ভ্রাম্যমান জীবন ও একটি বিশেষ স্টেশনঃ
যাত্রার সম্ভাব্য সময় ছিলো সকাল ৮ঃ৩০ বা ১০ টা। এটা গিয়ে ঠেকলো ১১ঃ৩০ কি ১২ টায়। চা-নাস্তার পাঠ চুকিয়ে দুলাভাই এর সাথে গেটের বাইরে পা রাখলাম। গন্তব্য উত্তরা থেকে মতিঝিল। কিভাবে যেতে হবে আমি নিদ্দৃষ্ট জানিনা। এটুকু জানি বিমানবন্দর রেল স্টেশন থেকে ট্রেনে করে খুব সহজেই যাওয়া যায়। রাইদায় চড়ে চলে এলাম খানিকটা, সেখান থেকে বিবানবন্দর স্টেশন।
এ যেন লাখের ভীড়ে চিরে চেপ্টা হওয়ার এক উদ্যান। যেখানে সবাই ছুটবে, যে যাকে ফেলে আগে লাফিয়ে-ঝাপিয়ে ট্রেনে উঠতে পারে! আমি তবুও বেশ নিস্তেজ ভাবেই হাটছিলাম অথবা ওজনের কারনে হাঠতে বাধ্য হচ্ছিলাম। দুলাভাই বেশ চটপটে ভাবে সমানে পা বাগিয়ে হেটে চলেছেন। স্টেশনের যে লাইনে ট্রেন অবস্থান করছিলো আমরা ঠিক তাঁর বিপরীত লাইনে ছিলাম। আমি যখন ভাবছিলাম পুরোটা পথ ঘুরে ওপাশে যাবো তখন ভাই কে দেখলাম হেসে-খেলে নীচে নেমে পার হয়ে যাচ্ছেন। আমি পেছনে পড়ে থাকি কি উপায়! নেমে গেলাম, তাল মেলাতে হিমশিম খেলেও পেছন ছাড়লাম না। ট্রেন যদি ধরতে না পারি আর ভাই যদি আগে উঠে বসে থাকে লজ্জার ব্যাপার হবে!
ট্রেনে উঠতে গিয়ে দেখি লঙ্কাকাণ্ড । মানুষ ঝুলছে, কেউ উঠার জন্য লাফাচ্ছে, কেউ সিনেমার ক্লাইমেক্সের মত দৌড়ে আসছে। ক্লামেক্স দেখতে গিয়ে আমি না আবার এন্টি ক্লামেক্স এর দৃশ্য হয়ে যাই এই ভেবে আমিও ভারি শরীর টা নিয়ে ঝুলে পড়লাম। ভেতরে প্রবেশের উপায় না পেয়ে কিছুক্ষন অসহায়ের মত ঝুলে থাকলাম। শেষ পর্যন্ত কিছুটা জায়গা পেয়ে ঝুলাঝুলি বাদ দিয়ে ঘর্মাক্ত মানুষের সাথে অনিচ্ছাকৃত কোলাকুলি করতে করতে ভেতরে ঢুকে পড়লাম।
সবাই যার যার স্থানে যেন অনড় পাথর। কেউ কাউকে জায়গা ছাড়তে নারাজ। আগত্যা যদিও ছাড়ছে মুখ থেকেও দু কথা ছাড়ছে। ৩০ মিনিটের পথ । ১৫ মিনিট যেতেই এক বৃদ্ধ হৈচৈ করে উঠলেন তিনি নামবেন। কেউ বলে উঠলো ট্রেন থামবেনা। আবার কেউ বলে উঠলো,”স্লো হলে নামবেন উনি”। কোন পাশ থেকে কে জানি বলে উঠলো আরে লাফ দেন তো! মনে মনে আতকে উঠছি, একি হাল! শেষ মেস কিনা চলন্ত ট্রেন থেকেই লাফ দিতে হবে! শেষ পর্যন্ত ট্রেন থামতে থামতে একেবারেই থেমে গেলো। বৃদ্ধ নেমে গেলেন।
আবার শুরু হলো যাত্রা। সবাই যে যার পকেটে এক হাত দিয়ে যত্নে রেখেছেন। ঘর্মাক্ত মুখ গুলো ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত। তবে কি যেন উদ্দেশ্য তাদের চোখে মুখে খেলা করে যায়! সেখানেই বুঝি তাঁরা জীবন শক্তি পায়। কেউ কারো না কারো জন্য , পরিবারের জন্য সংগ্রামে আছে । কেউ শুধুই নিজের ক্যারিয়ার এর জৌলুস বাড়াতে খেটে চলেছে। এটাই হয়ত তাদের জীবনশক্তি।
চলে এলাম। আহ হাফ ছেড়ে বাঁচলাম । স্টেশন থেকে মতিঝিল পৌছে গেলাম অনতিবিলম্বে। সেখানে কাজ সারতে সারতে বিকেল। যতই ফেরার সময় কাছিয়ে আসছিলো মনে জাকিয়ে আসছিলো ভয়! আবার সেই ট্রেন! আবার সেই ঝোলাঝুলি,কোলাকুলি! ভাবতে ভাবতেই দুলাভাইএর সাথে বঙ্গভবন, জাতীয় মসজিদ দেখা হলো। কলম, কোরআনা শরীফের বাংলা অনুবাদ , ব্যগ ইত্যাদি কেনাকাটা সেরে ফেরার পথ ধরলাম। আবার সেই স্টেশন! মাগরিবের নামাজ পড়ে ট্রেনের দিকে হাটা দিলাম। এর মধ্যেই কোন একসময় ভাইকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, উত্তরা এখান থেকে বাসে যাওয়া যাবে নাকি। উত্তরটা মোটেই রুচিকর ছিলোনা। যাওয়া যাবে তবে সময়টা ক্ষেপনের জন্য বেশি-ই।
সাতটার ট্রেনে চেপে বসলাম। কমলাপুর থেকে বিমানবন্দর গন্তব্য। দুটো সীটে বসে পড়লাম। সীটের লোক আসলে উঠে পড়তে হবে এই মর্মে নিজেকে ঝালিয়ে নিয়ে। দেখতে দেখতেই ঘর্মাক্ত, ক্লান্ত মানুষগুলোতে ট্রেনের বগি পূর্ণ হচ্ছিলো। আমরা একটা সীট হারালাম, সীটের মালিক এসে পড়ায়। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমি জনসমুদ্রে বার বার নিজেকে হারিয়ে ফেলছিলাম। যেখানটায় জায়গা নেই সেখানেই কেমন করে জানি দুই তিন জন দড়িয়ে যাচ্ছিলো বিভিন্ন কারিশমায়। মুড়ির টিনে মুড়িও বুঝি এত যুতসই ভাবে খাপে খাপে আটেনা!
এর মাঝেই ট্রেনের যাত্রা শুরু হলো। একটা বাচ্চা ছেলে কেঁদে কেঁদে ভিড় ঠেলে এগোনর চেষ্টা করছে। তাঁর খুবি ইয়ে পেয়েছে। এবং তাঁর জেদ সে টইলেটেই কাজ সারবে। তবে সে পর্যন্ত যাওয়া তাঁর ভাগ্যে ছিলোনা। সবাই তাকে যাওয়ার জায়গা করে দিতে চাইলেও সম্ভব হচ্ছিলোনা। এতটাই ঘনিষ্টতা এই দাড়ানোতে ছিলো। কেউ বুদ্ধি দিলো,”বোতলে…, কেউ বল্ল, “‘’রে পলিথিন আছেনা…”।
এত সব শুনে ছেলেটা অপমানে আরো জোরে অশ্রু বিসর্জন দিলো। ছেলেটা কেঁদে ভিড়ে হারিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তাকে কাঁদতেই দেখলাম্ , এরপর সে ভিড়ে হারিয়ে গেলো।
এর মাঝে আবার পকেটের টেনশন। সকালের আর এই বেলার মুখগুলোর মাঝে অনেক পার্থক্য। অনেকেই হয়ত হতাশ,অনেকেই খুশি, অনেকেই যেতে হবে যাচ্ছে ফিরতে হবে ফিরছে।সকালের তেজ আর নেই, সারাদিনের কাজের পরে । এখন সবাই একটু বিশ্রাম চায়। অনেকের চোখেই হয়ত এক কাপ চা বা ঠান্ডা এক গ্লাস শরবত আর নিজের বাসার ছবি-ই ভাসছে চোখে। অথবা অনেক্র জন্য বাসা বলে কিছু নেই, শূন্যতা ছাড়া।
এসব দেখতে দেখতেই চলে এলাম বিমানবন্দর। এখানে বেশিক্ষন ট্রেন থেমে থাকেনা। আবার শুরু… কাকে ঠেলে কে নামবে। সবার মাঝেই ভয় নামতে না পারলে পরের স্টেশন। যারা উঠবে তারাও ভয়ে ধরতে না পারলা শেষ, আর আশা নাই। এমতাবস্থায় কেহ কারো নহে। জোর যার মুল্লোক তাঁর এই কথার মর্মার্থ বুঝতে এর বেশি আর কিছু দেখার দরকার পড়েনা।
হুম নেমে এলাম অনেক সাধনার পরে। ভাইয়ের অভ্যেস আছে বেশ! তাঁর নির্বিকার চলাফেরায় বোঝা যায়। বিবানবন্দর স্টেশন থেকে বের হওয়ার অনেক পথের মধ্যে একটি---
” বিশেষ লোহার তিন লাইনের বর্ডারের বা পার্টিশনের উপর বা ভেতর দিয়ে কায়দা করে গলে পার হয়ে যাওয়া! বড় বড় মানুষেরা ছোট ছোট বাচ্চার মত নিশ্চিন্তে, মাথা গলিয়ে লাফিয়ে কুদিয়ে পার হয়ে যাচ্ছেন। বাচ্চারা এই দৃশ্য দেখলে মজা পাবে নিশ্চিত।
যথারীতি পেটের দায়ে আমি আটকা পড়লাম । পরে এক পা দু-পা করে সিঁড়ির মত চড়ে উপর দিয়ে পার হলাম আর দুলাভাই সুড়ুৎ করে পার হয়ে গেলেন। আমি পার হতে কষ্ট হওয়াতে কে জানি নিজের হালকা শরীর নিয়ে খুশি হয়ে বল্লঃ” আহ হালকা হয়ে আমার এই এক সুবিধা”
পার হয়ে লোকটাকে ধরে বলতে চাইলাম” মোটা লোকের অর্ধচন্দ্র কপালে জুটলে সুবিধা বের হয়ে যাবে” । সন্ধ্যার আঁধারে আর তাকে পাওয়া গেলোনা। আমি ভাইয়ের সাথে হাটা শুরু করলাম।
এর মাঝেই এক লোক বর্ডার ক্রস করার চেষ্টা করছে এপার থেকে ওপারে। ব্যাগ নিয়ে সে যদিও বা পার হলো, তাঁর ট্রেন ততক্ষনে ছেড়ে দিয়েছে । লোকটাকে দেখলাম লাফাচ্ছে আর ট্রেনের হাতল ধরে উঠার চেষ্টা করছে। সে কি প্রানান্তকর চেষ্টা। ট্রেনের স্পীড খুব বাড়লো। লোকটা তবুও চেষ্টা ছাড়লোনা। আরেক দরজায় গিয়ে আবার চেষ্টা , কিছু ধরে লাফ দিয়ে উঠার্, এই বুঝি ট্রেনের নীচে গেলো। লাফাতে লাফাতে লোকটা আরো সামনের দিকে চলে গেলো… শেষ পর্যন্ত আর দেখতে দাড়ালাম না। দৃশ্যটা মোটেই সুখকর নয়।
আপুর বাসায় আসতে আসতে একটা জিনিশ ই চিন্তা করছিলাম। এর শেষ কোথায়। প্রত্যেকটা মানুষ-ই ভ্রাম্যমান জীবন নিয়ে ছুটে চলছে এক স্টেশন থেকে আরেক স্টেশনে…
কেউ উঠতে পারছে কেউ পরের ট্রেন ধরছে, কেউ না পেরে অন্য ভাবে গন্তব্যে পৌছুচ্ছে। একটা জিনিশ বড় বেশি মনে বাজলো। সবাই আসলে ভ্রাম্যমান জীবন নিয়ে জীবনের শেষ স্টেশনের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছি! আর আমরা ভাবছি কমলাপুর, উত্তরা, উখিয়া, আখাউড়া বা অমুক জায়গায় যাচ্ছি। যত এগুচ্ছি সবাই শেষ স্টেশনের নীকটে চলে যাচ্ছি অজান্তেই! সেখানেই এই ভ্রাম্যমান জীবনের সমাপ্তি ।
আখেরি স্টেশন নীকটে! যাত্রি সাধারণ তৈরি থাকুন। এখানে আগে পরে নয়, আর যুদ্ধ নয়-সবাই পৌছুবে! ভুলেও কেউ বাদ যাব না আমরা। বিশেষ স্টেশন বলেই এটা সম্বব! এমন স্টেশন যার উদ্দেশ্যে আপনার যাত্রার শুরু জন্মের সাথেই সাথেই!
এই স্টেশন টাতেই কিন্তু আমরা সবার পরে নামতে চাই বা নামতেই চাইনা। সৌভাগ্যবান কয়েকজন আছেন যারা টিকিট হাতে থাকায় আর লাগেজ সাথে থাকায় বীরদর্পে সবার আগে ভাগে এই বিশেষ স্টেশনে নেমে যেতে চায়!
প্রথম প্রকাশঃ আমারজীবনী
লেখকঃজুনাইদ বিন কায়েস
লেখনী স্বত্বঃ লেখক
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই অক্টোবর, ২০১৮ দুপুর ২:০১