন্দ করেন। মাসের শেষ যদিও হাতটানাটানি চলছে তবুও একশো কুড়ি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×