বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গুলিতে এক নতুন ট্রেন্ড লক্ষ করা যাচ্ছে। সবাই স্থান কাল পাত্র আমলে না নিয়ে সমানে নিজের ছবি নিজে তুলে আপলোড করে যাচ্ছে। এ যেন নিজের সার্বক্ষণিক অবস্থা জানান দেওয়ার এক প্রতীকী প্রয়াস । এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গুলিতে ভাষায় স্ট্যাটাস ব্যক্ত করার আর কোন প্রয়োজন পড়ছেনা। নিজের আপলোড করা এ সকল ছবির এক্সপ্রেশানই বলে দেয় আপলোডকারির সর্বশেষে হাল হকিকত। নিজেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করার এই নবতর সংযোজন ‘সেলফি’ নামে সমধিক পরিচিতি লাভ করেছে।
সেলফি কি
ডিজিটাল ক্যামেরা অথবা ক্যামেরা ফোনের মাধ্যমে নিজের হাতে তোলা ছবিকেই ‘সেলফি’ বলা হয়। সেলফির মাধ্যমে সাধারণত ক্যাজুয়াল ছবি তোলা হয় যা বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেমন ফেসবুক, টুইটার, ইন্সটাগ্রাম ইত্যাদিতে শেয়ার করা হয়। সেলফি তোলার জন্য মিরর বা আয়নার সাহায্য নেওয়া যেতে পারে( সেলফোনে ফ্রন্ট ক্যামেরা যদি না থাকে)। তবে ক্যামেরা ট্রাইপডে রেখে টাইমারের সাহায্যে তোলা ছবিকে কিছুতেই সেলফি বলা যাবে না। সুতরাং এক কথায় হাতের নাগালে ক্যামেরা রেখে সোশ্যাল নেটওয়ার্কে শেয়ারের উদ্দেশ্যে নিজের হাতে তোলা ছবিকে সেলফি বলা হয়।
অক্সফোর্ড অভিধান মতে - স্মার্টফোন অথবা ওয়েব ক্যামেরার মাধ্যমে নিজেরই তোলা নিজের প্রতিকৃতি যা যে কোন সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার করা হয় তাকে সেলফি বলা হয়।
সেলফির ইতিহাস
১৯০০ সালে ‘ কোডাক ব্রাউনি’ বক্স ক্যামেরার মাধ্যমে আয়নার সাহায্য নিয়ে তোলা জনৈক মহিলার ছবিটিই সম্ভবতঃ বিশ্বের সর্বপ্রথম সেলফি।
১৩ বছর বয়েসি রাশিয়ার গ্র্যান্ড ডাচেস এনাস্টাসিয়া নিকল্ভেনা বিশ্বের প্রথম টিন এজার হিসাবে ১৯১৪ সালে নিজের সেলফি তুলে বন্ধুকে পাঠান। ছবির সাথে পাঠানো চিঠিতে তিনি বন্ধুকে লিখেছিলেন- ‘ আমি আয়নার দিকে তাকিয়ে এ ছবিটি তুলেছি। এভাবে ছবি তোলা খুব কঠিন, কারন আমার হাত কাঁপছিল’।
সেলফি শব্দটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন ফটোগ্রাফার জিম ক্রস ২০০৫ সালে। প্রাথমিক অবস্থায় তরুণদের মধ্যে সেলফি অধিক জনপ্রিয়তা পেলেও বর্তমানে এটি সমাজের সকল স্তরে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। ২০১২ সালের শেষের দিকে টাইম ম্যাগাজিনের দৃষ্টিতে ‘সেলফি’ শব্দটি বছরের আলোচিত সেরা দশ শব্দের অন্যতম শব্দ হিসাবে বিবেচিত হয়। ২০১৩ সালের জরিপ অনুযায়ী অস্ট্রেলিয়ান মহিলাদের দুই তৃতীয়াংশই (যাদের বয়স ১৮-৩৫) ফেসবুকে শেয়ারের উদ্দেশে সেলফি তুলেছেন। স্মার্টফোন এবং ক্যামেরা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান স্যামসাং এর জরিপ প্রতিবেদন বলছেঃ ১৮-২৪ বছর বয়েসি মানুষের তোলা ছবির ৩০% ই সেলফি। ২০১৩ সালে অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারির অনলাইন ভার্সনে ‘সেলফি’ শব্দটি নতুন সংযোজিত হয়। স্মার্টফোনের কল্যানে গত এক বছরে বাংলাদেশ সহ সমগ্র বিশ্বে সেলফি তুমুল জনপ্রিয় হয়ে উঠে।
সেলফির প্রকারভেদ
সেলফিকে নিম্নের কয়েকটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা যেতে পারেঃ
১। সেলিব্রেটি সেলফিঃ
বিভিন্ন জগতের বড় বড় তারকাগন নিজেদের যে সব স্বহস্তে তোলা ছবি ভক্তদের উদ্দেশে সোশ্যাল মিডিয়াতে শেয়ার করে থাকেন তাকে সেলিব্রেটি সেলফি বলা হয়।
২। পলিটিক্যাল সেলফিঃ
সেলিব্রেটি পলিটিশিয়ানদের সেলফি এ ক্যাটগরির আওতাভুক্ত।
৩। গ্রুপ সেলফিঃ
এক সঙ্গে কয়েকজন মিলে যে সেলফি তোলা হয় তাকে গ্রুফ সেলফি বলা হয়। কিছুদিন পূর্বে অস্কার পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে জেনিফার লরেন্স, মেরিল স্ট্রিপ, ব্রাডলি কুপারসহ অন্যান্য সেলিব্রেটিদের সাথে এলেন ডি গেনার্স এর তোলা একটা সেলফি টুইটারে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে।
উক্ত ছবিটিকে কেন্দ্র করে এক ঘণ্টার কম সময়ে ১.৭ মিলিয়ন রিটুইট হয়ে ছবিটি রেকর্ড বুকে স্থান করে নেয়। সম্প্রতি শেষ হওয়া বিশ্বকাপ ফুটবল উপলক্ষে বিভিন্ন দলের সমর্থকদের প্রিয় দলের জার্সি পরে গ্রুপ সেলফি তোলার প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। গ্রুপ সেলফিকে ‘wefie’ বা ‘Groupfie’ ইত্যাদি নামেও ডাকা হয়।
৪। ম্যাঙ্গো পিপল সেলফিঃ
আমার মত আম জনতা যারা তাদের তোলা সেলফি এ ক্যাটাগরিভুক্ত।
সেলফির সর্বশেষ ভার্সন – কাউফি এবং হজ্ব সেলফি
সম্প্রতি পালিত হওয়া হজ্ব এবং কুরবানির ঈদে হজ্ব সেলফি এবং কাউফি শব্দটি ব্যাপক পরিচিতি পায়। হজ্বের মত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত করতে গিয়ে অনেক মুসুল্লি এবার সেলফি জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনার স্বীকার হয়েছেন।
অনেকে মনে করেন এটা ভীষণ বাড়াবাড়ি। এতে পবিত্র হজ্বের ভাব গাম্ভীর্যতা নষ্ট হয়। আবার কেউ কেউ বলছেন- হজ্বে অনেকে জীবনে একবারই যাবার সুযোগ পায়, তাই সেলফির মাধ্যমে স্মৃতি ধরে রাখা দোষের কিছুনা। তবে অবশ্যই সব কিছুর একটা লিমিট থাকা উচিত। হজ্ব পালন করতে গিয়ে মুসুল্লিদের এ ধরণের আচরণ ধর্মীয় আচার সমূহ পালনে মনঃসংযোগ ব্যাঘাতের কারন বৈকি। মুসুল্লিদের এ সেলফি জ্বর ঠেকাতে সৌদি সরকার আগামীতে ক্যামেরা ব্যবহারে কড়াকড়ি আরোপ করতে পারে।
এবারের ঈদ –উল- আযহায় জনসাধারণের মধ্যে দেখা গিয়েছে কুরবানির গরুর সাথে সেলফি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপলোড করার হিড়িক। লোকমুখে এ ছবি সমূহ ‘কাউফি’ হিসাবে সমাদৃত হয়েছে।
কিছু দিন আগে ডাভ শ্যাম্পু কোম্পানি আয়োজন করেছিল- ডাভসেলফি কন্টেস্ট, যাতে তরুণীরা মাথায় ডাভশ্যাম্পু ব্যবহার করে চুলের বাহারি স্টাইল দেখিয়ে ছবি তুলে আপলোড করেছেন। উক্ত প্রতিযোগিতায় সেরা তিনজন বিজয়ীর ঘোষণা ডাভ শ্যাম্পুর ফেসবুক পেজে অলরেডি দেওয়া হয়েছে।
একইভাবে আমজনতার কাউফি ক্রেজকে কাজে লাগানোতে এবার মোবাইল অপারেটর রবি এবং টিভি চ্যানেল বৈশাখী ছিল এক কাঠি সরেস!! তারা আয়োজন করে ফেসবুক পেজে ‘কাউফি কন্টেস্ট’ এর। ইউটিউবে আপলোড হওয়া রবি’র ‘কাউফি সং’ ও এবার পবিত্র ঈদে জনসাধারণের মনে নির্মল বিনোদনের খোরাক যোগায়।
কাউফি সং
অতিরিক্ত সেলফি তোলা কি মানসিক ব্যাধি?
সম্প্রতি গবেষকগণ অতিরক্ত সেলফি তোলার প্রবণতাকে মানসিক ব্যাধি হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। তাদের ভাষায় এ রোগের নাম 'সেলফিটিস'। সেলফি তোলার প্রবণতার মাত্রা অনুযায়ী একে আবার বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। গবেষকেরা জানিয়েছেন, ব্যাধিটির তিনটি স্তর হতে পারে। প্রথম স্তরটি ‘বর্ডার লাইন সেলফিটিস’। মানসিক সমস্যার এই পর্যায়ে দিনে তিনবার নিজের ছবি তুলে কিন্তু সামাজিক যোগাযোগের সাইটে তা পোস্ট না করা। দ্বিতীয় স্তরটি হচ্ছে ‘অ্যাকিউট সেলফিটিস’। এই পর্যায়ে দিনে অন্তত তিনটি নিজের সেলফি তুলে সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটে তিনটি সেলফিই পোস্ট করা হয়। শেষ স্তরটি হচ্ছে ‘ক্রনিক সেলফিটিস’। এ পর্যায়ে নিজের সেলফি তোলা রোধ করা যায় না। দিনে অন্তত ছয়বার সেলফি তুলে সামাজিক যোগাযোগের সাইটে পোস্ট করতে দেখা যায়। এ ছাড়া বারবার নিজের ছবি তোলার প্রবণতা থাকে ক্রনিক সেলফিটিস পর্যায়ে।
সেলফি তোলা যদি মানসিক ব্যাধি হয়ে থাকে তবে কাউফি’কে কি বলা যায় ? –জাতির বিবেকের কাছে এ প্রশ্ন থাকল। কুরবানির পশুকে নিয়ে মানুষের এহেন কাউফি তোলার প্রবণতা আদিম যুগের বর্বরতা মনে হয় আমার কাছে। সেলফি তোলার এত সুন্দর সুন্দর উপজীব্য বিষয় থাকতে কুরবানির পশু কেন?
কিভাবে তুলবেন একটি ভাল সেলফি
সেলফির সঠিক ডেফিনিশন শুরুতে উল্লেখ করা হলেও এর আরও একটি অ্যাপ্লাইড ডেফিনিশন রয়েছে । এ ডেফিনিশন অনুযায়ী সেলফি হল - আশে পাশে ছবি তোলার মানুষজন না পেয়ে বাধ্য হয়ে নিজের ছবি নিজে তোলা!! আমার কাছে সেলফির এই ডেফিনিশনটা সবচেয়ে বেশি যুতসই মনে হয়। কারন আমি মাঝে মধ্যেই এ ধরনের মৃদু সমস্যায় পড়ি। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে লোকজনের ছবি তোলার পর হঠাৎ মনে হয় , আরে আমার তো একটি ছবি ও তোলা হল না। কখনো সখনো এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হয় যে কাউকে ছবি তুলে দিতে বলার মত অবস্থা থাকেনা। এ ধরনের পরিস্থিতিতে একমাত্র ভরসা সেলফি। একবার আইভরিকোস্টে এক আফ্রিকানকে আকারে ইঙ্গিতে একটা ছবি তুলে দিতে অনুরোধ করার পর সে অফেন্ডেড ফিল করে এমন কটমট করে তাকাল যে আমার তখন ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা। তখন ও সেলফির সাথে আমার পরিচয় ঘটেনি। এ ধরনের প্রতিকূল পরিবেশে নিজের স্মৃতি ধরে রাখার মোক্ষম উপায় হল সেলফি। তাই ভাল সেলফি তোলার খুঁটিনাটি বিষয় জেনে নেওয়া ভাল। নিচে দারুন কিছু টিপস দেওয়া হলঃ
১. সেলফি তোলার সময় আলোর বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। কারণ, সেলফির গুণগত মান ঠিক রাখতে আলোর ঔজ্জ্বলতা একটি বিবেচ্য বিষয়। নয় তো ফ্লাশের ঝলকানির মতো চেহারাও ঝলসে যাবে।
২. ক্যামেরার অ্যাঙ্গেল একটু সাইড করে নিয়ে ছবি নিতে হবে। যাতে বিপরীতে কিছু ছায়া পড়ে। এতে আপনার মুখ স্পষ্ট বোঝা যাবে।
৩. আলোকে সরাসরি পেছনে রেখে সামনে থেকে ছবি তোলা যেতে পারে। তবে ক্যামেরা ও আলোর মাঝখানে ফেইস রাখতে হবে।
৪. ছবিটিকে সম্পাদনা (এডিট) করার জন্য অসংখ্য অ্যাপ রয়েছে। এসব অ্যাপ ব্যবহার করে একটি বাজে ছবিকেও সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করা যায় । আর সম্পাদনা করার হাত ভালো হলে কেউ বুঝতেই পারবেনা যে ছবিটি সম্পাদনা করা ।
৫. ছবি এডিটিং খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ভালো ছবিতেও এডিট করতে হয়। এ জন্য একজন এক্সপার্টকে কাজে লাগাতে পারেন।
৬. বন্ধুদের নিয়ে একসঙ্গে সেলফি করলে সেটা সবচেয়ে ভালো হয়। জর্জিয়ার ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির এক গবেষণায় বলেছে, বন্ধুদের সঙ্গে ছবি তুললে আপনার ভাবমূতি ৩৮ শতাংশ বেশি ফুটে উঠে।
৭. আপনার ফোনের পেছনের ক্যামেরাটিকেই বেশি ব্যবহার করুন। কারণ পেছনের ক্যামেরাটিই মূল ক্যামেরা এবং এতে ছবি অনেক ভালো আসে।
৮. আর যদি আইফোন ৫ থাকে তবে তো কথাই নেই। এর মূল ক্যামেরার ছবির কোনো জুড়ি নেই। আইফোন ৫ এর পেছনের ক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলা অনেক সহজ।
৯. সেলফি নিতে ব্যাকগ্রাউন্ডের কথা যেন ভুল করেও ভুলে যাবেন না। এতে ছবিটি নান্দনিকতা পাবে। মনে রাখবেন, ছবি কেমন হবে তা নির্ভর করে ব্যাকগ্রাউন্ড কতো ভালো তার উপর।
১০. ব্যাকগ্রাউন্ড কোন দর্শণীয় স্থান হলে আপনার চেহারাটি ব্যাকগ্রাউন্ডের সঙ্গে সেট করে নিন। এতে ব্যাকগ্রাউন্ড স্পষ্ট হয়ে উঠবে এবং ছবিটির আবেদনও ফুটে উঠবে।
প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় নিত্য নতুন ট্রেন্ড আসবে যাবে। তবে এসব কিছুর ভাল দিক গ্রহন করে খারাপ বিষয় বর্জন করাই প্রকৃত স্মার্টনেসের বহিঃপ্রকাশ। তাই সকলের প্রতি সূক্ষ্ম আহ্বান – সেলফি ম্যানিয়ায় আক্রান্ত না হয়ে মাঝে মধ্যে সেলফি তুলুন আর ফেসবুকে নিজেকে স্মার্টলি উপস্থাপন করুন। আর ভুলেও কাউফি, , গোটফি, চিকেনফি, ডগফি, ক্যাটফি’র বিষয়টি মাথায় আনবেন না।
সাহস থাকলে চিড়িয়া খানা কিংবা সুন্দরবনে গিয়ে টাইগারফি তুলুন।
তথ্যসুত্র ও ছবিঃ উইকিপিডিয়া , প্রথম আলো, গুগল ।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই অক্টোবর, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:৪৩