১)
শহর কাকে বলে তা বোঝার আগেই আমি মাঝে মাঝে একটা শহরের স্বপ্ন দেখতাম; সেই শহরে দেখতাম আকাশের গায়ে হেলান দেয়া বাড়ি, সমুদ্র, জেটিতে লাইন দিয়ে রাখা নৌকা... বাড়িগুলো অদ্ভুত, আবার যে গাড়িগুলো শহরের রাস্তায় চলত সেগুলোও অদ্ভুত, ঘোড়া ছাড়াই সেই গাড়িগুলো চলত! আবার কখনো দেখতাম আকাশে রূপালী রঙের মাছের মত জিনিস ভাসছে, সেগুলো আবার পাখিও না!
অদ্ভুত এই স্বপ্নটা দেখতে খুব ভালো লাগতো। একদিন আমি বড়বোন মেরীকে বললাম স্বপ্নের কথা। মেরী শুনে বলল, হয়ত আমি স্বপ্নে প্রাচীন পৃথিবীর কোন ছবি দেখেছি; প্রাচীনকালের সেই সুন্দর পৃথিবী, যাতে নেমে এসেছিল ঈশ্বরের অভিশাপ; তারপর তা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। হয়তো কোন ভাবে আমার স্বপ্নে সেই ছবি আসছে...
অবশ্য একথা বলেই মেরী আমাকে সতর্ক করে দিল, আর কাউকে যেন এসব কথা না বলি। অন্য কেউ এ ধরনের কোন ছবি বা স্বপ্ন দেখেনা, সুতরাং তাদের কাছে এসব বললে বিপদ ঘটতে পারে! আমার বয়স অল্প হলেও, আমি মেরীর সতর্কবাণীর গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিলাম; আমাদের এই সমাজে কোন অস্বাভাবিকতা বা বিচ্যুতি সহ্য করা হয় না একেবারেই, আমার এই স্বপ্ন দেখা যদি অস্বাভাবিক কিছু হয় তবে আমার বিপদ হতে পারে। তাই আমি স্বপ্নের কথা আর কারো কাছে বললাম না। পরে অবশ্য স্বপ্নটা প্রায় ভুলেই গেলাম; বয়স বাড়ার সাথে সাথে এই স্বপ্ন দেখা আস্তে আস্তে কমেও আসছিল...
ভালোই হয়েছিল; মেরী স্বপ্নের ব্যাপারে সতর্ক না করলে হয়তো রোজালিনের সাথে আমার যোগাযোগের কথা কাউকে বলে বসতাম, আর তারপর দুজনেই মহা বিপদে পড়তাম! যোগাযোগের ব্যাপারটা আমরা দুজন ঠিকমতো বুঝতাম না, কিন্তু এটুকু বুঝতাম যে এটা স্বাভাবিক নয়। এমনিতে আমি নিজেকে স্বাভাবিক একটা ছোট ছেলে বলে ভাবতাম, আমার জীবনযাত্রাও স্বাভাবিকই ছিল। কিন্তু নিজেকে নিয়ে প্রথম সন্দেহ জাগে সোফীকে দেখার পরে।
সোফিকে প্রথম দেখেছিলাম বাঁধে খেলতে গিয়ে।আমার বয়স তখন বোধহয় দশ হবে। বাঁধটা ছিল আমার বাসা থেকে অনেকটা দূরে। সেখানে যেতে প্রথমে গরুর গাড়ি চলার পথ ধরে দক্ষিণ দিকে অনেকটা গিয়ে, তারপর অনেকগুলো মাঠ পেরোতে হত। এই বাঁধ নাকি প্রাচীন মানুষদের বানানো; এর উপর আমি অনেকবার উঠেছি, কিন্তু কখনও এর অন্য পাশে কি আছে দেখতে যাইনি, আমার মনে হতো সেটা একটা সম্পূর্ণ অপরিচিত জগত হতে পারে! বাঁধের এপাশে এক জায়গায় আমি একটা ছোট্ট শুকনা ঢালু নালা আবিষ্কার করেছিলাম। নালাটা এমন, এটা দিয়ে কিছুদূর গড়িয়ে নামলেই একসময় বাতাসের মধ্যে দিয়ে উড়ে গিয়ে নরম বালিতে পড়ে যাওয়া যেত।
সেদিনও আমি নালা বেয়ে গড়ানোর খেলা খেলছিলাম। যখন চতুর্থবার গড়াতে যাব, তখনই শুনি কেউ বলছে, "এই"! চারপাশে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেলাম না প্রথমে, তারপর দেখি একটা ঝোপের পাতাগুলো একদিকে সরে গিয়ে কোঁকড়া চুলে ঢাকা একটা ছোট্ট মুখ উঁকি দিল, মুখে উদ্বিগ্ন ভাব কিন্তু চোখ দুটো ঝিকমিক করছে। একটু সময় দেখে নিয়ে আমি উত্তর দিলাম "কি বলছ?"
কয়েক মুহূর্তের দ্বিধা, তারপরই ঝোপের ডালপালা সরিয়ে একটা ছোট মেয়ে বেরিয়ে এলো। দেখে মনে হল আমার চাইতে বয়সে ছোটই হবে, হলুদ জামা পরেছে, হলুদ ফিতা দিয়ে বাঁধা চুল, জামার সামনের দিকে একটা কাপড়ের ক্রস সেলাই করা। আমি অবাক হয়ে মেয়েটাকে দেখছিলাম। মাঝেমাঝে আমাদের কিছু অনুষ্ঠান হয়, যেখানে কয়েক মাইলের মধ্যে থাকা সব পরিবার একত্রিত হয়। কিন্তু এই মেয়েটিকে তো তাদের মধ্যে দেখি নি!
- "তোমার নাম কি?"
- "সোফি। তোমার?"
- "ডেভিড"। আমি বললাম, "তুমি কোথায় থাকো?"
- "ওইদিকে", হাত নেড়ে বাঁধের অন্য পাশে কোন্ দিকে দেখালো, কিছু বুঝলাম না।
আমার দিক থেকে চোখ সরিয়ে নালার দিকে তাকিয়ে বলল, " গড়িয়ে নামা খুব মজা, না?"
আমি একটু দ্বিধা করলাম তারপর বললাম, "হ্যাঁ, দেখবে একবার?" শুনে সোফি আমার দিকে তাকিয়ে অল্পক্ষণ কি জানি ভাবলো, তারপর মন স্থির করে দৌড়ের উপরে উঠে, নালা দিয়ে গড়িয়ে নামল। আমি দেখলাম ওর চোখ দুটো খুশিতে ঝকমক করছে! "আবার" বলে সে আবার গড়িয়ে নামল। কিন্তু তিন নাম্বার বার নামার সময় গোলমাল হয়ে গেল! বালির স্তুপ এর মধ্যে যেখানে পড়ার কথা, সেখানে না পড়ে সে বাঁদিকে কিছু দূরে পড়ল। আমি ভাবলাম, ও উঠে গেলেই আমি খেলা শুরু করব। কিন্তু দেখি সে বসেই রইল। আমি বললাম, "উঠে পড়ো", "পারছিনা তো... খুবই ব্যথা", সোফি বলল।
আমি ওর পাশে বসে ঝুঁকে দেখলাম; দেখি সোফির বাঁ পা বালুর নিচে দুটি পাথরের মাঝখানে আটকে গেছে। আমি চেষ্টা করে পারলাম না, সোফিকে বললাম, "তুমি পা মোচড় দিয়ে বের করার চেষ্টা করো!" সোফি কান্না চেপে পা বের করার চেষ্টা করল, কিন্তু তাতে ব্যথা শুধু বেড়েই যাচ্ছিল। একটু ভেবে আমি বললাম, "জুতার ফিতাটা কেটে পা জুতা থেকে বের করে নিয়ে আসো" সোফি আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলো, "না না না, এটা করা যাবে না"!
আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না কি করা যায়! জুতো খুলে পা বের করলেই জুতোটা বের করে আনা যেত...
এবার সোফি ব্যথায় ফোঁপাতে শুরু করলো।
চলবে??
==================================================================================
আশির দশকে আমেরিকা আর তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে শীতল যুদ্ধ চলছিল, দু'দেশের হাতেই ছিল অনেকগুলো পারমাণবিক অস্ত্র। ভুল মানুষের হাতে পড়ে এই অস্ত্রগুলো ব্যবহার হবার সম্ভাবনা ছিল; তাতে এক মূহুর্তের মধ্যে যে প্রলয় নেমে আসবে তার বিধ্বংসী রূপ নিয়ে নানারকম জল্পনা কল্পনা করা হত, ব্যবহৃত হত আইনস্টাইনের সেই বিখ্যাত উক্তি, "চতুর্থ বিশ্বযুদ্ধের অস্ত্র হবে মাটির ঢেলা।"
পারমাণবিক যুদ্ধের ভয়াবহতা নিয়ে তৈরি হয়েছিল সাড়াজাগানো টেলিফিল্ম, "The day after" view this link আমেরিকার ছোট, শান্ত শহর ক্যানসাসে পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণ হবার পর মূহুর্তে যে ধ্বংসের তান্ডব শুরু হয়, অধিবাসীদের উপর যে দুর্যোগ নেমে আসে, তা এই সিনেমায় দেখানো হয়েছিল। সেই সময়ে এই সিনেমা খুবই ভীতিকর বাস্তবতা বলে মনে হতো। "The day after" দেখার রেশ মন থেকে মিলিয়ে যাবার আগেই রাশিয়ার চেরনোবিলে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বিস্ফোরণ ঘটে, আর আমরা প্রত্যক্ষ করি পারমাণবিক বিস্ফোরণের ভয়াবহতা! এই সময়েই আমি "The Chrysalids" বইটা পড়ি; view this link এটা একটা বিজ্ঞান- কল্পকাহিনী। এই বইয়ে পারমাণবিক বিস্ফোরণের পরের পৃথিবীর কথা বলা হয়েছে; যেখানে জন্ম নেয় অনেক বিকলাঙ্গ মানুষ, প্রাণী ও উদ্ভিদ। পারমাণবিক বিস্ফোরণের কত বছর পর সেখানে প্রাণের বিস্তার ঘটেছে তা স্পষ্ট করে লেখক বলেননি, এমনকি পারমাণবিক বিস্ফোরণের উল্লেখও করেননি, কিন্তু পোড়া ভূমি আর তাতে বিকিরণের বর্ণনা দিয়েছেন তা স্পষ্টতই তেজস্ক্রিয়তার ফলে সৃষ্ট।
যখন রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা শুরু হয়, তখন এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ঝূঁকি নিয়ে অনেক লেখা পড়ি। আমি একটা পোস্ট দেই এ নিয়ে, তারপর আখেনাটেনও দেন। এরপর এ সংক্রান্ত আরো অনেকগুলো লেখা পড়ি; হাস্যোজ্জ্বল কিছু তরুণের ছবি দেখে উদ্বিগ্ন হই, যারা সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রে যোগ দিয়ে প্রশিক্ষণের জন্য রাশিয়ায় গেছে! বহুদিন আগে পড়া "The Chrysalids" বইয়ের কথা মনে পড়ে আমার, বইটা খুঁজে বের করে আবার পড়ি। সামুতে সকলের সাথে শেয়ারের জন্য কাহিনীটা নিজের মতো করে লেখা শুরু করি, তারপর লেখা বন্ধ করে দেই...কয়েকদিন আগে ব্লগার তানজির আহমেদ সিয়ামের চেরনোবিল নিয়ে লেখা সিরিজ পড়ে ইচ্ছা হল আমার লেখাগুলো ব্লগে দেই...
"Chrysalids" শব্দের অর্থ গুটির ভেতরে থাকা শুককীটের প্রজাপতিতে পরিণত হওয়া; বইয়ে পারমাণবিক দুর্যোগের কয়েকশ', বা হাজার বছর পরের এক এলাকার কয়েকজন মানুষের গল্প বলা হয়েছে যারা তাদের সমাজে গুটিয়ে থাকলেও শেষ পর্যন্ত পৃথিবীর অন্য প্রান্তে পোঁছে গিয়ে নিজেদের বিকশিত করতে পারে, প্রজাপতির মতোই। যুক্তরাষ্ট্রের সংস্করণে এই বইয়ের নাম Re-Birth বা নতুন জীবন। এই নামটাই আমার পছন্দ।
চেরনোবিল নিয়ে সামুতে প্রকাশিত কিছু লেখার লিঙ্ক, রূপপুর পাবিকে নিয়ে আমার আর আখেনাটেনের লেখার লিঙ্ক, আর আরো কিছু লিঙ্ক এখানে দিলাম।
১)চেরনোবিল: রূজেল
২)রূপপুরের জন্য চেরনোবিল দুর্ঘটনার বার্তা
৩) পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করে দিচ্ছে জার্মানি।view this link
৪)পারমাণবিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় গঠন হবে কোম্পানি। view this link অথচ আগে বলা হয়েছে পারমাণবিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করবে রাশিয়া!
৫) আখেনাটেনের পোস্ট: view this link
৬) আমার পোস্ট: view this link
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জানুয়ারি, ২০২০ দুপুর ২:৪৫