আপনি কি জানেন আজ সুর্য্য ডোবার সাথে সাথেই অধিকাংশ থাইবাসীদের দরজা বন্ধ হয়ে যাবে, গাঢ় রঙের পর্দা টেনে দেয়া হবে এমন ভাবে যেন একটুও ফাক না থাকে,বাইরে থেকে একফোটা আলোও যেন ঘরে প্রবেশ না করে। কেউ যদি সন্ধ্যার পর পরিচিত গলায় ডেকে ডেকে বাইরে থেকে দরজা ধাক্কিয়ে মরেও যায় তবুও দরজা খুলবে না সকাল না হওয়া পর্যন্ত। খুব অবাক হলেন কি ! আমি যখন ব্যাপারটা প্রথম শুনি আমার কাছেও খুবই আজব লেগেছিল ।
প্রথম যিনি আমাকে এ ব্যাপারে জানিয়েছি্লেন তাঁর কথা শুনে আমি থ! আমি বিস্মিত নেত্রে তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম কেন !! সেও ততোধিক বিস্মিত হয়ে আমাকে উলটো জিজ্ঞেস করেছিল "কেন তুমি জানো না আজ যে চন্দ্র বছরের সপ্তম মাসের ১৫ তম দিন"! হ্যা জানি তাতে কি ! সে ভীত সন্ত্রস্ত মুখে আমার কানের কাছে ফিস ফিস করে বল্লো "জানো আজ নরকের রাজা নরকের দ্বার খুলে দেবে যাতে সমস্ত ক্ষুধার্ত প্রেতাত্বারা পৃথিবীতে আসতে পারে, স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়ানোর সাথে সাথে তাদের জীবিত আত্মীয়স্বজনের সাথে দেখা করতে পারে"। আমার তো শুনে ভয়ে হাত পা কাপতে লাগলো । তোতলাতে তোতলাতে বললাম 'কি বলো এইসব' !! বল্লো "সত্যি বিশ্বাস না হয় দেখো তুমি আজ কেউ রাস্তায় বের হবে না"।
ব্যাংকক একটা শহর যে কি না সারা রাত জেগে থাকে, নারী পুরুষ নির্বিশেষে সারারাত নিশ্চিন্তে চলাচল করছে, যখন ক্ষিধে পায় রাস্তায় বের হলেই খাবার। সেখানে কিনা সব ভেন্ডার থেকে শুরু করে বেশিরভাগ দোকান বন্ধ করে দিবে সুর্যাস্তের আগেই। এই আধুনিক যুগে এমন কাহিনী যে অবিশ্বাস্য ।
সেই কৌতুহলই আমাকে টেনে নিয়ে গেল এক অচেনা জগতে যা পড়ে আমি বিস্ময়াভুত হোলাম বৈকি, বিভিন্ন তথ্য থেকে জানলাম এই ব্যাতিক্রমী ভুত উৎসবের উৎপত্তি বৌদ্ধ আর তাও ধর্ম থেকে হলেও প্রাচীনকাল থেকেই চীনে এর ব্যাপক প্রসার ঘটে, যা পরবর্তীতে দক্ষিন পুর্ব এশিয়ার বৌদ্ধাধর্মাবলম্বী অনেক দেশেই এটা বিভিন্ন নামে উদযাপিত হয়ে থাকে। চন্দ্র পঞ্জিকার সপ্তম মাসের ১ম দিনেই নরকের রাজা নরকের দরজা খুলে দিলেও ১৫ তম দিন হলো প্রধান উৎসবের দিন। এই দিনই দলে দলে ক্ষুধার্ত নরকবাসীরা পৃথিবীর দিকে ছুটে আসে।
ভুত উৎসব
বিভিন্ন দেশে এই ভুত উৎসবের বিভিন্ন নাম থাকলেও থাইল্যান্ডে এর নাম সাত থাই / ওয়ান না রক। এই উৎসব চন্দ্র বছরের সপ্তম মাসব্যাপী সারা থাইল্যান্ডের বিভিন্ন মন্দির জুড়ে চলতে থাকে বিশেষ করে নাখন রাচাসিমা সংক্ষেপে কোরাট প্রদেশে এর ব্যপকতা বেশি। বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা বিভিন্ন মন্দিরে নিয়মিত প্রার্থনার সাথে সাথে এই সব নরকবাসীর জন্য বিশেষ প্রার্থনা করে থাকে।
মৃত ব্যাক্তিদের আত্মীয়স্বজনরা যারা মনে করে এই প্রেতাত্বাদের সাথে তাদের পুর্বপুরুষরাও রয়েছে। আর তাই তাদের আত্মার শান্তি কামনার জন্য মন্দির প্রাঙ্গনে লাল মোমবাতি জালিয়ে থাকে, করে চমকপ্রদ আলোকসজ্জা,জ্বালায় সুগন্ধি ধুপকাঠি,পানিতে ভাসিয়ে দেয় অসংখ্য ছোট ছোট কাগজের নৌকা যাতে জলতে থাকে প্রদীপ। এছাড়াও বাতিগুলোতে মৃত ব্যাক্তিদের নাম লেখা থাকে এবং সেটা জলতে থাকে পুরো উৎসব পর্যন্ত। এ ছাড়াও ক্ষুধার্ত নরকবাসী আত্মীয়স্বজনের জন্য উৎসর্গ করে থাকে ভাত, মাংস আর ফল, নাহলে হয়তো জ্যান্ত মানুষকেই খেয়ে ফেলবে বলে তারা বিশ্বাস করে না তবে ক্ষতি করতে পারে তারা। তাদেরকে সন্তষ্ট করার জন্যই এই সব অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
এর মাঝে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হলো সারা মাস ধরে কাগজের নকল টাকা পোড়ানো। এছাড়াও কাগজের তৈরি ছোট ছোট গাড়ি-বাড়ি,কাপড়-চোপড়ও পোড়ানো হয়ে থাকে এই বিশ্বাসে যে এই জিনিসগুলো নরকবাসীদের আগামী বছর পর্যন্ত কাজে লাগবে। মানুষজন মনে করে এই সব প্রেতাত্বারা হলো তাদের পুর্ব পুরুষ যাদের মৃত্যুর পর সঠিকভাবে নিয়ম নীতি মেনে শেষকৃত্য করা হয় নি। এইসব নরকবাসীরা পৃথিবীতে বেচে থাকা আত্মীয়স্বজনের জন্য সৌভাগ্য বয়ে নিয়ে আসবে এই হলো ভুত উৎসব পালনের মূল বিশ্বাস।
তবে ভীতু থাইবাসীরা অনেকেই ভুতের সাথে মোলাকাত করতে সাহস পায় না তাই আজ সন্ধ্যার পর তারা খাবার নিয়ে ঘর বন্দী। তাদের বিশ্বাস এই নরকবাসীরা সুযোগ পেলেই তাদের সাথে সাথে ঘরে চলে আসবে। এছাড়াও আজকের দিনে রাতে
১।কালো পোশাক পরা যাবে না,
২।সন্ধ্যা বিশেষ করে মধ্য রাতের পর বাইরে থাকা যাবে না,
৩।কোন জীব এমন কি পোকা মাকড়ও মারা যাবে না,
৪। প্রার্থনার জিনিস পা দেয়া যাবে না,
৫।গভীর পানিতে নামা যাবে না,
৬।পাহাড় বনানী এড়িয়ে চলতে হবে
৭।কোন অপরিচিত লোক দেখলে এড়িয়ে চলতে হবে।
এমন আরও নিয়ম কানুন আছে ।
আজ চীন সহ সারা দক্ষিন পুর্ব এশিয়া ভুতের ভয়ে ভীত। আপনারাও আজ সন্ধ্যার পর থেকে ঘরে থাকুন, থাইল্যান্ড আর আমাদের মাঝখানে শুধু মিয়ানমার । তো এই মিয়ানমার পার হয়ে নরকের ক্ষুধার্ত প্রেতাত্বাদের আমাদের দেশে আসতে বেশি সময় লাগার কথা না। এই আধুনিক যুগেও কি অদ্ভুত বিশ্বাস, তবে আধুনিক তরুন তরুনীরা একে উৎসব হিসেবে শুধু অংশগ্রহন করে কিন্ত বিশ্বাস করে না।
ছবি নেট , কিছু কিছু তথ্য নেট ও আমার থাই প্রতিবেশি
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০২১ সন্ধ্যা ৭:৪২