somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

১৯৭১ঃ গণহত্যা, প্রোপাগান্ডা এবং দৈনিক সংগ্রাম

১৪ ই অক্টোবর, ২০১৫ রাত ১১:০৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


১৯৩৩ সালের দিকে নাৎসী জার্মানির বাজারে আসে পুরো নতুন মডেলের এক রেডিও; মডেলের নাম্বার ৩০১। (৩০১ কারণ, ৩০ শে জানুয়ারী নাৎসী বাহিনী ক্ষমতায় আসে।) নতুন মডেলের এই রেডিওর প্রধান বৈশিষ্ট ছিল, এটাতে শুধুমাত্র লংওয়েব ধরার নব ছিল আর ডায়ালে শুধু জার্মান স্টেশনগুলো মার্ক করা ছিল। কারণ, এতে জার্মানরা আর কোন ধরণের খবর জানতে পারবে না, শুধু তাই জানবে যা সরকার জানাতে চাইবে। আর যদি কেউ বিদেশী সংবাদমাধ্যম শুনতে চায় তবে সে নির্দেশনাও দেয়া ছিল ডায়াল ট্যাগেঃ
“Think about this: listening to a foreign broadcasts is a crime against the national security of our people. It is a Fuehrer order punishable by prison and hard labor.”

এই আইডিয়াটা আসে তৎকালীন নাৎসী সরকারের প্রচার মন্ত্রী ‘জোসেফ গোয়েবলস’ এর মস্তিষ্ক থেকে। তার কাজ ছিল দেশের ভেতর ও বাইরে নাৎসী প্রোপাগান্ডা চালানো। যুদ্ধ শেষের দিকে হিটলারের আত্নহত্যার পর এই নিকৃষ্ট লোকটিও আত্নহত্যা করে।

Der Sturmer –তৎকালীন কুখ্যাত সাপ্তাহিক পত্রিকা - নিরলসভাবে সে সময় ইহুদিদের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা চালিয়েছিল। এই পত্রিকায় প্রকাশিত খবর এবং ছবি নুরেমবার্গ ট্রায়ালের সময় নাৎসীদের বিরুদ্ধে Evidence হিসেবে ব্যবহার করা হয়। পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন Julius Streicher; গনহত্যায় উস্কানী দেয়ার অভিযোগে নুরেমবার্গ ট্রায়ালে তাকে দোষী সাব্যস্থ করে মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেয়া হয়। তাদের প্রোপ্যাগান্ডার একটা নমুনা নিচের ছবিতে দেখেন যেখানে দেখানো হয়েছে the “Jew” as a warmonger who looks on approvingly as the non-Jewish world is crucified on a cross.



১৯৪৫ সালে বন্ধ করে দেয়া হয় এই পত্রিকা। উল্লেখ্য, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে বলা হয় যে, “The genocide was not perpretrated by evil doers, but also by those who believed in the propaganda”।



প্রশ্ন হতে পারে এই প্রোপ্যাগান্ডা কিভাবে গণহত্যাকে প্রভাবিত করে?

আমাদের মনে রাখতে হবে, যে কোন ধরণের নির্বিচারে হত্যাকে “শুদ্ধি অভিযান” আখ্যায়িত করে একে সমর্থন করা, গনহত্যা কারীদের নির্দোষ প্রমাণের লক্ষ্যে বিভ্রান্তমূলক খবর প্রচার করা, আক্রান্তদের বিরুদ্ধে ধর্মীয় কিংবা জাতিগত বিদ্ধেষ ছড়িয়ে জনমত তৈরীর প্রচেষ্টা – এ সবই শুধু গনহত্যাকে প্রভাবিতই করে না, বরং গণহত্যার পথকে করে তুলে আরো সুগম, আরো সহজ। এই প্রোপ্যাগান্ডাও তাই কনভেনশনের ধারা অনুযায়ী স্পষ্ট “Direct and public incitement to commit genocide”।

এখানে প্রাসঙ্গিক একটা বিষয়ে একটু বলি; Hate Media – মিডিয়াকে ব্যবহার করে কোন গুষ্টির বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানো - যা কিনা গনহত্যায় উস্কানিতে প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করে। এই শব্দ যুগলের সংজ্ঞাটা একটু বড় হলেও তুলে দিচ্ছি বুঝার সুবিধার্থেঃ
“… Must be defined as directly provoking the perpetrator(s) to commit genocide, whether through speeches shouting or threats uttered in public spaces or at public gatherings or through the sale or dissemination of … written materials or printed matter … or through public displays of placards or posters or through another means of audiovisual communication.”

অতএব, এটা নির্দ্বিধায় বলা যায়, যেহেতু কনভেনশন অনুযায়ী গণহত্যায় উস্কানী দেয়া মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, সেহেতু Hate media কিংবা এমন প্রোপ্যাগান্ডাও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ (crime against humanity)।


এবার চোখ দেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের দিকে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রোপ্যাগান্ডা আসলে শুরু হয়েছিল ৭১ এরও বহু আগে। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ আর সিদ্দিকীর ১৯৯৬ সালে The military in Pakistan: Image and reality নামক তথ্যপূর্ণ একটা বই প্রকাশিত হয়; এই বই সম্পর্কে মুনতাসির মামুন বলেনঃ
“তিনি তুলে ধরেছেন, কিভাবে ফাকা বুলির উপর ভিত্তি করে সেনাবাহিনীর ইমেজ গড়ে উঠেছিল যার সঙ্গে বাস্তবতার কোন মিল ছিলনা। এবং কীভাবে সে প্রচারণা আবার দু’প্রদেশের মধ্যে বিচ্ছিন্নতার সৃষ্টি করছিল”

এই বইয়ের অধ্যায়ের নামগুলোও বেশ চমকপ্রদ; ‘The birth of an image’, ‘The growth of an image’, ‘The rise of an image’... ইত্যাদি। তিনি এখানে আলোচনা করেন কিভাবে প্রপাগান্ডার মাধ্যমে আইয়ুব খানকে জাতীয় ‘বীর’ এ পরিণত করা হয়। পাক ভারত যুদ্ধের পর সেনাবাহিনীর শৌর্য বীর্যের এই প্রচারণা এতই বেশি চলতে থাকে যে সেই সময় কিছু গান খুব জনপ্রিয় হয়েছিল, যেমনঃ “মেরা মাহি চাইলে চাবে লি/ কানাইলি জার্নাইল নি’ বা ‘ মেরি চান মাহি কাপ্তান’।

ঠিক সেই সময় তাদের সে প্রচারণা সাথে যুক্ত হয় নতুন উপাদান, “ধর্ম”। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এত বীরত্বপূর্ণ লড়াই করেছিল কেন? কারণ সে মুসলমান। সে ইসলামের জন্যে যুদ্ধ করেছে। প্রচারণার এই ইসলামীকরণ ৭১ এ গণহত্যা চালানোর সময় ব্যাপক সাহায্য করেছিল পাকিদের। এরপর থেকে যখনই কেউ পাকি সেনাদের বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়েছে তাকে ‘ইসলামের দুশমন’, ‘ভারতের (হিন্দুদের) দালাল’ আখ্যা দিয়ে সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। ধীরে ধীরে ‘পাকিস্তান’, ‘সেনাবাহিনী’ এবং ‘ইসলাম’ হয়ে উঠে একে অপরের সম্পূরক শব্দ।

এবার দেখি যুদ্ধ চলাকালীন অবস্থায় পাকিস্তানিরা কি ধরণের প্রপাগান্ডা চালিয়েছিল। এ নিয়ে সবার আগে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার ‘জহির রায়হান’এর মুখ থেকে শুনিঃ
“I am Jahir Raihan. I don’t belong to any political party. I am a writer and a film maker. But I saw, in Bangladesh, the most surprising aspect of that war; When a military unit was moving for an operation after destroying and killing people, they were taking shots by a movie camera..... After completing the people to loot a shop they were taking shots of those looters through a movie camera. And later on when I heard and when I saw that, they edited those portions and release it .... and telling and showing that, Bangalis are killing non – Bangalis and because of that chaos and confusion, they had to intervene. It was an utter lie.” [Nine Months to freedom – ডকুমেন্টারী]

বিখ্যাত পাকিস্তানি সাংবাদিক অ্যান্থনী মাসকারেনহাস এর কথা সবাই জানি। তিনি নিজেই লিখেছিলেন, “পাকিস্তান সরকারের তথ্য মন্ত্রনালয়ের আমন্ত্রণে পাকিস্তানী ক’জন সাংবাদিক ও আলোক চিত্রশিল্পী সহ আমিও ঢাকায় গিয়েছিলাম। পূর্ববাংলা ‘স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছে’ এ বিষয়ে সংবাদ সংগ্রহ ও প্রচার করা ছিল আমাদের কাজ বা এ্যাসাইনমেন্ট”। নিজের পেশাগত ও মানবিক দায়বদ্ধতার কারণেই অতঃপর অনেকটা পালিয়ে গিয়ে লন্ডনে ‘সানডে টাইমস’ এর মাধ্যমে বিশ্বকে জানিয়েছিলেন আসলে কি হচ্ছিল এই বাংলায়। এই রিপোর্টকে নিয়ে পরে ‘ দ্যা পাকিস্তান অবজারভার’ প্রতিবেদন ছাপায় “Mascarenhas report in Sunday Times malicious” শিরোনামে।




পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এক বাঙ্গালী অধ্যাপকের সাহায্যে তখন তৈরী করে ডকুমেন্টারি, “The Great Betreyal” – যা দেখার পর ইয়াহিয়া প্রশ্ন করেছিলেন, “I hope all the devastation shown in the film is not result of army action”। অবশ্য পরে আর রিলিজ দেয়া হয় নি এটা।

পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সকল প্রচারণা তখন প্রচার করত The pakistan Observer। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের কাছে ছিল Anti-State element এবং Indian Agent। সেখানে এই ‘ভারতীয় দালালদের’ মৃত্যুর সংবাদ এবং ‘পূর্ব পাকিস্তানের সবকিছু স্বাভাবিক’ – এই সংবাদ প্রতিনিয়ত প্রকাশিত হত। হ্যাঁ! পূর্ব সম্পর্কে পশ্চিমের তখনকার নিরবতা প্রমাণ করে বিশাল একটা গুষ্টি এ সব প্রচারণা বিশ্বাসও করেছিল! খেয়াল করে দেখুন নিচের পেপার কাটিংঃ






আইএসআই এর অর্থায়নে তখন পূর্ববাংলা থেকে প্রকাশিত হতে থাকে আরেকটি পত্রিকা, “দৈনিক সংগ্রাম”। জামায়াতে ইসলামীর মুখপত্র এই পত্রিকা সৃষ্টি করেছিল ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ “মিথ্যা”র আখ্যান; সেটা আপনি সে সময়ের দুনিয়ার তাবৎ নামি দামী পত্রিকার খবরের সাথে তুলনা করলেই প্রমাণ পেয়ে যাবেন। চেষ্টা করেছিলাম দৈনিক সংগ্রামের আসল কপির জন্যে; না পেয়ে আলি আকবর টাবি’র ‘মুক্তিযুদ্ধে দৈনিক সংগ্রামের ভূমিকা’ নামক বইটাই হয়ে উঠে শেষ সম্বল। এতক্ষন নাৎসী ও পাকিস্তানীদের পত্রিকা নিয়ে আলোচনা করেছিলাম শুধু মাত্র এই দৈনিক সংগ্রামের কার্যকলাপ এবং অপরাধের মাত্রা যেন আমাদের বোধগম্য হয়।

আলোচনার সুবিধার্থে মার্চ থেকে নিয়ে ডিসেম্বর পর্যন্ত সংগ্রামে প্রকাশিত খবর এবং সম্পাদকীয়গুলোকে আমরা মোটা দাগে কয়টা ভাগে ভাগ করতে পারিঃ
১) শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখার জন্যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রশংসা এবং ‘দুষ্কৃতিকারী’ মুক্তিবাহিনী নিধনের কিংবা নিধনে উৎসাহ দানের খবর;
২)গোলাম আযম, মওদুদী, নিজামী, মুজাহিদ সহ শান্তিকমিটির বিবৃত সমূহ;
৩) আওয়ামী লীগের সাথে একত্র হয়ে হিন্দু তথা হিন্দুস্থান কর্তৃক ষড়যন্ত্র; এখানে উল্লেখ্য, খবরে ভারত আর হিন্দু আসলে সমার্থক হিসেবেই ব্যবহৃত হয়েছে।
৪) বিখ্যাত ব্যাক্তিদের নিয়ে বিশেষ করে ইন্দিরা গান্ধীকে নিয়ে রসালো, চটুল এবং অশালীন ভাষার খবর।

আমি আলাদা আলাদা ভাবে উপরের এই চারটা পয়েন্ট নিয়েই আলোচনা করব। প্রথমেই দেখি সেনাবাহিনীর প্রশংসা সংক্রান্ত খবর। ২৫ শে মার্চ থেকে বাংলার জমিন হয়ে উঠে এক মৃত্যুপুরী – পাকিস্তানি ও তার দোসরদের দ্বারা হত্যা, লুন্ঠন, নারী ধর্ষণ চলতে থাকে অবিশ্বাস্য আকারে। অথচ এর কোন কিছুই ‘দৈনিক সংগ্রামের’ চোখে পড়েনি। তাদের কাছে মুক্তিযোদ্ধারা দুষ্কৃতিকারী, নমরুদ, ভারতের দালাল, ডাকাত ইত্যাদি নামেই পরিচিত ছিল আর তাদেরকে শায়েস্তা করে পাকিস্তানের শান্তি বজায় রাখার জন্যে পাকি সেনাবাহিনীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিল পুরো নয় মাস। এ ধরণের খবর এর প্রধান উদ্দ্যেশ্যই ছিল আসল খবর লুকিয়ে জনগনকে গণহত্যার বিষয়ে অন্ধকারে রাখা, অর্থাৎ এক কথায় গণহত্যার প্রতি প্রত্যক্ষ সমর্থন এবং গণহত্যাটাকে অস্বীকার করা। প্রথমেই দেখি ২৫ মার্চ সম্পর্কে তাদের ভাষ্যঃ
"মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে এপ্রিল পর্যন্ত এ প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে হাজার হাজার নরনারীকে অমানুষিক ভাবে হত্যা করা হয়, বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়, ২৫ শে মার্চের মধ্যরাত্রিতে আওয়ামী লীগের চূড়ান্ত বিদ্রোহের সমস্থ পরিকল্পনা যখন সম্পূর্ণ হওয়ার পথে এমন এক সংকট মুহূর্তে আল্লাহর অফুরন্ত রহমতে পাক সেনাবাহিনীর সময়োচিত পদক্ষেপের ফলে ষড়যন্ত্রকারীদের সমস্থ চক্রান্ত ব্যার্থ হয়"। (দৈনিক সংগ্রাম, ৭ আগস্ট, ১৯৭১)

সে রাতের নায়ক(!) কসাই খ্যাত টিক্কা খান কেমন ছিলেন?
"পাকিস্তানের ইতিহাসে এক চরম সংকট সন্ধিক্ষণে তিনি যে বীরত্ব, নিষ্ঠা, প্রজ্ঞা ও দৃঢ়তার সাথে পরিস্থিতির মোকাবেলা করেছেন, এ দেশের ইতিহাসে তাঁর এ কীর্তি যেমন চিরদিন অম্লান ও অক্ষয় হয়ে থাকবে, তেমনি এ দেশবাসী তাঁর কাছে থাকবে কৃতজ্ঞ"। (দৈনিক সংগ্রাম, ২ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১)

৮ এপ্রিল ‘ভারতীয় অপপ্রচারের ব্যর্থতা’ শিরোনামের সম্পাদকীয়তে লেখা হয়ঃ
“... ভাতৃদন্দ্বে উত্যত জাতি শত্রুর বিরুদ্ধে গলায় গলা মিলিয়ে রুখে দাড়িয়েছে। নতুন করে জাতীয় মীর জাফরদের তারা চিনবার সুযোগ পেয়েছে। ভারত ও তার এজেন্টেদের চক্রান্ত ব্যার্থ করে যে কোন মূল্যে তারা স্বদেশ ও জাতি রক্ষার জন্যে দৃড় প্রতিজ্ঞ হয়েছে”

এপ্রিলের দিকে যখন শরণার্থীর সংখ্যা হু হু করে বেড়ে চলছে তখন ১২ এপ্রিল ‘অর্থনীতি পুনর্গঠন’ সম্পাদকীয়তে বলা হয়ঃ
‘গত মাসে রাজনৈতিক আন্দোলন হিংসাত্বক পথে মোর নেয়ার পর যারা নিরাপত্তাহীনতা বোধ করে শহর ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন, তারাও ফিরে আসছেন, এমনকি যারা প্রদেশ ছেড়ে অন্যত্র চলে গিয়েছিলেন তারাও পরে আসছেন...অশান্তি ও বিশৃঙ্খলার এক পর্যায় থেকে শান্তি ও শৃঙ্খলার দিকে দেশের উত্তরণ ঘটেছে”

১৪ এপ্রিল ‘ফ্যাসিবাদী ভারতের স্বরূপ’ উপসম্পাদকীয়তে লেখা হয়ঃ
“জয় বাংলা আন্দোলন বানচাল হয়ে যাওয়ায় পূর্ব পাকিস্তনে এখন সুদিন ফিরে এসেছে”

১৫ এপ্রিলের সম্পাদকীয়তে সেনাবাহিনীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলা হয়ঃ
“সরকারের কাছে আরজ করা হচ্ছে ভারতীয় অস্ত্রশস্ত্র ও অনুপ্রবেশকারী নিয়ে এখনও কিছু সংখ্যক ভারতীয় চর পূর্ব পাকিস্তানের কোন কোন পল্লী এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব চালাচ্ছে বলে শোনা যায়, তারা যেন অনতি বিলম্বে সে সব প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌছে প্রদেশের শহরগুলোর মতই দুষ্কৃতিকারী মুক্ত করে স্বাভাবিক জনজীবন ফিরিয়ে আনে”।

৩০ এপ্রিল ‘নৈরাজ্যের অবসান’ লেখায় পাকি বাহিনীর প্রশংসা করে লেখা হয়ঃ
“মাত্র এক মাসের ভিতর আমাদের ঐতিহ্যবাহী পাক সেনারা পূর্ব পাকিস্তানের গোটা ভূখন্ড নাপাক হিন্দুস্তানী অনুপ্রবেশকারী ও অনুচরদের হাত থেকে মুক্ত করে এ এলাকার জনতাকে দুঃসহ এক অরাজকতার রাজ্য থেকে মুক্তি দিয়েছে”।

২৭ মে ‘দেশপ্রেমিক জনগন পুরষ্কৃত’ শিরোনামে বলা হয়ঃ
“দুষ্কৃতিকারীদের ধরিয়ে দেয়ার জন্যে কর্তৃপক্ষ জনগনের মধ্যে এক হাজার টাকা বিতরণ করেছেন ... দুষ্কৃতিকারীদের ধরিয়ে দিলে বা তাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে তথ্য জানালে কর্তৃপক্ষ উপযুক্ত পুরষ্কার দেবে”।


৯ জুন প্রথম পাতার খবরের শিরোনাম ছিল “পুনর্বাসন কাজে সেনাবাহিনীর আত্ননিয়োগ”
৮ জুলাই এক খবরে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে দাড়াতে বলা হয় “দুষ্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ান” শিরোনামে।

প্রথম ধরণের এমন খবরের আরো বহু উদাহরণ দেয়া যায়; মাত্র কয়টা আমি উল্লেখ করলাম। এবার আসি দ্বিতীয় ধরণের খবরে – পাকিদের দোসর শান্তি কমিটির বিবৃতসমূহ। আমরা জানি যে, যুদ্ধ শুরুর কয়দিন পরেই গঠিত ‘শান্তি কমিটি’’র আড়ালে আসলে লুকিয়ে ছিল জামায়াতে ইসলামী নামক দলটা। এই শান্তি কমিটি থেকে ধীরে ধীরে রাজাকার, আলবদর, আল শামস প্রভৃতি সশস্ত্র দল গঠিত হয়। এই দালালদের সাহায্য ব্যতিরেক পাকিরা এতবড় গণহত্যা এত কম সময়ে চালাতে পারত না। তাদের কর্মকান্ডে পাকিস্তানিরা এতই খুশি ছিল যে জেনারেল নিয়াজী তাঁর বইটি ‘রেজাকার’দেরকেই উৎসর্গ করেন। রাজাকাররা পুরো নয় মাস জুড়েই মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে, সংঘর্ষ হলে খুন করেছে, লুটপাট ও ধর্ষণ করেছে, পাকিদের নারী সরবাহ করেছে । আর অন্যদিকে আলবদর ছিল ডেথ স্কোয়াড এবং তাদের লক্ষ্যও ছিল স্থির। ‘প্রকৃতিতে তারা ছিল অতীব হিংস্র ও নিষ্টুর’ (মুনতাসির মামুন, “রাজাকারের মন”)। ‘দৈনিক সংগ্রাম’এর ‘শান্তি কমিটির বিবৃতি সংক্রান্ত’-খবরে আমরা দেখতে পাব, সশস্ত্র একটা বাহিনী তৈরী করার জন্যে কিভাবে তারা বারে বারে অনুরোধ জানিয়েছিল পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের কাছে যা সরাসরি গণহত্যার ষড়যন্ত্রের সাথে সম্পর্কিত। এই সশস্ত্র বাহিনীর কারণেই যে সবদিকে শান্তি বিরাজ করছে সেটাও প্রতিটা বিবৃতেই উল্লেখ থাকত। মোটামুটি প্রতিদিনই ছাপা হত এমন বিবৃতি, নমুনাস্বরূপ আমি কয়টা তুলে দিলামঃ

১১ এপ্রিল ‘ঢাকায় শান্তি কমিটি গঠন’ শিরোনামের খবরে বলা হয়ঃ
‘ঢাকায় দৈনন্দিন জীবন যাত্রার স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যে গতকাল শনিবার ১৪০ সদস্যের একটি নাগরিক শান্তি কমিটি গঠন করা হয়েছে”

১২ এপ্রিল একটি লেখায় শান্তি কমিটি গঠনকে একটি শুভ পদক্ষেপ আখ্যায়িত করে শিরোনাম করা হয় “একটি শুভ পদক্ষেপ” নামে।

১৩ এপ্রিল পাকিস্তান রক্ষার জন্যে গোলাম আযমের মোনাজাতের খবরও ফলাও করে ছাপা হয়।

২৮ মে শান্তিকমিটির মত আরো আরো কিছু বাহিনী গঠনের পরামর্শ দেয় দৈনিক সংগ্রামঃ
“আমাদের বিশ্বাস পাকিস্তান ও জাতীয় আদর্শে বিশ্বাসী নির্ভরযোগ্য লোকদের সমন্ব্য়ে একটি বেসামরিক পোশাকধারী বাহিনী গঠন করে তাদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র দেওয়ার ব্যবস্থা করা হলে অতি তাড়াতাড়ি এসব দুষ্কৃতিকারীকে নির্মূল করা সহজ হবে”। ২ সেপ্টেম্বর ‘সহযোগীতার দৃষ্টিতে’ নামক উপসম্পাদকীয়তে বলা হয়ঃ “অধ্যাপক গোলাম আযম তাঁর বিগত পশ্চিম পাকিস্তান সফরকালে বারবার দাবী করেছিলেন যে দেশপ্রেমিদের সশস্ত্র করা হোক অন্যথায় পরিস্থিতির মারাত্বক অবনতি ঘটবে। সুখের বিষয় সরকার এ সঠিক পরামর্শ গ্রহণ করে পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষায় দেশপ্রেমিকদের সামিল করেছে”। ৭ অক্টোবর এক সম্পাদকীয়তে ঠিক একই ধরনের কথা বলা হয়ঃ ‘রেজাকারদেরকেও ভারী অস্ত্র দেয়া আবশ্যক'। ১১ অক্টোবর আরেক সম্পাদকীয়তেও রাজাকারদের হাতে অস্ত্র দেয়ার জন্যে অনুরোধ জানিয়ে বলা হয়, “অন্যথায় রেজাকারদের মন দুর্বল হয়ে যেতে পারে”। ১২ নভেম্বর ‘রোকেয়া হলের ঘটনা’ উপম্পাদকীয়তে প্রকাশিত খবর- “বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তর থেকে যারা এ দুষ্ককর্মকে সহায়তা করছে তাদেরকে যদি খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হয় তবে সেটাই সঠিক পদক্ষেপ হবে বলে আমরা মনে করি” - বুদ্ধিজীবি হত্যার দিকে স্পষ্ট ইঙ্গিত বহন করে।

এই খবরগুলোর মাধ্যমে এটাও প্রমানিত হয়ে যায় আলবদর, আলশামস প্রভৃতি দল তৈরী করার পেছনে এই পত্রিকার প্রত্যক্ষ হাত আছে, যা কিনা কনভেনশন অনুযায়ী, “Conspiracy to commit genocide” কিংবা “Direct and public incitement to commit genocide”।

২৬ জুলাই রাজাকার বাহিনীর প্রশংসা করে লেখা হয়ঃ
“ইতিমধ্যেই প্রদেশের বিভিন্ন এলাকায় রেজাকার বাহিনী গঠিত হয়ে তারা দুষ্কৃতিকারীদের দমনে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে”‘আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ময়দানে রাজাকারদের গুলি চালনা ট্রেনিং’ (৪ জুলাই), ‘জনগন এখন স্বেচ্ছায় রাজাকার ট্রেনিং নিচ্ছে' (৯ জুলাই) টাইপের খবর তখন নিয়মিতই ছাপা হত।

এবার সংগ্রামে প্রকাশিত গোলাম আযম, মওদুদী, নিজামীদের কিছু বিবৃতি তুলে ধরিঃ
“দুষ্কৃতুকারীরা জনগনকে রেডিও পাকিস্তান শুনতে দেয় না”। - গোলাম আযম (১৭ জুন)
“বর্তমানের এমন কোন শক্তি নাই যা সেনাবাহিনীর প্রাধান্যকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে”। - গোলাম আযম (২১ জুন)
“সামরিক হস্তক্ষেপ ছাড়া দেশকে রক্ষা করার বিকল্প ছিল না”।- গোলাম আযম(২২ জুন)
“৬ দফা কর্মসূচীর উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া” ।- গোলাম আযম(২৩ জুন)
“মুজিবের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন জনতা সমর্থন করেনি”। - মওদুদী (৭ জুন)
“প্রেসিডেন্টের শাসন্তান্ত্রিক পরিকল্পনা খুবই যথোপযুক্ত এবং জামায়াত একে অভিনন্দন জানিয়েছে। - মওদুদী (৩০ জুন)
“পাকিস্তান কোন ভূখন্ডের নাম নয়, একটি আদর্শের নাম”। - নিজামী (১৬ আগস্ট)
“পাকিস্তানকে যারা বিচ্ছন্ন করতে চায় তারা এ দেশ থেকে ইসলামকেই উৎখাত করতে চায়”। - নিজামী (২৩ আগস্ট)
“ছাত্রসংঘ কর্মীরা পাকিস্তানের প্রতি ইঞ্চি জায়গা রক্ষা করবে”। - নিজামী (৮ সেপ্টেম্বর)
“পাকিস্তান যদি না থাকে জামায়াত কর্মীরা দুনিয়ায় বেচে থাকার কোন সার্থকতা মনে করে না”। - গোলাম আযম (২৬ সেপ্টেম্বর) [ এই উক্তিখানি আমাকে বিরাট হাস্যরস উপহার দিয়েছিল]
“সেদিন আর খুব বেশী দূরে নয় যে দিন আল বদরের তরুণ যুবকেরা আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর পাশাপাশি দাঁড়িয়ে হিন্দু বাহিনীকে পর্যদুস্থ করে হিন্দুস্থানের অস্তিত্বকে খতম করে সারা বিশ্বে ইসলামের বিজয় পতাকা উড্ডীন করবে”। - নিজামী (১৪ নভেম্বর)
“পাকিস্তান আল্লাহর ঘর”। –নিজামী (১৬ নভেম্বর)

এবার আসি তিন নম্বর ধরণের খবরের দিকে – হিন্দু তথা হিন্দুস্থান কর্তৃক ষড়যন্ত্র বিষয়ক খবর। আগেও বলেছি প্রতিটা খবরেই হিন্দু ও ভারত আসলে সমার্থক হিসেবেই তুলে ধরা হয়েছিল; যেখানে হিন্দুস্থানের ষড়যন্ত্র বলা হয়েছে সেখানে আসলে হিন্দুদের ষড়যন্ত্রের দিকেই ইঙ্গিত করা হচ্ছিল। প্রথম দুই ধরণের খবর থেকেই দেখা যাচ্ছে, যেখানেই মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক খবর এসেছে সেখানেই এই ‘হিন্দু – তত্ত্ব’ এসেছে। এ ধরণের খবরের প্রধান টার্গেট ছিল মূলত হিন্দু ধর্মালম্বীরা; তাদের বিরুদ্ধে ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ প্রচার করে এবং তাদের দ্বারা যে মুসলমানদের ক্ষতি হচ্ছে,যেমন, “মুসলমানদের দাড়ি জোর করে কেটে দিচ্ছে”(১৭ জুন) – এমন উত্তেজনাকর খবর প্রকাশ করে দুই ধর্মের মধ্যে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করাই ছিল প্রধান লক্ষ। আগেই বলেছিলাম, ৭১ এর আগে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী প্রচারণার “ইসলামীকরণ” শুরু করেছিল; ৭১ এসে সেই প্রচারনা সবচেয়ে বেশী কাজে লাগিয়েছিল দৈনিক সংগ্রাম। এবার তাদের ‘হিন্দুয়ানী ভীতি’ সংক্রান্ত কিছু খবর তুলে ধরলামঃ

“রবীন্দ্রনাথের সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি হিন্দু” (১০ এপ্রিল, শিরোনামঃ ‘ভারতের মায়াকান্না’)

“আমরা গত ১ লা মার্চ থেকে থেকে তাদের তথাকথিত জয়বাংলার স্বেচ্ছাচার দেখেছি, তাদের লুঠতরাজ ও হত্যা অপহরণ আমাদের অনেকেই স্বচক্ষে দেখেছে। দেখেছে তাদের অমুসলিমদের সহযোগীতায় পাইকারী হারে মুসলমানের গলাকাটার লীলা” (১৫ এপ্রিল, শিরোনামঃ জনতা পাকিস্তান চায়)

‘জনাব তাজউদ্দীন পাকিস্তানকে অস্বীকার করে ভারতের নাগরিত্ব গ্রহনের সাথে সাথে তিনি স্বভাবতই শ্রী তাজউদ্দীন হয়ে গেছেন”। (৮ মে, শিরোনামঃ ‘শ্রী তাজউদ্দীনের বাংলাদেশ”)

‘মুসলমানী ভাবধারা পুষ্ট জাতীয় সঙ্গীতের স্থান দখল করেছিল মুসলিম বিদ্বেষী হিন্দু কবির রচিত গান’। (১২ মে, শিরোনামঃ ‘সাংস্কৃতিক অনুপ্রবেশের ইতি হোক’)

‘এ নতুন জাতির নাম হলো ‘জয় বাংলা’ জাত। তাদের কলেমা ও সালাম – কালাম হলো “জয় বাংলা”, তাদের দেশের নাম বাংলাদেশ, তাদের ধর্মের নাম বাঙ্গালী ধর্ম। এ ধর্মের প্রবর্তকের নাম দিয়েছে তারা বঙ্গবন্ধু’। (১৩ মে, শিরোনামঃ জয় বাংলা ধর্মমত)

৬ মে ‘শরণার্থী বাহানা’ শিরোনামের খবরে বলে, ভারতে কোন শরণার্থী যায়নি; অথচ, ৩ জুন খবরে বলা হয়ঃ “ভারত এ নীতি নিয়েছে যে হিন্দু হলে শরণার্থী এবং মুসলমান হলে অনুপ্রবেশকারী। খাবার ও চিকিৎসার ক্ষেত্রেও হিন্দু মুসলমানের বৈষম্য বিদ্যমান রয়েছে। এমনকি কোন কোন শিবিরে মুসলমান যুবকদের আলাদা করে গুলি করে হত্যা করার মত ঘটনা ঘটেছে”। এখানেও হিন্দু - মুসলিম উত্তেজনা ছড়ানোর প্রচেষ্টা!

“মুসলমানদের জাত শত্রু ইহুদীরা আরব মুসলমানদের যেভাবে ব্যাতিব্যস্থ করে তুলেছে তেমনি ইহুদিদের পরম বন্ধু হিন্দুরাও একই যোগসাজশে মুসলমানদের অস্তিত্ব বিলোপের কাজ করে যাচ্ছে”। (১৫ জুন, শিরোনামঃ আলেমদের বিরুদ্ধে হিন্দু প্রচারণা)

“শত শত বাংলাভাষী আলেম ও ওলামা ও দাড়ি টুপীওয়ালাদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী হোতাদের আসল রূপ আজ ধরা পড়েছে” (১২ আগস্ট, শিরোনামঃ দালালদের স্বরুপ)

“মুক্তিবাহিনী আসলে একটি হিন্দু বাহিনী” (৯ অক্টোবর)
“তথাকথিত মুক্তিবাহিনীর শতকরা ৯০ জনই এখন হিন্দু এবং তাদের চালাচ্ছে ভারতীয় আর্মি ও বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের অফিসাররা”। (১৩ অক্টোবর)

“শেখ মুজিবের বাংলাদেশ ছিল আসলে হিন্দু ইহুদিদের বাংলাদেশ”। ( ৮ নভেম্বর, শিরোনামঃ হিন্দু ইহুদী পরিকল্পিত বাংলাদেশ)




ব্রিটিশ টেলিভিশনে বাংলাদেশের গণহত্যার ছবি প্রদর্শন করার পর সারা বিশ্বে যখন হৈচৈ পড়ে যায় তখন ১৯ জুলাই দৈনিক সংগ্রাম ‘ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি’ উপসম্পাদকীয়তে লিখেঃ
“ বৃটিশ টেলিভিশনে যে সব ছবি দেখানো হচ্ছে সে গুলো সাম্প্রতিককালের নয় বরং সেগুলো ঘূর্ণিঝড়ের সময়কার ছবি। ... সন্দেহ নেই বৃটিশ প্রচার মাধ্যমের এ ষড়যন্ত্র হিন্দুস্থান থেকেই প্রেরণা পেয়েছে”।
এখানে উল্লেখ্য, তাদের ‘ষড়যন্ত্র – তত্ত্ব’ ধীরে ধীরে এতই ভয়াবহ আকার ধারণ করছিল যে তারা ব্রিটিশ পত্র পত্রিকা থেকে শুরু করে জাতিসংঘের মাঝেও ভারতীয় ও হিন্দুদের চক্রান্ত খুঁজে পেয়েছিল। ৫ জুলাই ‘হিন্দুস্থানের চক্রান্ত জালে ব্রিটিশ’ ও ৬ জুলাই ‘চক্রান্তকারী ভারতের আরেক দোসর মার্কিন পত্র – পত্রিকা’ শিরোনামের খবরগুলো সে চক্রান্ত সংক্রান্তই।


সবশেষ ধাপে আসি এবার; বিখ্যাত ব্যাক্তিবর্গদেরকে নিয়ে রসালো অশালীন ভাষায় পরিবেশিত খবর। এ ক্ষেত্রে তারা বিসর্জন দিয়েছে সাংবাদিকতার নূন্যতম মূল্যবোধটুকুও। স্বভাবতই তাদের মূল টার্গেট ছিলেন শেখ মুজিব ও ইন্দিরা গান্ধী। যখন তারা দেখত যে তাদের অপকর্মকে ঢেকে রাখতে পারছে না তখনই তারা আশ্রয় নিত ব্যাক্তিগত এইসব নোংরা আক্রমণের। এ ধরণের খবর নিয়ে বেশী বলব না, শুধু দুটো খবর তুলে ধরব তাতেই বোঝা যাবে নোংরামী কতধরণের হতে পারে।

শিরোনামঃ "দশ হাত শাড়ীর রাজনীতি"
"ইন্দ্রদেবের স্বর্গরাজ্যের ইন্দিরা দেবীর কথাই বলছি। ... ... তাই আসুন ইন্দিরা দেবী এবারে মান অভিমান ছেড়ে দিয়ে সইদের মাধ্যমে খোশামোদ না চালিয়ে সোজাসুজি আমাদের কাছে আত্নসমর্পণ করুন। শেরোয়ানীর কাছে শাড়ীর আত্নসমর্পণে কোন লজ্জা নেই। তারপর আসুন মিলেমিশে যারা ঘর ভেঙ্গে ঘর করতে চায় তাদের ভালো হাতে দেখে নেই"। (দৈনিক সংগ্রাম, ৬ জুলাই, ১৯৭১)

শিরোনামঃ "রাজনৈতিক ধ্রুমজাল"
"বৈধ হোক কি অবৈধ, আমাদের মুজিবের সাথে যে তাঁর একটি সম্পর্ক আছে তা আজ আর তিন ঢেকে চালাতে পারছেন না। .........

মুজিব কোন প্রয়োজনে দু একবার ইন্দিরা দেবীর দিকে তাকিয়েছিলেন। সেটাকেই প্রেম ধরে নিয়ে ইন্দিরা দেবী যদি তাদের আদর্শ রমনীর রাধিকার মত চির জীবন ভাগ্নের গান গাইতে থাকেন, তো আমাদের কিছুই বলার থাকেনা।.........আমাদের সবিনয় নিবেদন, ইন্দিরা দেবী যদি একান্তই আমাদের মুজিব কে ভালোবাসেন, তা হলে বিশ্বময় চেচামেচি করে মুজিবকে অধিকতর বিপন্ন না করে তাদের প্রেমের আদর্শ রাধিকার পথ অনুসরণ করুন। সে পথেই মুজিব ও তাঁর তথা মুজিবের দেশ ও তাঁর দেশের কল্যান নিহিত। আশা করি ইন্দিরা দেবী আমাদের এ নিবেদনটি নারীসুলভ আবেগের অতিশয্যে উপেক্ষা করবেন না।"
(দৈনিক সংগ্রাম, ২৯ অক্টোবর, ১৯৭১)



উপরের প্রতিটি সংবাদ মনোযোগ দিয়ে পড়লে খেয়াল করে দেখবেন যে, তারা একদিকে যেমন প্রচার করছিল পূর্ব পাকিস্তানে শান্তি বিরাজ করছে আবার অন্যদিকে বলছিল শান্তি আনয়নের লক্ষ্যে ‘শান্তি কমটি’ গঠনের কথা। একদিকে যেমন বলছিল শরণার্থী একটা বাহানা আবার অন্যদিকে বলছিল সেই শরণার্থী শিবিরে নাকি হিন্দু মুসলিম বৈষম্য চলছে। অর্থাৎ, কোন ভাবেই তারা সত্যকে চেপে রাখতে পারছে না, তাদের মুখ দিয়েই নিজের অজান্তে ফাস করে দিচ্ছিল তাদের কু কর্ম। তাদের খবরগুলোর ধরণ বিচার করলে সন্দিহান হয়ে যেতে হয় যে গণহত্যাটা কি পাকিস্তানি সেনাবাহিনী করেছিল নাকি ‘দৈনিক সংগ্রাম’ এর কর্তৃপক্ষ করেছিল। আগেও উল্লেখ করেছি, Genocide Convention অনুযায়ী গণহত্যার যেমন শাস্তিযোগ্য অপরাধ ঠিক তেমনি গণহত্যার ষড়যন্ত্রে অংশগ্রহণ করা(Conspiracy to commit genocide) কিংবা গণহত্যায় উষ্কানী দেয়াও (Direct and public incitement to commit genocide) শাস্তিযোগ্য অপরাধ। দৈনিক সংগ্রামে প্রকাশিত খবরগুলোতে এই দুটো অপরাধ দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট। তাই, এবার আমি জোর গলায়ই বলবো, গণহত্যার জন্যে যেমন পাকিস্তানিরা দায়ী ঠিক সমান ভাবে দায়ী হচ্ছে ‘দৈনিক সংগ্রাম’।

পরিণতিঃ
শুরুতেই বলেছিলাম, Der Sturmer পত্রিকার সম্পাদক Julius Streicher কে গণহত্যায় উষ্কানিদানের জন্যে মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেয়া হয়েছিল, যুদ্ধের পরপরই বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল পত্রিকার প্রকাশনাও ।

‘দৈনিক সংগ্রাম’ এর তৎকালীন সম্পাদক আখতার ফারুকের কি কোন শাস্তি হয়েছিল? জানা নেই। আমাদের দেশে ‘দৈনিক সংগ্রাম’ এখনো বহাল তবিয়তে টিকে আছে আমার ত্রিশ লক্ষ ভাইয়ের আত্নাকে কষ্ট দিয়ে, আমার চার লক্ষ মা – বোনের ইজ্জতকে অপমান করে। এখনো প্রচার করে যাচ্ছে তাদের ‘পাকিস্তানি’ আদর্শ যাদের কারণে বারবার এই প্রজন্ম মেতে উঠছে এক বিভৎস পাকি উন্মাদনায়।

“জাতির পতাকা আজ খামছে ধরেছে সেই পুরোনো শকুন”


তথ্যসূত্রঃ
১) Wikipedia
২) রাজাকারের মন - মুনতাসীর মামুন
৩) পাকিস্তানি জেনারেলদের মন - মুনতাসীর মামুন
৪) মুক্তিযুদ্ধের দৈনিক সংগ্রামের ভূমিকা - আলী আকবর টাবী
৫) ডকুমেন্টারী: Nine months to freedom
৬) ডকুমেন্টারীঃ যুদ্ধাপরাধ ৭১ – শাহরিয়ার কবির
৭) Rape of Bangladesh – Anthony Mascarenhas
৬) The New York Times Archive
৮) বিভিন্ন ব্লগ ও সাইট















সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই অক্টোবর, ২০১৫ রাত ১১:৩৪
১১টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:০২



ইউটিউব হুজুর বললেন, মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে। তখন নাকি নিজ যোগ্যতায় ঈমান রক্ষা করতে হয়। আল্লাহ নাকি তখন মুমিনের সহায়তায় এগিয়ে আসেন না। তাই শুনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মহিলা আম্পায়ার, কিছু খেলোয়ারদের নারী বিদ্বেষী মনোভাব লুকানো যায় নি

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯



গত বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল প্রাইম ব্যাংক ও মোহামেডানের ম্যাচে আম্পায়ার হিসেবে ছিলেন সাথিরা জাকির জেসি। অভিযোগ উঠেছে, লিগে দুইয়ে থাকা মোহামেডান ও পাঁচে থাকা প্রাইমের মধ্যকার ম্যাচে নারী আম্পায়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

জানা আপুর আপডেট

লিখেছেন আরাফআহনাফ, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৭

জানা আপুর কোন আপডেট পাচ্ছি না অনেকদিন!
কেমন আছেন তিনি - জানলে কেউ কী জানবেন -প্লিজ?
প্রিয় আপুর জন্য অজস্র শুভ কামনা।



বি:দ্র:
নেটে খুঁজে পেলাম এই লিন্ক টা - সবার প্রোফাইল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×