যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে, ফাঁসি হচ্ছে, সেই সাথে দেশ ও জাতি ধীরে ধীরে কলঙ্কমুক্ত হচ্ছে। কিন্তু এই যুদ্ধাপরাধীদের গত ৪০ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমে ‘ধর্মের মুখোশ’ পরে নিয়মিত প্রচারের ফলে গড়ে ওঠা এক নির্লজ্জ প্রজন্ম ঠিকই থেকে যাচ্ছে। তাদের হাতে বারে বারে অপমানিত হচ্ছেন আমাদের শহীদেরা, ছিন্নভিন্ন হচ্ছে ৭১ এর ইতিহাস।
সিলেটের দিকে ১৯৭১ এ খুব একটা যুদ্ধ হয় নি কিংবা যুদ্ধের ভয়াবহতাও তেমনি দেখা যায়নি – এই কথাটা কানের দু’ পাশে ছোটকাল থেকে কত অজস্রবার যে শুনতে হয়েছে তার ইয়াত্ত্বা নেই। একটা সময় পর্যন্ত ভাবতাম, এই ভুল ধারণা নিয়ে হয়তোবা শুধু আমিই বড় হয়েছি! কিন্তু একসময় খেয়াল করলাম, এই ধারণা শুধু আমার না, বরং আসলে সিলেটের নতুন এই প্রজন্মের একটা বিরাট গোষ্টীর ধারণা, সিলেটের দিকে খুব একটা কিছুই হয় নি, পুরো নয় মাসই সবকিছু স্বাভাবিক ছিল। এই প্রসঙ্গে একজন মুক্তিযোদ্ধা আমার সাথে কথার প্রাক্কালে বলেছিলেন, ‘যুদ্ধপরবর্তী অবস্থায় বিশেষ করে ৭৫ এর পরবর্তী সময়ে রাজাকারদের আমাদের সমাজে অবাধে পুনর্বাসনই এমন মিথ্যে ধারণার জন্মের কারণ’।
এটা খুবই লজ্জার বিষয় যে আমাদের সিলেটের অনেকেই আজকাল শুধু এমন ধারণা পোষণই করে না, বরং রীতিমত তর্ক জুড়ে দেয়। আমি এই লেখায় ছোটাখাটো কিছু দলিল হাজির করার চেষ্টা করেছি যেন ১৯৭১ এ সিলেটের অবস্থা কিছুটা হলেও তুলে ধরতে পারি।
প্রথমেই দৃষ্টি দেয়া যাক ৩০ এপ্রিল, ১৯৭১ এ Pakistan Observer এর একটি খবর এর দিকে। শিরোনামঃ LIFE RETURNING TO NORMAL IN SYLHET। ইংরেজীতে প্রকাশিত এই খবরের অনুবাদটা নিচে তুলে দিলাম।
“সেনাবাহিনী দুষ্কৃতিকারী ও ভারতীয় দালালদের হাত থেকে মুক্ত করার পর সিলেট শহর ও তার পার্শবর্তী এলাকা সমূহের জীবন দ্রুতই স্বাভাবিক হচ্ছে। দিনের বেলায় শহর জীবনভারে জীবন্ত হয়ে উঠছে। দোকান পাট ধীরে ধীরে খুলতে শুরু করেছে এবং সাধারণ মানুষ তার প্রাত্যাহিক কাজে ব্যাস্থ হয়ে পড়ছে। জিন্দাবাজার ও বন্দরবাজার মানুষের ভিড় এতটাই হচ্ছে যে, কাধের সাথে কাঁধ না মিলিয়ে হাটা দুরূহ হয়ে পড়ছে। গ্রাম থেকে তাজা সবজি এনে ফুটপাথে ভিড় জমিয়েছে সবজি বিক্রেতারা। দোকানপাট গুলো নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যে ভরপুর এবং সারাদিনই বেচাকেনার তীব্রতা লক্ষ করা যাচ্ছে। ...
প্রতিদিনই আমি দেখছি প্রচুর মানুষজন গ্রাম থেকে শহরে আসছে দুষ্কৃতিকারীদের সক্রিয়তার কারণে যারা সেখানে আশ্রয়ের জন্যে গিয়েছিল। সরকারী ও বেসরকারী অফিস গুলোও খুলেছে এবং উপস্থিতি বাড়ছে প্রতিদিনই। পরিস্থিতি এখন পুরোপুরি কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রনে আছে। ...
আর্মি বর্তমানে ব্যাস্থ সময় পার করছে বাকী দুষ্কৃতিকারী ও ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীদের নির্মূল করতে। দুষ্কৃতিকারীরা এলাকার জঙ্গল ও বনাবৃত পাহাড় গুলোর সুবিধা কাজে লাগিয়ে জনগনকে হয়রানি করছে। সিলেট জেলার চতুর্দিকে ভারতীয় সীমান্ত ঘিরে ধরায় বিশেষ করে শহর থেকে সীমান্তের দূরত্ব ৩০ থেকে ৪০ মাইলের বেশী না হওয়ায় সমস্যা আরো ঘনীভূত হচ্ছে।“ [এপ্রিল, ৩০,১৯৭১।]
প্রসঙ্গত বলে রাখি, ২৫ শে মার্চের পর সিলেটে একধরণের তীব্র প্রতিরোধের মুখে পাকিস্তানিরা কিছুটা পিছিয়ে পড়তে বাধ্য হয়। কিন্তু এপ্রিলের প্রথম থেকেই পাকিস্তানিরা আবারো শুরু করে আক্রমন।
এখন উপরের খবরের শিরোনামটা আবার একটু পড়ে দেখেন। Life returning to normal in Sylhet – যদি অস্বাভাবিক কিছু নাই ঘটত তাহলে স্বাভাবিকে ফিরে আসার প্রশ্ন আসে কেন? এ কথা সহজেই অনুমেয়, আক্রমন কারী যখন ঘোষণা দেয় সবকিছু নরমাল তখন সহজেই বুঝা যায় আক্রান্তদের অবস্থাটা কতটা করুন! খেয়াল করুন, অবস্থাটা যে স্বাভাবিক তা বোঝাতে কিন্তু খবরটা বেশ অতিরঞ্জিত করা হয়েছে, যেমন, জিন্দাবাজার ও বন্দরবাজার মানুষের ভিড় এতটাই হচ্ছে যে, কাধের সাথে কাঁধ না মিলিয়ে হাটা দুরূহ হয়ে পড়ছে।। এই কথাগুলো বলছি কেননা, পত্রিকাটা পাকিস্তানের পক্ষের এবং তাদের খবরের মাধ্যমেই কিন্তু প্রকাশ পাচ্ছে সিলেটের তৎকালীন অবস্থা, তাদের স্বাভাবিকতার মধ্যেই আছে আমাদের ‘অস্বাভাবিকতা’। বিশেষ করে “আর্মি বর্তমানে ব্যাস্থ সময় পার করছে বাকী দুষ্কৃতিকারী ও ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীদের নির্মূল করতে” – এই বাক্যটাই বলে দিচ্ছে অনেক কিছু। এ কথা আমরা সকলেই জানি যে, পাকিস্তানিদের কাছে স্বাধীনচেতা বাঙ্গালীমাত্রই “দুষ্কৃতিকারী” ও “ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী”।
এই এপ্রিলে সিলেটের অবস্থা বুঝতে হলে এবার একটু ঘুরে আসি “বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধেঃ দলিলপত্র” এর ৮ম খন্ড থেকে। ১৯৭২ সালে ‘বাংলার বাণী’ এক বিশেষ সংখ্যায় ‘ওরা ডাক্তার মেরেছে’ শিরোনামে অধ্যাপক ডাঃ শামসুদ্দিন আহমদ কে নিয়ে এক রিপোর্ট প্রকাশ করে।
''শুধু শ্লোগান আর মিছিলের সংগ্রাম নয়। যত সত্বর পারো ইমার্জেন্সি মেডিকেল ফার্স্ট এইড স্কোয়াড তৈরী কর্। ব্যাপক রক্তক্ষরণের জন্য প্রস্তুত থাক”- ১৯৭১ সালের ২১ শে মার্চ যখন বাংলাদেশের পথে - প্রান্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়েছে তখন সিলেট চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ের ছাত্রদের উদ্দেশ্য করে যে কথাগুলো বলেছিলেন মানবতার সেবায় আত্মোতস্বর্গকৃত নির্ভীক মহৎপ্রাণ সিলেট চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ের প্রধান শল্য চিকিৎসক অধ্যাপক ডা: শামসুদ্দিন আহমদ।
বাংলাদেশে গণহত্যার বর্বরোচিত ও নৃশংসতম উদাহরণ বিশ্বে তুলনাহীন। কয়েক মিনিটের ঘটনা কিন্তু কত ব্যাপ্ত , কত বিস্তৃত , কত মর্মান্তিক , কত দুর্ঘটনা , কত মর্মস্পর্শী দৃশ্য , কত পৈশাচিকতা ছিল এ হত্যাকান্ডে। শতাব্দীর পর শতাব্দী বিশ্বে যে ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে , বাংলাদেশের গণহত্যার কাছে সব ম্লান হয়ে গেছে। এত বড় হত্যাকাণ্ড কোন ভাষায় লিখব, কেমন করে লিখব , কি লিখব , কে লিখতে পারবে? বাংলাদেশের এক কোটি পরিবারের কথা লিপিবদ্ধ করতে হলে এক কোটি ইতিহাস লিখতে হবে। তা না হলে এ নৃশংসতার বহু অধ্যায় বাদ পড়ে যাবে। কিন্তু তা কি সম্ভব? না সম্ভব নয়। সুতরাং এ ইতিহাস অলিখিত থাকবে। এ ইতিহাস লেখা যায় না। এ ইতিহাস লেখা যাবে না। এখানে ঐতিহাসিক ব্যর্থ , এখানে ইতিহাস ব্যর্থ। এ ব্যর্থ ইতিহাসে শহীদ ডা: শামসুদ্দিন আহমদ কে প্রকাশ করাও এক ব্যর্থ প্রয়াস।
কেন তাকে হত্যা করা হল? কেমন করে তাকে হত্যা করা হল? সৌম্য দর্শন দেবতুল্য লোকটিকে পাক বর্বর পশুরা কি করে গুলী করলো? এতো মানুষকে হত্যা করা নয় , মানবতাকে হত্যা করা হয়েছে। মার্চের অসহযোগ আন্দোলন শুরু হতেই অধ্যাপক শামসুদ্দিন আহমদ নতুন এক কার্যক্রম এর অবতারণা করলেন। অসহযোগ এর ফলে অন্যান্য দের কাজ কমে গেলেও তাঁর নতুন আরো কাজ বেড়ে গেল। সামনে কি ঘটতে যাচ্ছে তা তিনি যেন চোখের সামনে স্পস্ট দেখতে পেলেন। ছাত্র ছাত্রী সেবক সেবিকাদের ডেকে ফার্স্ট এইড স্কোয়াড গঠনে প্রবৃত্ত হলেন। প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি নিয়ে অনেকগুলো প্যাকেট তৈরী করে বিভিন্ন স্থানে মওজুত করে রাখলেন। তিনি যেন দেখতে পারছিলেন ঐ যে কয়েক গজ দূরে হানাদার বাহিনী তেড়ে আসছে , এতেই আঘাত করবে , এক্ষুনি ফার্স্ট এইডের প্রয়োজন হবে।
হ্যাঁ, সত্যি সত্যি নরপশুরা এসে বর্বরোচিত আক্রমণ করেছে , অসংখ্য লোককে হত্যা করেছে , অগনিত লোককে আহত করেছে আর শল্যবিদ শামসুদ্দিন আহমেদ তড়িৎ গতিতে চিকিৎসা শুরু করেছেন। কিন্তু মানুষ শামসুদ্দিন কে যখন হিংস্র দস্যুরা গুলি করেছে , গুলি করে ধরাশায়ী করেছে , হত্যা করেছে তখন তাকে কেউ ফার্স্ট এইড দিতে আসেনি। কারণ তিনিই ছিলেন শেষ মানুষ , তিনিই ছিলেন শেষ সেবক, তিনিই ছিলেন সে ইতিহাসের শেষ নায়ক।
১ লা এপ্রিল , ১৯৭১ সাল। সূর্য সারা প্রকৃতিতে ছেয়ে রেখেছে। রক্তিম রশ্মী বিচ্ছুরিত হচ্ছে চারিদিকে. সিলেট শহর আবার শত্রু কবলিত। ২৫ শে মার্চের কাল রাতের পর হতেই স্বতস্ফুর্তভাবে বেংগল রেজিমেন্ট , তখনকার ই , পি, আর , আনসার , মোজাহিদ্, ইউওটিসি , ক্যাডেট , জেসিসি , ক্যাডেট, পুলিশ , ছাত্র ও যুবকরা সিলেটের বিভিন্ন জায়গায় মুক্তিবাহিনী গঠন করে শত্রুদের উপর মারাত্মক আঘাত হানে। কয়েকদিনের মধ্যেই সিলেট জেলার তিনশত মাইল সীমান্ত এলাকা থেকে সমস্ত পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যকে হত্যা অথবা বিতাড়িত করে মার্চের মধ্যেই সমস্ত হবিগঞ্জ মহকুমা , মৌলভীবাজার মহকুমা ও সুনামগঞ্জ মহকুমা মুক্তিবাহিনীর পূর্ন কর্তৃত্বাধীনে চলে আসে।
৩রা এপ্রিল মুক্তিপাগল বাঙ্গালী বীরেরা সিলেট শহর দখল করে নেয়। হানাদার বাহিনী শালুটিকর বিমানবন্দর ও সংলগ্ন জঙ্গলে আশ্রয় গ্রহণ করে। তারপরই শুরু হয় বৃস্টির মত পাক বাহিনীর বিমান হানা। সারা শহরে ঝাকে ঝাকে গুলির ঝড়। শত শত আদম সন্তান রক্তাক্ত আহত হয়ে হাসপাতালের দ্বারস্থ হয়। মানব সেবার প্রতীক প্রখ্যাত শল্যবিদ অধ্যাপক শামসুদ্দিন শানিত ছুরি হাতে ঘড়ির কাটার সাথে তাল মিলিয়ে কাজে রত রয়েছেন। হাসপাতালে আলো নেই , পানি নেই , পথ্য নেই। তাতে কি , শামসুদ্দিন সাহেব আছেন। এক হাতে অস্ত্র চালনা, অন্য হাতে অন্যান্য সব কাজ।
৮ই এপ্রিল থেকে আবার শুরু হল তুমুল যুদ্ধ।পাক দস্যুরা স্থল ও বিমানবাহিনি নিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে মুক্তি বাহিনীর উপর ঝাপিয়ে পড়ল। সমস্ত শহর তখন জনশূন্য . প্রানপণ বাঁচার আদিম উগ্রতায় শহরবাসী চলছে গ্রামের আশ্রয়ে - দুর্গত শহরের সাক্ষী ডাঃ শামসুদ্দিন আর তার রোগী।
ছাত্রদের প্রতি ডাঃ শামসুদ্দিন - " আমরা প্রবীন। আহত বাঙ্গালীদের সেবায় আমাদের থাকতে দাও। তোমরা নবীন যুবক , নিজেদের বুদ্ধি খাটিয়ে কাজ কর্। এখানে থেকে বর্বর পশুদের শিকার হয়ে কোন লাভ নেই"
ডাক্তারদের প্রতি - " কোথায় যাবেন আপনারা? আমরা ডাক্তার্। রোগী ফেলে আহত মানুষ ফেলে আমরা তো কোথাও যেতে পারি না। "
সেই রক্তস্নাত ৯ই এপ্রিল। ইতিহাস থমকে গেছে। আন্তর্জাতিক রীতি নীতি ভঙ্গ করে জেনেভা কনভেনশন এর নিয়ম অমান্য করে মারণাস্ত্র সহ কতকগুলো পাক নরঘাতক সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ঘেরাও করে অভ্যন্তরে প্রবেশ করল। শল্য প্রকোষ্ঠ. বুদ্ধিদীপ্ত ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন গৌরবর্ণ সুদর্শন অধ্যাপক শামসুদ্দিন আহমদ অবিশ্রান্ত কর্মরত। ঝড়ের বেগে প্রকোষ্ঠে ঢুকে সংগীন উচিয়ে ক 'টি পশু সেনা ডাঃ শামসুদ্দিন আহমদ কে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল। হাসপাতালের পূর্ব -দক্ষিন কোনে অশ্রুসিক্ত সবুজ ঘাসের শীষে দাঁড় করালো তাকে। তারপর্। না , আমি সম্বিত হারিয়ে ফেলছি। কি লিখবো , কেমন করে লিখবো। লিখে কি হবে?লাভ কি? পৃথিবীর মানুষ কি বিশ্বাস করবে আমাকে? অবিশ্বাস্য ঘটনা কি বিশ্বাস করা যায়। না , অন্যের বিশ্বাস অবিশ্বাসের উপর নির্ভর করে আমি লিখবো নাকি? আমি আমাকে তো অবিশ্বাস করতে পারি না। ভগবান যীশুও ক্রুশবিদ্ধ হয়েছিলেন। হ্যা , হাসপাতালের চিরাচরিত মানবিক পবিত্রতা কে বিদীর্ণ করে গুলী করা হল। গুলি করা হল ঋষি শামসুদ্দিন কে , মানুষ শামসুদ্দিন আহমদ কে।
উনসত্ত্বরের গণআন্দোলনে ডাঃ শামসুদ্দিন বলেছিলেন - "হে সভ্য জগত, গন আন্দোলনকে দমন করতে গুলি করো না। তার বদলে ব্যবহার কর রাবার বল বা বেগে চালিত পানি। "
এক - দুই করে তিনটি গুলী করা হল তাঁকে। মৃত্যুহীন প্রাণ ক্ষনিকের ভিতর শেষ হয়ে গেল। প্রানপ্রিয় দরদী শিক্ষককে অনুসরণ করল তরুণ অস্ত্রোপচারক ডাঃ শ্যামল কান্তি লালা , সহকারী সেবক মাহমাদুর রহমান , এম্ব্যুল্যান্স চালক কোরবান উল্লাহ। ক্লান্ত হল নরপশুদের সামরিক ক্ষুধা।
ডাঃ শামসুদ্দিন ছিলেন মানব সেবার ইতিহাসে এক বিরল আদর্শ। কি সম্মোহনী শক্তি তার ছিল জানি না। ছাত্রবেলা থেকেই তিনি ছিলেন নম্রভাষী। তাঁর কাজই কথা বলত। বিভাগ - পূর্ব ভারতে তিনি ছিলেন আসাম মুসলিম স্টুডেন্টস ফেডারেশনের সভাপতি। কলিকাতা মেডিকেল কলেজে অধ্যয়নকালে তিনি ছিলেন প্রথম শ্রেনীর ছাত্র নেতাদের অন্যতম ।
সেবাই ছিল অধ্যাপক শামসুদ্দিন আহমদের প্রধান ও প্রথম ধর্ম। তাই সেবা করতেই তিনি জীবন বিলিয়ে দিলেন। আজীবন সেবাধর্মী ডা শামসুদ্দিন ছিলেন গঠনমূলক কাজে পারদর্শী ও অভিজ্ঞ। তরুণ ডাক্তার হিসেবেই তিনি ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান মেডিকেল এসোসিয়েশন এর সাধারণ সম্পাদক . অফুরন্ত ক্ষমতাসম্পন্ন ডাঃ শামসুদ্দিন মেডিকেল সার্ভিস এসোসিয়েশন এর মৃতপ্রায় প্রতিষ্ঠান কে শক্তিশালী করে তোলেন। তিনি ছিলেন একজন বিশিষ্ট চিন্তাবিদ ও সংগঠক। তিনি বহু জনকল্যাণকর প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা। তিনিই প্রতিষ্ঠা করেন পাকিস্তান এম্ব্যুলেন্স কোর্।
১৯৬৪ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন জালালাবাদ অন্ধ কল্যাণ সমিতি। "অন্ধজনে দেহ আলো" এ মূল মন্ত্র নিয়ে এ সমিতির উদ্যোগে সিলেট , মৌলভীবাজার , শ্রীমঙ্গল , হবিগঞ্জ , কুমিল্লা ও নোয়াখালীতে এ পর্যন্ত ১৪টি চিকিৎসা শিবিরের মাধ্যমে কয়েক হাজার রোগীকে দৃস্টিশক্তি ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। দক্ষিন - পূর্ব এশিয়াব্যাপী এ প্রতিষ্ঠানের সুনাম বিস্তৃত।
ডাঃ শামসুদ্দিন আহমদের আর একটি কীর্তি হল সিলেট যক্ষা নিবারনী সমিতি। এর মাধ্যমে বহু দূরারোগ্য যক্ষা রোগীকে চিকিৎসা করা হয়ে থাকে। তিনি আরো প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রক্তচাপ ও বহুমূত্র রোগ নিরোধ কেন্দ্র। বহু লোকও এর মাধ্যমে উপকৃত হয়েছে।"
“পাকিস্তান অবজারভার” এর আরো দুটো সংবাদের কথা এবার উল্লেখ করব। এই দুটো সংবাদের মাধ্যমে সিলেটে বিশাল সংখ্যক রাজাকারদের উপস্থিতির কথা লক্ষ করা যায়। তবে পাশাপাশি পরোক্ষভাবে চলে আসে বাঙালি নিধনের খবর।
জেনারেল নিয়াজী সিলেটে এসেছিলেন তার ট্রুপের সাথে দেখা করতে। তার এই সফর নিয়ে জুলাই, ০৯ তারিখের Pakistan Observer, “Gen. Niazi inspetcs defensive deoplyment of troops in Sylhet” শিরোনামে খবর প্রকাশ করে। যথারীতি এখানেও আছে দুষ্কৃতিকারীদের নির্মূল করার সংবাদ।
“ইস্টার্ণ কমান্ডের কমান্ডার জেনারেল নিয়াজী গত বৃহস্পতিবার সিলেট সফরের প্রাক্কালে উত্তর – পূর্বাঞ্চল সীমান্তে প্রতিরক্ষা বাহিনীর ঘাটি পরিদর্শন করেন। ISPR এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, সে সময় তার সাথে ছিলেন জি ও সি।
জেনারেল নিয়াজী সেখানকার ট্রুপের কমান্ডারদের সাথে কথা বলেন এবং তাদের খোজ খবর নেন।
স্তানীয় কমান্ডার নিয়াজীকে বলেন, জনসাধারণের সহায়তায় সিলেট শহর থেকে সকল দুষ্কৃতিকারীদেরকে নির্মূল করা হয়েছে। তিনি আরো জানান, দুষ্কৃতকারীরা ভারত থেকে ট্রেনিং নিয়ে গোপনে সীমান্ত ক্রস করার চেষ্টা করছে, কিন্তু তাদের জন্যে যথাযথ ব্যাবস্থা নেয়া হয়েছে। রাজাকার ও স্থানীয় জনগনের সহায়তায় অনেক স্থানেই এ সকল দুষ্কৃতকারীদের অন্তর্ঘাতি কাজ রহিত করা যাচ্ছে...” [জুলাই, ০৯, ১৯৭১।]
এবার দেখুন, পাকিস্তান অবজারভার এর ০৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ এ প্রকাশিত খবর।
শিরোনামঃ DEFENCE DAY OBSERVED IN SYLHET
“রঙ্গিল জমকালো আবহে সিলেটে পালিত হয়েছে পাকিস্তান প্রতিরক্ষা দিবস। স্বরণকালের সবচেয়ে বড় এই মিছিলে শহরের রাস্তঘাটে এক লাখেরও বেশি মানুষ ‘আল্লাহু আকবার’, পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ এবং ‘ভারতীয় দালালরা নিপাত যাক’ স্লোগানে মুখরিত করে তুলে।
দুর্যোগপূর্ণ পরিবেশের প্রতিকূলতাকে পরাজিত করে প্রত্যন্ত অঞ্ছল থেকে আগত মানুষ সিলেট রেজিস্টারী মাঠে ভিড় করে। ঐতিহাসিক বিশাল এই র্যা লিটির আয়োজন করে সিলেট জেলা শান্তি কমিটি যা শেষ হয় রেজিস্টারী মাঠে গিয়ে।
হাতির পিঠে চড়ে আসা লোক এবং রাস্তায় লাঠিখেলা দেখানো লোকদের কারণে মিছিলটি হয়ে উঠেছিল অনন্য। শত শত লাঠি খেলোয়াড় যুদ্ধের মত করে এক ধরণের খেলা দেখাচ্ছিল এবং তরুণ ছেলেরা নেচে গেয়ে আনন্দ উল্লাস করছিল।
ঐতিহাসিক এই র্যা লিটি আয়োজন করেন জেলা শান্তি কমিটির আহ্বায়ক জনাব গোলাম জিলানী সহ আরো অনেক রাজাকার, আনসার, স্কাউট এবং মুজাহিদবৃন্দ মিলে। কয়েক ঘন্টা যাবত পুরো শহর ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ ধ্বনিতে মুখরিত ছিল।
সভার শুরুতেই রাজাকারদের পুরষ্কার দেয়া হয়। আদম মিয়া, ওসমান গনী এবং আব্দুর রাহমানকে সার্টিফিকেট প্রদান করা হয়। রাজাকার ওসমান গনী সুতাং রেলওয়ে ব্রিজ ২০ জন ভারতীয় দালালদের হাতে ধ্বংস হওয়া থেকে বাচানোর জন্যে অসাধারণ সাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন। রাজাকার আদম মিয়া জামালগঞ্জে দুইজন ভারতীয় এজেন্টকে আটক করেন।
রাজাকার আব্দুর রাহমান গোয়াইনঘাটে একটি ব্রিজ রক্ষার্থে অস্বাভাবিক বীরত্বের পরিচয় দিয়েছেন। তিনি একাই সেদিন ৬০ জন ভারতীয় দালালদের সাথে লড়েছিলেন। এমন অসামান্য সাহসের জন্যে আরো অনেক রাজাকারদেরকে পুরষ্কৃত করা হয়েছে। মো আব্দুল হাসিম কে পুরষ্কার দেয়া হয় কুশিঘাটে চারজন ভারতীয় এজেন্টকে আটক করার জন্যে।
ঐতিহাসিক এই জনসমাবেশের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দেয়ার সময় ডেপুটি কমিশনার সৈয়দ আহমেদ ১৯৬৫ সালের পাক ভারত যুদ্ধের শহীদদের প্রতি গভির শ্রদ্ধা নিবেদন করেন এবং ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াবার জন্যে তিনি আর্মির (পাকি) ভূয়সী প্রশংসা করেন”। [সেপ্টেম্বর, ০৯, ১৯৭১।]
লেখাটাতে দেখুন, প্রতিরক্ষা দিবসের উদযাপন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্টানে রাজাকারদের পুরষ্কৃত করা হচ্ছে। কেন পুরষ্কার দেয়া হচ্ছে – এই প্রশ্নের উত্তরও দেয়া আছে প্রকাশিত খবরে; যুদ্ধের ময়দানে সাহসের সাথে “ভারতীয় দালাল”দের মোকাবিলার জন্যে এবং ভারতীয় এজেন্টের আটক করার জন্যে। পাকিস্তানিদের চোখে এই “ভারতীয় দালাল” কিংবা “দুষ্কৃতিকারী” কারা?
আপাতত পাকিস্তানিদের পত্রিকায় প্রকাশিত সিলেট সংক্রান্ত এই খবরগুলোওই জোগাড় করা সম্ভব হয়েছে।
বাংলাদেশের অন্যান্য প্রান্তের মত সিলেটেও পাকিস্তানিদের সহায়তার জন্যে গঠন করা হয় শান্তি কমিটি। ১৩ মে, ১৯৭১ এ “দৈনিক আজাদ” খবর ছাপায় ‘সিলেটের বিভিন্ন স্থানে শান্তি কমিটি গঠন’ শিরোনামে। ১৬ জুনেও তারা এ সংক্রান্ত খবর ছাপায় “সিলেট, পিরোজপুর এবং মুন্সীগঞ্জ শান্তিকমিটির ব্যাপক তৎপরতা” শিরোনামে। ৩০ জুন ‘শাহজালালের পবিত্রভূমি হইতে সমাজবিরোধীদের উৎখাতের শপথ’ শিরোনামে খবর প্রকাশ করে একই পত্রিকা।
নিচের পেপার কাটিংয়ের ছবিটা দেখুন; ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারীর ৫ তারিখে ‘বাংলাদেশ অভজারভার’ এ প্রকাশিত একটা খবর।
ইংরেজীতে প্রকাশিত খবরের অনুবাদটুকু তুলে দিলামঃ
শিরোনামঃ PAK ARMY BUTCHERED 10,000 IN SYLHET AREA
“বিবিসির সাথে এক সাক্ষাৎকারে জেলা আওয়ামীলীগের সেক্রেটারী দেওওয়ান ফরিদ গাজী জানান, নয় মাস ব্যাপী চলা ম্যাসাক্যারে পাকিস্তানী আর্মি শুধু মাত্র সিলেট নগর ও নগরের উপকন্ঠে নারী শিশু সহ দশ হাজারের বেশী মানুষকে হত্যা করেছে।
শহর থেকে মাত্র তিন মাইল দক্ষিনে অবস্থিত লালমাটিয়া ও গুট্টিকর গ্রামে সম্প্রতি অনেক গুলো গনকবর পাওয়া গিয়েছে । বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রী জনাব আব্দুস সামাদ আজাদ দুদিনের এক সিলেট সফরে এসে সেগুলো পরিদর্শন করে গেছেন।
জনাব গাজীর মতে, দখলদার বাহিনী শহরে দুটো জল্লাদখানা তৈরী করে, একটি লালমাটিয়াতে এবং আরেকটি সিলেট থেকে তিন মাইল উত্তরে সালুটিকরে। বর্বর পাকিস্তানিরা হাজার হাজার নর-নারী ও শিশুদেরকে হত্যা করে এই দুই ক্যাম্পে।
বিবিসির সংবাদদাতা সিলেট সফরের সময় লালমাটিয়াতে বেশ কয়েকটি গণকবর দেখতে পান। এক হিসাব মতে, শুধুমাত্র লালমাটিয়াতে পঞ্চাশের উপরে গণকবর আছে এবং প্রতিটা কবরে দুই থেকে তিন ডজন শরীর পাওয়া যাচ্ছে। পাশবিক পাকিস্তানিরা প্রথমে মাটি খুড়ত, নিস্তেজ শরীরগুলোকে ছুড়ে ফেলে দিত গর্তের মধ্যে এবং তারপর লাশগুল মাটিচাপা দিয়ে চলে যেত।
শহরের পাশেই শালুটিকরের রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুলে পাকিস্তানি দখলদাররা ক্যাম্প গড়েছিল এবং সেখানেই শুধু মাত্র পাচ হাজারের বেশি লোককে হত্যা করা হয়েছিল।
আওয়ামীলীগের সেক্রেটারী জানান, কর্তৃপক্ষ সিলেটে দখলদার বাহিনী দ্বারা চালিত গণহত্যার যাবতীয় নমুনা জোগাড়ের চেষ্টা করছে”। [ফেব্রুয়ারী,০৫, ১৯৭১।]
বালাগঞ্জ; জেনারেল ওসমানীর জন্মস্থান; সিলেটের এই উপজেলাটা ১৯৭১ এ শিকার হয়েছিল সবচেয়ে ভয়াবহ গণহত্যার শিকার। রাজাকার সাদ মিয়ার সহযোগীতায় মাত্র আঠারো দিনের ব্যাবধানে বালাগঞ্জের বুরুঙ্গাতে ৭৮ জন ও আদিত্যপুরে ৬৩ জন কে হত্যা করা হয়। নিচের ছবিটা আদিত্যপুরের সে বধ্যভূমি থেকে উদ্ধারকৃত মানব কঙ্কাল।
শহরের ধোপাদীঘির পাড়ে পড়ে আছে এক মুরগি ব্যাবসায়ীর লাশ।
১৯৭১ এ ধ্বংস হয়ে যাওয়া আমাদের পরিচিত কীনব্রিজ।
নিচের ছবিটা শহরের নাইওরপুলে অবস্থিত জেনারেল ওসমানীর যুদ্ধে বিধ্বস্থ বাড়ির ধ্বংসাবশেষ। বাড়িটার ছবি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭২ সালের ৩১ জানুয়ারীর ‘দৈনিক পূর্বদেশ’ পত্রিকায়।
সিলেটের শালুটিকরে পাকিস্তানি হেরেমের দেয়ালে আকা ছবিগুলো নারী নির্যাতনের প্রামান্যদলিল।
আসুন, আবারো আমরা ফিরে যাই, “বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধেঃ দলিলপত্র” এর ৮ম খন্ডে।
১৯৭২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারীতে “দৈনিক আজাদ” ও “সংবাদ” সিলেটের মৌলভীবাজারে সন্ধান পাওয়া বধ্যভূমি নিয়ে খবর প্রকাশ করে। দুটো খবরই দলিলের ৮ম খন্ডে দেয়া আছে।
শিরোনামঃ মনুব্রিজে প্রকাশ্য গণহত্যা
দৈনিক আজাদ
২৬ ফেব্রুয়ারী, ১৯৭২।
পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী মৌলভীবাজার মহকুমার বিভিন্নস্থানে যে হত্যাকান্ড চালিয়েছে সেসব বধ্যভুমি ক্রমে আবিষ্কার করা হচ্ছে।
এ ধরনের একটি বধ্যভুমি শেরপুর জেটি থেকে আবিষ্কৃত হয়। তথায় প্রায় দুই হাজার লোককে হত্যা করা হয় এবং তাদের লাশ কুশিয়ারা নদীতে নিক্ষেপ করা হয়।
শেরপুরে হানাদার বাহিনীর একটি সরবরাহ কেন্দ্র ছিলো। সেখান থেকে তারা নৌ ও সড়ক পথে সমগ্র জেলায় হামলা চালিয়েছে। শেরপুরে তিন-তিনবার মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়। ফলে পার্শ্ববর্তী গ্রাম হালোরখুনা, শেরপুর, বণগাঁও, কলরগাঁও, আয়েনপুর, নতুনবস্তি, মোবারকপুর ও কাসুরপুর জনশূণ্য হয়ে পড়ে।
শেরপুরে পাক বাহিনীর সুন্দর ঘাটি ছিলো। এমনকি তথায় নৌবাহিনীও ছিলো। এখান থেকে তারা নরহত্যাসহ যাবতীয় ধ্বংসযজ্ঞ চালাতো। তারা নৌ জাহাজ ও গানবোট ব্যাবহার করতো এবং তা থেকে কূলবর্তী গ্রামে গোলাবর্ষণ করতো। তারা বিভিন্ন স্থানে হামলা চালিয়ে বিশেষতঃ মহিলাদের ধরে তাদের অন্যান্য ক্যাম্পে নিয়ে যেতো।
এছাড়া গত ১৪ই মে হানাদার সৈন্যরা মৌলভীবাজারে মনুব্রীজের উপর বিভিন্ন লোককে ধরে এনে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করে। প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় অধিবাসীরা এ হত্যাকান্ডের নারকীয়তা এখনো ভুলতে পারছে না। হানাদার জল্লাদ বাহিনী উল্লেখিত দিনে সমস্ত থানাবাসীকে উক্ত ব্রীজে সমবেত হবার নির্দেশ দেয়।
ভয়ে আতঙ্কিত প্রায় এক হাজার লোক তথায় উপস্থিত হলে তাদের সামনে হিলারপুরবাসী ময়না মিয়া, কলমদার মিয়া ও উস্তার হাজীকে আনা হয় এবং ব্রীজের উপর শুইয়ে গুলি করে হত্যা করা হয় এবং পরে তাদের পানিতে ফেলে দেয়া হয়। ময়না মিয়া প্রাণে বেঁচে গেলে তাঁকে ক্যাম্পে নিয়ে তথায় হত্যা করা হয়”।
শিরোনামঃ মৌলভীবাজারে আরো বধ্যভূমির সন্ধান
সংবাদ,
২৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২
“২৫শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২ (এনা)- শেরপুর জেটিতে হানাদার বাহিনীর বর্বরতা সাক্ষী এমন একটি বধ্যভূমি আবিষ্কৃত হয়েছে। এখানে প্রায় ১হাজার ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়। তারপর মৃতদেহগুলো কুশিয়ারা নদীতে ছুড়ে ফেলা হয়।
বরুরা চা বাগানের পশ্চিমে আচেরাতে আর একটি বধ্যভূমির খবর পাওয়া গেছে। জনসাধারণের সহায়তায় পুলিশ এটি আবিস্কার করেছে। শ্রীমঙ্গল কলেজের পূর্বদিকে এই বধ্যভূমিটি ছিল। এখানে ৪৩ জন চা বাগান শ্রমিককে হত্যা করা হয়। মৃতদেহগুলো একটি গর্তে কবর দেয়া হয়।
সাধুবাবাতেও তাঁরা আর একটি বধ্যভূমি আবিস্কার করেছেন। এখানে জল্লাদরা ৫০ জন হতভাগ্যকে হত্যা করে। ভাগ্যগুনে চার জন রক্ষা পায়। তারা মরেনি কিন্তু আহত হয়েছিল। এই মর্মান্তিক ঘটনা তাঁরাই বর্ণনা করেন।
আর একটি বধ্যভূমি আবিষ্কৃত হয়েছে কুলাউরা রেল ক্রসিংএ। এখানে একটি কবরে চল্লিশটি কংকাল পাওয়া গেছে।
জল্লাদদের আর একটি বধ্যভূমি ছিল মৌলভীবাজার কোর্ট। এখানে ৩৫ জনকে হত্যা করে জল্লাদরা। তারপর মৃতদেহগুলো গর্তে কবর দেয়া হয়।
বারবাড়িতে আর একটি বধ্যভূমি আবিষ্কৃত হয়েছে। মৌলভীবাজার শহর থেকে দূরত্ব আধা মেইল। এখানে যে কত লোককে হত্যা করা হয়েছে তার সঠিক সংখ্যা এখানে জানা যায়নি”।
সিলেটে যেসব পাকিস্তানি আর্মি এসব নির্যাতন চালিয়েছিল তাদের মধ্যে অন্যতম ছিল সরফরাজ মালিক এবং ব্রিগেডিয়ার ইফতেখার রানা। নিচের ছবিটা ব্রিগেডিয়ার ইফতেখার এর।
১৯৭১ এ সিলেটে অবস্থা সম্পর্কে বিশদ আকারে গবেষণা করেছেন তাজুল মোহাম্মদ। তাঁর ‘সিলেটে গণহত্যা’ এবং ‘সিলেটের যুদ্ধকথা’ দুটো অনবদ্য গ্রন্থ। তাছাড়া, ডা এম এ হাসানের ‘যুদ্ধ ও নারী’ বইটাতে সিলেটের নারী নির্যাতন নিয়ে আলোচনা করা আছে। অপূর্ব শর্মার ‘বীরাঙ্গনা কথা’ নামক বইটাতে এই অঞ্চলের ১২ জন বীরাঙ্গনার জীবন কাহিনী বর্ণনা করেছে। এ ছাড়া আরিফ রহমানের ‘ত্রিশ লক্ষ শহীদঃ বাহুল্য নাকি বাস্তবতা’, মুনতাসির মামুনের ‘শান্তি কমিটি ১৯৭১’ , ডা এম এ হাসানের ‘পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধী ১৯১ জন’ বইগুলো পড়ে দেখতে পারেন।
আমরা জাতি হিসেবে বড়ই বিস্মৃতিপরায়ন এবং নির্লজ্জ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এতটা বছর পরেও কোরিয়ানরা আন্দোলন করছে জাপানীজদের কাছে থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ের। আর আমরা বাঙ্গালীরা, ক্ষমা প্রার্থনা চাওয়ার কথা দূরে থাক, উল্টো পাকি ভালোবাসায় মাতাল এক উন্মাদ প্রজন্মকে পেয়েছি। আমরা ‘ম্যারি মি, আফ্রিদি’ গলায় ঝুলিয়ে খেলার মাঠে যাই, পাকিস্তানের পতাকা তুলে খেলার মাঠে যাই। কেউ এ নিয়ে আপত্তি তুললে চরম বিরক্তি, ঘৃণা এবং ভ্রু কুচকে জবাব দেই, ‘ভাই, খেলার সাথে রাজনীতি মেশান কেন?”
আমাদের, এই স্বাধীন বাংলার দুই বারে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীও সন্দেহ প্রকাশ করেন আমার ৩০ লক্ষ শহীদ ভাইকে নিয়ে...
এই প্রজন্ম নির্লজ্জের মত তর্ক করে ৩ লক্ষ না ৩০ লক্ষ এই নিয়ে...
শহীদ বুদ্ধিজীবিরা এখানে হয়ে পড়েন ‘নির্বোধ’...
“৭১ এর পরে জন্মগ্রহণকারীরা ইতিহাস নিয়ে ঘাটতে পারবে না’ – বলে ফতোয়া দেয়া হয় এখানে...
এই কষ্টকে সঙ্গী করেই লেখাটা শেষ করব দুজন শহীদের লেখা চিঠি দিয়ে। শহীদ সোলেমান – সিলেটের বিশ্বনাথে জন্মগ্রহণ করেন, যুদ্ধ করতেন ৪ নম্বর সেক্টরে। ১৯৭১ এর ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানিরা তাকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করে।
“মা,
পত্রে আমার ভক্তিপূর্ণ সালাম গ্রহণ করবেন। আশা করি খোদার অশেষ কৃপায় সবাই ভালো। আমিও আপনাদের দোয়ায় ভালো আছি। মা আমাদের জন্য আপনাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। এবং আরো কষ্ট করতে হবে। আমার বিশ্বাস আমার মা কখনও এই কষ্টে ভেঙ্গে পড়বেন না।...
মা আজকে আপনার সবচেয়ে বড় গোরব যে, আপনার ছেলে সত্যিকারের দেশসেবার উপায় পেয়েছে। বিবরণ ভাই সাহেবের কাছ থেকে জানতে পারবেন। সত্যিকারের দেশ সেবা করে যদি প্রাণ বিসর্জন দিতে হয় সেটা ভালো। যাক আমার জন্য কোন চিন্তা করবেন না।, অদূর ভবিষ্যতেই দেখা হবে। আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনের আর বেশী বাকি নয়। ...
সম্ভব হলে পরে পত্র দেব। দাদাজীর কাছে আমার সালাম রইলো। বাড়ির অন্যান্যদের কাছে শ্রেণীমত সালাম রইলো।
ইতি
আপনাদের স্নেহের সোলেমান”
আরেক শহীদ মোঃসিরাজুল ইসলাম- কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল কলেজের ভিপি ছিলেন (ছাত্র ইউনিয়ন)। সুনামগঞ্জের সাচনা বাজারে তিনি পাকবাহিনীর হাতে শহিদ হন। ৩০/০৭/১৯৭১ এ বাবার কাছে লিখেছিলেন চিঠিটা।
“মৃত্যুর মুখে আছি। যে কোন সময় মৃত্যু হইতে পারে এবং সর্বদা মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত। দোয়া করিবেন মৃত্যু হইলেও যেন দেশ স্বাধীন হয়। তখন দেখবেন লাখ লাখ ছেলে বাংলার বুকে পুত্র হারাকে “বাবা বাবা” বলে ডাকবে। এই ডাকের অপেক্ষায় থাকুন...
দেশবাসী,স্বাধীন বাংলা কায়েমের জন্য দোয়া কর, মীরি জাফরী করিও না। কারণ মুক্তিফৌজ তোমাদের ক্ষমা করিবে না এবং এই বাংলায় তোমাদের জায়গা দেবে না।
ছালাম, দেশবাসী ছালাম।
ইতি
মোঃসিরাজুল ইসলাম”
বিঃদ্রঃ পেপারকাটিং গুলো বিভিন্ন সাইট থেকে নেয়া হয়েছে। পরের ছবিগুলো তাজুল মোহাম্মদের ‘সিলেটে গণহত্যা’ বইটা থেকে নেয়া। শেষের চিঠিদুটো দীপংকর মোহান্তর ‘চিঠিপত্রে মুক্তিযুদ্ধ’ নামক বই থেকে প্রাপ্ত। এবং ইংরেজী খবরের অনুবাদটুকু আমার নিজের করা।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধঃ দলিলপত্র থেকে বলছিনামক গ্রুপটাকে বিশেষ ধন্যবাদ, তাদের জন্যে দলিলগুলো আর টাইপ করা লাগে নি।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ১:০৭