এ আমাদের ব্লগের ভূয়া মফিজ না, সত্যিকার মফিজ। আমার সহপাঠী ছিল; তার গল্প।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ পর্যায়ে যখন থিসিস করতে হবে, তখন দুজন আমার থিসিসের পার্টনার হলো। একজনের নাম মফিজ, দারুন চৌকস, তাকে আমি আগে চিনতাম না। আরেকজন রাণা; একটু আলাভোলা টাইপ, আগে থেকেই আমি ভালভাবে চিনতাম। প্রথম দিন অধ্যাপক বুঝিয়ে দিলেন, আমাদের কি নিয়ে কাজ করতে হবে। অধ্যাপকের ঘর থেকে বের হয়েই মফিজ বলল,
-আমি ভাই বুঝি কম, কি করতে গিয়ে আবার কি গোলমাল লাগাই ফেলবো, তোমরা দুইজন মিলে কাজ করো, আমি পিছনে আছি। যেসব কাজ করতে বুদ্ধি লাগে না, যেমন ধরো নীলক্ষেতে গিয়ে কিছু প্রিন্ট করা, এইসব কাজ আমি করতে পারি।
এমন কুন্ঠিত মুখে বলল, শুনে আমি বললাম,
-ঠিক আছে, ঠিক আছে! আমি আর রাণাই করতে পারব।
হলও তাই, আমি আর রাণা দু'জনে মিলে তিনজনের কাজ করতাম, খুব খাটতাম।মফিজের দেখা কখনো পেতাম না। প্রতি বুধবার অধ্যাপকের সাথে দেখা করার কথা; তখন মফিজের দেখা দেখা মিলত। জিজ্ঞেস করত, এই এক সপ্তাহে আমরা কতদূর কি করলাম, বুঝে নিত। তারপর আমরা একসাথে অধ্যাপকের সাথে দেখা করতে যেতাম। সেখানে মফিজ সবজান্তার মত দু একটা প্রশ্ন করত, খুব মন দিয়ে অধ্যাপকের কথা শুনত, মনে হতো সব কাজ ও একাই করেছে!
একদিন কিসের জন্য জানি কোথাও আমাদের কিছু তথ্য দিতে হবে, সেটা দিতে গিয়ে দেখি মফিজের বয়স আমাদের দুজনের তুলনায় অনেক কম, অথচ ওকে বেশ বয়সী দেখায়! জিজ্ঞেস করলাম,
-তোমার বয়স এত কম মফিজ!!
-আরে না না। ভূয়া; এটাতো আমার আসল বয়স না! আমার নামও তো মফিজ না, ওটাও ভূয়া! আমাদের গ্রামের স্কুলে ক্লাস ফোরে যখন ভর্তি হতে গেলাম, আমার নাম ছিল তীতু মিয়া। স্যার বলল, "এটা ভালো লাগেনা, তোর নাম রাখলাম মফিজ মিয়া।" তারপর স্যারই একটা বয়স লিখে দিলো। নাইনে উঠে রেজিস্ট্রেশনের সময় আমি নাম লিখলাম, "মফিজুর রহমান", বয়সটা আরও একটু কমায় নিলাম। এসব বলে মফিজ খুব হাসলো, আমরাও খুব হাসলাম।
একসময় থিসিসের কাজ শেষ হলো। ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হবার দশ দিনের মধ্যে থিসিস জমা দিয়ে ডিফেন্স হবার কথা। এবার মফিজ সত্যিই কাজ করল অনেক। নীলক্ষেত থেকে সুন্দর করে থিসিস বাঁধিয়ে আনল জমা দেবার জন্য। অবশ্য এই বাবদে আমাদের দুজনের কাছ থেকে বেশ অনেকটা টাকা নিল; একটু খুঁত খুঁত করছিলাম,
এত টাকা লাগে! বলল,
- আমি বাবা যা তা করে কাজ করতে পারিনা। ভালো জিনিস বানাব, খরচ যা লাগে লাগুক!
কি আর করা! দিলাম টাকা। আমাদের ডিফেন্স হয়ে গেল। তখন দেখি আমার জন্য থিসিসের কোন কপি নেই।
-কি ব্যাপার মফিজ, আমি তো আমার কপির জন্য টাকা দিয়েছি! আমার কপি নেই কেন? তোমাদের তো আছে!
-স্যরি স্যরি! আসলে টাকা কম পড়ে গিয়েছিল তাই শুধু দুটো কপি করতে পেরেছি।
-তাহলে আমার কাছে আমার থিসিসের কোন কপি থাকবে না?
- কেন থাকবে না! কি যে বল না! আমি আজকেই তোমার কপি করে দিচ্ছি। কিন্তু আমার পকেটে একটাও টাকা নাই......তুমি প্লিজ এখন টাকা দাও। আমি হিসাব করে তোমার থেকে যা বাড়তি নিয়েছি সেই টাকা, আর তোমার কপি পরশুদিন নিয়ে আসব।
দিলাম টাকা। পরদিন মনে হল, রেজাল্ট আউট এর আগে আর বিশ্ববিদ্যালয় গিয়ে কি হবে, রেজাল্টের পরে ওর থেকে নিয়ে নিলেই হবে। রেজাল্ট আউট হবার পর যখন একের পর এক ক্লিয়ারেন্স নিচ্ছি, এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় দৌড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে তখন শুধু মফিজকে খুঁজছি, কোথাও দেখি না! হঠাৎ দেখি মফিজ, আমার থেকে বেশ খানিকটা দূরে। আমি চিৎকার করে বললাম,
- এই মফিজ, এই মফিজ! আমার থিসিস কই? ও তাড়াতাড়ি হাত নেড়ে ব্যস্ত ভাবে অন্যদিকে চলে গেল। আমি কিছুই বুঝলাম না।
তারপর প্রায় এক বছর কেটে গেছে। এর মাঝে আমি চেনা জানা অনেকের কাছে ওর খোঁজ করেছি। যাকেই আমি এই গল্প বলি, সেই শুনে হাসতে হাসতে মরে। মুখে বলে, "ইস! তুমি কি সরলমনা", সরলমনা যে বোকার প্রতিশব্দ তখনই আমি প্রথম শিখলাম!
ইতিমধ্যে আমি চাকরি করতে শুরু করেছি; একদিন অফিসের লিফটের সামনে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে আছি, ১১ তলায় যাব। হঠাৎ দেখি পাশের লিফটের লাইনে মফিজ! আমি যেই ওর দিকে তাকিয়েছি, সাথে সাথে দেখি লাইন ছেড়ে ও তাড়াতাড়ি সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে শুরু করেছে! ওর নাম ভুলে গিয়ে আমি "এই, এই" বলে ডাকতে লাগলাম, দেখি ও একবার তাকিয়ে আরও তাড়াতাড়ি উঠতে লাগলো। অন্য লোকেরা অবাক হয়ে আমাকে দেখছে; চুপ করে গেলাম।
কিন্তু এর পরের বার ও আর পালাতে পারলো না একদিন অফিসে কাজ করছি বসে, হঠাৎ করে দরজা খোলার আওয়াজে মুখ তুলে তাকিয়ে দেখি মফিজ ঢুকছে। ও বোধহয় জানতো না যে আমি এই অফিসে কাজ করি। ও-ও সেই মুহূর্তেই আমাকে দেখেছে! তৎক্ষণাৎ অ্যাবাউট টার্ন- মফিজ দরজা দিয়ে বের হয়ে গেল। কিন্তু এবার তো আমার নিজের অফিস, আমি দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে সামনে পিয়নকে দেখে বললাম,
- ঐ যে পালাচ্ছে! শিগগিরই একে ধরে আনো।
দুই মিনিট পরেই দেখি পিয়নের সাথে মফিজ আসছে। আমাকে দেখে খুব অবাক হয়ে বলল,
- আরে, তুমি এখানে! কত দিন পর দেখা হল বল তো?
- কত দিন পর দেখা মানে! কিছুদিন আগেই তো তুমি আমাকে দেখলে, আমাকে দেখেই লিফটের
লাইন ছেড়ে পালালে, আবার পালাতে পালাতে আমার ডাক শুনে সিঁড়ির থেকে আমার দিকে তাকালেও তো, ভুলে গেলে নাকি এত তাড়াতাড়ি?
- ও আল্লাহ! ওটা তুমি ছিলে নাকি? দেখে এতো কম বয়সী মনে হচ্ছিল! আমি তো ভাবলাম তোমার ছোট বোন হবে; ওটা তুমি ছিলে!! আশ্চর্য! এখনো অবশ্য তোমাকে ঠিক চিনতে পারছি না, আমাদের বয়স বাড়ছে, আর তোমায় দেখি বয়স কমছে! রহস্যটা কি?
- কোন রহস্য নাই। আমার থিসিসের কপি দাও। টাকাও তো কিছু পাই তোমার কাছে।
- ও, ভালো কথা মনে করেছ। কবে থেকে যে ওটা বয়ে বেড়াচ্ছি, তোমাকে তো আর পাই না। যাক, অবশেষে তোমাকে পাওয়া গেল! একসময় এসে দিয়ে যাব। তারপর, কেমন লাগছে চাকরি?
ভাবলাম, বেচারা আমাকে খুঁজে পায়নি; আমি মিছেমিছি ভুল বুঝেছি। এবার তাকে খাতির করে বসালাম। বলল,
- যা গরম! গলা শুকিয়ে গেছে। খুব ঠান্ডা কিছু খাওয়াতে পার? তোমার অফিসের নিচে দেখলাম কোয়ালিটি বেকারির শাখা। এদের চিকেন প্যাটিস নাকি খুব ভালো হয়?
ঠান্ডা কোক আর পেটিস খাওয়ালাম। বলল, দু'চারদিনের মধ্যেই একদিন সময় করে এসে আমার বহু কাঙ্খিত কপি খানা দিয়ে যাবে। আমি আমার বাসার ফোন নাম্বার আর অফিসের ফোন নাম্বার দিয়ে বললাম, আসার আগে যেন একটা ফোন করে নিশ্চিত হয়, আমি অফিসে এসেছি। ও বলল, ও একটা বাসায় সাবলেট থাকে। তাদের ফোন নাম্বার দিল; যদি আমি দু'চার দিনের মধ্যে কোন দিন অফিস কামাই করি, তাহলে যেন অবশ্যই ওকে ফোন করে জানিয়ে দেই। (এটা মোবাইল ফোন আসার বহু বছর আগের কথা)। তারপর আমি অপেক্ষা করি প্রতিদিন, একদিন- দুদিন করে ১৫ দিন কেটে গেল, মফিজ আসে না। ভাবলাম হয়তো অসুখ-বিসুখ করেছে। একদিন সেই নাম্বারে ফোন করলাম, ওপাশ থেকে জানালো, এটা লালমাটিয়া ফায়ার ব্রিগেডের নাম্বার।
আমার এক সহপাঠী ছিল আমার অফিসেই সহকর্মী। একদিন তাকে বললাম এইসব ঘটনা। আমি কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না, এই সামান্য জিনিস নিয়ে মফিজ কেন এত মিথ্যা কথা বলেছিল। আমার সেই সহপাঠী বলল,
- তুমি এত বোকা! বোঝনা, তোমার টাকা ও খেয়ে ফেলেছিল! কোনদিনই ও তোমার জন্য কোন কপি করে নি, একটা মিথ্যা ঢাকার জন্য একের পর এক মিথ্যা বলে গেছে।
বোকাদের নাকি মফিজ নামে ডাকা হয়। মাঝে মাঝে এই ঘটনার কথা মনে পড়ে, আর মনে মনে ভাবি, সত্যিকারের মফিজ যে কে.......
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই এপ্রিল, ২০১৯ সন্ধ্যা ৭:১৪