somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গাবোর জন্য ভালোবাসা

১৭ ই এপ্রিল, ২০২১ রাত ১০:৩২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আজ নোবেল পুরস্কার জয়ী কথাশিল্পী গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের ৭ম মৃত্যু বার্ষিকী। এ উপলক্ষে মহান লেখকের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁর মৃত্যুর পর ২০১৪ খ্রিস্টাব্দের একটি শ্রদ্ধাঞ্জলি আজ আবার শেয়ার করলাম-

টি.এস.এলিয়ট কথিত নিষ্ঠুতম মাস এপ্রিলের ১৭ তারিখে (২০১৪) এ ধরাধাম ছেড়ে যান বিশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিক, যাদুবাস্তববাদের কুতুব মিনার, ১৯৮২ সালে নোবেল সাহিত্য পুরস্কার বিজয়ী গাব্রিয়েল হোসে দে লা কনকর্দিয়া গার্সিয়া মার্কেস (Gabriel José de la Concordia García Márquez) ওরফে গাবো। যাঁকে বলা হয় ’দোন কিহতে’ খ্যাত মিগুয়েল সারভান্তেসের পর হিস্পানী ভাষার সব চেয়ে বড়ো লেখক। ৮৭ বছরের (১৯২৭-২০১৪) বর্ণিল জীবন শেষ হয়েছে হলুদ রোদে ভেসে যাওয়া এক মেহিকান বিকেলে। সবাই জানেন, গাবোর প্রিয় রং ছিলো হলুদ। মায়েস্ত্রো গাবোর চলে যাওয়াটাও যাদুবাস্তবতায় রঙিন ! শিল্প সফলতা আর তুমুল পাঠকপ্রিয়তার মাঝে যে চরম বৈরিতা, সেটাকে হাতেগোনা যে দু’চার জন এক ঘাটে জল খাইয়েছেন, গাবো তাঁদের একজন। দৈহিক মরনের মাধ্যমে অমরত্বের পথে পাড়ি জমানো মহান কথাকারের জন্য নিবেদন করছি ভালোবাসার অর্ঘ্য।

গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস ওরফে গাবোর জন্ম ১৯২৭ সালের ৬ মার্চ দক্ষিণ আমেরিকার মাদক আর সন্ত্রাস কবলিত দেশ কলস্বিয়ার আরাকাতাকা গ্রামে। তাঁর বাবা গাব্রিয়েল এলিসিও গার্সিয়া (Gabriel Eligio García) আর তাঁর মা লুইসা সান্তিয়াগা মার্কেস (Luisa Santiaga Márquez)। গাবোর জন্মের পরপরই তাঁর বাবা মা চলে যান নতুন কর্মস্থল বারাঙ্কিলায়। শিশু গাব্রিয়েল থেকে যান তাঁর নানা কর্নেল নিকোলাস মার্কেস (Colonel Nicolás Ricardo Márquez Mejía) আর নানী দোনা ত্রাঙ্কিলিনার (Doña Tranquilina Iguarán) কাছে। শৈশবে নানা-নানীর সাহচর্য গাবোর মানসগঠনে বিপুল প্রভাব বিস্তার করে। তাঁর নানা কর্নেল নিকোলাস বিখ্যাত ’হাজার দিনের’ যুদ্ধে লিবারেলদের হয়ে লড়াই করেছিলেন। নানার রাজনৈতিক মতবাদ তাঁকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। নানীর কাছে অদ্ভুতভঙ্গিতে বলা বিচিত্র সব গল্প শুনে শুনে তৈরি হয়েছে তাঁর যাদুবাস্তববাদী মানস। তাঁর সব চেয়ে বিখ্যাত উপন্যাস ’নি:সঙ্গতার এক শ’ বছর’-এর বর্ণনায় নানীর গল্প বলার ভঙ্গির বিপুল প্রভাব রয়েছে।

কলম্বিয়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন পড়ার সময় গাবো সাংবাদিকতা পেশায় জড়িয়ে পড়েন। তিনি ’এল ইউনিভার্সাল’ (El Universal) , ’এল হেরালদো’ (El Heraldo) , ’এল এসপেকতাদোর’ (El Espectador) প্রভৃতি পত্রিকায় প্রতিবেদন, ধারাবাহিক কলাম, চলচ্চিত্র বিষয়ে লিখেছেন। তিনি ভেনিসুয়েলার ’মোমেন্তো’ (Momento) পত্রিকায়ও কাজ করেছেন। ধারাবাহিক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন আর ভেনিসুয়েলার রাজনৈতিক পরিবর্তনের সাথে জড়িয়ে কিছু বিতর্কেরও মুখোমুখি হন। সাংবাদিকতার পাশাপাশি নোবেলজয়ী মার্কিন লেখক উইলিয়াম ফকনার আর ভার্জিনিয়া উলফের লেখা পড়ে নিজের লেখালেখির ভিত্তি গড়ে তোলেন। ফকনারের বর্ণনাশৈলী, ঐতিহাসিক উপন্যাস আর গ্রামীন পটভূমিতে লেখা গ্রন্থাবলী মার্কেসসহ লাতিন আমেরিকার লেখকদের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে।

কথাসাহিত্যে গাবোর সূচনা ছোটগল্প দিয়ে। বোগোতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় এক বন্ধুর মাধ্যমে হাতে আসে ফ্রানৎস কাফকার ছোটগল্প সঙ্কলন। কাফকার ’মেটামরফসিস’ গল্পের প্রথম লাইন পড়ে চমকে গিয়ে বিছানা থেকে ছিটকে পড়ে গিয়েছিলেন। (লাইনটা অনেকটা এরকম-একদিন সকালে গ্রেগর শামসা ঘুম থেকে জেগে উঠে আবিষ্কার করলো, সে এক অতিকায় পতঙ্গে পরিণত হয়েছে।) সেখান থেকে ছোট গল্প লেখা শুরু করেন। গল্পগুলো ছাপা হতে থাকে এল এসপেকতাদোর পত্রিকার সাহিত্যের পাতায়। ঘটনাটা গাবো বলেছিলেন ১৯৮১ সালে প্যারিস রিভিউর পিটার স্টোনকে দেয়া সাক্ষাৎকারে।

একই সাক্ষাৎকারে পিটারকে প্রথম উপন্যাস লেখার কাহিনীও বলেছিলেন গাবো। গ্রাম ছেড়ে যাবার অনেক পরে গাবো তাঁর মায়ের সাথে নিজ গ্রাম আরাকাতাকাতে বেড়াতে যান। তখন তিনি ২২ বছরের যুবক। গ্রাম ছেড়েছিলেন ৮ বছর বয়সে। গ্রাম থেকে ফিরে এসে চিরচেনা গ্রামটিকেই তিনি তুলে ধরলেন তাঁর প্রথম উপন্যাস ’লা হোসারাসকা’ (Leaf Storm ) বা ’পাতার ঝড়’-এ। এটা আসলে ছোট আকারের, নভেলা। বইটির প্রকাশক পেতে গাবোকে অপেক্ষা করতে হয়েছিলো মাত্র সাত বছর। ১৯৫৫ সালে বইটি পাঠকের হাতে আসে। বইয়ের আখ্যান গড়ে উঠেছে ১৯২৮ সালের ১২ সেপ্টেম্বর বুধবার একটি কক্ষে সংঘটিত আধ ঘন্টার ঘটনাবলী নিয়ে। এটি (লেখকের নানার মতো) এক বুড়ো কর্ণেলের গল্প। বুড়ো এক নিন্দিত ফরাসী ডাক্তারকে যথাযথ খ্রীস্টীয় প্রথায় কবর দিতে চাইছেন, যাতে তাঁকে সমর্থন করছে তাঁর কন্যা আর নাতি। এতে একটি শিশুর মৃত্যু দেখার প্রথম অভিজ্ঞতা তুলে ধরা হয়েছে ’অন্তর্গত স্বগতোক্তি’ (stream of consciousness) রীতি অনুসরন করে, যে রীতি জেমস জয়েস ব্যবহার করেছেন তাঁর বিশ্বখ্যাত উপন্যাস ’ইউলিসিস’-এ; আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ব্যবহার করেছেন তাঁর মহাব্যিক উপন্যাস ’খোয়াবনামা’য়। মার্কেসের মতে এ কৌশল জয়েসের চেয়ে ভার্জিনিয়া উলফ বেশী দক্ষতার সাথে ব্যবহার করেছেন এবং এ রীতির প্রথম ব্যবহারকারী ’Lazarillo de torme’ বইয়ের অজ্ঞাতনামা লেখক।

গাবোর প্রেরণা আর খ্যাতির পেছনের মানুষটির নাম মের্সেদেস বার্চা। মিশরীয় বংশোদ্ভুত এ কলম্বিয়ান নারীই তাঁর স্ত্রী। মের্সেদেসকে গাবো প্রথম দেখেন কলম্বিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় শহর মাগানগেতে। তখন গাবোর বয়স ১৪ আর মের্সেদেসের বয়স ৮। প্রথম দেখাতেই প্রেম। এবং তখনই ঠিক করেন এ বালিকাকেই তিনি বিয়ে করবেন। ১৯৪৫ সালে প্রেমিকাকে নিয়ে লিখেছিলেন কবিতা। ঘর বাঁধেন ১৯৫৮ সালে। তাঁদের প্রথম ছেলে রদরিগো গার্সিয়া জন্ম নেন ১৯৬১ সালে। রদরিগো টিভি ও চলচ্চিত্র পরিচালক। তাঁদের ২য় পুত্র গনসালেস জন্মেছেন ১৯৬৪ সালে। গনসালেস একজন গ্রাফিক ডিজাইনার। গাবোর নাতি নাতনী ৫ জন।

কলম্বিয়ায় জন্মালেও গাবো মৃত্যু পর্যন্ত জীবনের শেষ ৫০ বছর ধরে বাস করেছেন মেক্সিকোর রাজধানীর দক্ষিণ প্রান্তে এল পেদ্রেগাল আবাসিক এলাকার কাইয়ে ফুয়েগো সড়কের ১৪৪ নম্বর বাড়ীতে। এ বাড়ীতেই তিনি লিখেছেন তাঁর বিশ্বখ্যাত উপন্যাস ’সিয়েন আনিয়োস দে সোলেদাদ’ (One Hundred Years of Solitude) বা ’নি:সঙ্গতার এক শ’ বছর’। আঠারো বছর বয়স থেকে মার্কেস তাঁর নানাবাড়ীর গ্রামকে নিয়ে একটি উপন্যাস লেখার স্বপ্ন লালন করেছেন। যে গ্রামে তিনি নানা-নানীর স্নেহে বেড়ে উঠেছেন। কিন্তু মনের মতো ভাব আসছিলো না বলে লেখা হচ্ছিলো না। সেই ভাব তাঁর মাথায় আসলো যখন তিনি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে গাড়ী চালিয়ে আকাপুলকো যাচ্ছিলেন। সাথে সাথে গাড়ী ঘুরিয়ে বাড়ী ফিরে এলেন যাতে অবিলম্বে লেখা শুরু করতে পারেন। নিরবচ্ছিন্নভাবে লেখার জন্য গাড়ীটা বেচে দিলেন, যাতে সে টাকায় তাঁর স্ত্রী সংসার চালাতে পারেন। যা ভেবেছিলেন তার চেয়ে ঢের বেশী সময় লাগলো উপন্যাসটি শেষ করতে। প্রতিদিন লিখতেন তিনি। তারপরও লাগলো পুরো আঠারো মাস। গাড়ীবেচা টাকা শেষ হবার পর তাঁর স্ত্রীকে বাকীতে খাবার কিনতে শুরু করতে হলো। বাড়ী ভাড়া বাকী পড়লো ৯ মাসের। প্রকাশকের কাছে পাণ্ডুলিপি পাঠাতে গিয়ে দেখেন পুরো ডাক মাশুল পকেটে নেই। অর্ধেক পাণ্ডুলিপি পাঠালেন। বাড়ী ফিরে বিয়ের সময় উপহার পাওয়া ফুড প্রসেসরটি বেচে সে টাকায় পাঠালেন পাণ্ডুলিপির বাকী অর্ধেক। ১৯৬৭ সালে প্রকাশের সাথে সাথে বইটি অভাবনীয় জনপ্রিয়তা পেয়ে গেলো। গ্রেগরী রাবাসার অনুবাদে ইংরেজীতে বইটি প্রকাশিত হয় ১৯৭০ সালে (রাবাসা তাঁর প্রায় সব বইয়ের ইংরেজী অনুবাদক)। বাংলাদেশে বাংলায় অনুবাদ করেছেন জি.এইচ.হাবীব। এর আগে উপন্যাসটির বাংলা অনুবাদ সাপ্তাহিক রোববারে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে গাবো নোবেল পুরস্কার পাবার পরপরই। বিশ্বের সব প্রধান ভাষায় অনুদিত এ বইয়ের প্রায় ৩ কোটি কপি বিক্রি হয়েছে। বইয়ের কাহিনী গড়ে উঠেছে দক্ষিণ আমেরিকার এক কাল্পনিক গ্রাম মাকোন্দোর বুয়েন্দিয়া পরিবারের ছয় প্রজন্মের ইতিহাস নিয়ে। বুয়েন্দিয়া পরিবার কর্তৃক মাকোন্দা গ্রাম গড়ে তোলা, এ পরিবারের সুখদু:খ, পারিবারিক আচার, অনাচার সবই এর অংশ। উপন্যাসের কিংবদন্তীতুল্য চরিত্র কর্ণেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া লেখকের নানা কর্ণেল নিকোলাসের প্রেরণায় সৃষ্ট। যে কর্ণেল বত্রিশটি সশস্ত্র বিদ্রোহ সংঘটিত করে সব ক’টিতে হেরেছেন, চৌদ্দটি হত্যা চেষ্টা ব্যর্থ করে বেঁচে গেছেন। ব্যর্থ হয়েছে তাঁর জন্য করা তিয়াত্তরটা অ্যামবুশ, একটা ফায়ারিং স্কোয়াড। সব ঘটনা দুর্ঘটনার কেন্দ্রে আছে মাকোন্দো গ্রাম। মার্কেস এসব ফুটিয়ে তুলেছেন যাদুবাস্তববাদের অনুপম শৈলীতে। ফলে সব অদ্ভুত ঘটনা পাঠকের কাছে একদিকে যেমন অলৌকিক মনে হয়, একই সাথে মনে হয় অনেক চেনা। মার্কেসের যাদুকরী কলমে পাঠক কুহকাচ্ছন্ন হয়ে যান। এ যেন মানব ইতিহাসেরই এক সুনিপুন পুনর্বয়ন। সমালোচকরা মাকোন্দা গ্রামকে দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশে ছড়িয়ে থাকা সকল গ্রামের প্রতিভূ বলে বিবেচনা করেন। কারো কারো মতে, এটি মূলত: মার্কেসের নানার গ্রাম আরাকাতাকা। এ বই নিয়ে শত শত প্রবন্ধ আর বই লিখেছেন সারা দুনিয়ার সাহিত্য সমালোচকরা। ১৯৮২ সালে নোবেল পুরস্কারসহ অনেক পুরস্কার জিতেছে এ বইটি। যদিও নোবেল পুরস্কার কমিটি তাঁকে পুরস্কৃত করার কারণ হিসাবে বলেছিলো- "for his novels and short stories, in which the fantastic and the realistic are combined in a richly composed world of imagination, reflecting a continent's life and conflicts"

ভেনিসুয়েলার একনায়ক মার্কোস পেরেস হিমেনেসের কাণ্ডকীর্তি দেখে ১৯৬৮ সালে মার্কেস লিখতে শুরু করেন তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ’এল ওতোনিয়ো দেল পেত্রিয়ার্কা’ (Autumn of the Patriarch) বা ’গোত্রপতির শরৎকাল’। ১৯৭১ সালে বইটি লেখা শেষ হলেও তা স্পেনে প্রকাশিত হয় ১৯৭৫ সালে। মার্কেস এ উপন্যাসটিকে বলেছেন,’ক্ষমতার নীরবতার কাব্য’। এতে একজন চিরন্তন একনায়ক হিসাবে একজন জেনারেলকে তুলে ধরা হয়েছে তাঁর জীবনের ছোট ছোট (ধারাবাহিকতা রক্ষা না করে লেখা) উপাখ্যানের মাধ্যমে। জেনারলের দেশটি কোথায় সেটা সরাসরি না বলে ক্যারিবীয় অঞ্চলের কোথাও অবস্থিত কাল্পনিক দেশ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। মার্কেস এ বইয়ের প্লট সম্পর্কে বলেছেন, আমি সবসময় লাতিন আমেরিকান একনায়কদের, বিশেষ করে যারা ক্যারীবীয়, তাদের সিনথিসিস তৈরীর চেষ্টা করেছি। ভেনিসুয়েলার একনায়ক হুয়ান ভিসেন্ত গোমেজের ব্যক্তিত্বের যে জোর সেটাই ফুটে উঠেছে এ বইতে। তিনিই সেই গোত্রপতি।

১৯৫১ সালে কলম্বিয়ায় সংঘটিত একটি খুনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে মার্কেস লিখলেন আরেকটি বহুল আলোচিত উপন্যাস ’ক্রোনিকা দে উনা মুয়ের্তে আনুনসিয়াদা’ (Chronicle of a Death Foretold) বা ’একটি পূর্বঘোষিত মৃত্যুর কালপঞ্জী’। ১৯৮১ সালে প্রকাশিত উপন্যাসটি সান্তিয়াগো নাসার নামের এক ব্যক্তির খুন হবার ঘটনা নিয়ে। যে কিনা মার্কেসের শৈশবের ঘনিষ্ট বন্ধুদের একজন সায়তানো সিমেন্তোর ছায়া অবলম্বনে সৃষ্ট। সাহিত্য সমালোচক রুবেন পায়েলো উপন্যাসটিকে সাংবাদিকতা, বাস্তবতা আর গোয়েন্দা গল্পের সমন্বয়ে গড়া বলে চিহ্নিত করেছেন। সান্তিয়াগো নাসারের হত্যাকাণ্ডকে ঘিরে আবর্তিত উপন্যাসটির কথককে পাওয়া যায় একজন গোয়েন্দার ভূমিকায়, যিনি হত্যাকাণ্ডের প্রতি সেকেণ্ডের ঘটনাবলী উন্মোচন করে চলেন। বইয়ের কাহিনীটি উল্টো করে বলা হয়েছে। প্রথম অধ্যায়েই কাহিনীর কথক পাঠকদের জানিয়ে দেন সান্তিয়াগোকে কে খুন করেছেন। তারপর ধীরে ধীরে বিশদভাবে বর্ণনা করেন কিভাবে খুনটি করা হয়েছে।

১৯৮৫ সালে (নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির ৩ বছর পরে) প্রকাশিত হয় মার্কেসের আরেক বিখ্যাত উপন্যাস ’এল আমোর এন লোস তিয়েম্পোস দেল কলেরা’ (Love in the Time of Cholera) বা ’কলেরার দিনে ভালোবাসা’। বইটি দু’টির জুটির ভালোবাসা নিয়ে লেখা। একটি জুটিতে আছে মার্কেসের বাবা মায়ের প্রেমের ছায়া। আরেকটি জুটি ছিলো সত্তরোর্ধ, যারা বৃদ্ধ বয়সেও তাদের ভালোবাসা চালিয়ে গেছেন। প্রতি বছর দেখা করতেন। একবার নৌকায় চড়ে বাইরে গেলে মাঝি তাদর বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলে। প্রথাগত প্রেমের উপন্যাস থেকে ভিন্নধর্মী বলে এ উপন্যাসটি পাঠক সমালোচকের দৃষ্টি কেড়েছে।

মার্কেসের অন্যান্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে ’এল কোরোনেল নো তিয়েনেনে কিয়েন লা এস্ক্রিবা’ (No One Writes to the Colonel) বা ’কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখেনা’; মেডেলিনের ড্রাগ লর্ডদের গুম-খুনের ওপর ভিত্তি করে রচিত ’নোটিসিয়া দে উন সেকুয়েস্ত্রো’ (News of a Kidnapping) বা ’গুম সংবাদ’ (১৯৯৬); তিন খণ্ডে সমাপ্য আত্মজীবনীর প্রথম খণ্ড ’বিবির পারা কোনতারলা’ (Living to Tell the Tale) বা ’গল্প বলার জন্য জীবনযাপন’(২০০৩); ব্যাতিক্রমী প্রেমের উপন্যাস ’মেমরিয়া দে মিস পুতাস ত্রিস্তেস’ (Memories of My Melancholy Whores ) বা ’আমার দু:খভারাক্রান্ত বেশ্যাদের স্মৃতিকথা’ (২০০৪) ইত্যাদি। এ ছাড়া তিনি চলচ্চিত্র ও টেলিভিশনের জন্য চিত্রনাট্য লিখেছেন।

মার্কেসকে ঘিরে গল্প বলার যে কৌশল সারা দুনিয়ায় মশহুর হয়েছে তার নাম ’যাদুবাস্তববাদ’। সেটা আসলে মার্কেসের তৈরী নয়। লাতিন আমেরিকায়ও নতুন নয়। কিন্তু সারা দুনিয়া এখন একবাক্যে স্বীকার করে মার্কেসই যাদুবাস্তববাদের কুতুব মিনার। যাদুবাস্তববাদের কথা প্রথম বলেছিলেন জার্মান শিল্প সমালোচক ফ্রান্স রোহ। ১৯২৫ সালে কয়েকজন চিত্রশিল্পীর কাজের স্টাইল বর্ণনার সময় কথাটি ব্যবহার করেছিলেন। যাদুবাস্তববাদ আসলে কি সেটা ব্যাখ্যা করে বলা প্রায় অসম্ভব একটা কাজ। উইকির মতে, যাদুবাস্তববাদ এমন এক ধরনের সাহিত্যরীতি যাতে যাদুর উপকরণ অপরবাস্তব জগতের অপরিহার্য অংশ। যে রীতি চলচ্চিত্র আর চিত্রকলায়ও ব্যবহৃত হয়। উদাহরণ হিসাবে বলা হয়েছে, কোন চরিত্রের মৃত্যুর পরও প্রজন্মের পর প্রজন্ম বেঁচে থাকা কিংবা বাস্তব জন্মতারিখ বা আরো কোন বাস্তব বিষয়ের অংশ হিসাবে চিত্রিত চরিত্রের দু’শ বছর বেঁচে থাকার স্বপ্নের মতো সত্য বিষয়। এটি সূক্ষ্মভাবে কষ্ট করে জানার বিষয় নয়, বরং বিস্তৃত বিবরণধর্মী। প্রফেসর ম্যাথু স্ট্রেচের মতে জাদুবাস্তবতা হচ্ছে,"what happens when a highly detailed, realistic setting is invaded by something too strange to believe." যাদুবাস্তববাদী ঘরানার আরেক বিখ্যাত লেখক আলেহো কার্পেন্তিয়ার তাঁর বই ’এল রেইনো দে এস্তে মুন্দো’র ভূমিকায় যাদুবাস্তববাদ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, যাদুবাস্তববাদ পাঠকের কাছে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত একটা জিনিস গল্পে নিয়ে আসে, আর তার ফলে বাস্তব পৃথিবীর ঐশ্বর্য অবাস্তবের সামনে ধ্বসে পড়ে। স্বয়ং মার্কেস কি বলেছেন সেটাও স্মরণ করা যায়-”আমরা যে বাস্তবকে দেখি, তার পেছনে যে ধারণাটা আছে সেটাই যাদুবাস্তবতা।” বিষয়টিকে বিস্তারিত তুলে ধরতে M.H. Abrams তাঁর A Glossary of Literary Terms বইতে বলেছেন,"The term magic realism, originally applied in the 1920s to a school of painters, is used to describe the prose fiction of Jorge Luis Borges in Argentina, as well as the work of writers such as Gabriel García Márquez in Colombia, Gunter Grass in Germany, and John Fowles in England. These writers interweave, in an ever-shifting pattern, a sharply etched realism in representing ordinary events and descriptive details together with fantastic and dreamlike elements, as well as with materials derived from myth and fairy tales. Robert Scholes has popularized metafiction as an overall term for the large and growing class of novels which depart drastically from the traditional categories either of realism or romance, and also the term fabulation for the current mode of free-wheeling narrative invention. These novels violate, in various ways, standard novelistic expectations by drastic -- and sometimes highly effective -- experiments with subject matter, form, style, temporal sequence, and fusions of the everyday, the fantastic, the mythical, and the nightmarish, in renderings that blur traditional distinctions between what is serious or trivial, horrible or ludicrous, tragic or comic."

মার্কেসের লেখায় যেমন দেখা যায়, গ্রীষ্মে এমন গরম পড়ছে যে, মুরগীরা ভাজা ডিম পাড়তে শুরু করছে; বৃষ্টি হচ্ছে একটানা চার বছর এগারো সপ্তাহ দুই দিন ধরে। ’নি:সঙ্গতার এক শ’ বছর’ বইতে দেখা যায় মাকোন্দো গ্রামের সবচেয়ে সুন্দরী ও বিদুষী রমণী রেমিদিওন, যার প্রেমে পাগল হয়ে গ্রামের যুবকরা টপপটপ মরে যাচ্ছে, একদিন বিকাল চারটায় সেই রূপসী উঠানে একটা চাদর ভাঁজ করতে করতে আকাশে উড়ে যাচ্ছে। সুন্দরী মেয়ে গ্রামে থাকবে, তার প্রেমেও যুবকরা পাগল হবে সেটা বাস্তবতা। প্রেমের জন্য মরে যাওটাই কি যাদুবাস্তবতা ? বিকেলে উঠানে শুকনা চাদর ভাঁজ করার যে বাস্তবতা, আকাশে উড়ে যাবার সাথেই লেপ্টে আছে যাদুবাস্তবতা। তিনি নিজেই যেন এক ধরণের যাদুবাস্তব মানুষ। নিরেট বাস্তব ছবি আঁকেন না। এমন অবাস্তব বা অর্ধবাস্তব ছবি আঁকেন যা স্বপ্নেই ঘটা সম্ভব কিংবা জুয়েল আইচ বা ডেভিড কপারফিল্ডের মতো যাদুকরের পক্ষেই এমন রঙিন জগৎ তৈরী করা সম্ভব। কিন্তু সব মিলে তিনি এমন এক জগৎ ফুটিয়ে তোলেন যা বাস্তবের চেয়ে বাস্তব বলে বিভ্রম তৈরী হয়। এমন সব পাগল বা আধপাগল ধরণের চরিত্র তৈরী করেন যাকে পাঠকের কাছের কোন মানুষের প্রতিরূপ হয়ে ধরা দেয়। সেখানেই মার্কেসের জিৎ। যাদুবাস্তববাদের বহু উপকরণ ছড়িয়ে আছে রূপকথার গল্পে, এমনকি আমাদের ঠাকুরমা’র ঝুলিতে। যাদুবাস্তবতা লেপ্টে আছে বোর্হেস বা গুন্টার গ্রাস বা ফ্রানৎস কাফকার লেখায়ও। কিন্তু ঠাস বুনট, বিস্তৃত আখ্যান আর জাদুর ইন্দ্রজাল মিলে এক পরিপূর্ণ রূপ ধারণ করেছে মার্কেসের লেখায়। যেখানে এভারেস্টে চড়ে বসে আছেন তিনি।

তাঁর চলে যাওয়ায়ও আছে তুমুল যাদুবাস্তবতা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা কিংবা কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রো কিংবা পাঁড় মার্কিন বিরোধী ভেনিসুয়েলার প্রেসিডেন্ট মাদুরোর মতো পরষ্পরবিরোধী মানুষদের সমানভাবে ভক্ত বানিয়ে ফেলেছেন গাবো। দুনিয়ার দেড় শ’ দেশের প্রধান সব সংবাদপত্রে প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হয়েছে তাঁর মৃত্যুসংবাদ। সম্পাদকীয় লিখেছে বহু প্রধান পত্রিকা। তাঁর লেখার যাদুর ইন্দ্রজালে আটকে ফেলেছেন সবাইকে ! মৃত্যুর ভেতর দিয়ে গাবো ঢুকে গেলেন অমরত্বের অমরাবতীতে।

গাবো, অন্তরের গভীর থেকে রইলো তোমার জন্য ভালোবাসা। বৃটিশ রাজাদের জন্য উচ্চারিত হয় এক আপ্তবাক্য-“The King is Dead ! Long Live the King !” যা বৃটিশ রাজতন্ত্রের ধারাবাহিকতা বা অব্যাহতভাবে টিকে থাকার কথা জানান দেয়। সে আদলে তোমার জন্যও আমরা উচ্চারণ করছি-"Gabo is Dead ! Long Live Gabo !”

বি.দ্র.-২০১৪ খ্রিস্টাব্দে গাবোর মৃত্যুর পর রচিত এবং 'সাহিত্য আড্ডা' নামক সামু ব্লগকেন্দ্রিক আড্ডার মুখপত্রে প্রকাশিত।

সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই এপ্রিল, ২০২১ বিকাল ৪:৫৮
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

গণতন্ত্র আর বাক-স্বাধীনতার আলাপসালাপ

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:২৩


একাত্তর সালে আওয়ামী লীগের লোকজন আর হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ছিল পাকবাহিনীর প্রধান টার্গেট। যদিও সর্বস্তরের মানুষের ওপর নিপীড়ন অব্যাহত ছিল। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধা আর তাদের পরিবারের... ...বাকিটুকু পড়ুন

কাফের কুফফারদের দেশে বাস করা হারাম।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:১৩

ফেসবুকে বাঙালিদের মধ্যে ইদানিং নতুন এক ফতোয়া চালু হয়েছে, এবং তা হচ্ছে "দাওয়াতের নিয়্যত ছাড়া কাফের কুফফারদের দেশে বাস করা হারাম।"
সমস্যা হচ্ছে বাঙালি ফতোয়া শুনেই লাফাতে শুরু করে, এবং কোন... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দুই টাকার জ্ঞানী বনাম তিনশো মিলিয়নের জ্ঞানী!

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ২:৫৯

বিশ্বের নামীদামী অমুসলিমদের মুসলিম হয়ে যাওয়াটা আমার কাছে তেমন কোন বিষয় মনে হত না বা বলা চলে এদের নিয়ে আমার কোন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু আজ অষ্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ডিজাইনার মিঃ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×