তোমাকে আমি বৈশাখী নামেই ডাকবো। তোমার দীঘল কালো কেশদাম, বড় বড় চোখের শান্তস্থির দৃষ্টি আর কমনীয় মুখের সাথে বৈশাখের সাদৃশ্য কোথায় আমি জানিনা কিন্তু তোমার কথা ভাবলে আমার কেন যেন বৈশাখের কথাই সবার আগে মনে পড়ে। তোমাকে বলতে দ্বিধা নেই, আমার সমস্ত প্রেমিকাকে আমি অমন একটি নামে ডাকতাম। আমার প্রথম প্রেমিকা, যে স্কুলে বেণী দুলিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে এত প্রশংসা অর্জন করেছিল যে আমাকেও তার প্রেমিক না ভেবে স্তাবক ভাবতে শুরু করেছিল। নীলিমা, আমার দ্বিতীয় প্রেম, যার কাছে আমি কখনো উপপ্রেমিকের বেশি মর্যাদা পাইনি এবং নন্দিনী, যে ছিল দুর্বোধ্য এক গোলকধাঁধা, আমাকে তাদের হৃদয়ে স্থান দিতে না পারলেও আমার কাছ থেকে বেশ একটি নাম আদায় করে নিতে পেরেছিলো। প্রেমিক প্রবরের কাছ থেকে অমন মিষ্টি নামে ডাক শোনার আকাংখা তোমার আছে বলে কখনো বলনি। কিন্তু জানোতো, প্রেমিক কর্তৃক ভালোবেসে প্রেমিকাকে নাম দেয়ার ইতিহাস অনেক পুরনো। শুনেছি নজরুল ও ভালোবেসে তার প্রেমিকার নাম দিয়েছিলেন নার্গিস।
আমার ভারি অদ্ভুত এক রোগ আছে, সেকথা তোমাকে বলা হয়নি। কাউকে ভালো লাগলে তাকে দেখার জন্য, তার নাম জানার জন্য লোকে কেমন মরিয়া হয়ে ওঠে, অথচ কি অদ্ভুত এক রোগ আমার, উত্তেজনা দূরে থাকুক সেসব নিয়ে আমার মধ্যে বিন্দুমাত্র আগ্রহও তৈরী হয়না। ম্যালেরিয়া জন্ডিসে ভুগলেও কিছুদিন পর সুস্থ হয়ে দিব্যি জগৎ সংসার যাপন শুরু করে দেয়া যায়, আর আমি সেই এক রোগে ভুগে চলেছি জন্মাবধি। কৈশোরে এক মেয়েকে ভালোবেসে তিন বছর কাটিয়ে দিয়ে তাকে হারিয়ে ফেলার পর অবাক হয়ে আবিষ্কার করেছিলাম তার নামটি পর্যন্ত আমি জানিনা যে খুঁজে বার করব। সেই শিক্ষাই হয়তো পরিচয়ের এই এতদিন পর তোমার সাথে দেখা করতে আমাকে অনুপ্রাণিত করেছিল। আফসোসের আগুনকে এড়াতে চেয়েছিলাম, আজ পুড়ে বুঝতে পারছি কামনার আগুনের দহন ক্ষমতাই সবচেয়ে বেশি।
লোকে দৈহিক প্রেমকে কেন অশ্লীল ভাবে কে জানে! আমার বরং প্রথম যৌবনের সেসব প্রেম যেখানে দৈহিক সংসর্গ ছিলনা আর ছিলনা বলেই সেগুলোর স্মৃতি ক্রমশ ফিকে হয়ে যাচ্ছে সেগুলোকেই কেমন অশ্লীল, অশূচিকর মনে হয়। নিজেকে সৎ ভেবে আত্নতৃপ্তি পাওয়ার গোপন একটা বাসনা বোধহয় কোথাও লুকিয়ে ছিল। পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের চাপিয়ে দেয়া নৈতিকতাবোধ হাত ধরলেও প্রেম অপবিত্র হয়ে যাবে বলে বারবার ভেতর থেকে বাঁধা দিত। অবশ্য প্রেমে নৈতিকতাবোধের দরকার আছে। নৈতিকতাবোধ না থাকলে প্রেম ঠিক জমেনা। বিশেষ করে একজনের প্রতি দায়বদ্ধ থাকাবস্থায় অন্যের সাথে প্রেম প্রণয়ে জড়িয়ে না পড়তে নৈতিকতাবোধের ভূমিকা বেশ গুরুত্বপুর্ণ বলা চলে। নৈতিকতাবোধহীন প্রেম প্রায়শই ছেনালীতে পরিণত হয়। আজকাল অবশ্য আগে শরীর দিয়ে মন দিতে না পারলে ফিরে যাওয়ার নিয়ম। আমাদের সময়ে নির্জন রাস্তায় হাত ধরে পাশাপাশি একটু হাঁটতে পারলে তাকে সবচেয়ে সার্থক প্রেম বলা হত। আর প্রেমাকাঙ্খা প্রবল হলে কিংবা প্রেম পুরনো হলে লোকচক্ষুর আড়ালে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে চুমুই ছিল প্রেমের সর্বোচ্চ পরিণতি। সেই পুরনো যুগের মানুষ হয়েও তোমার সাথে পরিচয়ের এই এতদিন পর তোমাকে দেখে আমার কেন যেন দৈহিক প্রেমই জেগে উঠছে বারবার।
লোকে বলে বাঙ্গালী নারী মাত্রই নাকি শাড়িতে মানানসই এবং উজ্জ্বল। একদম বাজে কথা। পৃথিবীর কোন কিছুর উপরই সার্বজনীনতার বোঝা চাপিয়ে দেয়া যায়না, পরিবেশ পরিস্থিতি তার ব্যত্যয় ঘটাতে বাধ্য করে। তোমাকেও শাড়িতে ভালো লাগেনা। কেমন যেন একটা মহিলা মহিলা ব্যাপার। এত সুন্দর, কমনীয় মুখের অধিকারী একজনের উপর মহিলা পরিচয়ের ছাপ মেরে দিলে তাতে যৌবনের, সৌন্দর্যের কেমন যেন অপমান হয়। তারচেয়ে টি-শার্টেই তোমাকে আকর্ষনীয় লেগেছে। যৌবনের আলো যেন ফুটে বেরুচ্ছিল তোমার শরীর থেকে।মেয়েদের ভ্রু প্লাক করা আমি একদম পছন্দ করিনা, হয়তো আদিকালের মানুষ বলেই। কিন্তু তোমার পূর্নিমার চাঁদের সাথে তুলনীয় মুখের সাথে সেটা এত চমৎকারভাবে মানিয়ে গেছে যে আমার অপছন্দের কথা জানাতে কেমন যেন সংকোচ হচ্ছে। অন্তরালে লুকিয়ে রাখা তোমার স্নিগ্ধ পয়োধরযুগল আমাকে এডওয়ার্ডের কথা মনে করিয়ে দেয়। অমন নধরকান্তি পয়োধর জোড়ার মাঝে স্থান পেলেই বুঝি পুরুষ সকল দুঃখ দুর্দশা তো বটেই সিংহাসনের মায়া পর্যন্ত ভুলে বসতে পারে। তোমাকে দেখেই আমি বুঝতে শিখেছি অলংকার ব্যবহার করা নারীর জন্য নিতান্ত বাহুল্য। গোটা দেহ যাদের অলংকার তারা কেন বাড়তি অলংকার ব্যবহার করে শরীর নোংরা করে কে জানে!
নিজের গভীরে ডুব দিয়ে দেখেছি, তোমার বাহ্যিক এসব গুনাগুন নয় আমাকে মূলত আকর্ষন করেছিল জ্ঞানচর্চার প্রতি তোমার তীব্র আকর্ষন। সুন্দরীরা সাধারনত শরীর সর্বস্ব হয়। পৃথিবীর তাবৎ প্রতিষ্ঠিত লম্পটেরা তাদেরকে শরীর ছাড়া অন্য সমস্ত কিছুর কথা ভুলে যেতে বাধ্য করে। সেজন্যই হয়তো যৌবনে যিনি রবীন্দ্র সঙ্গীত চর্চা করতেন, যিনি কবিতা লিখতেন, যিনি বলতেন নারীশিক্ষা ছাড়া কোন জাতির মুক্তি আসবে না তার শেষ পর্যন্ত স্থান হয় কোন হোটেল মালিক কিংবা অন্যের টাকায় হাত নোংরা করা কোন ব্যাংকারের ঘিনঘিনে বুকে। সেসব জেনেও তুমি র্যাম্প নয় কবিতাকে ভালোবেসেছ, শিল্পপতিদের টাকার পাহাড়ে রক্ষিতা নয় একজন দুঃখজর্জর হৃদয়বান কবির জীবনে পূর্ণ স্ত্রীর মর্যাদা পেতে চেয়েছ। তোমার প্রেমে পড়া আর যাই হোক অন্তত দোষের নয়।
প্রেমে কোন নারীর হাত ধরতে পারিনি, অথচ বহুনারী অনুরোধ করেছে প্রেমহীন তাদের নিয়ে দু'ছত্র কবিতা লিখে দিতে, পারিনি। নিজেকে পরিত্যাক্ত ন্যাকড়ার মত মনে হয়েছে যা ব্যবহার শেষ হওয়ার সাথে সাথে লোকে তীব্র ঘৃনা নিয়ে ছুড়ে ফেলে দেয়। কত নারীর প্রতি ভালোবাসা একটি মাত্র কবিতায় বিলীন হয়ে গেছে। শুধু তোমাকে দেখে মনে হয়েছে, আহা, সুন্দরীদের জীবন কতইনা যাতনাময় হয়। অন্তরে ব্যথার আগ্নেয়গিরি নিয়ে কবিতার প্রজাপতি হবার স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে কি নৃশংসভাবে তারা চিরসুখী হবার অভিনয় করে যায়। একমাত্র কবিতাই বুঝি পারে তাদের হৃদয়ের দীর্ঘশ্বাসকে প্রকাশ করতে। ভালোবেসে হাত না হয় নাই ধরলে অন্তত আমার কবিতার প্রজাপতি হবার অনুরোধটুকু ফিরিয়ে দিওনা বৈশাখী।