প্রথম শুরু হয়েছিল তার ৫৭ তম জন্মদিনের রাতে। প্রতি বছরে এদিনটিতে যেমন হয়, স্ত্রী নাজনীন আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন পরিবারসহ কয়েকজন কাছের বন্ধু বান্ধবকে; হৈ হুল্লোড় করে কেক কাটা, ডিনার, হাসি-গল্প সব হল। সবাই চলে যাবার পর নাজনীন রান্না ঘরে সব গুছাচ্ছেন, অধ্যাপক ডঃ শামীম উজ জামান আধ শোয়া হয়ে চোখ বুজে ভাবছিলেন ফেলে আসা জীবনের কথা। কতকাল আগে একবার মেলায় গিয়ে হারিয়ে গিয়েছিলেন..... একবার পুকুরে পড়ে প্রায় ডুবে যাচ্ছিলেন..... শৈশবের কত স্মৃতি..... কৈশোর, যৌবন........ হঠাৎই যেন তড়িতাহত হয় উঠে বসলেন ডঃ শামীম উজ জামান- জীবনের এতগুলো বছর কেন হারিয়ে গেল! হায় জীবনে কত কিছু করার ছিল, কিছুই তো করা হলো না, জীবন তো ফুরিয়েই এল! এই মুহূর্তে তার ভেবে খুব অবাক লাগলো, তিনি এতকাল যাবত নিজের জীবন নিয়ে সুখী ছিলেন কেন!! মেরিল্যান্ডের বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা, দুই মেধাবী পুত্র- কন্যা, আর পতিপ্রাণা সুন্দরী স্ত্রী নাজনীন- এই জিনিসগুলোই কি জীবনকে এমন গতানুগতিক, বৈচিত্র্যহীন করে তুলেছে !!
খুব অস্থির মন নিয়ে ডাঃ শামীম উজ জামান বেডরুমে চলে গেলেন। কাজ শেষ করে নাজনীন দুই কাপ কফি নিয়ে এসে দেখলেন, তার স্বামী ছাদের দিকে তাকিয়ে গভীর ভাবে কিছু ভাবছেন। নাজনীন কে দেখে উঠে বসলেন, হাত বাড়িয়ে কফিটাও নিলেন, কিন্তু তারপর কেমন শূন্য দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে থাকলেন। নাজনীন খুবই অবাক হলেন,
- কি হয়েছে তোমার?
- ঐ যে গানটা, "সখী বহে গেল বেলা....." ওটা খুব শুনতে ইচ্ছে করছে। দাও তো ওই গানটা, শুনি।
নাজনীন তার প্রশ্নের উত্তর পেলেন না, তবু গানটা দিলেন- সখী শামীম উজ জামান তন্ময় হয়ে গান শুনতে লাগলেন। মাত্র ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে কী হয়ে গেল.....শামীম উজ জামান এমন কেন করছেন..... মনে মনে তার উত্তর খুঁজতে খুঁজতে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলেন নাজনীন।
পরদিন সকাল থেকে শামীম উজ জামানের জীবনটাই যেন বদলে গেল; মনে হতে লাগলো, জীবনের হিসেবগুলো যেন মেলে নি, কোথায় যেন মস্ত একটা ফাঁকি রয়ে গেল! রোববারের সকাগুলোতে একটা আয়েশী ব্রেকফাস্ট হয়, নাজনীনের সাথে বেশ গল্পগাছা হয়, কিন্তু এদিনটা আর অন্য রোববারের মত হল না; শামীম উজ জামানের মন কি জানি কিসের ও লাগি কেবল হায় হায় করতে লাগলো....... উঠে স্টাডিতে গেলেন; এখন বেশ কিছুক্ষণের জন্য নিশ্চিত, নিজের মনকে কাটাকুটি করে বিশ্লেষণ করার সুযোগ পাবেন........উনি স্টাডিতে থাকলে কেউ বিরক্ত করে না........
মনে হল ফেসবুক খুলে দেখা যাক বন্ধুবান্ধবরা কেউ এমন ভাবে হা-হুতাশ করছে কিনা! অধিকাংশই তো তার বয়সী, জীবন ধারার সাথে অনেক মিলও আছে। খুলে দেখলেন..... কোথায় কি! ফেসবুকে সবাই যেন আনন্দ উচ্ছ্বাসে ভেসে যাচ্ছে; কখন কোথায় খেতে গিয়েছে তার ছবি, কখনো সাগরে- পাহাড়ে বেড়াবার সময়ের হাস্যোজ্জ্বল মুখের ছবি, কখনো পুত্র-কন্যার গ্র্যাজুয়েশনের সময়কার গর্বিত মুখের ছবি........তাতে লাইক কমেন্টের বন্যা বয়ে গেছে। বিরক্ত লাগলো শামীম উজ জামানের; এগুলি নিয়ে এরা ভুলে আছে!!!! বিরক্তি নিয়ে ফ্রেন্ডলিস্টের প্রত্যেকের নাম ধরে ধরে দেখতে লাগলেন; হঠাৎ একটা অন্যরকম জিনিস পেলেন! তার স্কুলের বন্ধু সোহরাব ফেসবুকে একটা কবিতা লিখেছে; বলছে, কবিতাটা নাকি কোন ব্লগে ছাপা হয়েছে! ব্লগ জিনিসটার সাথে শামীম উজ জামানের পরিচয় ছিল না; জিনিসটা বোঝার জন্য খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সোহরাবের ফেসবুকের সব পোস্ট পড়লেন; লিংক ধরে পৌঁছালেন সোহরাব যে ব্লগে লিখে, সেটাতে! ব্লগের নাম "হাতের মুঠোয় বিশ্ব", ব্লগাররা সংক্ষেপে বলে "হামু ব্লগ"। অবাক হয়ে গেলেন এটা ভেবে যে, এতদিন কেন এই হাতের মুঠোয় বিশ্বর সাথে তার পরিচয় হয়নি!! কি নেই এই মিনি বিশ্বে!! কত রকম বয়সের কত রকম মানুষের কতরকম যে মনের কত কথা!! রাজনীতি, ধর্মকথা, কবিতা, গল্প, ভ্রমণ কাহিনী, ইতিহাস, বিজ্ঞান, কূটকচালি- কি নেই হামুতে!! সব কিছু ভুলে শামীম উজ জামান হামুতে হারিয়ে গেলেন।
অপেক্ষা করতে করতে নাজনীন যখন শামীম উজ জামানকে লাঞ্চের কথা মনে করিয়ে দিতে আসলেন, তখন লাঞ্চের সময় প্রায় অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। ল্যাপটপ থেকে একটু মুখ তুলে জানালেন,
- লাঞ্চ খাব না। সময় নেই।
- না খেলে এত কাজ করবে কি করে? ঠিক আছে, আমি এখানেই এনে দিচ্ছি, খেয়ে নাও।
এত বেলায় একলা বসে লাঞ্চ করতে নাজনীনের একটু মন খারাপ হলো; ছুটির দিনে একসাথে গল্প করতে করতে লাঞ্চ করা বহু দিনের অভ্যাস......
নাজনীন কি একবারও ভেবেছিলেন, পরের কয়েক সপ্তাহ শামীম উজ জামান আরো বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়বেন! খাবার সময়টা অবশ্য দুজন একসাথেই খাচ্ছেন, সেই সময় শামীম উজ জামান বেশ কথাও বলছেন, কিন্তু বাসায় থাকা বাকি পুরো সময় ল্যাপটপ নিয়ে মগ্ন কি কাজ করতে থাকেন নাজনীন বুঝতে পারেন না! মাঝে মাঝে দেখেন, শামীম উজ জামান কাজের সময় মৃদু হাসছেন- নাজনীন বুঝতে পারেন, নিশ্চয়ই কাজে কোন একটা সফলতা এসেছে!
অবশ্য এই মৃদু হাসির রহস্যটা কেবল শামীম উজ জামানই জানেন; তার সকল হাসি- আনন্দের উৎস এখন হামু ব্লগ! সময় পেলেই ল্যাপটপ নিয়ে তিনি হামু ব্লগ খুলে বসেন; বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা নিয়ে ভাবতে তার এখন আর ভালো লাগে না! হামু ব্লগে রেজিস্ট্রেশন করেছেন কয়েক সপ্তাহ হলো, এখনো তিনি সেফ হন নি, অর্থাৎ ব্লগে লেখার অধিকার পাননি- কিন্তু তিনি অন্যের লেখা পড়ে আনন্দে আপ্লুত হচ্ছেন! ইতিমধ্যে নিজেও কবিতা লেখা শুরু করেছেন, সেটাও এক অন্যরকমের আনন্দ! নিজের কবিতাগুলো নিয়ে একটু কিন্তু কিন্তু আছে; হামুর ব্লগাররা পছন্দ করবে তো!! কোন একজন ভালো কবিকে দিয়ে একটু দেখিয়ে নিতে পারলে ভালো হত!
ভাগ্যের কি জোর, সহজেই এমন একজন কবি পেয়ে গেলেন। একদিন দেখেন তার বন্ধু ডঃ আলী রীয়াজের লেখা কবিতার উচ্চ প্রশংসা ফেসবুক জুড়ে। ডঃ রীয়াজ ঢাবিতে তার সমসাময়িক, আশির দশকের কবিতা লিখতেন, কিন্তু তারপর এতোকাল তো কেবল রাজনৈতিক বিশ্লেষণমূলক প্রবন্ধ/ গ্রন্থই তো লিখে আসছেন, তার কাব্য প্রতিভা হঠাৎ এমন বিকশিত হলো কি করে? ভাবতে ভাবতেই মনে পড়ল, ডঃ আলী রীয়াজের বর্তমান আবাসস্থল ব্লুমিংটনে ষাটের দশকে কবি বুদ্ধদেব বসু থাকতেন। হয়তোবা স্থান মাহাত্ম্য- ব্লুমিংটনের পরিবেশ হয়তো কাব্য প্রতিভা বিকাশের অনুকূল। দেরি না করে পরের উইকেন্ডেই শামিম উজ জামান উড়ে গেলেন ইলিনয়ের ব্লুমিংটনে, ডঃ আলী রীয়াজের কাছে। বন্ধুবৎসল ডঃ রীয়াজ তার কবিতার খাতা দেখলেন, অনেক কবিতা ঠিক করে দিলেন, অনেক কিছু শেখালেন। ফুরফুরে মন নিয়ে বাড়ি ফিরলেন শামীম উজ জামান!
অবাক কান্ড! দুদিন পরে দেখেন তিনি হামুতে সেফ হয়ে গেছেন। এবার শুরু করলেন কবিতা পোস্ট করা, প্রথমেই দিলেন যেটা পড়ে ডঃ রীয়াজ খুবই প্রশংসা করেছিলেন; ভাবলেন এটা পড়ে ব্লগাররা অনেক লাইক দেবে! একটু পর পর মোবাইলে চেক করেন কে কেমন মন্তব্য করল! মন্তব্য দূরে থাক, কেউ তার কবিতা পড়েই না! ২৪ ঘন্টায় পঠন সংখ্যা হল ২৮। খুবই মন খারাপ হলো শামীম উজ জামানের। তবু হতাশ হলেন না, প্রতিদিন নতুন নতুন কবিতা লিখেন, প্রতিদিন একটা করে কবিতা পোস্ট করেন, কিন্তু দেখা গেল কেউ তার কবিতা পড়ে না; ১৪ টা কবিতায় মন্তব্য এল ৯ টা! খুবই মন খারাপ হল- তিনি তো নিয়মিত অনেক কবিতায় মন্তব্য করেন, সেই কবিরা তো অন্তত তার কবিতায় মন্তব্য করতে পারে! আবার এও দেখলেন, তার পরে ব্লগে এসেও অনেক কবি আলোচিত, সেলিব্রিটি হচ্ছেন! এর রহস্য ভেদ করতে গিয়ে শামীম উজ জামান লক্ষ্য করলেন, কবির নাম যদি স্ত্রীবাচক হয় তবে অনেক পাঠক ও মন্তব্যকারী পাওয়া যায়! দুদিন ভেবে শামীম উজ জামান ঠিক করলেন যে, তিনি একটা মেয়ের নাম নিয়ে হামুতে রেজিস্ট্রেশন করবেন; একজন ভার্চুয়াল মেয়ে ব্লগার সৃষ্টি করবেন, আপন মনের সমস্ত মাধুরী মিশিয়ে তাকে তিনি রচনা করবেন........ এই ভাবনা শামীম উজ জামানের মনের সকল দুঃখ বহু দূরে হটিয়ে দিল.......
প্রথমে নাম ঠিক করতে হবে। মনের মধ্যে কয়েকটা নাম নিয়ে নাড়াচাড়া করলেন- রুমানা, মাহবুবা, সাবরিনা...... নাহ, কোনটাই ঠিক জুতসই হচ্ছে না। এমন একটি নাম দিতে হবে যেটা একটু অন্যরকম হবে, আধুনিক কিন্তু অপ্রচলিত। গল্প উপন্যাসে পড়া কয়েকজন নায়িকার নাম মনে পড়ল; শেষের কবিতার লাবণ্য খুব প্রিয় চরিত্র, কিন্তু তিনি যেমন ঝলমলে চরিত্রের সৃষ্টি করতে যাচ্ছেন তার সাথে শান্ত, আত্মস্থ লাবণ্য ঠিক মেলে না। সিনেমায় প্রিয় নায়িকার কথা ভাবলেন; সানফ্লাওয়ার দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন, সেই থেকে তিনি সোফিয়া লরেনের ভক্ত। কিন্তু সুফিয়া জামান নামটা যে বড্ড বুড়ি বুড়ি শোনাচ্ছে, এই ব্লগার তো হবে তরুণী.......নাহ্, এই নাম দেয়া যাবে না! এবার ভাবলেন তার তারুণ্যের প্রিয় টেনিস তারকাদের কথা। তখন খুব টেনিস খেলা দেখতেন; স্বর্ণকেশী স্টেফি গ্রাফ ছিল তার খুবই পছন্দের, দেখলেই মনে হতো রাজকন্যা! কিন্তু এই নাম তো বাঙালি মেয়ের হয় না! ভালো লাগতো সুঠামদেহী আর্জেন্টিনার গাব্রিয়েলা সাবাটিনিকে; কিন্তু এই নামও তো চলবে না। হঠাৎ মনে পড়ল মনিকা সেলেসের কথা, এর খেলারও ভক্ত ছিলেন খুব। হ্যাঁ..... এবার পাওয়া গেছে! মনিকা নাম দেওয়াই যায়, মনিকা জামান নামটা আধুনিক বাঙালি মেয়ের নাম হিসাবে চমৎকার হবে! চকিতে একবার মনে হল, কেউ আবার এই নাম শুনে মনিকা লিউনেস্কি ভেবে না বসে। নাহ্, তা ভাবার সুযোগ দেবেন না। মনিকা জামান হবে এমন চমৎকার এক তরুণী.......
হামু ব্লগে জন্ম হলো মনিকা জামান নামে নতুন এক ব্লগারের, সেফ হতে যার সময় লাগলো মাত্র চার দিন। সেফ হবার পর প্রথম পোস্ট কবিতা নয়, নিছক পরিচিতিমূলক পোস্ট; পোস্টের শিরোনাম, "আমি পথ ভোলা এক পথিক এসেছি", পোস্ট লিখলেন কিছু মনভোলানো কথা দিয়ে। দশ মিনিটের মধ্যে মন্তব্য আসা শুরু হল; পথ ভোলা পথিককে পথ দেখানোর জন্য কত চামেলী, মল্লিকা, অশোক, পলাশ এসে হাজির!
চলবে......
ছবি: অন্তর্জাল
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জুলাই, ২০১৯ দুপুর ২:০৪