বাংলা সাহিত্যের প্রধান লেখকদের মধ্যে একজন হয়েও স্বল্পায়ু আখতারুজ্জামান ইলিয়াস (মাত্র ৫২ বছরের জীবনকাল তার) জনপ্রিয় লেখক হবার চেষ্টা করেননি। পাঠকপ্রিয়তা, জনপ্রিয়তা এসব শব্দকে তিনি লেখকজীবনের প্রথম থেকে অত্যন্ত সচেতনভাবে পাশ কাটিয়ে গেছেন। প্রকাশকের বা সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদকদের চাপে পড়ে বা পাঠক সমাজকে তার লেখার সাথে আটকে রাখার অভিপ্রায়ে একটি লেখাও তিনি লিখেননি। এ কাজকে তিনি পাঠক সমাজের সাথে প্রতারনা মনে করতেন, এজন্যই তার সমস্ত লেখা দুটি মাত্র উপন্যাস, একটি প্রবন্ধগ্রন্থ, এবং গোটা পাঁচেক গল্পগ্রন্থের মধ্যে সীমাবদ্ধ যার একটি আবার প্রকাশিত হয়েছে তার মৃত্যুর পর। মধ্যবিত্ত সমাজের লোক দেখানো ভদ্রতা, ধরি মাছ না ছুঁই পানি টাইপের প্রেম, ধর্ম পালনের নামে ভন্ডামি, পর্দার অন্তরালে লুকিয়ে রাখা হীনমন্যতা, একশ্রেনীর লোকের ধর্মব্যবসা, সমাজের পতিত জনগোষ্ঠির নোংরামি ও গালাগালি, উন্নাসিক মধ্যবিত্তের উচ্চবিত্তে পরিনত হওয়ার আজন্ম লালিত স্বপ্ন থেকে উদ্ভুত নিচুতলার লোকদের সম্পর্কে খারাপ ধারনা ইত্যাদি প্রকট হয়ে ফুটে উঠে তার লেখায়। তার যাবতীয় ক্রোধ, রাগ, ঘৃণা গিয়ে পড়েছে মধ্যবিত্তের উপর যে মধ্যবিত্ত সমাজের প্রচলিত নিয়মকে আজীবন পূঁজা করে এসেছে নিজের স্বার্থের জন্য। মুখে লোক দেখানো আদর্শের কথাও বলা ফের নিজের প্রয়োজন হলে রাতের আঁধারে চুপিসারে খেমটা নাচ নাচা। ছিঁচকাঁদুনেদের প্রেম বা পুতুপুতু আবেগে ভরপুর লেখাকে তিনি মনেপ্রানে ঘৃণা করতেন। তার সৃষ্ট কোন চরিত্রই লেখকের হাতের ছোঁয়া পেয়ে মহানায়ক হয়ে উঠেনি এমনকি তিনি নায়ক শব্দটিকেই বিশ্বাস করতেন না। তার গল্পের মূল চরিত্রগুলো সবসময় ছিল চিকিৎসা বঞ্চিত বিকারগ্রস্থ বৃদ্ধা, পাগল, অসুস্থ রিকসাচালক, নববিবাহিত দম্পতি, কবরস্থানের ব্যবস্থাপক ইত্যাদি। ব্যতিক্রম যে ছিলনা তা নয়। কিন্তু মৃত বামপন্থি কর্মীর ছেলের চরিত্র বা কলেজের প্রফেসরের চরিত্রগুলো ব্যতিক্রম হয়েই থাকে তার গল্পে। মূল চরিত্র যে পেশার বা শ্রেণীরই হোক না কেন তাদের ভেতরের রূপ উলঙ্গ করে দিতে তিনি বরাবরই যথাযথ শিল্পীর ভূমিকা নেন। তাদেরকে অযাচিতভাবে মহৎ করে তোলার কোন উদ্যোগ তার মাঝে দেখা যায় না। তিনি তার পাঠককে কল্পনার স্রোতে রূপকথার রাজ্যে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে লাথি মেরে নোংরা, ঘিঞ্জি, পুঁতিগন্ধময় বাস্তবতার সামনে দাঁড় করিয়ে দেন। এ লাথি খেয়ে সহ্য করতে না পারার কারনেই মধ্যবিত্ত মানসিকতার বাঙালি কোনদিন তার পাঠক হিসেবে স্থায়ী হতে পারেনি। প্রেম, ভালোবাসা, আবেগ, মায়া ইত্যাদি তার লেখায় পাপকর্মের মতো এবং এজন্যই তিনি তার সমগ্র লেখক জীবনে একটি মাত্র গল্প লিখেছেন "প্রেমের গপ্পো" শিরোনামে যা কোনভাবেই সত্যিকারের প্রেমের গল্প নয়। সংকীর্ন মনা বাঙালীর বিবাহিত স্ত্রীর বিয়ের আগের জীবনের প্রতি চিরাচরিত সন্দেহ ও অবিশ্বাস এবং স্ত্রীর বিশ্বস্ততাকে দুর্বলতা ধরে নিয়ে সুযোগ পেলেই অন্য নারীর দিকে চোখ দেয়ার অভ্যাসকে তিনি এ গল্পে তুলে ধরেছেন।
তার প্রতিটি গল্পের বিষয়বস্তু যেমন অভিনব তেমনি বলার ভঙ্গি, নির্মাণ কৌশল, প্রেক্ষাপট তাকে বিশিষ্টতা দান করেছে। দেশ স্বাধীন হবার পরের ঝঞ্জাবিক্ষুব্ধ সময় এবং মৃত্যু তার লেখায় বারবার বিভিন্নভাবে ঘুরেফিরে এসেছে যার প্রতিটিকে অনায়াসে অসাধারন সৃষ্টির তকমা পরিয়ে দেয়া যায়। দেশ স্বাধীন হবার পর এক শ্রেণীর লোকের স্বাধীন দেশের অভ্যন্তরে ক্ষমতাসীনদের সাথে আঁতাত করে সম্পদের পাহাড় গড়া এবং এই করতে গিয়ে নিজের এককালের রাজনৈতিক সতীর্ত বন্ধুকে পর্যন্ত বাড়ি থেকে তুলে দেয়া থেকে শুরু করে অভিজাত পরিবারের অন্দরমহলে লুকিয়ে থাকা স্বামী-স্ত্রীর পরষ্পরের প্রতি প্রতারনা, নিজের যৌন জীবনে অতৃপ্তি থেকে নিজের পুত্রকে সন্দেহ ছাড়াও অধিকার বঞ্চিত কৃষকদের শ্রেনীসংগ্রামের চিত্র পর্যন্ত তিনি তৈরী করেছেন। এসব করতে গিয়ে কোথাও তিনি কাহিনীতে জড়িয়ে পড়েননি। তিনি সবকিছু কেবল দেখে গেছেন আর নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বর্ননা করে গেছেন যেন কারো কোন কিছুতেই তার কিছু যায় আসেনা। এমনকি তার সৃষ্ট চরিত্র রাস্তায় কাপড় খুলে সবাইকে জননাঙ্গ দেখিয়ে বেড়ালেও না।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস মানুষের মধ্যে মানবিকতা, সন্তান বাৎসল্য, প্রেম, মায়া, সামাজীকতা, মূল্যবোধের বিকাশ দেখেননি বরং তিনি মধ্যবিত্তের লোক দেখানো ভন্ডামো এবং সমাজে সম্মান ধরে রাখতে গিয়ে মধ্যবিত্ত যে কত নিচে নামতে পারে তা দেখিয়েছেন।
মধ্যবিত্তের প্রতি ইলিয়াসের প্রবল ক্রোধের কারন কিছুটা অনুমান করা যায় এ থেকে যে তিনি যে সমাজকে দেখেছেন সে সমাজের প্রায় সকলেই ছিল মধ্যবিত্ত অথবা মধ্যবিত্ত মানসিকতা সম্পন্ন। এ মধ্যবিত্ত বড় হয় সমাজ, পরিবার এবং রাষ্ট্রের চাপিয়ে দেয়া একগাদা বিশ্বাস ও সংস্কারকে সঙ্গী করে। প্রচলিত বিশ্বাসকে গোঁ ধরে আঁকড়ে থাকা, চাপিয়ে দেয়া সংস্কারের বাইরে কোন ভাবেই না যাওয়া ও বিপরীত মত সম্পর্কে কিছুমাত্র না জেনে দুমড়ে মুচড়ে দেয়ার প্রবল বাসনা এদের মধ্যে কাজ করে। এই মধ্যবিত্ত শ্রেনীই মূলত এদেশে সাহিত্য চর্চা করে। যারা আবার বড় হয়েছে দু'চারটি বিভূতিভূষন ও রবীন্দ্রনাথ পড়ে এবং ছোটবেলায় নানী দাদীর কোলে রূপকথা শুনতে শুনতে। এইভাবে সাহিত্য সম্পর্কেও এদের সাধারন মত গড়ে উঠে যে সাহিত্য মানেই পাতালপুরীতে আটকে থাকা রাজকুমারীকে উদ্ধার করার পর রাজকুমারের সাথে তার বিয়ে অতঃপর সুখে শান্তিতে বসবাস। তাদের সাহিত্যবোধানুযায়ী সাহিত্যে কেবলমাত্র আদর্শ প্রেমিক, দায়িত্ববান পিতা, মহান শিক্ষক, স্বজাতি সেবায় আত্ননিয়োগকৃত ডাক্তার, মহান রাজনীতিবিদরাই থাকবেন। তারা জাতিকে তাদের মহান কর্মের মাধ্যমে বারবার উদ্ধার করবেন। সমাজের চোর, বাটপার, বাসের হেল্পার, ঘুষখোর পুলিশ অফিসার ও আমলা, অসুস্থ রোগী, নদী ভাঙ্গা মানুষ,পাগল সর্বোপি বঞ্চিত মজুরদের এরা সাহিত্যের আম্রকাননে অনাহুত মনে করেন।
ইলিয়াস তার সাহিত্যের মাধ্যমে নতুন একটা প্রশ্নও মধ্যবিত্তকে করেন। সাহিত্যে কি কেবলমাত্র স্নেহ, প্রেম, ভালোবাসা, মায়া ইত্যাদি সমস্ত মানবীয় গুনাবলীই থাকবে নাকি এসবের পাশাপাশি ভন্ডামো, চাটুকারিতা, অবৈধ প্রেম, ধর্মের নামে ব্যবসা এসব ও স্থান পাবে। নিজেরা লোক দেখানো ভন্ডামোর মাঝে আকন্ঠ ডুবে থাকলেও মধ্যবিত্ত যে সাহিত্যে এসবকে সমর্থন করবে না বরং পালিয়ে বেড়াবে তা ইলিয়াস ঠিকই জানতেন। তার সৃষ্ট চরিত্র যখন নিজের মৃত বাবা সম্পর্কে তার জানা ধারনার বাইরে অনেক অজানা তথ্য পায় যা তার ধারনার সম্পূর্ন বিপরীত এবং সেখান থেকে পালিয়ে বেড়ায় তখনই বোঝা যায় পালিয়ে বেড়ানোই যে মধ্যবিত্তের নিয়তি সে ব্যপারে তিনি জ্ঞাত ছিলেন। তিনি মধ্যবিত্তের আজন্ম লালিত সংস্কারকে এবং প্রচলিত বিশ্বাসকে সমূলে উপড়ে ফেলার জন্য ধনুকভাঙ্গা পণ করেন। কিন্তু তার ধরনটি আলাদা । তিনি আর সবার মত প্রচলিত পন্থায় মধ্যবিত্তের আজন্ম লালিত সংস্কারকে এবং প্রচলিত বিশ্বাসকে ভাঙ্গার সহজ রাস্তাটিকে সযত্নে এড়িয়ে চলেন। তিনি আঘাত করতে করতে মধ্যবিত্তের সামনে একটা আয়না হাজির করেন যেখানে আচমকা মধ্যবিত্ত নিজেকে আবিষ্কার করে উলঙ্গ অবস্থায়। এ করতে গিয়ে কখনো কখনো মনে হয় ইলিয়াস নিজেই হিস্টিরিয়াগ্রস্থ হয়ে পড়েছেন যখন তার চরিত্ররা মায়ের আসন্ন মৃত্যুকে উপেক্ষা করে নিজেদের উদর ভর্তি করার জন্য উন্মাদ হয়ে উঠে বা কুকুরের সঙ্গম দেখে কেউ যখন স্ত্রীর সাথে মিলিত হতে উৎসাহিত হয়।
শেষ পর্যন্ত ইলিয়াস আমাদের চারপাশের চেনা বাস্তবতা আর বহমান জীবনের কথাই বলেন যে বাস্তবতার স্বরূপ হয়তো ইলিয়াস না পড়েলে আমাদের জানাই হতো না।