মুখখানা কতক্ষণ ধরে ত্যালত্যালে করে রেখেছি? তিনঘণ্টা হয়ে গেল?
না বোধহয়, চারঘন্টাই হবে।
আর বেশিক্ষণ এভাবে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব না।
.
সবার সামনে নিজেকে চেপে ধরে রাখতে যে কি কষ্ট হচ্ছে, যারা শুধুমাত্র এ অবস্থায় পরেছে তারাই কেবল বুঝতে পারবে।
দম ফেটে যাচ্ছে। ওয়াশরুমের দিকে দৌড় দেব নাকি?
.
শেষ পর্যন্ত মনে হয় ধরা পরেই গেলাম। আমার এ অবস্থা দেখে এক বন্ধুপত্নী জিজ্ঞেস করল আমার কোন সমস্যা হচ্ছে কিনা। দুইদিকে মাথা ঝাঁকিয়ে না করলাম, মুখ দিয়ে কথা বলার অবস্থাও তো এখন নাই।
বেচারি আমার কথায় বিশ্বাস করেছে বলে মনে হলনা। কিছুক্ষণ সন্দেহজনকভাবে তাকিয়ে চলে গেল। আমি একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।
স্বস্তিটা যদি আমার কপালে থাকতো তবে তো বেঁচেই যেতাম। তা আর হলো কই!
একটু পরেই আমার সেই বন্ধুপত্নীর সুমহান পতিদেবতার অট্টহাসি শুনে এবার আমি পুরোপুরি কুপোকাত।
আরে বাবা, বেচারী একটু আগে যে মনে করেছিল আমি পাকস্থলীজনিত সমস্যায় ভুগছি সেটাই বরং বেশি ভালো ছিল। ছি ছি! এখন আমার এমন অবস্থায় পরার সত্যিকারের কারণটা জানতে পারলে আমি কারো কাছে মুখ দেখাবো কিভাবে!!
.
বিয়েবাড়ির অনুষ্ঠান নিয়ে বরাবর আমার তুমুল আগ্রহ থাকলেও আমি নিজে বিয়ে করার পর সে আগ্রহ পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেছি। আজকেও আসতে চাইনি কিন্তু আমি যার একান্ত অনুগত, আমার সেই পত্নী অহনা, তার কারণেই আমাকে আজ আসতে হল।
অনুষ্ঠানে এসে হাজির হওয়ার পর থেকেই বন্ধুরা অহনার সামনে সমানে ছবি তোলার কথা বলে যাচ্ছে আর বাঁদরগুলো আমার কানের কাছে এসে বলছে,
- দোস্ত! এতদিন দেখছি বউয়েরা স্বামীর সামনাসামনি পৌঁছানোর জন্য হাই হিল পরে, এখন তো মনে হয় বউয়ের চোখে চোখ রাখার জন্য তোকেই উল্টা হিল পরতে হবে .
এ কথা শোনার পর সেই যে বসে আছি তো বসেই আছি, ভুলেও একফোঁটা দাঁড়াই নি পর্যন্ত।
হতে পারে অহনা আর আমার মধ্যে হাইট নিয়ে একটু প্রবলেম আছে তাই বলে বন্ধুরাও এ নিয়ে খ্যাপাবে!!! লজ্জায় বলতে ইচ্ছে করছে, "ধরণী!! তোমার বুকে একটুকু জায়গা দিয়ে এ কুপুত্রকে রক্ষা কর মা!"
.
কোনসময় ধরণী এসে এ অধমকে রক্ষা করবে সেটা ভাবতে ভাবতেই দেখি হাজির হয়ে গেছে! জি না, ধরণী না। এত সৌভাগ্য আমার কপালে নাই সেটা আমি ভালো করেই জানি। অহনা এসে হাজির হয়েছে। এসেই বলল,
- কিসব শুরু করেছেন বলুন তো! আমি আপনার চেয়ে এক ইঞ্চি খাটো আছি। আর আমি হাই হিল পরি না। আসুন আমার সাথে, এক্ষুণি এইমুহূর্তে আমরা দাঁড়িয়ে ছবি তুলব।
বলে আমাকে টেনে নিয়ে গেল।
.
এ ঘটনা শোনার পর অনেকেই মনে করতে পারেন অতঃপর তাহারা সুখে শান্তিতে বাস করিতে লাগিলো।
কিন্তু আমার কপালে কি আর সুখ বলে কিছু আছে??
লাজুক স্বভাবের এই আমি কোনদিন ভুলেও কোন মেয়ের দিকে তাকাই নি। বাবা মা বলতেই কেমিস্ট্রিতে অনার্স অধ্যয়নরত অহনাকে মুখ বুজে চুপচাপ বিয়ে করে ফেলেছি। অবশ্য এ বিয়েটায় রাজি হওয়ার পেছনে অন্যরকম একটা ফ্যান্টাসিও কাজ করছিল। ভেবেছিলাম রসায়নে পড়ুয়া মেয়েকে বিয়ে করে দুইজনে ভালোবাসার রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটিয়ে ফেলব, তা আর হলো কই!
আচ্ছা, রসায়নে পড়ুয়া মেয়েরা এত কাঠখোট্টা হয় কিভাবে?
.
হয়ত দেখা গেল কোন একটা মজার ঘটনা তাকে রসিয়ে রসিয়ে বেশ আয়েশ করে বলব, সেখানে কথার মাঝে বাঁ হাত ঢুকিয়ে দুই লাইনে কিসব হাবিজাবি বলে আমার সবকিছু তালগোল পাঁকিয়ে দেয়। ইচ্ছে করে এমন করে, সেটা আমি ভালোই বুঝতে পারি! ভাবখানা এমন যেন দুনিয়ার সবকিছুই তার জানা হয়ে গেছে!
.
একবার বিয়ের পর সবার সাথে গ্রামের বাড়ি গিয়েছি। নতুন বিয়ে ছিল, বউয়ের লজ্জা ভাঙানোর দায়িত্ব তো আমারই। তাই রাতে ঘুমানোর সময় বললাম,
- জানো, সামনের বটগাছটায় না একটা ভূত থাকে!
বলেই জমে গেলাম। তখনি তো মনে পরলো, আরে! আমার মুখ দিয়ে 'ভূত' শব্দটা বের হল কিভাবে? আমি নিজেই তো ভূতে ভীষণ ভয় পাই।
অহনা হাই তুলে বলল,
- তাই নাকি! তাহলে আজ জানালার কাছে শুয়ে দেখি ভূতটা আসে কিনা!
বলে জানালা না লাগিয়েই শুয়ে পড়ল। এদিকে আমার তো জান কাঁপাকাঁপি অবস্থা। জানালা না লাগিয়ে ঘুমাবো কিভাবে!! সত্যি সত্যিই বটগাছটায় ভূত আছে কিনা কে জানে!
ভেবেছিলাম ভূতের কথা শুনে অহনা সারারাত আমাকে জড়িয়ে ঘুমোবে আর আমি তাকে অভয় দেব। এখন দেখি উল্টোটাই করতে হবে! কোনমতে সেদিন রাতটা না ঘুমিয়ে পার করে দিয়েছিলাম।
..
..
অহনার উপর প্রচন্ড রাগ লাগছে। কি দরকার ছিল সেদিন ওভাবে সবার সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার!
বাঁদরগুলো সেই ছবিগুলোতে কাঁচি চালিয়ে আমাকে অহনার ঘাড় পর্যন্ত নামিয়েছে। সেগুলো আবার ফেসবুকে অাপলোড দিয়ে আমাকে ট্যাগ পর্যন্ত করেছে!
অহনাকে একটা কঠিন শাস্তি দেয়া লাগবে। ও জানতো বাঁদরগুলো এমন করবে তবু ছবি তোলা চাই। আজ এমন একটা কাজ করব যাতে অহনা সারাজীবনে আর ঘাড়ত্যাড়ামি না করে আমার কথা শুনে যায়।
.
যে কথা সেই কাজ। খাটের পাশে গিয়ে কৌটার মুখটা খুলে দিলাম। অনেক কষ্ট হয়েছে তেলাপোকাটাকে ম্যানেজ করতে হয়েছে । দারোয়ানকে ঘুষ দিয়ে তেলাপোকা হাসিল করতে কম সময় যায়নি। সে ব্যাটাও ভীষণ ফাজিল, আজকাল নাকি তেলাপোকারও ডিমান্ড বেড়ে গেছে! যাক, আমার কাজ তো হয়েছে। এবার অহনা টের পাবে কত ধানে কত চাল!
তেলাপোকাটাকে ছেড়ে দিয়ে তৃপ্তির হাসি ঠিকমত হাসার আগেই দেখি সেটা আমার দিকে ছুটে আসছে। বারবার হুশহাশ করেও যখন লাভ হলনা তখন চিৎকার করে উঠলাম,
- বাঁচাও!! তেলাপোকা!!!
.
আমার চিৎকার শুনে অহনা দৌড়ে এসে তেলাপোকাটা দেখল। তারপর হাতে গ্লাভস পরে কি একটা স্প্রে নিয়ে তেলাপোকার গায়ে ছুড়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে তেলাপোকা ব্যাটা পটকা তুলল। অহনা গিয়ে সেটা বাইরে ফেলে দিয়ে এলো।
.
আমি ভুলেই গিয়েছিলাম কেমিস্ট্রিতে পড়ুয়া মেয়ের যে তেলাপোকা মারার প্রয়োজনীয় সরঞ্জামও থাকে!
অহনা আমার দিকে সূক্ষ্মদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
- কি বিড়বিড় করছেন?
আমি কোনরকম শান্ত হয়ে বললাম,
- মানে, তোমার খুব সাহস। তেলাপোকাটা কেমন করে মেরে ফেললে!
অহনা মুখ বাঁকিয়ে বলল,
- এটাকে তো ভয়ের কিছু নেই। ক্লাস নাইনে থাকতে আমাকে তেলাপোকার ডিসেকশন করতে হয়েছিল। তখন থেকেই বুঝেছি, যত গর্জে তত বর্ষে না।
বহু চেষ্টা করেও সেদিন মুখ দিয়ে একটা শব্দ বের করতে পারিনি। ত্যালত্যালে হাসিটাই শুধু রয়ে গিয়েছিলো।
.
এরপর আমি নিজেই আর কোনদিন ঘাড়ত্যাড়ামি করতে সাহস পাইনি।
বর্তমানে বাইরের সব কাজ সেরে চুপচাপ জেলখানার ভেতরে বসে অহনার কাজকর্ম দেখি। জেলখানা বলাটা বোধহয় কম হয়ে গেল, বাসাটাকে তো এর চেয়েও ভয়াবহ মনে হয়। লাইফটাকে চেয়েছিলাম কেমিস্ট্রিময় করে তুলতে, সেটা যে উল্টা রিয়েকশন ঘটিয়ে ফেলবে তা কে জানতো!
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ বিকাল ৫:৫৭