(গতকাল এই গল্পের প্রথম অংশ পোস্ট করেছি। আজ দ্বিতীয় ও শেষ অংশ দেয়া হল। আগে যারা পড়েননি তারা অনুগ্রহ করে প্রথম অংশ পড়ে নেবেন। যুক্তিযুক্ত আলোচনা কাম্য)
পৃথিবীর সমস্ত শিশু সম্পর্কে জানি তারা ব্যথাবোধ, ক্ষুধা নিবারনের প্রয়োজনে বা মনোবাঞ্ছা পূরণ করার তাগিদে মা মা বলে চিৎকার করে কাঁদে। তার বেলায় অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম কাঁদার সময় সে মোটেই পাশে তার মা’কে কামনা করে না। এই সময়ে তার প্রত্যাশা কেবল বাবা। আমার ভাবি কিছুটা কঠিন প্রকৃতির। তিনি একান্ত প্রয়োজন ছাড়া মায়া মমতা প্রদর্শন করে আদর জিনিসটাকে খেলো করে ছাড়েন না। অতিরিক্ত আদরে মাথায় তোলার তো প্রশ্নই আসেনা। তদুপুরি তার যত্তসব আজগুবি বায়না শুনতে শুনতে তিনি এতোই অভ্যস্ত ছিলেন যে কান্নাকাটির সময় তিনি কিছুটা অতিরিক্ত কাঠিন্য প্রদর্শন করতেন। সারাদিন বাইরে কাটানো দাদাকে এইসব আবদারের মুখোমুখি হতে হতনা বলে এই সময়ে তিনি ভাবির কাঠিন্যতার বিপরীতে অতিরিক্ত সহানুভুতিশীল আচরন করতেন। ঐটুকু বয়সের তার কচি মন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কার কাছ থেকে বেশি সহানুভূতি পাওয়া যাবে সে সম্বন্ধে পূর্ণ ওয়াকিবহাল ছিল। সেকি একাই ব্যতিক্রম নাকি সকল শিশুরই অধিকার আদায়ের আলাদা ধরন আছে জানিনা। একটা শিশুই তা ভালো বলতে পারবে। শিশুদের আলাদা জগত আছে। সে জগতে অন্য কারো প্রবেশাধিকার নেই এমনকি সে জগত বোঝার সাধ্যও কারো নেই।
তার বয়স চার পূর্ণ হওয়ার আগেই খেলাচ্ছলে আমি তাকে ইংরেজী বর্ণমালার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম। চৌধুরী এন্ড হোসাইনের মোটা ইংরেজী গ্রামার বইটির উপরে গাঢ় লাল অক্ষরে লেখা নাম থেকে একটি অক্ষর তাকে ভালোভাবে চিনিয়ে বলতাম সেখান থেকে অনুরূপ আরেকটি খুঁজে বের করতে। এইভাবে অক্ষর খুঁজে বের করতে করতে সে খুব দ্রুত বর্ণমালা চিনে ফেলল। তবে অক্ষর শনাক্ত করার বেলায় তার নিজস্ব একটা পদ্ধতি ছিল। তাকে যে অক্ষরই দেখাইনা কেন সে ঐ অক্ষরের সাথে গৃহস্থালির নিত্য ব্যবহার্য কোন বস্তুর সাদৃশ্য আবিষ্কার করে ফেলত। এইভাবে সে শিখল T মানে হাতুড়ী, H মানে মই, I মানে বাঁশ আর V মানে গুলতি। তার সাদৃশ্যানুমানের চমৎকারিত্বে আমি প্রায়ই অভিভূত হতে লাগলাম।
শিশুরা সাধারনত বড়দের কাছে রূপকথা শোনার বায়না ধরে, সেও এর ব্যতিক্রম ছিলোনা। তার দাদার কাছে রূপকথা শুনতে শুনতে রূপকথার ভান্ডার ফুরিয়ে ফেলার পথে সে একদিন শুনেছিল আলিবাবা ও চল্লিশ ডাকাতের কাহিনী। আলিবাবার চিচিং ফাঁক বলে গুহার দরজা খোলার ব্যাপারটাতে সে মনে হয় খুব আনন্দ পেয়েছিল। তাই একদিন প্রাকৃতিক কর্ম সারার জন্য প্যান্ট খুলতে গিয়ে সে বলল চিচিং ফাঁক।
অল্প কিছুকাল আগেও আমার ভাবি একটা কিন্ডার গারটেনে শিক্ষকতা করতেন। সেও মাঝে মাঝে মায়ের সঙ্গে স্কুলে যেত। একদিন তিনি তার ক্লাসের ছাত্রদেরকে পড়া না পারার শাস্তিস্বরূপ কানে ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখলেন। এতে সে কি মজা পেল কে জানে! সেও ছাত্রদের কাতারে কানে ধরে দাঁড়িয়ে থাকলো। এরপরের ঘটনা সহজেই অনুমেয়। যা ছাত্রদের শাস্তি হওয়ার কথা ছিল তাই তাদের কাছে আনন্দের বিষয়ে পরিণত হল।
আরেকটু বড় হলে তাকে বাড়ির কাছেই একটি স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়া হল। একদিন স্কুলে এসেম্বলি চলাকালীন জাতীয় পতাকার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের সময় সে বলে উঠল, টিচার, পতাকা তো নাই। আমরা বাঁশকে স্যালুট দিতেছি। সে শিক্ষকদেরকে টিচার সম্বোধন করত। আর বাস্তবিকই সেদিন পতাকা উঠানো হয়নি। শিক্ষকেরা সবাই বারান্দায় টিনের চালার নিচে থাকার কারনে সেটা লক্ষ্য করেন নি। তার কথায় শিক্ষকেরা সবাই লজ্জা পেলেন।
আমি তাকে নিয়ে সবসময় অল্প বিস্তর আহ্লাদ করে থাকি। কখনো তাকে কাঁধে চড়িয়ে মাঠে নিয়ে যাই, আমি ফুটবল বা ক্রিকেট খেলি, সে বসে বসে দেখে, কখনো বাড়ির সীমানা দেয়ালে উঠিয়ে দিয়ে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত হাঁটাই, কখনো তাকে শুদ্ধ বেল বা আমগাছে উঠে পড়ি। বেল বা আম পেড়ে তার হাতে দেই আর সে বাসায় নিয়ে যায়, কখনো তাকে শারীরিক কসরতের তালিম দেই। এসব দেখে আমার মা-বাবা শুদ্ধ সকল পাড়া প্রতিবেশী আঁতকে উঠেন। সবকিছুতে তাদের প্রবল আপত্তি। তাদের চাউনিতে পরিষ্কার ফুটে উঠে, নিজে উচ্ছন্নে গেছ খুব ভাল, কিন্তু অপরের ছেলেকে উচ্ছন্নে পাঠিওনা বাপু।
জীবনের চারপাশে বেড়া দিয়ে সংবাদপত্রের হেডলাইন বানানোর জন্য সকলের প্রানান্ত চেষ্টা দেখে আমার শেরে বাংলার কথা মনে পড়ে। দুরন্ত বা ডানপিঠে হলেই কি কেউ উচ্ছন্নে যায়! অবশ্য এসব কথা কাউকে বলিনা, পাছে তারা সবাই চুপ করে থাকেন। তারা কি ভাবেন এটা জানা খুব জরুরী আমার কাছে। আর উচ্ছন্নে গেলেইবা! বুঝতে পারবো তার উচ্ছন্নে যাওয়ার ক্ষমতা অন্তত আছে। এমন তো অসংখ্য ছেলেকে দেখেছি যারা এমনই নির্মোক পুতুল যে উচ্ছন্নে যাওয়ার ক্ষমতা পর্যন্ত তাদের নেই।
কিছুদিন হল সে বানান করে পড়তে শিখেছে। এখন যেখানে যে লেখা দেখে তাই সে বানান করে পড়ে এবং যাই বলে সেটা বানান করে বলে। তার ছোট বোন যখন তখন বিছানা ভিজিয়ে ফেললে কাজে ব্যস্ত মা’কে সে চিৎকার করে বলে, “আম্মু, প্রলয়শিখা ম উ কার মু, ত ই কার তি মুতি, দ ই কার দি, ছ এ কার ছে দিছে, মুতি দিছে।” তার ডাক শুনে তার মা এসে ছোট বোনের বিছানা পাল্টে দেন। ছোট বেলা থেকে মা-বাবা, দাদা-দাদীর আদর সে একাই ভোগ করত। এ ক্ষেত্রে তার কোন প্রতিদ্বন্দ্বীই ছিল না। হঠাত তার আদরের সাম্রাজ্যে হানা দিয়ে তারই ছোটবোন প্রলয়শিখা তাকে কোনঠাসা করে ফেলল। তার বালক মন বোনকে সেবা করার জন্য ব্যতিব্যস্ত হলেও মায়ের আদর ভাগাভাগি করার জন্য বোধ করি তখনো প্রস্তুত ছিল না। উপরন্তু সকলে মিলে তাকে দিবা রাত্রি অহর্নিশি তার একচ্ছত্র আধিপত্য যে শেষ একথা মনে করিয়ে দিতে মোটেই ভুলতাম না। সবকিছুর ফলে একা সবার আদর পেতে অভ্যস্ত তার বালক মন কখন যে সকলের অলক্ষ্যে বিদ্রোহী হয়ে উঠলো আমরা কেউই তা টের পাইনি। যখন থেকে স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে তখন থেকে প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই আমি স্কুলে যাবো না বলে দিন শুরু করা সে যে ধীরে ধীরে একথা বলা বন্ধ করে দিচ্ছে তাতে বোধহয় সকলে স্বস্তিই পেয়েছিল। কিন্তু সে যে হারানো সাম্রাজ্য ফিরে পেতে ব্যাকুল হয়ে তার প্রতিদিনের নিয়মের ব্যত্যয় ঘটাচ্ছে তা পরিবারের একটি প্রানিও বোঝার চেষ্টা করিনি। একদিন রাতে তার মা তাকে লিখতে দিয়ে আমাদের বাড়ির দু’বাড়ি পরেই সাদ্দামদের বাসায় ভাড়া থাকা আমার বড় বোনের বাড়িতে গেলেন। তিনি সেখানে যাওয়ার পরপরই সেও টেবিল ছেড়ে সেখানে যেতে উদ্যত হলে আমি টের পেয়ে লেখা শেষ করার জন্য ধমকে পুনরায় টেবিলে বসালাম। আমি আমার রুমে ফিরে পড়ায় মনোনিবেশ করার পরক্ষনেই ভিতরের রুম থেকে কান্নার শব্দ শুনতে পেয়ে দুষ্টামি করে কান্নার ভান করছে ভেবে লেখা শেষ করার জন্য পুনরায় ধমক দেবো ঠিক করে উঠে গেলাম। কিন্তু আমি অবাক হয়ে দেখলাম, সে মোটেই কান্নার ভান করছে না, সত্যিই বিছানায় উপুড় হয়ে ফুলে ফুলে কাঁদছে। হঠাত করে আমার কাছে সবকিছু জলের মত পরিষ্কার হয়ে উঠতে লাগলো। যে মা তাকে প্রতিবেলা গ্রাস ধরে ভাত খাইয়ে দিত, সকালে ঘুম থেকে উঠিয়ে মুখ ধুইয়ে দিত, সেই মা’কে সারাদিনের মধ্যে একবারও পূর্বের মত আপন করে না পেয়ে এই কিছুক্ষনের জন্য একা, ছোটবোনের সাথে আদর ভাগাভাগীহীন পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। সেখানেও আমার বাঁধা পেয়ে তার সমস্ত রাগ, অভিমান, বিদ্রোহ গলে গলে পড়ে সমস্ত বালিশকে ভিজিয়ে ফেলল। তা দেখে আমি কখনোই যা করিনি তাই করলাম। তাকে বুকে নিয়ে আদর করে কান্না থামালাম।
স্কুলের ডায়রিতে নামতা শেখার কথা লিখে দেয়ার পর থেকে তাকে বাসায় প্রত্যহ নামতা পড়তে হত। একদিন চারের নামতা মুখস্ত করার পর মুখস্ত বলতে গিয়ে সে চার আটে বত্রিশ না বলে বলল কানাডা বত্রিশ। প্রথমটায় আমি ঠিক বুঝতে না পারলেও একটু খেয়াল করতেই বুঝলাম সে কি বলছে। নামতা দ্রুত পড়তে গেলে চার আটে বত্রিশ কথাটি চার আটা বত্রিশ থেকে ক্রমে চারাডা বত্রিশ হয়ে যায়। আর সেদিন বিকেলে মা কোন একজনকে কানাডা বলে গাল দিয়েছিলেন। মূলত ত্যাঁদড় অর্থে কানাডা শব্দটি ব্যবহৃত হয়। ত্যাঁদড় বোঝানোর জন্য একটি দেশের নাম কবে থেকে ব্যবহৃত হচ্ছে বা সেটা আদৌ গাল হয় কিনা আমার জানা নেই। কিন্তু সেই শব্দে অনুপ্রানিত হয়ে ভোটকা মিয়া তার যথেচ্ছ ব্যবহার শুরু করল। সে যে ভুল করে কথাটি বলেছে বা অবচেতনে মুখ ফসকে শব্দটি বের হয়ে গেছে এমন নয়। সে জেনে বুঝেই কথাটি বলেছিল। পাঁচ বছরের একটি ছেলের পক্ষে এমন একটি শব্দ যথাস্থানে প্রয়োগ করা সম্ভব কিনা এরকম প্রশ্ন আপনাদের মনে জাগতেই পারে! সত্য হল সে এর চেয়েও অনেক কঠিন কথা অনায়াসে বলে ফেলতে পারে। প্রকৃতপক্ষে তার দুরন্তপনার আভাস পাঁচ বছর নয় বরং পনের মাস বয়সেই পাওয়া গিয়েছিল যখন সে প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মানুযায়ী বোল ফুটার পর প্রথম ডাক ‘মা’ না ডেকে ‘বল’ বলা শুরু করেছিল।
তার বাবা একবার নারায়ণগঞ্জ গিয়েছিল। যাওয়ার সময় সেও সাথে যাওয়ার জন্য বায়না ধরেছিল। তার বাবা তাকে ফাঁকি দিয়ে চলে যাওয়ার পর থেকে সে তাকে না নিয়ে চলে যাওয়ার কারনে বাবার সঙ্গে সরাসরি কথা বলা বন্ধ করে দিল। তার প্রয়োজনের কথা সে বলতে লাগলো ভাববাচ্যে। তার মা তার বাবার কাছে ফোন করে তাকে কথা বলার জন্য দিলে সে বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলল, আমাকে না নিয়ে চলে যাওয়া হয়েছে কেন ?
তার বাবা কিছু একটা উত্তর দিলে সে আবার বলল, ফাঁকিবাজি শেখা হয়েছে না! বাবার জবাব শুনে সে পুনরায় বলল, ‘আসার সময় আমার জন্য যেন জার্সি নিয়ে আসা হয়’। তখন বিশ্বকাপ ফুটবল চলছিল। তাকে সাথে না নিয়ে যাওয়ার ফলে জমে থাকা অভিমান গলানোর জন্য বাবা তাকে জার্সি কিনে দেবেন বলে কথা দিয়েছিলেন। পরদিন আবার ফোন করে সে তার বাবাকে বলল, ‘আমার জন্য জার্সি কেনা হয়েছে?’ তার কথা শুনে আমার এতকালের অর্জিত সমস্ত শিক্ষা ব্যর্থ বলে প্রতীয়মান হল। আমার বয়স এত হল কিন্তু আমি ভাববাচ্য কাকে বলে বুঝতাম না। তার কথা শুনে আমি বুঝলাম, আচ্ছা! কর্তা সম্বোধন না করে কথা বলাই তাহলে ভাববাচ্য! এত সহজ কথাটা এতকাল আমাকে কেউ বুঝিয়ে বলতে পারলনা!
একটি একটি করে দিন আমি প্রতীক্ষায় পার করছি। কবে সে বড় হবে! আমার সমস্ত অতৃপ্তি, না পাওয়ার হাহাকার দূর করবে। বড় মধুর, বড় স্বাপ্নিক সে অপেক্ষা। তবে আমি অপেক্ষায় থাকলেও সে আমাকে মোটেই অপেক্ষায় রাখছে না। নিত্যনতুন কথা, কাজ এবং ধাঁধাঁ দিয়ে আমাকে যেমনি জীবনের এক একটি অধ্যায়ের চরম শিক্ষা দিচ্ছে তেমনি দুরন্ত, ডানপিঠে কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আশেপাশের সমস্ত বিরুদ্ধতাকে বশ করে নিচ্ছে নিপুণ শিল্পীর দক্ষতায়। এমনি করে একদিন যেন সে সমস্ত পৃথিবীটাকে বশ করে নেয় এই আমার আকাঙ্ক্ষা।
(শেষ)
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জুলাই, ২০১৭ সকাল ১১:৪২