২০১১ সালের কথা বলছি। “আমার বাংলাদেশ” নামের যে গ্রুপটি এখন ফেসবুকে আছে আমি তখন তার একজন এডমিন। কিছুদিন আগে এই গ্রুপেরই একজন এডমিন মুশতাককে সরকার ৫৭ ধারায় ধরে জেলে পুরেছিল, পরে তাঁর অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু হয় জেলের ভেতরেই। আমি যখন এডমিন ছিলাম তখন এই গ্রুপ চালাতেন বিদেশ থেকে এক ব্যক্তি, যাকে কোনদিন আমরা দেখিনি, যার নাম কোনদিন শুনিনি, তবে বহুদিন তাঁর সাথে অনলাইনে মিটিং হয়েছে। তিনি নিজেকে পরিচয় দিতেন সাবেক সেনা অফিসার, প্রবাসে থাকেন, হাসিনা সরকারকে হটিয়ে ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী সরকার প্রতিষ্ঠাই তাঁর লক্ষ্য। আমার কাজ হল সরকারের নানা অনাচার নিয়ে লেখা। ওই ভদ্রলোক লিখতেন কোথায় কিভাবে ইসলাম ধ্বংস হয়ে গেল তা নিয়ে। একদিন বেইলি রোডে এক নাটকের খবর প্রকাশ পেল, নাম “নটী বিনোদিনী”। কথিত এই সাবেক সেনা কর্মকর্তা “নটী” শব্দের অর্থ পরিপূর্ণ না বুঝে গ্রুপে পোস্ট করলেন- “উচ্ছন্বে গেল দেশ- এই দেখুন হাসিনার আমলে কীসব নাটক হচ্ছে”।
সম্মানিত পাঠক, আপনারাও “নটী” শব্দটি দেখে ভুল বুঝবেন না। এই নটী সেই নটী নয়। এটি একটি চরিত্র, যিনি মঞ্চে অভিনয় করে মানুষকে বিনোদিত করেন। উনিশ শতকে বিখ্যাত এক মঞ্চাভিনেত্রীর নামই ছিল বিনোদিনী।
“নটী”-র আরেক অর্ধ বেশ্যা। বেশ্যা বলা হয় যিনি দেহকে বিক্রি করে অর্থ আদায় করেন। সেই অর্থে পৃথিবীর প্রতিটা শ্রমিকই বেশ্যা। কেউ যোনি ভাড়া দেয়, সেই ভাড়া দেয় দুটি হাত। হাত এবং যোনি দুটিই শরীরের অঙ্গ। আমরা কিভাবে একটি বিশেষ অঙ্গ ভাড়া দেয়াকে জঘণ্য ভাবা শিখলাম, কে আমাদের এভাবে শেখালো সেটি নিয়ে একটি বই পড়ছি, “উনিশ শতকে বাঙ্গালি মেয়ের যৌনতা”- যা নিয়ে আমি পরে একটি লেখা প্রকাশ করার বাসনা করেছি।
কথা হচ্ছে পরীমনি ও আরো কয়েকজন অচেনা মডেলকে গ্রেফতার করা নিয়ে। ওই মডেলদের কাউকে চিনিনা, পরিমনীর কোন সিনেমা দেখার ভাগ্যও আমার হয়নি। তবু তাঁদের এভাবে আটক নিয়ে অনেকেই লিখছে কারণ- মানুষ হিসেবে যে ন্যুনতম মানবিক মর্যাদা নিয়ে মানুষের বাঁচার অধিকার আছে- সরকার প্রশাসন সকলে মিলে মানুষের সেই সাংবিধানিক অধিকারকে প্রতিনিয়ত খর্ব করে যাচ্ছে। ধর্ষকের অভিযোগে কাউকে গ্রেফতার করে তাঁর বুকে লিখে দিচ্ছে ধর্ষক, মাদকের অভিযোগে ধরে বুকে সেঁটে দেয়া হচ্ছে মাদক ব্যবসায়ী। জনগণ হিসেবে আমাদের তিনটি বিষয় মনে রাখতে হতে হবে। প্রথমত পুলিশ র্যাব বিচারক নয়, তাঁরা ধৃত লোকের বুকে এই তকমা দিতে পারেন না, দ্বিতীয়ত, এগুলো মানুষ, শিম্পাঞ্জী নয়। মানুষের আছে অপমানবোধ, আছে ন্যুনতম সম্মান পাওয়ার অধিকার। রক্ত দিয়ে অর্জিত এই দেশের পবিত্র সংবিধান মানুষের সেই অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে।
তৃতীয়ত, জনমানসের আদালত- যেটি দিয়েই লেখার পরিসমাপ্তি করবো। কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠার সাথে সাথে আমরা আমাদের হৃদয়ের আদালতে বিচার করে ফেলি, রায় দিয়ে ফেলি। সেই বিচারটা আবার একটু নারীবিদ্বেষীও। যেমন ধরুন, সুবর্ণা মুস্তাফা এক কম বয়েসী পুরুষকে বিয়ে করেছেন তাই সে চরিত্রহীনা। অপরদিকে শাওন বা মিথিলা বেশি বয়সী পুরুষ হুমায়ুন আহমদ বা সৃজিতকে বিয়ে করেও চরিত্রহীনা। এসবের কোন ক্ষেত্রেই নারীকে যেভাবে জনগণের বিবেকের আদালতে বিচার করে দোষী সাব্যস্ত করা হয়, পুরুষকে তার কানাকড়ি দুর্নামও সইতে হয় না।
আদালতে প্রমাণের আগেই কাউকে অপরাধী সাব্যস্ত করার বহু বিপদ আছে। এতে নিরাপরাধ মানুষও অবিচারের মুখোমুখি হতে পারে। ২০১১ সালে চিত্রপরিচালক তারেক মাসুদ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। যে বাসের সাথে সংঘর্ষ হয় সেটির চালক জামির হোসেন যাবজ্জীবন সাজার বোঝা মাথায় নিয়ে গত সপ্তাহে কারাগারেই হৃদরোগে মারা গেছেন। কিন্তু বিভিন্ন গবেষণায় আমরা জানি জামির হোসেন নির্দোষ ছিলেন, মূল দোষ ছিল তারেক মাসুদদের বহনকারী মাইক্রোবাসের চালকের। বুয়েটের গবেষণাকারীরা এটি প্রমাণ করেছেন। কিন্তু তারেক মাসুদের মত মূল্যবান ও নামী মানুষের মৃত্যুর পর জনগণের মাঝে যে বিশাল প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল, সেকারণেই যথেষ্ট প্রমাণ থাকা স্বত্বেও জামির হোসেনকে আদালত দণ্ড দেয়।
১৯৯০ সালের মার্চে কোলকাতার হেতাল পারেখ নামের এক কিশোরীকে ধর্ষণ ও হত্যার দায়ে নিরাপত্তাকর্মী ধনঞ্জয়কে অভিযুক্ত করা হয়। ১৪ বছর জেল খেটে তাঁর ফাঁসি হয় ২০০৪ সালে। অভিযোগ আছে, তৎকালীন সরকার জনমানুষের চাপে বাধ্য হয়ে, ভোটের স্বার্থে পরিপূর্ণ দোষী প্রমাণিত না হয়েও ১৪ বছর জেল খেটে ফাঁসিতে ঝুলতে হয় ধনঞ্জয়কে। এই নিয়ে সমাজকর্মী পরমেশ গোস্বামী, অধ্যাপক দেবাশিস সেনগুপ্ত এবং অধ্যাপক প্রবাল চৌধুরী একটি বইও লেখেন ‘আদালত মিডিয়া সমাজ এবং ধনঞ্জয়ের ফাঁসি’ নামে। ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়ের ফাঁসির ফাঁক ফোকর নিয়ে বিস্তারিত তাঁরা আলাপ করেন এই বইতে। এ নিয়ে ২০১৭ সালে ওখানে সিনেমাও হয়েছে “ধনঞ্জয়” নামে।
এত কথার একটাই অর্থ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যখন কাউকে ধরবে, মানুষ হিসেবে যতখানি সম্মান প্রাপ্য সেটা মেনেই যাবতীয় কর্মকান্ড চালাতে হবে। অপরদিকে অপরাধী প্রমাণ হওয়ার আগে কেউ অপরাধী নয়। নীতিবাদী শুভবাদী ও সাধারণ জনগণ হিসেবে এই কথাটুকু যেন আমরা মাথায় রাখি।
বার্লিন থেকে
জাহিদ কবীর হিমন
সম্পাদক, জার্মান প্রবাসে