(২০১০ এ এই লিখাটা লিখেছিলাম। কিছুটা চেঞ্জ করে সম্প্রতি ফেসবুকে পোস্ট করেছি। বড় বলে দুই ভাগ করে পোস্ট করব। আজ প্রথম অংশ দিলাম। আশা করি ভাল লাগবে।)
আমাদের পরিবারটিকে একটি মধ্যবিত্ত আটপৌরে পরিবারের আদর্শ উদাহরণ হিশেবে অনায়াসে চালিয়ে দেয়া যায়। একমাত্র উপার্জনক্ষম বাবার চাকরীর সুবাদে সবাই একসঙ্গে মফস্বলে থাকতাম। পাঁচ ভাইবোনের সংসারে কারো চাহিদাই ভালোভাবে পূরণ হয়না বলে বৎসরের একমাত্র রমযানের ঈদটির দিকে সবাই চাতক পাখির মত চেয়ে থেকে আমাদের দিন কাটতো। সেসময়ও যাদের প্রয়োজন মেটানো সম্ভব হতনা তাদের কেউ কেউ আবার দু’মাস পরবর্তী উপলক্ষটির আশায় দিন গুনত। “ভোরে ঘুম থেকে উঠতে না পারলে জীবনে উন্নতি করা সম্ভব নয়” এই আপ্তবাক্যকে হৃদয়ে ধারন করে দিনের আলো ফুটতে না ফুটতেই টিনের চালার নিচের কোনসে বাসা বাঁধা চড়ুই পাখির সাথে পাল্লা দিয়ে আমাদের বাড়িটা সরগরম হয়ে উঠতো। আমাদের তিন ভাই বোনের প্রাইভেট পড়তে যাওয়া, বাবার অফিসে যাওয়া এবং ফের আমাদের স্কুলে যাওয়ার প্রস্তুতির অংশ হিসেবে খাবারের বন্দোবস্ত করার জন্য মা’কেও প্রতিযোগিতা করে ততোধিক ভোরে আদর্শ গৃহিণীর বেশে রান্নাঘরে প্রবেশ করতে হত। অভিশপ্ত মধ্যবিত্ত জীবনে সন্তানদের অপূর্ণতার অজস্র অভিযোগ থেকে রক্ষা পেতে নাকি সত্যই তাদের জন্য নাস্তা প্রস্তুত করতে তিনি কাঁকডাকা ভোরে রান্নাঘরে যেতেন তা নিয়ে ঘোরতর বিতর্কের সম্ভাবনা আছে। কারন ভোরে প্রাইভেট পড়তে যাওয়ার আগে আমাদের প্রায়ই নাস্তা হতনা। তাই বলে আমাদের প্রাইভেট পড়া কিন্তু থেমে থাকেনি। আমরা না পারতাম বিলাসি জীবনযাপন করতে, না পারতাম আবুদের সাথে তাল মিলিয়ে বাবার ভ্যান ঠেলতে। অথচ আশেপাশের বিলাসী জীবন যাপনে অভ্যস্ত কাউকে দেখে মনের গহীনে লুকানো দুঃখবোধগুলো যে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতো না তেমন নয়, এমনকি না পারার অসহায়ত্ব থেকে তাদের ঝাঁ চকচকে চলাফেরা দেখে চোখ টাটানোর অভ্যাসও বেশ নিয়মিত। আবুরাও আমাদের মত পাঁচ ভাই বোন। ভ্যানওয়ালা বাবার সন্তান হওয়ার সুবাদে তাকে প্রতিদিন আমার মত স্কুল স্কুল খেলতে হতনা। সকালে উঠেই খালি পায়ে লোকের ফরমাশ অনুযায়ী বাবার ভ্যানের পিছনে ধাক্কা দিতে দিতে কত কোথায় যে ঘুরে বেড়ায় তার হদিস সে নিজেও বলে শেষ করতে পারতোনা।
একই রকম নিরন্তর উত্তেজনাহীন জীবন একই পরিবারে থেকেও আমার দাদার ছিলোনা। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হওয়ার অভিশাপে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার ইচ্ছা অপূর্ণ থেকে যাওয়ার হতাশায় তিনি যখন প্রবলভাবে নিমজ্জিত তখন কতিপয় মধ্যবিত্ত শুভাকাঙ্ক্ষীর পরামর্শ অনুযায়ী বাবা সেই বয়সেই দাদাকে ছাঁদনাতলায় বসিয়ে দেন। এর ফলস্বরুপ দাদার রাত করে বাড়ি ফেরার অভ্যাসের কিঞ্চিৎ পরিবর্তন হলেও ঘরের সদস্য একজন নয় গেল দুজন বেড়ে। কারন বছর খানেকের মধ্যেই তিনি বেকার পুত্র থেকে বেকার পিতায় রূপান্তরিত হলেন।
ভোটকা মিয়ার জন্মের পর থেকে আমাদের পরিবারের সকলে আমূল বদলে যেতে লাগলো আর বদলানোটা শুরু হল দাদার হাত ধরেই। তার চাকরি হওয়ার পর থেকে বাবার একার পক্ষে পুরো পরিবারের ঘানি টানাতে কিছুটা ভাটা পড়ল। মা’ও কর্মচঞ্চল দিন শুরু করার বেলায় একা একা চড়ুই পাখির সঙ্গে পাল্লা দেননা। তিনি তার পুত্রবধূকে সহযাত্রী হিসেবে পেয়েছেন। আমার একাকী সন্ধ্যা বিকেলগুলোও আবুর সাথে তার বাবার ভ্যানে লাশ তোলার পর সেই ভ্যান দশ বারোজন লোক মিলে ঠেলেও নড়াতে না পারার আধো উত্তেজনাময়, আধো ভৌতিক গল্প শুনে কাটেনা। সবার দিনলিপি যেন হঠাত করে ছন্দোবদ্ধ হয়ে উঠতে লাগলো। ভোটকা মিয়াও তার আধো আধো বুলি প্রকাশের মধ্য দিয়ে সাধারন মানবশিশু থেকে ক্রমেই বৃহৎ পরিবারটির প্রধান চরিত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে শুরু করল। তার বড় হওয়ার সাথে পাল্লা দিয়ে তাকে নিয়ে আমার আহ্লাদ এবং দুশ্চিন্তাও দিন দিন বেড়ে চলল।
ইদানিং তার বয়স পাঁচ পেরিয়ে ছয়ের কোঠার দিকে অগ্রসর হলেও তার প্রানচঞ্চলতায় এবং মুখরতায় প্রায়ই তাকে দশ বার বলে ভ্রম হয়। তার এ অকালপক্কতার জন্য সকলে যে আমাকে দায়ী করে তা থেকে অব্যহতি পাবার তেমন কোন ইচ্ছাও আমার নেই। বরং সকলে যে তার চারপাশে একের পর এক নিয়মের বেড়াজাল দাঁড় করিয়ে তাকে জীবনের স্বাদ আস্বাদন বঞ্চিত করতে উঠে পড়ে লেগেছে তাতে আমি সামান্য বাঁধ সেধেছি মাত্র। এর স্বপক্ষে আমার গোটাকয়েক সেকেলে, গোঁয়ারগোবিন্দ মার্কা যুক্তি আছে এবং আমি তা পেশ করার প্রয়োজন মনে করছি।
আমি যে তাকে তার বয়সের শিশুদের তুলনায় অধিক পরিমানে দুরন্তপনার তালিম দিচ্ছি তার কারন প্রথমতঃ বড় হওয়ার পরও সে যেন খেলাধুলায়, চঞ্চলতায় অন্যসবার চেয়ে চৌকস হিসেবে নিজেকে আবিষ্কার করে। শৈশবে যারা প্রানচঞ্চলতায়, মুখরতায় অন্যদের মুগ্ধ করে রাখে তারাই যৌবনে অন্যদের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে। আর বড়বেলায় অন্যদের নেতৃত্ব দেয়ার, বুক পেতে অন্যদের রক্ষা করার বীজ ছোটবেলায় অন্যদের ছাড়িয়ে যাওয়ার মধ্যেই নিহিত থাকে। দ্বিতীয়তঃ আমাদের শৈশব কৈশোর কেটেছিল বনে বাদাড়ে রূপকথার রাজকুমারীকে আটকে রাখা দৈত্যের প্রান ধারন করা কৌটায় বন্দি ভ্রমরের খোঁজে ঘুরে বেড়িয়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, পুকুরে ডুবিয়ে আর রৌদ্রে শুকিয়ে। এই নিয়ে আমাদের গল্পের অন্ত নেই। কিন্তু এখন সে ঘোরার জন্য বনই বা কোথায় পাবে, ডুবানোর জন্য পুকুরই বা কোথায় খুঁজবে কিংবা রৌদ্রে ঘোরার স্বাধীনতাই বা কে দিবে। পিতামাতার একমাত্র সন্তান হওয়ায় দাদা-দাদী, চাচা-ফুফুদের আদরের নামে শৈশবের স্বাধীনতায় লাগাম পরানোর পরও সে যেন বড় হয়ে মনে রাখার মত যথেষ্ট আনন্দময় কিছু গল্প পায় সে জন্যই আমি দুর্নামের বোঝা মাথা পেতে নিয়েছি। তৃতীয়তঃ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধাবী বলে স্বীকৃত এমন অসংখ্য ছেলেকে দেখা যায়, যারা ছোটবেলা থেকে পিতামাতার নিতান্ত বাধ্য সন্তান হয়ে তিনবেলা ভরপেট ভাত খেয়ে, দু’বেলা নাস্তা করে, মায়ের আঁচড়ে দেয়া পাট করা চুল নিয়ে ফুলবাবু সেজে, কলের পুতুলের মত পড়া মুখস্ত করে, পরীক্ষার হলে প্রাণপণে উগরে দিয়ে সবসময় প্রথম হয়ে এসেছে। সন্দেহ করি তারা উগরে দেয়ার রীতি অব্যাহত রেখে অচিরেই ম্যাজিস্ট্রেট ব্যারিস্টার হয়ে জাঁকিয়ে বসবে। কিন্তু তাদের বলার মত কোন শৈশব নাই, কৈশোর নাই। যা আছে তার নাম ধূধূ বালুচর। অনুমান করে নিতে কষ্ট হয়না টাকা উপার্জন করার ভালো যন্ত্র হওয়ার দরুন শেষ পর্যন্ত তাদের প্রত্যেকে সমাজ সংসারে সকলের প্রিয় পাত্র হয়ে উঠবে। চতুর্থতঃ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখেছি সত্যিকারের ভালো ছাত্ররা কখনো প্রথম হয়না। ভালো ছাত্ররা যেখানে অজানাকে জেনে নিজের জানার পরিধি বাড়িয়ে নেয়ার দিকে মনোযোগী থাকে সেখানে অন্যরা সিলেবাসশুদ্ধ মুখস্থ করে, দাঁড়ি কমাসহ পরীক্ষার হলে উগরে দিয়ে কিভাবে প্রথম হওয়া যায় তা নিয়ে রীতিমত পিএইচডি করে প্রথম হয় যায়। আমার ভাই ও ভাবিও তাকে সবসময় পরীক্ষার হলে প্রথম এবং ভবিষ্যতে ম্যাজিস্ট্রেট ব্যারিস্টার হিসেবেই দেখতে চান। তাদের সে স্বপ্নের পালে আমি ছোট্ট একটি ফুটো মাত্র।
আমার ভাইপো যাকে আমি স্নেহবশত ভোটকা মিয়া বলে ডাকি সে বড় হলে শৈশবেই তাকে কলের পুতুলে পরিণত করার জন্য তার মা বাবাকে দায়ী করবে এতে কোন সন্দেহ নেই, কিন্তু আমাকে যেন কোনভাবেই করতে না তা আমি নিশ্চিত করতে চাই। অবরুদ্ধ শৈশব যাদের কেটেছে সমাজ সংসার ও তাবৎ সভ্যতার প্রতি তাদের বুকে অহর্নিশ জ্বলতে থাকা ক্রোধের আগ্নেয়গিরি আমি অনুভব পারি।
যাই হোক, যে কথা বলার জন্য আপনাদের এখানে টেনে এনেছি সে কথা বলি। তার শৈশব স্মৃতি ক্রমেই আমার কাছে ঝাপসা হয়ে আসছে। প্রথম কোন কর্মকাণ্ড দ্বারা সে সকলকে মুগ্ধ করেছিলো তা আজ বিস্তৃত প্রায়। সম্ভবত বাবার প্রেশারের ওষুধ খেয়ে ফেলা দিয়ে সে অধ্যায়ের শুরু হয়েছিলো। তিনি হাই প্রেশারের রোগী ছিলেন বলে প্রতিদিন রাতে একটি করে টেনোরেন ৫০mg ট্যাবলেট খেতেন। বাবাকে নিজ হাতে পান খাইয়ে দেয়ার অভ্যাশবশত ওষুধটিও খাইয়ে দেয়ার জন্য সে নিয়মিত বায়না ধরত। আদরের নাতির বায়না রক্ষার্থে বাবা তখন হা করে তার হাতে ওষুধটি দিয়ে মুখে ফেলতে বলতেন এবং পানি দিয়ে গিলে ফেলতেন। এমনি একদিন তার হাতে ওষুধ দেয়ার পর বাবা লক্ষ্য করলেন ভুলবশত পানি নেয়া হয়নি। তখন সে নিজেই পানি আনতে তৎক্ষণাৎ অন্য রুমে গিয়ে গ্লাসে পানি নিয়ে মুখে ট্যাবলেটটি দিয়ে গিলে ফেলল। পানি নিয়ে ফিরতে দেরি হচ্ছে দেখে বাবা তাকে ডেকে আনলেন এবং হাতে ট্যাবলেটটি না দেখে সেটা কোথায় জিজ্ঞেস করলেন। কি বলবে বুঝে উঠতে না পেরে নাকি কাজটি যে অনুচিত হয়েছে বুঝতে পেরে সেই অপরাধবোধ থেকে সে চুপ করে থাকলো কে জানে! সে যে ওষুধটি খেয়ে ফেলতে পারে সম্ভবত সেটা কারো মাথায় না আশায় সবাই মিলে ওষুধ খুঁজতে লাগলো। হঠাত কারো মনে সন্দেহটা উঁকি দিতেই তৎক্ষণাৎ তাকে জিজ্ঞাসা করা হল, সে কি ওষুধটা খেয়েছে ? সে খুব ভালো কাজ করেছে ভেবে বিজ্ঞের মত মাথা নেড়ে সায় দিলো। মা তখন বললেন, তিনি রসুইঘর থেকে আসার সময় তাকে টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে পানি খেতে দেখেছেন। তখন সবাই বুঝতে পারলো, তিনি তাকে ওষুধই খেতে দেখেছেন। কিন্তু তিনি কি করে জানবেন যে সে তার দাদার প্রেশারের ওষুধ খাচ্ছিলো! কাজেই তিনি বাঁধা দেন নি। সে হয়তো মনে মনে যে দাদা তাকে প্রতিদিন হানিফের দোকান থেকে চকলেট কিনে দেয় এবং নিজে কোনদিন সে চকলেট খায়না সেই দাদাকেই তাকে না দিয়ে কোন কিছু খেতে দেখার মধ্যে গভীর কোন রহস্য লুকিয়ে আছে বলে ভেবেছিলো। কাজেই সে রহস্য মোচন করেছে। কিন্তু রহস্য উন্মোচন করতে গিয়ে কি গভীর রহস্যের জালে যে নিজেকে জড়িয়ে ফেলছে তা বুঝতে পারেনি। সেদিন তাকে দুধ, শরবত, ডাবের পানি ইত্যাদি পুষ্টিকর খাদ্য নানাভাবে গিলিয়েও সবাই উৎকণ্ঠায় ভুগছিলো পাছে কিছু ঘটে। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায় সে যাত্রায় সে রক্ষা পায়। তবে সে যাত্রায় রক্ষা পেলেও ওষুধ পথ্য, ইনজেকশনের প্রতি তার স্থায়ী একটা দুর্বলতা থেকেই যায়। সম্ভবত পরিবারের সদস্যদের ঘরময় ছড়ানো ছিটানো ওষুধ দেখে ওষুধের প্রতি তার একটুখানি মায়ায় জন্মে গিয়েছিলো। কিংবা এককালের ওষুধের দোকানি পিতার ওষুধপ্রীতি পুত্রের মধ্যে সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যায়না। অন্য একদিন, আমার ভাগ্নী আঁখির জ্বর হলে তাকে পুশ করার জন্য এক এম্পুল ইনজেকশন আনা হয়। তার বাবা শিশি ভেঙ্গে সিরিঞ্জটি আঁখিকে পুশ করার ফাঁকে অন্য সকলের মনযোগ আঁখির দিকে কেন্দ্রীভূত থাকার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে সে শিশিটি মুখের মধ্যে দিয়ে দিব্যি চিবিয়ে ফেলল। তার বাবা ইনজেকশন দেয়া শেষ করে শিশিটি বাইরে ফেলার জন্য যথাস্থানে না পেয়ে খোঁজাখুঁজির এক পর্যায়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে টের পেলেন সে কিছু একটা চিবাচ্ছে। তৎক্ষণাৎ তাকে ঠেসে ধরে মুখে আঙ্গুল ঢুকিয়ে ভাঙ্গা শিশি উদ্ধার করা হল। সেদিনও সে দৈববলে রক্ষা পেয়েছিল।
(আপনাদের চাহিদামত সময়ে পরের অংশ পোস্ট করা হবে)
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জুলাই, ২০১৭ বিকাল ৩:০৭