বাংলা বর্ষবরণ বাংলাদেশের বড় উৎসবে পরিণত হয়েছে। এটা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সামাজিক উৎসব। দিনদিন তার উজ্জ্বলতা বাড়ছে। বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো এর পৃষ্ঠপোষকতা করছে। বর্তমানে যেভাবে বাংলা নববর্ষ পালিত হচ্ছে তার সূচনা খুব বেশি আগে হয়নি। ১৯৬৭ সাল থেকে ছায়ানট রমনার বটমূলে বর্ষবরণের অনুষ্ঠানটি করছে। আর চারুকলার শোভাযাত্রা শুরু হয়েছে ১৯৮৯ সালে। শুরুতে এর নাম ছিলো আনন্দ শোভাযাত্রা। ১৯৯৬ সাল থেকে এর নাম হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। এই ক’বছরেই তা এভাবে বিকশিত হয়েছে। ১৯৮৬ সালে চারুপীঠ নামের একটি প্রতিষ্ঠান যশোরে প্রথমবারের মতো নববর্ষ উপলক্ষ্যে আনন্দ শোভযাত্রার আয়োজন করে। যশোরের সেই শোভাযাত্রায় ছিল পাপেট, বাঘের প্রতিকৃতি, পুরানো বাদ্যসহ আরো অনেক শিল্পকর্ম। শুরুতেই যশোরে সেই শোভাযাত্রা আলোড়ন তৈরি করে। যশোরের শোভাযাত্রার উদ্যোক্তাদের একজন মাহবুব জামাল শামীম মাস্টার্স ডিগ্রি নিতে ঢাকার চারুকলায় চলে আসেন। যশোরের সেই শোভাযাত্রার আদলেই ঢাকার চারুকলা থেকে শুরু হয় বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা। নববর্ষ উপলক্ষে বাঙালির সংস্কৃতিতে যুক্ত হয় নতুন মাত্রা।
তবে নববর্ষ উদযাপনের বর্তমান রীতিটি একেবারেই নাগরিক। পান্তা-ইলিশ খেয়ে একটা গ্রামীন ভাব আনার চেষ্টা থাকলেও তার সাথে গ্রামের কোন সংযোগ নেই। গ্রামের লোকেরা বরং নতুন বছরে ভালো ভালো খাবার খান। তাঁরা মনে করেন, বছরের প্রথম দিনে ভালো খেলে সারা বছর ভালো খাবার খাওয়া যাবে। শহরের বর্ষবরণে পাশ্চাত্য ধারার নববর্ষ উদযাপনের অনুকরণই বেশি চোখে পড়ে। সাথে অবশ্য আমাদের গ্রামীণ ঐতিহ্যের কিছু মিশেলও থাকে। গ্রামের মেলার আদলে শহরে বৈশাখী মেলা হচ্ছে। গ্রামীণ মেলার অনেক উপকরণ শহরের মেলায় বিক্রি হয়।
গ্রামে গ্রামে চৈত্রসংক্রান্তির মেলা হতো। আর হতো বৈশাখী মেলা। বাজারের দোকানগুলোতে হতো হালখাতা অনুষ্ঠান। শৈশবকালে বাবা চাচার হাত ধরে দোকানে যেতাম। প্রথমেই মিস্টিমুখ করানো হতো। বড়োরা পান মুখে দিয়ে কিছু টাকা দিতেন। সেই টাকার অংক নতুন খাতায় তুলে নতুন হিসাব নিকাশ শুরু হতো।এটাই হালখাতা নামে পরিচিত।এছাড়া চৈত্র সংক্রান্তিতে হিন্দু পরিবারগুলোতে বিশেষ ধরণের খাবার তৈরী হতো। কোনো কোনো মুসলমান বাড়িতেও তার কিছু ছাপ দেখতাম। বিশেষ করে তিতা আইটেম থাকতো। গাছভরা ছোট ছোট আম থাকলেও চৈত্র সংক্রান্তি পার না হলে আমরা সে পিচ্চি আম খাওয়া শুরু করতাম না।
মেলাগুলো বসতো মাঠের মাঝে কোন বড়ো গাছের নীচে। কোন কোনটা বসতো বাজারের অদূরে খোলা জায়গায়। বড়োদের হাত ধরে অনেক মেলায় গেছি। মূলত: গ্রামে উৎপাদিত ফসল আর ঘরে তৈরী নানা জিনিস মিলতো সেখানে। অনেক ধরনের মিষ্টি. জিলাপী, বাতাসা, মুড়ি, মুড়কি, খই ইত্যাদি পাওয়া যেতো। পাওয়া যেত অনেক রকমের খেলনা, বাঁশি, বেলুন, শাড়ী চুড়ি, লেইস ফিতা, আলতা সাবান ইত্যাদি। নানা রকমের খেলার আয়োজন হতো। ছিলো লোকগানের আয়োজন। দোলনা আর চরকী চড়ার প্রতি ছোটদের সবার ছিলো অনেক আকর্ষণ। সবার সাথে ভাববিনিময়ের পাশাপাশি ব্যবসাবাণিজ্য ছিলো মূল লক্ষ্য। কিছুটা বদলে গেলেও গ্রামীণ মেলাগুলোর বেশীরভাগ এখনো চালু আছে। নানা উপলক্ষে তার আয়োজন চলে। কিছু কিছু মেলা এক/দুই সপ্তাহ ধরে চলে।
অবাক আঁধার !
বাংলা সনের ঠিকুজি খুঁজতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম এর নির্ভরযোগ্য ইতিহাসের কোন হদিশ নেই। সেখানে রাজত্ব করছে অজানার এক অবাক আঁধার। মাত্র দুটি বইতে সন তারিখের বিষয়ে কিছু আলোচনা আছে। একটি আল বিরুনীর ’’ভারততত্ত্ব”’ আরেকটি আবুল ফজলের ’’আকবরনামা ও আইন-ই-আকবরী’’। সেখানেও বাংলা সনের উল্লেখ নেই। আর সব ইতিহাস বইতে কোন ঘটনার সন তারিখ নিয়ে বহু বাকবিতন্ডার দেখা পেলেও সন তারিখের কোন ইতিহাস নেই। সব ইতিহাস বইতে দেখি খ্রীস্টাব্দের রাজত্ব। যদিও এই খ্রীস্টাব্দ-প্রবণ ইতিহাস চর্চা এমন বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে যে, মানুষ যেন যুগযুগ ধরে খ্রীস্টাব্দ ব্যবহার করে আসছে। যদিও প্রকৃত পক্ষে বর্তমান খ্রীস্টিয় তথা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার ১৫৮২ সালে চালু করেন ভ্যাটিকানের পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরী। কিন্তু সেটা সবাই তখনই মেনে নেয়নি। খোদ বৃটিশরাই এই ক্যালেন্ডার গ্রহণ করতে প্রায় দু’শ বছর দেরি করেছে। বৃটিশ ভারতে ইংরেজরাই এর চর্চা করেছে সীমিত পরিসরে। বৃটিশ শাসনাধীন বাংলায় আইন করার সময়, বৃটেনে যোগাযোগের জন্য লেখালেখিতে বা অফিসে এই ক্যালেন্ডার ব্যবহৃত হলেও খাজনা আদায় হয়েছে বাংলা সন ধরে। এখনো ভূমি সংক্রান্ত সকল কর আদায় বা একসনা সব বন্দোবস্ত বাংলা ক্যালেন্ডার অনুসারেই হয়। অথচ বাংলা সনেরই শুরুর কাহিনীর কোন হদিশ নেই !
সন তারিখের খোঁজখবর
ক্যালেণ্ডার ব্যবহারের ইতিহাস ৬ হাজার বছরের। এই ক্যালেণ্ডার ব্যবহারের গৌরব প্রাচীন মিশরীয়দের। প্রাচীন মিশরীয় ক্যালেণ্ডারটি ছিলো সৌর ক্যালেণ্ডার। প্রাচীন ব্যবিলনীয়, গ্রীক আর রোমান ক্যালেণ্ডারও ছিলো সৌর ক্যালেণ্ডার। কারণ এই চার সভ্যতাই ছিলো কৃষি নির্ভর তথা ঋতু নির্ভর। মিশরের কৃষি নির্ভর করতো নীল নদের বার্ষিক বন্যার ওপর। যা পুরোটাই ঋতু নির্ভর। মিশরীয় ক্যালেণ্ডারে ছিলো ১২ মাস। প্রতি মাসে ৩০ দিন। আরো ৫ দিন তারা ব্যয় করতো দেবতার জন্মবার্ষিকীর উৎসবে। সে ৫ দিন কোন মাসের সাথে যোগ করা হতো না। তবে বছরে মোট দিন দাঁড়াতো ৩৬৫। অধিবর্ষ সম্পর্কিত ৪ বৎসরান্তের কোন দিন যোগ করতো না তারা।
বেবিলনের ক্যালেণ্ডার ২৭০০ খ্রীস্ট পূর্বাব্দে তৈরী অর্থাৎ ৪৭০০ বছরের পুরনো। তারা বছর গুনতো ৩৬০ দিনে। ১২টি চান্দ্র মাসের প্রতিটিতে ছিলো ৩০ দিন করে। ঋতুর সাথে ফারাক মেটাবার জন্য তারা প্রতি ৬ বছর পর পর একমাস বাড়িয়ে নিত (১৩ মাসে বছর)।
মায়া সভ্যতার চিহ্ন হিসাবে যে ক্যালেণ্ডার পাওয়া গেছে তার বয়স প্রায় ৩ হাজার বছর। তারা ‘Venus year’ ব্যবহার করতো।
প্রতি মাসে ২০ দিন, ১৮ মাসে বছর। মোট ৩৬০ দিন। সাথে জুড়ে নিত আরো ৫ দিন। এই ৫টি দিনকে তারা অশুভ বলে গন্য করতো।
আমরা মূলত: ব্যবহার করছি খ্রীস্টিয়, হিজরী আর বাংলা ক্যালেণ্ডার। এবার তাই এ তিনটাতেই মনোনিবেশ করি।
রোমান থেকে গ্রেগরিয়ান ক্যালেণ্ডার
রোমানরা প্রথম গ্রহণ করে গ্রীক ক্যালেণ্ডার। তখন বছর ছিলো ৩০৪ দিনের। ১০টি মাস। মার্চে বছর শুরু হয়ে ডিসেম্বরে শেষ। শীতের বাকী দিনগুলোতে তারা কোন কাজ করতো না বলে ক্যালেণ্ডারেও রাখতো না। এ সময়কে বলা হতো হাইবারনেশন। অনুমান করা হয় খ্রীস্টপূর্ব ৭০০ অব্দে রোমের রাজা Numa Pompilus জানুয়ারী আর ফ্রেব্রুয়ারী মাস যুক্ত করে ১২ মাসে বছর গনণা শুরু করেন। শীতের সময়ের না গোনা দিনগুলো পড়ে এই দুই মাসের ভাগে। জুলিয়াস সিজার রোমের সম্রাট হবার আগে পর্যন্ত এ বিষয়টি সুশৃঙ্খল ছিলো না। ক্যালেণ্ডারের হিসাবের গোলমালের জন্য ঋতুচক্রের সাথে সঙ্গতি বিধানের জন্য সম্রাট জুলিয়াস সিজার ৪৬ খ্রীস্ট পূর্বাব্দে এক রাজকীয় ডিক্রি বলে সে বছরকে ৪৪৫ দিনের বছর হিসাবে ঘোষণা করেন। সে সাথে বছরের দৈর্ঘ্য স্থির করেন ৩৬৫ দিন ৬ ঘন্টা। প্রতি মাসে দিন হবে ৩০/৩১। বাড়তি ৬ ঘন্টার সমন্বয়ের জন্য প্রতি ৪ বছর পর পর ৩৬৬ দিনের লীপ ইয়ার চালু করেন। আগে বছর শুরু হতো সূর্যের মহাবিষুবে (vernal equinox ) প্রবেশের সময় অর্থাৎ মার্চে। তিনি তা রদ করে প্রতি বছর ১ জানুয়ারী বছর শুরুর আদেশ দেন। সে থেকে এ ক্যালেণ্ডার জুলিয়ান ক্যালেণ্ডার হিসাবে পরিচিত হয়। এ সংস্কারের পরও সৌর বছরের চেয়ে সাড়ে ১১ মিনিট দীর্ঘ হয় জুলিয়ান ক্যালেণ্ডারের বছর। শত শত বছরের এই গরমিলের ফলে আবার ঋতুর সাথে ক্যালেণ্ডারের গরমিল হয়ে যায়।
এই গরমিল দূর করার জন্য পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরী ১৫৮২ সালে জুলিয়ান ক্যালেণ্ডার সংশোধনের উদ্যোগ নেন। সে সংস্কারের প্রধান দিক ছিলো ৩টি। প্রথমত: ২১ মার্চ সূর্যের মহাবিষুবে প্রবেশের সাথে মিল রাখার জন্য ১৫৮২ সালের অক্টোবর মাস থেকে ১০দিন বাদ দেন। ফলে সে বছরের ক্যালেণ্ডারে বৃহস্পতিবার ৪ অক্টোবর আর শুক্রবারকে ১৫ অক্টোবর লেখা হয়। দ্বিতীয়ত: সৌর বছরের দৈর্ঘ্যের সাথে সঙ্গতি রাখার জন্য প্রতি ৪০০ বছরের মধ্যে ৩টি লীপ ইয়ার বাদ দেবার ব্যবস্থা করেন। ফলে শতাব্দী পূর্ণকারী বছর (যথা ১৫০০, ১৬০০ সাল) হলে যে সব বছর ৪০০ দ্বারা বিভাজ্য হবে না সেগুলো লীপ ইয়ার হবে না। তাই ১৯০০ সাল লীপ ইয়ার ছিলো না, ২০০০ সাল লীপ ইয়ার ছিলো। তৃতীয়ত: এই হিসাবে চান্দ্র তিথির সাথে কোন মিল না রাখায় চান্দ্র তিথি নির্ভর ধর্মীয় পর্ব যথা ইস্টার সানডে, গুড ফ্রাইডে ইত্যাদি যথাসময়ে না আসায় তার এক হিল্লে করার দরকার হয়। এ জন্য সৌর বছর আর চান্দ্র মাসের অনুপাতের মধ্যে সূক্ষ্ণ কিছু পরিবর্তন আনা হয়। ফলে নতুন নিয়মে ইস্টার সানডের তিথিটি ৫৭ লক্ষ বছরে একবার আবর্তিত হবে।
এ ক্যালেণ্ডারে দিনের শুরু হয় মধ্য রাতে অর্থাৎ রাত ১২টার পরের সেকেণ্ড থেকে।
এই ক্যালেণ্ডারে মাসের নাম গুলোর তাৎপর্য হলো- জানুয়ারী(৩১দিন)- (ল্যাটিন জানুয়ারীয়াস) দেবতা জানুসের নাম হতে এসেছে। ফেব্রুয়ারী(২৮/২৯)- (ল্যাটিন ফেব্রুয়ারীয়াস) পিউরিফিকেশন উৎসব ফেব্রুয়া হতে এসেছে। মার্চ (৩১দিন)-(ল্যাটিন মার্টিয়াস) দেবতা মার্সের নাম হতে এসেছে। এপ্রিল (৩০দিন)-(ল্যাটিন এপ্রিলিস) গ্রীক দেবী আফ্রোদিতি মতান্তরে ল্যাটিন শব্দ aperire হতে এসেছে। মে (৩১দিন)-(ল্যাটিন মাইয়াস) দেবী মায়ার নাম হতে এসেছে বলে অনুমান করা হয়। জুন (৩০দিন)- (ল্যাটিন জুনিয়াস) দেবী জুনোর নাম হতে এসেছে বলে অনুমান করা হয়। জুলাই (৩১দিন)- (ল্যাটিন জুলিয়াস) সম্রাট জুলিয়াস সিজারের নাম হতে এসেছে। আগস্ট (৩১দিন)-(ল্যাটিন অগাস্টাস) রোমান সম্রাট অগাস্টাসের নাম হতে এসেছে। সেপ্টেম্বর (৩০ দিন)- (ল্যাটিন সেপ্টেম্বর)- সেপ্টেম অর্থাৎ সাত হতে এসেছে। এটা প্রাচীন রোমান ক্যালেণ্ডারের সপ্তম মাস ছিলো। অক্টোবর (৩১ দিন)- (ল্যাটিন অক্টোবর) অক্টো অর্থাৎ আট হতে এসেছে। এটা রোমান ক্যালেণ্ডারের অষ্টম মাস ছিলো। নভেম্বর (৩০দিন)-(ল্যাটিন নভেম্বর) নভেম অর্থাৎ নয় থেকে এসেছে। রোমান ক্যালেণ্ডারের নবম মাস ছিলো। ডিসেম্বর(৩১দিন)-(ল্যাটিন ডিসেম্বর) ডিসেম অর্থাৎ দশ থেকে এসেছে। রোমান ক্যালেণ্ডারের দশম মাস ছিলো। সিজারের সংস্কারের ফলে শেষ চারটি মাসের নাম সংখ্যার বিচারে ভুল হিসাবে চালু আছে অর্থাৎ বছরের ৭,৮,৯,১০ নং মাসের বদলে এখন ৯,১০,১১ ও ১২ নং মাস হিসাবে আছে।
পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরীর এ সংস্কার ক্যাথলিক খ্রীস্টানরা মেনে নিলেও প্রোটেস্টান্টসহ অন্য অনেকেই মেনে নিতে অনেক বিলম্ব করেছে। ১৫৮২ সালেই নতুন ক্যালেণ্ডার গ্রহণ করে ইতালী, পর্তুগাল, স্পেন, বেলজিয়াম, হল্যাণ্ড এবং পোল্যাণ্ড-এর ক্যাথলিক রাষ্ট্রসমূহ। ১৫৮৪ সালে গ্রহণ করে জার্মানী ও সুইজারল্যাণ্ড-এর ক্যাথলিক রাস্ট্রসমূহ। ১৫৮৭ সালে হাঙ্গেরী। ১৭০০ সালে জার্মানী, সুইজারল্যাণ্ড ও হল্যাণ্ডের প্রোটেস্টান্ট রাষ্ট্রসমূহ, ডেনমার্ক ও নরওয়ে তা গ্রহণ করে। ১৭৫২ সালে তা গ্রহণ করে বৃটেন (আমেরিকান কলোনীসহ), ১৮৭৩ সালে জাপান, ১৮৭৫ সালে মিশর, ১৯১৮ সালে রাশিয়া, ১৯২৪ সালে গ্রীস, ১৯২৬ সালে তুরস্ক ও ১৯৪৯ সালে চীন তা গ্রহণ করে। বৃটেন ও রাশিয়ায় এটা গ্রহণের সময় আবার অক্টোবর মাসে ১১ দিন বাদ দিতে হয়েছে জুলিয়ান ক্যালেণ্ডারের সাথে তৈরী হওয়া ব্যবধান ঘুচানোর জন্য। সেটা নিয়ে ব্রটেনে শ্রমিক আন্দোলন হয়েছে। রাশিয়ায় তাই অক্টোবর বিপ্লবের বার্ষিকী পালিত হয় নভেম্বরে।
বৃটিশ উত্তরাধিকার থেকেই আমরা ব্যবহার করছি গ্রেগরিয়ান ক্যালেণ্ডার।
হিজরী সনের কথকতা
হযরত মুহম্মদ ( সা: ) এর মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের (৬২২ খ্রীস্টাব্দে) স্মরণে প্রবর্তিত হয় হিজরী সন। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর ( রা: ) ৬৩৮-৩৯ খ্রীস্টাব্দে এ ক্যালেণ্ডার চালু করেন। সূর্যাস্ত থেকে দিন গণনা শুরু করা হয়। ১২টি চান্দ্র মাস ( মহররম, সফর, রবিউল আউয়াল, রবিউস সানি, জামাদিউল আউয়াল, জামাদিউস সানি, রজব, শাবান, রমজান, শাওয়াল, জিলক্বদ,জিলহজ্জ্ব) নিয়ে গঠিত। অমাবশ্যা শেষে চন্দ্রোদয় থেকে আরেক অমাবশ্যা পর্যন্ত ২৯/৩০ দিনে হয় মাস। সাধারণত: একটি মাস ৩০ দিনে হলে পরের মাসটি ২৯ দিনে হবে, তার পরেরটি আবার ৩০, তার পরেরটি ২৯ এভাবে আবর্তিত হয়। হিজরী বছরে ৩৫৪ দিন। গড় চান্দ্রযুতিকাল ২৯.৫৩০৫৮৮১ দিন হিসাবে ১২ চন্দ্রযুতিতে হয় ৩৫৪.৩৬৭১ দিন। অর্থাৎ হিজরী বছর চান্দ্র বছর থেকে ০.৩৬৭১ দিন কম। এই ঘাটতি সমন্বয় করার জন্য ৩০ বছরের একটা পুনরাবৃত্তি চক্র স্থির করা হয়। ঐ ৩০ বছরে মোট ১১ বার পূর্বনির্ধারিত চান্দ্র বছরের শেষ মাস জিলহজ্জ্ব মাসে ১ দিন যোগ করে ২৯ দিনের স্থলে ৩০ দিন করা হতো। ৩০ বছরে ৩৫৪*৩০=১০৬২০ দিনের সাথে ১১ দিন যোগ করে ১০৬৩১দিন হিসাব করা হয়। এর ফলে গড় চন্দ্রযুতি বা চান্দ্র মাসের স্থায়িত্ব দাঁড়ায় ২৯.৬৩০৫৬৬ দিন। যা বর্তমান চান্দ্র মাস থেকে মাত্র ০.০০০০৩২ দিন কম। এ ৩০ বছরের চক্রে কোন ১১টি বছর অধিবর্ষ হবে তা নির্ধারণ করা হয় এভাবে- হিজরী সনটিকে ৩০ দিয়ে ভাগ করলে ভাগফল ২,৫,৭,১০,১৩,১৬,১৮,২১,২৪,২৬ বা ২৯ হলে বছরের শেষের মাসে অর্থাৎ জিলহজ্জ্ব মাসে ১ দিন যুক্ত হবে।
এই হিজরী ক্যালেণ্ডার অনুযায়ী মুসলমানদের যাবতীয় ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালিত হয় সারা পৃথিবীব্যাপী। এ ছাড়া মুসলিম শাসনামলে তাদের সকল রাজ্যে সরকারী কাজে হিজরী ব্যবহার করা হয়। ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম শাসনামলেও হিজরী ছিলো সরকারী ক্যালেণ্ডার। এখনো সৌদী আরবে তা সরকারী ক্যালেণ্ডার হিসাবে ব্যবহৃত হয়। ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকও হিজরী ক্যালেণ্ডার অনুসরণ করে। এটা সেখানে এখনো সম্ভব কারণ তাদের অর্থনীতি কৃষি নির্ভর নয়, বাণিজ্য নির্ভর।
বাংলা সনের কথা
বাংলা সনের প্রচলন নিয়ে সরাসরি কোন ঐতিহাসিক তথ্য প্রমান নেই। আমাদের ইতিহাসচর্চার ভিত্তি হচেছ রাজা বা রাজবংশের ঠিকুজি, আধিপত্যবাদী ধনিক শ্রেণীর জীবন ইতিহাস, প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার আর শিলালিপি পাঠ। আমাদের সনাতন ইতিহাস চর্চায় এদেশের মূল জনগোষ্ঠী তথা কৃষকের জীবনাচরণ সরাসরি উপেক্ষিত। এটাই বাংলা সনের কোন খোঁজ না থাকার কারণ। কৃষক জীবনের সাথেই শুরু থেকে আজ পর্যন্ত বাংলা সনের প্রকৃত যোগাযোগ। তাই ভায়া পথে অন্যান্য ঐতিহাসিক তথ্য বিশ্লেষণের ভিত্তিতে বাংলা সন প্রচলন নিয়ে চারটি মত চালু আছে। সম্প্রতি জয়নুল আবেদীন খান ’’বঙ্গাব্দ’’ নামে একটি বইতে পঞ্চম মত প্রকাশ করেছেন।
সব চেয়ে প্রচলিত মতটি হলো মুঘল সম্রাট মহামতি আকবর এই সনের প্রবর্তন করেছেন। মূলত: অক্সফোর্ড থেকে ইতিহাসে এম,এ, পাশ করা প্রখ্যাত ঐতিহাসিক কাশীপ্রসাদ জয়সোয়ালই (১৮৮১-১৯৩৭) প্রথম নানা যুক্তি প্রদর্শন করে বলেন আকবর এর প্রবর্তক। পরে বিশ্বখ্যাত জ্যোতির্পদার্থবিদ ও ভারতের ক্যালেন্ডার সংস্কার কমিটির প্রধান ড.মেঘনাদ সাহা, নোবেল পুরষ্কার জয়ী অর্থনীতিবিদ ড.অমর্ত্য কুমার সেন, প্রত্নতত্ত্ববিদ অমিতাভ ভট্টাচার্য (দ্য বেঙ্গলী এরা ইন দ্য ইন্সক্রিপশনস অফ লেটার মেডিয়েভাল বেঙ্গল), কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ভূতপূর্ব কারমাইকেল অধ্যাপক ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, বাংলা সন গবেষক মোবারক আলী খান প্রমুখ এই মত সমর্থন করেন। তাঁদের যুক্তি হলো আকবর যখন সিংহাসনে আরোহন করেন তখন ছিলো ৯৬৩ হিজরী। বর্তমান বাংলা সনের হিসাব অনুযায়ীও তখন ছিলো ৯৬৩ সাল। আইন-ই-আকবরীতে বলা হয়েছে আকবর নতুন সন ’’তারিখ-ই-ইলাহী’’ চালু করেন তাঁর সিংহাসন আরোহনের বছর তথা ১৫৫৬ সাল থেকে কার্যকারিতা দিয়ে। তখন ৯৬৩ হিজরী। এখন চলছে ২০১৭ সাল। ড.মেঘনাদ সাহার অনুসরনে যদি হিসাব করি তাহলে দেখা যায় ৯৬৩+২০১৭-১৫৫৬=১৪২৪। এ বছর বাংলা ১৪২৪ সাল শুরু হতে চলেছে। ড. সাহা লিখেছেন, হিজরী সন চালু করার একটা কারণ ছিলো ধর্মীয় উৎসব পালনের ক্ষণ বের করার জন্য সাধারণ মানুষকে যেন আলেমদের ওপর নির্ভরশীল না থাকতে হয়। এই ক্যালেন্ডার সৌর বছরের যে কোন সময়ে শুরু হতে পারে। ফলে ঋতু নির্ভর সরকারী কার্যক্রমে এর প্রয়োগে অসুবিধা দেখা দেয়। ১০৭৯ খ্রীস্টাব্দে সুলতান জালাল উদ্দীন মালিক শাহ ইরানে সৌর ক্যালেন্ডার চালু করেন। আকবর সেটার অনুসরনেই তারিখ-ই-ইলাহী চালু করেন। ড. সাহার নেতৃত্বে গঠিত ভারতীয় ক্যালেন্ডার সংস্কার কমিটির প্রতিবেদনে এ বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া হয়েছে। বস্তুতপক্ষে জালালী ক্যালেন্ডার নামে পরিচিত এই ইরানী সৌর ক্যালেন্ডারটি সুলতানের অনুরোধে সংস্কার করেন সে কালের শ্রেষ্ঠ গনিতবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও কবি ওমর খৈয়ামের নেতৃত্বে গঠিত এক কমিটি। হিসাবেরর গরমিলের জন্য নওরোজ বসন্তের সূচনায় আসছিল না বলেই এ সংস্কারের দরকার পড়ে। এ কাজটিই পোপ গ্রেগরী ওমরের ৫শ’ বছর পরে করে বর্তমান গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার চালু করেন। বর্তমানে যে বাজেট প্রণয়নের প্রথা চালু আছে সে আদলে আকবর রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় সংস্কার সাধন করেন। সারা বছরের সম্ভাব্য আয় ঠিক করে তার ভিত্তিতে ব্যয়ের প্রথা চালু করেন। ফসল তোলার সাথে সঙ্গতি রেখে নির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে খাজনা আদায়ের ব্যবস্থা চালু করা হয়। ইউরোপীয়দের চেয়ে প্রায় আড়াইশ' বছর আগেই আকবর বাজেট প্রথা চালু করেন। ফসল ওঠার সাথে ঋতুচক্রের সম্পর্ক আছে বলেই চান্দ্র ক্যালেন্ডার হিজরীর স্থলে সৌর ক্যালেন্ডার চালুর প্রয়োজন পড়ে। ড.মেঘনাদ সাহার মতে তারিখ-ই-ইলাহীর আদলেই বাংলা সন চালু হয়েছে। ১৯৫২ সালে এক বক্তৃতায় ড. সাহা এ কথা বলেন। তাঁর ভাষায়,”In 1079 A.D. Sultan Jelaluddin Melik Shah of Iran introduces solar calendar of Iran, and this was introduced by Emperor Akber in India in 1584 A.D. Under the name of tarik-ilahi, Akber’s calendar was used to date all events from his accession (1556A.D.) and was official calendar during the reign of Jehangir and early part of Sahjahan’s reign when it fell into disuse. But it gave rise to a number of hybrid Eras like the ‘Bangla San’ and of ‘Fasli’ Era which are still in use.”
আকবরের সভপণ্ডিত আমীর ফতেহ উল্লাহ সিরাজী সংস্কার কাজটি করেন। হিজরী থেকে সন (৯৬৩) নিয়ে জালালী ক্যালেন্ডারের গণনা পদ্ধতিকে মিলিয়ে দেন। মাসের নামগুলো ছিলো ফারসী। আকবরের সমন্বয়বাদী নীতির প্রতিফলন আছে এই সন গণনাতেও। এসবের বিস্তারিত বিবরণ ও সম্রাটের ডিক্রির তথ্যাদি লিখা আছে আবুল ফজল আল্লামীর লেখা আকবরনামা ও আইন-ই-আকবরীতে।
এখানে যে দুটি প্রশ্নের কোন তথ্যভিত্তিক জবাব নেই তা হলো তারিখ-ই-ইলাহী শুরু হয় সূর্যের মহাবিষুবে প্রবেশের সময় অর্থাৎ মার্চ মাসে, আর বাংলা সন শুরু হয় এপ্রিলে এবং আকবরের ক্যালেন্ডারের মাসের নাম ফারসি আর বাংলা সনের মাসের মাসের নাম কার্যত: বাংলায়, যা নেয়া হয়েছে শকাব্দ থেকে। শকাব্দ সে নাম গ্রহণ করেছে জ্যোতিষশাস্ত্র থেকে। এ বিষয়ে অধ্যাপক ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের মতে এর সম্ভাব্য কারণ হলো বাংলায় সৌর বঙ্গাব্দ প্রচলনের সময় ঐ অঞ্চলে সমধিক জনপ্রিয় অব্দ সৌর শকাব্দের উপস্থিতি। শকাব্দের আরম্ভ চৈত্র মাসে। যে অভ্যাসের বশে সৌর এলাহী অব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে জনগন পরিচিত মাসক্রম ব্যবহার করতেন সে অভ্যাসেরই পুনরাবৃত্তি বঙ্গাব্দের মাসক্রমে দেখা যেতে পারে।
বঙ্গাব্দ প্রচলনের বিষয়ে আরেকটি প্রধান মত হলো গৌড়ের সম্রাট শশাঙ্ক এর প্রচলন করেছেন। শ্রী সুনীল কুমার মুখোপাধ্যায় একটি বই লিখে এই মত প্রকাশ করেছেন। ( এর আগে ১৯৫০-এর দশকে টাকী গভর্নমেন্ট হাইস্কুলের সহকারী শিক্ষক শ্রীযুক্ত স্মরজিৎ দত্ত স্কুল ম্যাগাজিনসহ কিছু পত্রিকায় শশাঙ্ক কর্তৃক বাংলা সন প্রচলনের কথা লিখেছিলেন। তখন তাঁর সহকর্মী মোবারক আলী খান তাঁর সে যুক্তি খন্ডন করে প্রবন্ধ লিখেছিলেন।) সুনীল বাবুর মতে ৫৯৪ খ্রীস্টাব্দের ১২ এপ্রিল বঙ্গাব্দের গণনা শুরু হয়েছে এবং ঐ দিনই শশাঙ্ক গৌড় বঙ্গে স্বাধীনভাবে রাজত্ব শুরু করেন। ড.অতুল সূরসহ কেউ কেউ এ মত সমর্থন করেন। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় বলেন, এই মতের সপক্ষে কিছু বলতে হলে প্রথমেই প্রমান করতে হবে শশাঙ্ক ৫৯৪ খ্রীস্টাব্দে এক স্বাধীন রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বা তখন তিনি রাজত্ব করতেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত এর কোন নিশ্চিত প্রমান নেই। বেশিরভাগ ঐতিহাসিকের মতে শশাঙ্ক সপ্তম শতকের প্রথমভাগে রাজত্ব করতেন। তাছাড়া ৫৯৩-৯৪ সাল থেকে পরবর্তী এক হাজার বছরে এমন কোন নথিবদ্ধ তারিখ পাওয়া যায়নি যাকে নিশ্চিতভাবে বঙ্গাব্দের সাথে যুক্ত করা যায়। শশাঙ্কের রাজ্যের সবচেয়ে বিস্তৃত সীমানার মধ্যে পরবর্তী হাজার বছরে যে বিরাট সংখ্যক লেখ আবিষ্কৃত হয়েছে তাতে বঙ্গাব্দ ব্যবহারের চিহ্ণ নেই। বঙ্কিমচন্দ্র যদিও ১৮৬৫ সালে (১২৭২ বাংলা সাল?) দুর্গেশনন্দিনী উপন্যাসে বঙ্গাব্দের কথা উল্লেখ করেছেন তা ইতিহাসসিদ্ধ বাংলা সন নয়। বঙ্গাব্দ কিছুটা আধুনিককালের শব্দ। এখনো গ্রাম বাংলায় লোকজন বলে বাংলা সন বা বাংলা সাল। সন আরবী শব্দ, আর সাল ফারসি শব্দ। ব্রতীন বাবুর মতে এটাও বাংলা সন চালুর সাথে কোন মুসলিম শাসকের যুক্ত থাকার প্রমান দেয়। ১২০৮ শকাব্দে নারদীয় পুরানের উত্তরভাগের এক পুঁথিতে বাংলা সনকে জ(য)বনে নৃপতে শকাব্দ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ থেকেও বাংলা সন চালুতে মুসলিম শাসকের যুক্ত থাকার অনুমান করা যায়। এখানে আরেকটি তথ্য প্রাসঙ্গিক। ড.নীহাররঞ্জন রায় জানাচ্ছেন,”শশাঙ্ক এবং পাল রাজারা সমগ্র পশ্চিম-বঙ্গের অধিকারী হইয়াও নিজেদের রাঢ়াধিপতি বা রাঢ়েশ্বর না বলিয়া নিজেদের পরিচয় দিলেন গৌড়াধিপ এবং গৌড়েশ্বর বলিয়া, ... পাল এবং সেন রাজাদের লক্ষ্য ও আদর্শ ছিল গৌড়েশ্বর বলিয়া পরিচিত হওয়া। বঙ্গপতি যে মুহূর্তে গৌড়ের অধিপতি সেই মুহূর্তেই তিনি গৌড়েশ্বর। লক্ষ্মণসেন যে মুহূর্তে গৌড় অধিকার করিলেন সেই মুহূর্তে তিনিও হইলেন গৌড়েশ্বর।” এতে স্পষ্ট বোঝা যায় তখন গৌড়ই ছিলো স্বপ্ন ও প্রতাপের কেন্দ্র। বাংলার সে প্রতাপ বা আকর্ষণ তখন ছিলো না। তাই তখন যদি কোন ক্যালেন্ডার চালুও হতো তার নাম বঙ্গাব্দ হবার সম্ভাবনা ছিলো না। বরং তার নাম গৌড়াব্দ হবার সম্ভাবনাই বেশি ছিলো।
ড.নীহাররঞ্জন রায়ের আরেকটি মতও বিশেষ বিবেচনার দাবী রাখে। তাঁর ভাষায়,”কিন্তু গৌড় নাম লইয়া বাঙলার সমস্ত জনপদগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করিবার যে চেষ্টা শশাঙ্ক, পাল ও সেন-রাজারা করিয়াছিলেন সে চেষ্টা সার্থক হয় নাই; গৌড় নামের ললাটের সেই সৌভাগ্যলাভ ঘটিল বঙ্গ নামের, যে বঙ্গ ছিল আর্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির দিক হইতে ঘৃণিত ও অবজ্ঞাত, এবং যে বঙ্গ নাম ছিল পাল ও সেন রাজাদের কাছে কম গৌরব ও আদরের। কিন্তু, সমগ্র বাঙলাদেশের বঙ্গ নাম লইয়া ঐক্যবদ্ধ হওয়া হিন্দু আমলে ঘটে নাই; তাহা ঘটিল তথাকথিত পাঠান আমলে এবং পূর্ণ পরিণতি পাইল আকবরের আমলে, যখন সমস্ত বাঙলাদেশ সুবা বাঙলা নামে পরিচিত হইল।” আকবরের আমলের আগে বাংলা নামে প্রশাসনিকভাবে বিস্তৃত জনপদই ছিলো না, তাই তার আগে বাংলা সন চালুর সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এ তথ্য আকবরের পক্ষে পরোভাবে হলেও সাক্ষ্য দিচ্ছে।
পুঁথি গবেষক যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্যের মতে বাংলার স্বাধীন সুলতান আলাইদ্দিন হোসেন শাহ বাংলা সন চালু করেছেন। বাংলা ভাষা সাহিত্যের বিকাশে সুলতান আলাইদ্দিন হোসেন শাহের অবদান সর্বজন স্বীকৃত। তবে সুলতানী আমলের বিশেষজ্ঞ ঐতিহাসিক সুখময় মুখোপাধ্যায় হোসেন শাহ কর্তৃক বাংলা সন চালুর কোন তথ্যপ্রমান পাননি। সুলতানী আমল সম্পর্কে আরেক বিশেষজ্ঞ ড. আবদুল করীমও এ বিষয়ে কিছু উল্লেখ করেননি। যতীন বাবুও তেমন কোন শক্ত তথ্যপ্রমান হাজির করতে পারেননি। আরেকটি বিষয়ও আমি বিবেচনাযোগ্য বলে মনে করি। যে কবিগণ হোসেন শাহের বা তাঁর কোন সভাসদের আনুকূল্য পেয়েছেন তাঁরা প্রায় সবাই কৃতজ্ঞতাবশতঃ তাঁদের রচনার নানা জায়গায় তার উল্লেখ করেছেন। মনসামঙ্গলের কবি বিজয়গুপ্ত লিখেছেন-
”ঋতু শশী বেদ শাশী পরিমিত শক।
সুলতান হোসেন সাহা নৃপতি-তিলক
সংগ্রামে অর্জুন রাজা প্রতাপেতে রবি।
নিজ বাহুবলে রাজা শাসিল পৃথিবী।”
মনসামঙ্গলের আরেক কবি বিপ্রদাস লিখেছেন,
”সিন্ধু ইন্দু বেদ শশী শক পরিমাণ।
নৃপতি হুসেন শা গৌড়ের সুলতান।।”
মহাভারতের অনুবাদক কবীন্দ্র পরমেশ্বর শ্রীকর নন্দী লিখেছেন,
”নৃপতি হুসেন সাহ হএ মহামতি।
পঞ্চম গৌড়েতে যার পরম সুখ্যাতি।।
অস্ত্রে-শস্ত্রে সুপণ্ডিত মহিমা অপার।
কলিকালে হৈল যেন কৃষ্ণ অবতার।।”
বিজয়গুপ্ত এবং বিপ্রদাস উভয়েই রচনাকাল হিসাবে শকাব্দ ব্যবহার করেছেন। ৬ ঋতু (৬), ১টি শশী বা চাঁদ (১), ৪টি বেদ (৪), শশী (১)। এখানে উল্টো করে দেয়া হয়েছে বছরটি ৬১৪১। এটা মধ্যযুগে প্রচলিত ছিল। একে বলা হতো অঙ্কস্য বামা গতি। প্রকৃতপক্ষে বছরটি ১৪১৬ শকাব্দ (১৪৯৪ খৃস্টাব্দ)। বিপ্রদাস লিখেছেন ১৪১৭ শকাব্দ বা ১৪৯৫ খৃস্টাব্দে। সিন্ধু বা সাগর ৭টি (৭), ইন্দু বা চাঁদ (১), বেদ (৪), শশী (১)। বাংলা সন চালু থাকলে তাঁরা বাংলা সন ব্যবহার করতেন বলেই ধরে নেয়া যায়। হোসেন শাহ বাংলা সন চালু করলে এই কবিগণ যে সাড়ম্বরে সেটা লিখে যেতেন সেটাও নিশ্চিত করে বলা চলে।
খ্যাত নামা প্রাচ্যবিদ সিলভাঁ লেভি তাঁর লেখা ’লে নেপাল’ বইতে বলেছেন ৬০০ খ্রীস্টাব্দের কিছু আগে সংস্রন নামে এক তিব্বতী রাজা মধ্য ও পূর্বভারত জয় করেন। তিনিই তার নামের শেষের ’সন’ যুক্ত করে বাংলা সন চালু করেন। ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের মতে এই সম্ভাবনা নেই। কারণ সংস্রন কর্তৃক বাংলা আক্রমনের কোন তথ্য বা কোন সন তারিখ চালু করার বিষয়ে কোন তথ্য প্রমান নেই।
জয়নুল আবেদীন খান ’’বঙ্গাব্দ’’ নামক বইতে বিক্রমপুরের রাজা বল্লাল সেন কর্তৃক বঙ্গাব্দ চালু হয়েছে বলে মত প্রকাশ করেছেন। কিন্তু এর সমর্থনে যে সব যুক্তি প্রমান দাখিল করেছেন তা যথেষ্ট নয়। এর সমর্থনে কোন সরাসরি দলিলও তিনি হাজির করতে পারেননি। ৫টি কারণে তিনি আকবরকে বাংলা সনের প্রবর্তক মনে করেন না। তাঁর মতগুলো হচ্ছে-১.আকবরের রাজ্যের ১২টি প্রদেশের মধ্যে সুবে বাংলায় তিনি সন চালু করেছেন, অন্য কোন প্রদেশে করেননি। তাই এ দাবী গ্রহণযোগ্য নয়। ২.আকবরের সন চালুর সময় বারো ভূঁইয়ার কারণে বাংলা অশান্ত ছিলো। তাই সন চালু হতে পারে না। ৩.বাঙালীর জীবন জীবিকার প্রতি আকবরের আগ্রহ ছিলো না। আগ্রহ ছিলো খাজনার প্রতি। তাই বাংলা সন আকবর চালু করেছেন বলে তিনি মনে করেন না। ৪.কোন মুসলমানের চালু করা সন হিন্দুরা ধর্মীয় কারণে (কারণ এতে ধর্মীয় আচারদির সংশ্লেষ আছে) তা মেনে নেবার কথা নয়। ৫.আকবরনামা বা আইন-ই-আকবরীতে বাংলা সনের উল্লেখ নেই তাই বাংলা সন আকবর চালু করেননি। এরপর তিনি বলেন, এ দেশেরই কোন প্রজাহিতৈষী ও কীর্তিলিপ্সু হিন্দু বা হিন্দু ভাবাপন্ন কোন রাজা বা রাজপুরুষ একটি সমন্বয়বাদী সন হিসাবে বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। তিনি বল্লাল সেনকে বাংলা সনের প্রবর্তক মনে করেন। কেন মনে করেন তার কোন যথাযথ প্রমান দাখিল করতে পারেননি। বরং তাঁর মতের মধ্যেই স্ববিরোধিতা আছে।
আকবর তাঁর পুরো সাম্রাজ্যের জন্যই তারিখ-ই-ইলাহী চালু করেছেন। কোন প্রদেশের জন্যই আলাদা করে সন চালু করেননি। যাঁরা আকবর কর্তৃক বাংলা সন চালুর কথা বলেন তাঁরা বলেছেন সেই সনের ভিত্তিতে বাংলা সন চালু হয়েছে। বাংলার জন্য পৃথক সন চালুর কথা বলেননি। অপরদিকে বারো ভূঁইয়ারা কিছু অঞ্চলে স্বাধীন অস্তিত্ব বজায় রাখলেও প্রাদেশিক সরকার ছিলো আকবর কর্তৃক নিযুক্ত। বাঙালীর জীবিকার প্রতি আকবরের আগ্রহ ছিলো না এ তথ্য তিনি কোথায় পেলেন ? আকবরের রাজস্ব মন্ত্রী রাজা টোডরমলের নেতৃত্বে ভূমি ও রাজস্ব সংস্কার সম্রাট হিসাবে আকবরের শ্রেষ্ঠত্বের স্মারক হয়ে আছে। তর্কের খাতিরে যদি তাঁর এ মত মেনেও নিই তাহলে সন চালুর কৃতিত্ব আকবরের দিকেই ইঙ্গিত করে। কারণ আকবর সন সংস্কার করেছেন খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্যই। তাঁর কথা অনুযায়ী মুসলমানের চালু করা সন যদি হিন্দুরা না মানেন তাহলে হিন্দু রাজার চালু করা সন মুসলমানগণ কেন মানবেন ? তিনি বৌদ্ধ ও মগদের সাথে সম্পর্ক থাকার বিষয় বিবেচনায় নিয়ে বল্লাল সেনকে বাংলা সন চালুর কৃতিত্ব দিয়েছেন। কিন্তু কোন যৌক্তিক সমীকরণ টানার যে পদ্ধতি ঐতিহাসিকগণ ব্যবহার করেন তেমন কিছু তাঁর লেখায় চোখে পড়েনি। কি প্রক্রিয়ায়, কি কারণে বল্লাল সেন বাংলা সন চালু করেছেন তার কোন বিবরণ দেননি, বা দালিলিক প্রমান দেননি। বরং সমাপনী বক্তব্যে নিজেই নিজের মতের বিরোধী মত প্রকাশ করেছেন। তাঁর ভাষায়-”বাংলা সনে চান্দ্র হিজরী সনের ইসলামী ঐতিহ্যের সঙ্গে ভারতীয় সৌর সনের বৈজ্ঞানিকতা যুক্ত হয়েছে। এই সনের মধ্যে হিন্দু ও বৌদ্ধদের দিন ও মাসগুলো আছে। আছে বর্ষ শুরুর মাস হিসেবে ভগবান বুদ্ধের ত্রি-স্মৃতি বিজড়িত পবিত্র বৈশাখ মাস। আছে সূর্য পূজার অনুষঙ্গ চৈত্রসংক্রান্তির চড়ক উৎসব। আছে মগ রাজাদের নববর্ষের খাতা উৎসব। আর আছে ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)-এর মদীনা গমন, হিজরী সন ও মোগল সম্রাট মহামতি আকবরের সিংহাসন আরোহন।” এ বক্তব্য দিয়ে তিনি পুরো ব্যাপারটি আকবরের দিকেই নিয়ে গেলেন। কারণ আকবরের তারিখ-ই-ইলাহীর মূল বক্তব্যতো এগুলোই। যার বিস্তারিত বিবরণ আকবরনামা আর আইন-ই-আকবরীতে দেয়া আছে। সেখানে বাংলা সন চালুর কথা বলা থাকলে তো এতো মতভেদের সুযোগই থাকতো না। আর বল্লাল সেন কোন দুঃখে আকবরের সিংহাসনে আরোহনের বিষয়টি বিবেচনায় নেবেন তার কোন ব্যাখ্যাও নেই।
বাংলা মাসের নাম বৃত্তান্ত
বাংলায় আমরা যে মাসগুলো ব্যবহার করি তা এসেছে মূলত: জ্যোতিষশ্রাস্ত্র ও শকাব্দ থেকে। প্রতিটি নাম রাখা হয়েছে নক্ষত্রের নাম থেকে। চাঁদ সূর্যকে বছরে ১২ বার প্রদক্ষিণ করে। প্রতিবারে গড়ে সময় লাগে ৩০ দিন। চাঁদের এই আবর্তন থেকেই মানুষ মাসের ধারণা গ্রহণ করেছে। month শব্দের অর্থ হিসাবে Oxford Dictionary -তে বলা হয়েছে period of moons revolution অর্থাৎ পৃথিবীকে কেন্দ্র করে চন্দ্রের আবর্তনকাল। এই ১২ বার প্রদক্ষিণের পথে ২৭টি নক্ষত্রের সাথে চাঁদের মোলাকাত হয়। এর সাথে মিশে আছে একটি পৌরাণিক কাহিনী। পুরাণ অনুসারে দক্ষ প্রজাপতির ছিলো ২৭টি সুন্দরী কন্যা। তাঁদের নাম-অশ্বিনী, ভরণী, কৃত্তিকা, রোহিণী, মৃগশিরা, আদ্রা, পুনর্বসু, পুষ্যা, অশ্লেষা, মঘা, পূর্ব-ফাল্গুনী, উত্তর- ফাল্গুনী, হস্তা, চিত্রা, স্বাতী, বিশাখা, অনুরাধা,জ্যেষ্ঠা, মূল্য, পূর্বাষাঢ়া, উত্তরাষাঢ়া, শ্রবণা, ধনিষ্ঠা, শতভিষা, পূর্ব ভাদ্রপদা, উত্তর ভাদ্রপদা ও রেবতী। এই সাতাশ কন্যার বিয়ে হয় একমাত্র উপযুক্ত পাত্র চন্দ্রদেবের সাথে। চন্দ্রদেবকে প্রতিমাসে স্ত্রীদের দর্শন দিতে হবে। এতে সময় লাগবে ২৭ দিন, বাকী ৩ দিন বিশ্রাম। আর্যভট্ট রচিত ’সূর্যসিদ্ধান্ত’ ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ হিসাবে স্বীকৃত। মাসের নামকরণের বিষয়ে সূর্যসিদ্ধান্তে বলা হয়েছে,”নক্ষত্রনামা মাসান্তুজ্ঞেরাঃ পর্বান্তযোগতঃ” অর্থাৎ পূর্ণিমান্তে সাধারণতঃ যে নক্ষত্রের সাথে সংযোগ দৃষ্ট হয় সেই নক্ষত্রের নামানুসারে চান্দ্রমাসের নামকরণ হয়েছে। প্রাচীন কালে সব জাতির ন্যায় ভারতীয়রাও চান্দ্র মাস ব্যবহার করতো। পরে চান্দ্র-সৌর কালেন্ডার চালু হয় ভারতে। সে হিসাবে বিশাখা নক্ষত্রের সাথে সংযোগকালে যে মাসে চাঁদ পূর্ণিমা দেখায় সে মাসের নাম বৈশাখ। সে ধারাবাহিকতায় জ্যেষ্ঠা থেকে জ্যৈষ্ঠ, পূর্বাষাঢ়া থেকে আষাঢ়, শ্রবণা থেকে শ্রাবণ, পূর্বভাদ্রপদ থেকে ভাদ্র, অশ্বিনী থেকে আশ্বিন, কৃত্তিকা থেকে কার্তিক, মৃগশিরা বা অগ্রহায়ণী থেকে অগ্রহায়ণ, পুষ্যা থেকে পৌষ, মঘা থেকে মাঘ, পূর্বফাল্গুনী থেকে ফাল্গুন এবং চিত্রা থেকে চৈত্র।
বাংলা বছরের সূচনা-বিরোধ
বাংলা বছরের সূচনা নিয়েও আছে নানা মত। ইতিহাসে সুনির্দিষ্ট কোন সূচনা চিহ্ন মেলে না। চর্যগীতিকায় বাঙ্গালীর কথা থাকলেও বাংলা সনের কোন কথা নেই। মধ্যযুগের কিছু কিছু সাহিত্য পাঠে অস্পষ্ট একটা ধারণা করা যায়, অগ্রহায়ণ মাসে বছর আরম্ভ হতো। অগ্রহায়ণ শব্দের মধ্যেই বছর শুরুর একটা আভাস আছে। অগ্র মানে প্রথম আর হায়ন মানে বছর। মধ্যযুগের বারমাসীতে এর সমর্থন মেলে। সিলেট থেকে সংগৃহীত আবিরার বারমাসীতে বলা হয়েছে,”পরথমে আগন মাস ঘরে ঘরে ধান/ তুমি নি আইছরে বন্ধু এমন পাষাণ/ কার্তিক মাসের দিনে বছরের শেষ।/ না আইলা আবিরার সাধু ছাড়িয়া বৈদেশ।” প্রাক-আধুনিক যুগের কবি ভারত চন্দ্র রায়গুণাকরের ’অন্নদা মঙ্গল’ কাব্যে লেখা হয়েছে,”হায়নের অগ্র অগ্রহায়ণ জানিয়া/শুভ দিনে পুণ্যাহ করিলা বিচারিয়া।” ভারত চন্দ্রের এ বই লেখার আগেই মুর্শিদাবাদে বৈশাখ মাসে পুণ্যাহ চালু হয়ে গেছে। অন্যদিকে এর আগের কবির রচনায় বৈশাখে বারমাসীর কথা আছে। বিজয়গুপ্তের ’পদ্মপুরাণ’-এ বেহুলার বারমাসী বৈশাখে আরম্ভ হয়ে চৈত্রে শেষ হয়েছে। ষোড়শ শতকের কবি মুকুন্দরামের চণ্ডী মঙ্গলে ফুল্লরার বারমাসীও বৈশাখে আরম্ভ হয়ে চৈত্রে শেষ হয়েছে। রংপুরের অজ্ঞাতনামা কবির রচিত কমলার বারমাসীও বৈশাখে শুরু। কিন্তু শাহ মোহাম্মদ সগীরের ইউসুফ জুলেখা কাব্যে জুলেখার বারমাসী মাঘ মাসে শুরু হয়ে পৌষে শেষ হয়েছে। অন্য দিকে দৌলত কাজীর সতী ময়না ও লোরচন্দ্রানী কাব্যে এবং মহাকবি আলাওলের পদ্মবতী মহাকাব্যে ময়নামতি ও নাগমতির বারমাসী আষাঢ় মাসে শুরু হয়ে জ্যৈষ্ঠে শেষ হয়েছে। পুরো বিষয়টিই গোলকধাঁধায় ভরা। কবে থেকে বাংলা সন চালু হয়েছে তার যেমন কূলকিনারা মেলে না তেমনি কবে থেকে বৈশাখে বাংলা নববর্ষ শুরু তারও হদিস মেলে না। কোন কোন বইতে পাই চৈত্র মাসে বছরের শুরু। ১৮১৩ সালে চার্লস স্টুয়ার্ট রচিত ’’বাংলার ইতিহাস’’ বইতে বছরের প্রথম মাস হিসাবে চৈত্র মাসের কথা বলা আছে। ফলে কবে থেকে বাংলা সন বৈশাখে শুরু হলো তার প্রমান নেই। অর্থাৎ বাংলা সনের ইতিহাসের পুরো বিষয়টি এখনো শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়ায়নি।
কবে থেকে ব্যবহার করছি বাংলা সন
কোন ইতিহাসের বই বা অন্য কোন লেখায় বাংলা সন চালুর কোন তথ্য এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তাই নানা তাম্রলেখ, দলিল বা কবিতায় বাংলা সনের ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলা সন চালু হবার তত্ত্ব তালাশ করা যেতে পারে। পুঁথি গবেষক যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য পাণ্ডুলিপিতে রচনাকাল নির্দেশক ২৪ রকমের অব্দ বা সনের ব্যবহার চিহ্নিত করেছেন। তবে হিজরী, শকাব্দ আর বাংলা সনই বেশি ব্যবহৃত হয়েছে। কখনো কবিরা রচনাকাল সরাসরি বলেছেন, কখনো সংখ্যাবাচক হেঁয়ালীতে রচনাকাল নির্দেশ করেছেন। একে বলা হয় ’কবি শকাঙ্ক’। দু’একটি ব্যতিক্রম ছাড়া সংখ্যা বলেছেন উল্টো করে। যাকে বলা হয়েছে ’অঙ্কস্য বামা গতি’। রামজীবন বিদ্যাভূষণ রচিত মনসা-মঙ্গলের রচনাকাল নির্দেশক পদটি এরূপ-”শর কর ঋতু বিধু শক নিয়োজিত।/মনসা-মঙ্গল রামজীবন রচিত।।” এখানে শর মানে ৫ (পঞ্চ শর), কর মানে ২ (দুই হাত), ঋতু মানে ৬ (ছয় ঋতু), বিধু মানে ১ (চাঁদ)। উল্টো করে লিখলে হয় ১৬২৫ শকাব্দ (১৭০৩ খৃস্টাব্দ)। কবি শক শব্দটি ব্যবহার করেছেন। মুক্তারাম সেন রচিত সারদা-মঙ্গল কাব্যের রচনা কাল-”গ্রহ ঋতু কাল শশী শক শুভ জানি।/মুক্তারাম সেন ভণে ভাবিয়া ভবানী।।” এখানে গ্রহ=৯, ঋতু=৬, কাল=৩ (ত্রিকাল), শশী=১। অঙ্কস্য বামা গতি হিসাবে ১৩৬৯ শকাব্দ। ড.দীনেশ চন্দ্র সেন ১৫টি হাতে লেখা পুঁথির রচনা কাল ১০৯৫ সন থেকে ১০১৭ বাংলা সনের মধ্যে বলে নির্দেশ করেছেন। এর মধ্যে প্রাচীনতম তারিখ ফকিররাম দাস রচিত ’সত্যনারায়ণ’ পুঁথি। রচনাকাল-ইতি সন হাজার সতের ১০১৭ জ্যৈষ্ঠ মাসে। এখন পর্যন্ত বাংলা সনের সবচেয়ে প্রাচীন ব্যবহার দেখা গেছে বিশ্বভারতীর একটি পুঁথিতে (কাশীরাম দাসের মহাভারত নং ৩৫০৬)। লিপিকাল পাওয়া যায় সং ১০০২ সাল। একই তারিখ পাওয়া গেছে বারো ভূঁইয়ার অন্যতম ঈসা খাঁর কামানে। তাতে লেখা রয়েছে,”সরকার শ্রীযুত ইছা খাঁনে মসনদ্দালি সন হাজার ১০০২। যাঁরা বাংলা সন প্রবর্তক হিসাবে আকবরের কথা বলেছেন তাঁদের হিসাবে বাংলা সনের প্রাচীনতম ব্যবহার হবার কথা ৯৬৩ সন। এটি তার সব চেয়ে নিকটবর্তী।
যে বাংলা সন আমরা ব্যবহার করছি
আমরা যে বাংলা সনটি ব্যবহার করছি তা নানা সংস্কারের মাধ্যমে এখানে এসেছে। ১৯৫৭ খৃস্টাব্দে ড. মেঘনাদ সাহার নেতৃত্বে গঠিত ক্যালেন্ডার সংস্কার কমিটির সুপারিশ ভারত সরকার গ্রহণ করে। ১৯৬৩ খৃস্টাব্দে ভাষাবিদ পণ্ডিত ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে বাংলা একাডেমি বাংলা সন সংস্কারের উদ্যোগ নেয়। সে কমিটি ড. মেঘনাদ সাহার নেতৃত্বে গঠিত কমিটির সুপারিশ বিবেচনায় রেখে কাজ করেছে। শহীদুল্লাহ কমিটির রিপোর্টে লীপ ইয়ারসহ কিছু জটিলতা থাকায় তা নিরসনের জন্য বাংলা একাডেমি ”বাংলা বর্ষপঞ্জী সংস্কার কমিটি” গঠন করে। সে কমিটি শহীদুল্লাহ কমিটির রিপোর্ট পর্যালোচনা করে কিছু সুপারিশ করে। পরে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় ২৬ জুলাই ১৯৯৫ তারিখে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালককে আহবায়ক করে একটি টাস্কফোর্স গঠন করে। শহীদুল্লাহ কমিটিসহ পরের কমিটির রিপোর্ট পর্যালোচনা করে দাখিলকৃত টাস্কফোর্সের প্রধান সুপারিশগুলো ছিলো-
(ক) সাধারণভাবে বৈশাখ থেকে ভাদ্র মাস ( ৫ মাস ) পর্যন্ত প্রতি মাসে ৩১দিন এবং আশ্বিন থেকে চৈত্র ( ৭ মাস ) পর্যন্ত প্রতি মাসে ৩০ দিন গণনা করা হবে। ( এটি শহীদুল্লাহ কমিটির সুপারিশের অনুরূপ)
(খ) গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জীর অধিবর্ষে যে বাংলা বছরের ফাল্গুন মাস পড়বে, সেই বাংলা বছরকে অধিবর্ষ রূপে গণনা করা হবে।
(গ) ১৪০২ সালের ১লা বৈশাখ থেকে এটি কার্যকর হবে এবং তারিখ পরিবর্তনের সময় হবে আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী মধ্যরাত (১২.০০টায়)
এখন বাংলাদেশে এ ক্যালেন্ডার চালু আছে। কিন্তু বাংলাদেশ ও ভারতে বিশেষতঃ পশ্চিম বঙ্গের সনাতন ধর্মাবলম্বীরা এখনো আদি পঞ্জিকা অনুসারে আচারাদি পালন করেন। তাই দু’টি ক্যালেন্ডারে প্রায়ই গরমিল দেখা দেয়। ফলে চৈত্রসংক্রান্তি বা ১লা বৈশাখ ভিন্নদিনে পালিত হয়। বাংলাদেশের সনাতন ধর্মাবলম্বীরাও নববর্ষের উৎসব আমাদের সাথে পালন করলেও ধর্মীয় আচারাদি সনাতন পঞ্জিকা অনুসারেই পালন করেন। এ বছর (২০১৭ খ্রিষ্টাব্দ) পশ্চিম বঙ্গে এবার নববর্ষ পালিত হবে বাংলাদেশের ২ দিন পর। এটি এখনো একটা অমীমাংশিত এক সমস্যা।
আবারো সংস্কার হচ্ছে বাংলা সন
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলা ফাল্গুন মাসের ৮ তারিখ ছিল। কিন্তু আমরা চলমান বাংলা বর্ষপঞ্জিতে তা ৯ তারিখে পালন করে আসছি। একইভাবে বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, রবীন্দ্রজন্মজয়ন্তী, নজরুল জন্মজয়ন্তী ইংরেজি তারিখের সঙ্গে প্রতিষঙ্গী বাংলা তারিখ ঠিক নেই। এ বিষয়টিকে ঠিক করতেই বাংলা বর্ষপঞ্জি সংশোধন করা হচ্ছে। বাংলা একাডেমির নির্বাহী কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাংলা বর্ষপঞ্জির বৈশাখ থেকে আশ্বিন পর্যন্ত প্রথম ছয়মাস ৩১ দিন, কার্তিক থেকে মাঘ এবং চৈত্র মাস ৩০ দিন এবং ফাল্গুন মাস ২৯ দিন গণনা করা হবে। তবে গ্রেগরিয় পঞ্জিকার অধিবর্ষে ফাল্গুন মাস ২৯ দিনের পরিবর্তে ৩০ দিন গণনা করা হবে।
পঞ্জিকার এই সংশোধনের ফলে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস একুশে ফেব্রুয়ারির প্রতিষঙ্গী বাংলা তারিখ হবে ৮ (আট) ফাল্গুন। জাতীয় দিবস ২৬ মার্চের প্রতিষঙ্গী তারিখ হবে ১২ চৈত্র। রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী ৮ মে’র প্রতিষঙ্গী তারিখ হবে ২৫ বৈশাখ। নজরুল জন্মজয়ন্তী ২৫ মের প্রতিষঙ্গী তারিখ হবে ১১ জৈষ্ঠ্য এবং বিজয় দিবস ১৬ ডিসেম্বরের প্রতিষঙ্গী বাংলা তারিখ হবে পহেলা পৌষ। অর্থাৎ মূল দিবসের ইংরেজি তারিখেই বাংলা তারিখ যা ছিল তাই ফিরে আসছে। বাংলা ১৪০২ সাল থেকে যে বর্ষপঞ্জি দেশে প্রচলিত আছে তা ‘শহীদুল্লাহ বর্ষপঞ্জি’। ২০১৮ সালের ক্যালেন্ডারে এই্ নতুন বাংলা ক্যালেন্ডার চালু হবার কথা রয়েছে।
সমাপনী
দীর্ঘ দিন থেকে বাংলা সন তারিখ নিয়ে গবেষণায় নিয়োজিত শামসুজ্জামান খান মুনসী সলিমুল্লাহর ’’তারিখ-ই-বাঙ্গালা’’ (বাংলার ইতিহাস) বইয়ের কিছু তথ্যের আলোকে অনুমান করেন কেন্দ্রীয়ভাবে আকবর প্রবর্তিত তারিখ-ই-ইলাহীকে ভিত্তি ধরে আঞ্চলিক ফসলী সন হিসাবে বঙ্গাব্দের সূচনা করেন নবাব মুর্শিদকুলি খান। মুর্শিদাবাদের নবাবরা অষ্টাদশ শতকের প্রথম দিকে পূণ্যাহ প্রবর্তনের মাধ্যমে বাংলা সন ও নববর্ষ পালনের সূচনা করেন। ব্যবসায়ীরা চালু করেন হাল খাতা। জনাব খানের এই মতটি বেশ যুক্তিপূর্ণ মনে হয়। কিন্তু দীনেশচন্দ্র সেন উল্লিখিত ১০১৭ সন এবং ঈসা খানের কামানে লেখা ১০০২ সন এর চেয়ে শতাধিক বছরের বেশি প্রাচীন। এটা সঠিক হলে জনাব খানের এ দাবী সঠিক বিবেচনা করা যায় না।
যে দুটি ঐতিহাসিক আকরগ্রন্থে সন আরিখের কথা বলা আছে সেখানে বঙ্গাব্দের উল্লেখ নেই। ১০৩১ খ্রীস্টাব্দে প্রকাশিত আল বেরুনীর ’’ভারততত্ত্ব’’-এ শ্রীহর্ষাব্দ, বিক্রমাব্দ, শকাব্দ, বলভাব্দ ও গুপ্তাব্দের উল্লেখ আছে। বঙ্গাব্দের কথা নেই। আবুল ফজল আল্লামীর ’’আকবরনামা ও আইন-ই-আকবরী’’ বইতে সে সময় সারা বিশ্বে প্রচলিত প্রায় সকল ক্যালেন্ডারের উল্লেখ আছে কিন্তু বঙ্গাব্দের কথা নেই। আবুল ফজল যে বাংলা সম্পর্কে জানতেন তার প্রমান তাঁর বইতে আছে। এ দু’টি আকরগ্রন্থে বঙ্গাব্দের উল্লেখ না থাকা প্রমান করে আল বেরুনীর বই লেখার সময় (১০৩১ খ্রীস্টাব্দ) বা তার আগে অথবা আকবরের রাজত্বের আগে বঙ্গাব্দের প্রচলন থাকার কোন দলিল নেই। এটা আকবর কর্তৃক বাংলা সন প্রবর্তিত বলে প্রমান না দিলেও তার আগে যে প্রবর্তিত হয়নি সেটার প্রমান দেয়।
আমাদের ঘরে ঘরে যে ক্যালেন্ডার শোভা পায় তা গত ৩৫/৪০ বছরের ঘটনা। তার আগে স্বচ্ছল ঘরে কিছু ক্যালেন্ডার চোখে পড়তো। প্রকৃত পক্ষে সন তারিখ দরকার হতো ধর্মীয় আচারানুষ্ঠানে। তার মূল অবলম্বন ছিলো পঞ্জিকা। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা লোকনাথ ডাইরেক্টরী বা গুপ্ত প্রেস পঞ্জিকা বা বিশুদ্ধসিদ্ধান্ত পঞ্জিকা দেখতেন বা এখনো দেখেন। আর মুসলমানরা মোহাম্মদী পঞ্জিকা দেখেন। আমি একসময় অনুমান করেছি,আকবর প্রচলিত ফসলী সন আর বিদ্যমান পঞ্জিকাকে মিলিয়ে বাংলা সনের প্রচলন পঞ্জিকাকারগণও করে থাকতে পারেন। কিন্তু মুদ্রিত পঞ্জিকার প্রথম প্রকাশকালের চেয়ে প্রাচীনতর বাংলা সনের উল্লেখ পাওয়া গেছে। হাতে লেখা পঞ্জিকার যুগে এটা ঘটেছে কিনা তার এখনো কোনো প্রমান মেলেনি। যতো দিন এর কোন বিহিত না হচ্ছে ততোদিন সর্বাপেক্ষা যুক্তিপূর্ণ প্রস্তাবটির পক্ষেই আমার অবস্থান। অধ্যাপক ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের সাথে সুর মিলিয়ে বলি-
’’...আলোচনা থেকে এটা পরিষ্কার যে আকবরের রাজত্বের পূর্বে বাংলা সন বঙ্গাব্দ ব্যবহারের কোন নিশ্চিত প্রমান নেই।এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত ও আলোচিত তথ্যাদি আকবরের আমলে চান্দ্র হিজরী অব্দের সংস্কারের মধ্যেই বঙ্গাব্দের সূচনার ইঙ্গিত করে। এর বিপরীতে কোন ঘটনা নির্দেশক বিশ্বাসযোগ্য তথ্যসূত্র আবিষ্কৃত না হওয়া পর্যন্ত এই মতই গ্রহণযোগ্য।’’
কৃতজ্ঞতা স্বীকার
১. অজয় রায়-প্রাচীন ভারতীয় বর্ষপঞ্জী: একটি সমীক্ষা
২. ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়-বাঙ্গালা সন
৩. মোবারক আলী খান-বাংলা সনের জন্মকথা
৪. শামসুজ্জামান খান-বাংলা সনের ইতিহাস অনুসন্ধান ও নববর্ষ উদযাপনের রূপান্তর কথা
৫. শামসুজ্জামান খান-বাংলা সন ও পঞ্জিকার বৈশিষ্ট্য
৬. সত্যেন সেন-বিশ্ব পটভূমিতে বাংলা মাস তালিকা
৭. মোহাম্মদ আবদুল কাইউম-বাঙালির একান্ত অব্দ বঙ্গাব্দ
৮. ড.আশরাফ সিদ্দিকী-নববর্ষের উৎসব ও অনুষ্ঠান
৯. ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ-বাংলা সাহিত্যের কথা (দ্বিতীয় খন্ড-মধ্যযুগ)
১০. নীহাররঞ্জন রায়-বাঙ্গালীর ইতিহাস আদি পর্ব
১১. দীনেশচন্দ্র সেন-বঙ্গভাষা ও সাহিত্য
১২. উইকিপিডিয়া