আগের পর্ব: নতুন জীবন- সতের
যন্ত্রযান ও আঠার সুতা
পেট্রা লড়াই দেখছিল না, একমনে কিছু শুনছিল। ডেভিডকে জিজ্ঞেস করল,
- কিসের এমন গমগম শব্দ হচ্ছে ডেভিড?
উত্তর এল যিল্যান্ডের মহিলার থেকে,
- এই শব্দে ভয় পেয়ো না পেট্রা, আমরা পৌঁছে গেছি!
যিল্যান্ডের মহিলা যে সত্যিই পৌঁছে গেছেন তাতে আর কোনো সন্দেহ ছিল না, কারণ একটা অদ্ভুত গমগমে আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল, আর তা ক্রমেই বাড়ছিল। এরই মধ্যে ডেভিড দেখল জঙ্গল থেকে আরো ঘোড়সওয়ার বেড়িয়ে খোলা জায়গায় জমা হচ্ছে, প্রান্তিক মানুষদের দিকে তীর ছুঁড়ছে, এদের অনেককেই ডেভিড জন্মাবধি চেনে, আজ তারা ছুটে এসেছেন ওকে হত্যা করতে...
এসব ভাবতে ভাবতে ডেভিড দেখল ঘোড়সওয়ারেরা উপর দিকে তাকিয়ে চিৎকার করছে। ডেভিডও সেদিকে তাকাল, দেখল কুয়াশার মত একটা আবরণে আকাশ ঢেকে গেছে, তারমধ্যে চমকাচ্ছে নানা রঙের বিদ্যুতের মতো আলো, সাদা চকচকে একটা প্রকান্ড মাছের মতো জিনিস কুয়াশার ভেতর দিয়ে দেখা যাচ্ছে! ডেভিডের মনে পড়ল ছোটবেলায় স্বপ্নে সে এরকম আকাশে ভাসমান মাছ দেখত!
আকাশ থেকে ক্রমাগত মাকড়সার জালের মতো হালকা সুতা ঝরে পড়ছিল, আর সবকিছু ঢেকে দিচ্ছিল। একটা মহা হুলুস্থুল শুরু হলো, ঘোড়াগুলো ভয়ে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পালাতে গিয়ে একটা আরেকটার উপরে পড়তে লাগলো... মানুষ চাপা পড়ছিল...ডেভিড মাইকেলকে ডাক দিলে মাইকেল সাড়া দিল, ডেভিড দেখতে পেল মাইকেল দাঁড়িয়ে আছে একটা পড়ে যাওয়া ঘোড়ার পাশে। মাইকেল গুহার দিকে তাকিয়ে ডেভিডদের দেখে হাত নাড়ল, তারপর বলল,
- আসছি এখুনি...
বলে গুহার দিকে আগাতে আগাতে বাম হাত দিয়ে ডান কব্জি থেকে ঝরে পড়া কিছু সুতা সরাতে গেল, কিন্তু হঠাৎ ভয়ে চিৎকার করে উঠল,
- এটা ভীষণ আঠালো, আমার হাত আটকে গেছে, নাড়তে পারছিনা!!
শান্তভাবে যিল্যান্ডের মহিলা মাইকেলকে বললেন যে ভয়ের কিছু নেই, ও যেন মাটিতে শুয়ে পড়ে, আর কোনরকম নড়াচড়া না করে। মাইকেল বাধ্য ছেলের মতো শুয়ে পড়ল, কিন্তু ওর মনের সংশয় স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। বাকি সব মানুষ শরীর থেকে সুতা সরানোর চেষ্টা করছিল, কিন্তু যেখানেই তাদের হাত লাগছিল সেখানেই হাত আটকে যাচ্ছিল! কেউ দৌড়ে পালাতে গেল, দু'পা যেতেই আঠালো সুতায় পা আটকে মাটিতে পড়ে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা গেল, সব মানুষ আর ঘোড়া মাটির সাথে আটকে গেছে, তখনো তাদের উপর অবিরাম সুতা ঝরে পড়ছে...
রোজালিন আর পেট্রা একটু ভেতর দিকে বসে বাইরে দেখছিল। হঠাৎ পেট্রা পরম নিশ্চিন্ত হয়ে "যাক,ওরা এসে গেছেন" বলায় ডেভিড দেখল, বড় মাছের মত জিনিসটা মাঠে এসে নেমেছে, আর গুহার খোলা মুখ দিয়ে ভেতরে হালকা সুতা ভেসে আসছে... আর কিছু দেখার আগেই ওর মুখের উপর সুতার হালকা ছোঁয়া টের পেল, দুই চোখ আঠালো সুতায় বন্ধ হয়ে গেল!!
ডেভিড চুপচাপ শুয়ে ছিল, কিন্তু অনবরত সুতা শরীরে জমা হওয়ায় ওর মনে হচ্ছিল ওর হাতে মুখে কেউ পাখির পালক দিয়ে সুরসুরি দিচ্ছে, আবার কিছুক্ষণ পরেই সুতাগুলো শক্ত হয়ে চামড়ায় ব্যথা করছিল। ডেভিড শুনল মাইকেল ভাবছে, এভাবে শুয়ে না পড়ে তাড়াতাড়ি পালিয়ে যাওয়া ভালো হতো। ডেভিড কিছু বলার আগেই যিল্যান্ডের মহিলা ওদের আশ্বস্ত করে ধৈর্য্য ধরতে বললেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই গমগমে আওয়াজ থেমে গেল, কোনরকম শব্দই শোনা যাচ্ছিল না। যিল্যান্ডের মহিলা মাইকেলকে বললেন এক,দুই করে গুনতে, যাতে উনি ওর কাছে পৌঁছাতে পারেন। মাইকেল সংখ্যার আকার পাঠাচ্ছিল, বারোতে পৌঁছাতেই ডেভিড দেখল সংখ্যার আকারের সাথে স্বস্তি আর কৃতজ্ঞতা মিশে গেছে, শুনতে পেল মাইকেলের কন্ঠ,
- ওরা ওই গুহায় আছে, ওই যে...
পরিচয় পর্ব
মইয়ের ক্যাচক্যাচ শোনা গেল, একটু পরে ডেভিড টের পেল ওর সারা গায়ে ভেজা কিছু ছেটানো হচ্ছে। চোখের আঠালো ভাব কেটে যেতেই ও চোখ খুলে দেখল মইয়ের শেষ ধাপে হাতে পিচকিরী নিয়ে যিনি দাঁড়িয়ে আছেন, চকচকে সাদা পোশাকে তিনি পুরোপুরি আবৃত, একটা স্বচ্ছ আবরণের ভেতর দিয়ে শুধু তার চোখ দেখা যাচ্ছে। তিনি গুহার ভেতরে ঢুকে রোজালিন আর পেট্রাকেও মুক্ত করতে লাগলেন, ওর পেছন পেছন ভেজা পোশাকে মাইকেল উঠে এল। ডেভিড বাইরে তাকিয়ে দেখতে পেল বড় মাছের মতো যন্ত্রের উপরের ঘূর্ণির মত জিনিসটা থেমে আছে, মাছের মধ্যে একটা খোলা দরজা দেখা যাচ্ছে। ফাঁকা জায়গার দৃশ্যপট পুরোপুরি বদলে গেছে, মনে হচ্ছে পুরো জায়গাটা অজস্র মাকড়সার জালে ঢেকে গেছে; কুটির, তাঁবু, মানুষ, ঘোড়া সব জালে আটকা পড়ে নিথর হয়ে রয়েছে।
বাইরে থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে ডেভিড ভেতরে তাকালো। রোজালিন আর পেট্রা মুক্ত হয়েছে, পেট্রার কৌতুহলী চোখ আগন্তুকের চকচকে পোশাকের উপর! তিনি হাতের দস্তানা আর মাথার আবরণ খুলে নিয়ে ওদের দেখতে লাগলেন, ওরা চারজনও গভীর বিস্ময়ে উনাকে দেখতে লাগলো, কারণ এত নিখুঁত সুন্দর মানুষ ওরা কখনো দেখেনি। যিল্যান্ডের মহিলা পেট্রার দিকে তাকিয়ে হাসলেন, উনার থেকে ডেভিডদের কাছে যে ভাবনা চিত্র এল তাতে আনন্দ, সন্তুষ্টি, কৃতিত্ব অর্জন, স্বস্তি, অনুমোদন, সর্বোপরি প্রবল বিস্ময় একাকার হয়ে ছিল। যিল্যান্ডের মহিলার এই ভাবনার সবটুকু পেট্রা ধরতে পারল না, ও একটু অস্বস্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল, কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই ও খিলখিল করে হেসে উঠায় ডেভিডের মনে হলো যিল্যান্ডের মহিলা আর পেট্রার মধ্যে কোনো বার্তা বিনিময় হলো, কিন্তু তা এমন স্তরের যে ডেভিড তা ধরতে পারেনি!
যিল্যান্ডের মহিলা পেট্রাকে উঁচু করে ধরলেন, পেট্রা উনাকে ছুঁয়ে দেখল। উনি পেট্রাকে নামিয়ে ওকে চুমু খেয়ে হাসলেন, তারপর বললেন,
- আমাদের এত কষ্ট করে আসা সার্থক হয়েছে! অনেক ঝামেলা হয়েছে অনুমতি পেতে... এর আগে এই দূরত্বের অর্ধেকও আমরা কেউ আসিনি... এতদূরে জাহাজ পাঠানো অনেক ব্যয়বহুল, এটা করে কতটা লাভ হবে তা নিয়ে সবার সন্দেহ ছিল... কিন্তু এত কষ্ট করে আসা সার্থক হয়েছে, আমরা অমূল্য রত্ন খুঁজে পেয়েছি।পেট্রা এত অল্প বয়সে, কোনরকম প্রশিক্ষণ ছাড়াই ওর ভাবনা পৃথিবীর একেবারে অন্য প্রান্তে পৌঁছে দিতে পারে, এটা অবিশ্বাস্য এক দক্ষতা!! প্রশিক্ষণ পেলে ওর দক্ষতা অনেক বেড়ে যাবে...ওকে প্রশিক্ষণ দেবেন আমাদের সেরা প্রশিক্ষকেরা... তারপর একসময় ও হবে সবার শিক্ষক...
যিল্যান্ডের মহিলা সোফির ডালপাতার বিছানায় বসে ওদের কিছুক্ষণ দেখলেন, তারপর পেট্রার হাত ধরে রেখে বললেন,
- একে অন্যকে সাহায্য করে তোমরা বহুদূর এসেছ, সেজন্য তোমাদের অভিনন্দন জানাই। আশাকরি আমাদের মাঝে নতুন জীবন শুরু করে তোমরা সুখী হবে, আমাদের থেকে তোমরা আরো অনেক কিছু শিখতে পারবে...
চল, এবার রওয়ানা হই।
মাইকেল উনাকে অনুরোধ করল ওয়াকনুকে গিয়ে রেচেলকেও তুলে নিতে। উনি একটু চিন্তিত হয়ে মাছ- যন্ত্রের ভেতরে থাকা কারো সাথে যোগাযোগ করলেন, তারপর মাথা নেড়ে বললেন,
- মাইকেল, আমি খুবই দুঃখিত, ওকে গিয়ে তোলার উপায় নেই, যদি পারতাম আমরা অবশ্যই ওকে নিতাম। কিন্তু আমরা আমাদের হিসাবের চেয়ে বেশি দূরত্ব অতিক্রম করে ফেলেছি... এই যন্ত্র চলে একরকম জ্বালানি দিয়ে, এখন যেটুকু আছে তাতে খুব সাবধানে গেলে আমরা ঠিকমতো পৌঁছাতে পারব। কিন্তু ওয়াকনুকে নামতে আর উঠতে বাড়তি জ্বালানি খরচ হবে, ফলে আমাদের ফিরতি যাত্রা শেষ করতে হবে মাঝপথে, হয়ত কোন সমুদ্রের উপরে...
উনি চুপ করলেন, সহানুভূতি আর ধৈর্য্য নিয়ে ওদের সময় দিলেন পরিস্থিতি বোঝার জন্য। সবাই চুপ করে বসে রইল, গভীর নিস্তব্ধতা নেমে আসায় ওরা লক্ষ্য করলো, বাইরের এতগুলো মানুষ আর প্রাণী কোন শব্দ করছে না! এর অর্থ বুঝতে পেরে রোজালিন কেঁপে উঠল,
- ওরা... ওরা কি সবাই মরে গেছে? আমি, আমি ভেবেছিলাম ওরা...
- হ্যা, ওরা মারা গেছে। প্লাস্টিকের সুতাগুলো শুকিয়ে ওদের অচেতন করেছিল, পরে মারা গেছে। তীরধনুক বা বর্শায় মৃত্যুর তুলনায় এই মৃত্যু কষ্টহীন।
রোজালিনের মতো ডেভিডও কেঁপে উঠলো, এইভাবে এত মানুষকে মেরে ফেলা ও মানতে পারছিল না। কিন্তু যিল্যান্ডের মহিলাকে একেবারে নির্বিকার দেখাচ্ছিল, ওরা দুজন মানতে পারছে না দেখে উনি বললেন,
- প্রাণী হত্যা কোন আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা নয়, তবু নিজে বাঁচার জন্য কখনো কখনো অন্যকে মারতে হয়... প্রান্তিক মানুষদের জীবন ছিল চরম কষ্টকর, তাদের জীবনে কোন আশা- আনন্দ ছিল না। এইরকম জীবন যাপনে যারা তাদের বাধ্য করেছিল, অর্থাৎ তোমার বাবারা, তারা অনেকটা সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ছিল, তোমরা তো সেটা দেখেছ! কিন্তু প্রকৃতির নিয়মই এটা, সর্বময় ক্ষমতার অধিকারীকেও একসময় যেতে হয়। তোমরা কি মহা টিকটিকির কথা শুনেছ? পৃথিবী থেকে তাদেরও চলে যেতে হয়েছিল।
তোমরা এদের জন্য দুঃখবোধ করছ, এদের মাঝে তোমাদের জীবন কেটেছে তাই এদেরকে তোমরা তোমাদের স্বজন বলে ভাবছ। কিন্তু আসলে ওরা তোমাদের স্বজন নয়, তোমরা ওদের চাইতে উন্নত প্রজাতির, তোমরা আমাদের মতো সম্মিলিত ভাবে ভাবতে পার, এই ক্ষমতা ব্যবহার করে আমরা একসাথে অনেক দুর্যোগ কাটাতে পারি, নতুন অনেক কিছু সৃষ্টি করতে পারি...
জীবনের প্রয়োজন অগ্রগতি, অগ্রগতির জন্য প্রয়োজন পরিবর্তনকে মেনে নেয়া, পরিবর্তনের বা বিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়ানো- এই সবই আমাদের জীবনের অংশ।
যে জীবন কোন ব্যতিক্রম বা পরিবর্তন গ্রহণ করতে পারে না সে জীবন স্থবির, এই স্থবিরতা জীবনের অগ্রগতি রোধ করে, অতএব যে মানুষেরা এমন স্থবির জীবন যাপন করে তারা আমাদের শত্রু... তাদের চলে যেতেই হবে। যদি এখনো তোমাদের মনে সংশয় থাকে, মনে করে দেখ এই মানুষগুলো অন্যরকম মানুষের সাথে কি আচরণ করার শিক্ষা তোমাদের দিয়েছিল! ভেবে দেখ, এই মানুষগুলো তোমাদের সাথে কী করতে যাচ্ছিল, কেন করতে যাচ্ছিল...
যিল্যান্ডের মহিলার কথা সবই ঠিক বলে মনে হচ্ছিল, তবু ডেভিড নিজেকে তার আত্মীয়স্বজনের থেকে আলাদা প্রজাতির বলে ভাবতে পারছিল না। কিন্তু পেট্রার দিকে চোখ পড়তেই ওর মনে পড়ে গেল কয়েকদিন যাবত সে পালিয়ে বেড়াচ্ছে, মনে পড়ে গেল অতীতের নানা স্মৃতি; পানিতে ভেসে থাকা হ্যারিয়েট খালার খোলা দুই চোখ, এ্যানের আত্মহত্যা, অত্যাচার করে হত্যা করা ক্যাথেরিন আর স্যালীর মুখ, বন্য জীবনে সোফির কষ্ট, ঘাড়ে তীর বিঁধে মাটিতে লুটিয়ে পড়া... পেট্রার জীবনও এদের জীবনের মতো যন্ত্রণাময় হতে পারতো, যদি যিল্যান্ডের মহিলা সাহায্য না করতেন...
মাইকেল
যিল্যান্ডের মহিলা যতক্ষণ কথা বলছিলেন, মাইকেল মুগ্ধ দৃষ্টিতে যন্ত্র- মাছ দেখছিল। কথা শেষ হবার পর ও পাথুরে মেঝের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ ভাবল, তারপর পেট্রাকে অনুরোধ করল রেচেলের সাথে যোগাযোগ করে ওকে জানাতে যে, মাইকেলরা সবাই নিরাপদে আছে। সেটা জানাবার পর মাইকেল ওর হয়ে রেচেলকে বলতে বলল যে, তিন চার দিনের মধ্যেই মাইকেল ওকে নিতে যাবে, এই সময়টা যেন রেচেল ধৈর্য্য ধরে থাকে, সতর্ক থাকে।
মাইকেলের কথা শুনে বাকিরা অবাক হল, এর অর্থ কি ও যিল্যান্ডে যাচ্ছে না! রোজালিন কিছু বলতে যেতেই মাইকেল ওকে থামিয়ে দিল, বলল যে রেচেলকে একা ফেলে রেখে ও যাবে না। রোজালিন জিজ্ঞেস করল,
- কিন্তু ওকে নিতে যাবে অর্থ কী? কোথায় নিয়ে যাবে?
- সে কথাই ভাবছিলাম! ধরা পড়ে যাবার ভয় সবসময় মাথায় নিয়ে আমরা ওয়াকনুকে থেকে যেতে পারি, অথবা এই ভয়াবহ প্রান্তভূমিতে পালিয়ে আসতে পারি... কিন্তু এর কোনটাই ভালো সমাধান না। রেচেলের কি একটা সুন্দর জীবন পাবার অধিকার নেই? আমি চেষ্টা করে যাব আমাদের জীবনকে সুন্দর করে গড়ে তোলার, সেজন্য আমরা সেখানে যাব এই যন্ত্র আমাদের যেখানে নিয়ে যেতে পারল না...
যিল্যান্ডের মহিলা চোখে সহানুভূতি নিয়ে মাইকেলের কথা শুনছিলেন। ওর কথা শেষ হতেই উনি বললেন,
- এটা অনেক দীর্ঘ পথ; তাছাড়া মাঝে মাঝেই দুর্গম, বিপদসংকুল এলাকা পড়বে!
- তা জানি, কিন্তু পৃথিবী তো গোলাকার, নিশ্চয়ই অন্যপাশ দিয়েও আপনাদের এলাকায় যাওয়া যায়।
- সেই পথ খুব কঠিন, বিপজ্জনকও...
- ওয়াকনুকও বিপজ্জনক! তাছাড়া আমি যখন এখন জানতে পেরেছি যে আমাদের মত অনেক মানুষ থাকে এমন এলাকা আছে, তখন সেখানে যাবার চেষ্টা আমাকে করতেই হবে।
- এই জ্ঞানই তোমার শক্তি মাইকেল! তুমি জানতে পেরেছ যে তুমি কোন বিকৃত, অস্বাভাবিক সৃষ্টি না, সুন্দর একটা জীবন তোমার নিশ্চয়ই হবে, আমাদের মাঝে। তুমি নিশ্চিত থেকো মাইকেল, তোমার জন্য আমরা অপেক্ষায় থাকবো...
নতুন জীবন
দরজাটা ধড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল। যন্ত্রটা প্রবলভাবে ঝাঁকুনি দেবার সাথে সাথে প্রচন্ড বাতাসের ঘূর্ণি উঠল, একটু পরেই মেঝেটা দুলে উঠলো, যন্ত্রটা মাটি ছেড়ে উপর দিকে উঠতে লাগলো, তারপর দক্ষিণ- পশ্চিমমুখী হয়ে যেতে থাকলো। পেট্রা একই সাথে আনন্দিত আর উত্তেজিত! মাইকেলের উদ্দেশ্যে বলল,
- কী অপূর্ব সুন্দর দেখাচ্ছে ওপর থেকে! যদি তুমি দেখতে মাইকেল! আমি মাইলের পর মাইল দেখতে পাচ্ছি, তোমাকে খুবই পিচ্চি দেখাচ্ছে।
নিচে একাকী দাঁড়ানো মাইকেল উপরে তাকিয়ে হাত নাড়ল, ওর ভাবনাও এসে গেল।
- এখন আমাকে দেখে তোমার পিচ্চি মনে হচ্ছে পেট্রাসোনা, কিন্তু যখন আমি তোমাদের কাছে পৌঁছাব তখন দেখবে আর একথা মনে হবে না!!
দীর্ঘসময় চলার পর ডেভিড একসময় ছেলেবেলায় দেখা স্বপ্নের দৃশ্য হুবহু দেখতে পেল! সেই নীল সমুদ্র রোদে ঝলমল করছে, জেটিতে বাঁধা সারি সারি নৌকা, তাতে নানা রঙের পালতোলা। সাদা রঙের বাড়িগুলোর মাঝে মাঝে বাগান আর পার্ক, সুন্দর রাস্তা, আরেকটা মাছের মতো যন্ত্র আস্তে আস্তে নিচে নামছে...
ডেভিডের মনে হচ্ছিল হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গিয়ে ও দেখবে আগের মত স্বপ্ন দেখছে!! ও রোজালিনকে জিজ্ঞেস করল রোজালিনও এসব দেখতে পাচ্ছে কিনা। রোজালিন মুগ্ধ স্বরে বলল,
- সত্যিই অপূর্ব ডেভিড! কখনো ভাবিনি এমন কিছু দেখব! কিন্তু তুমি কি কিছু শুনতে পাচ্ছ না? মনকে আরো ছড়িয়ে দিয়ে শোনার চেষ্টা কর... পেট্রাসোনা, এবার দয়া করে একটু চুপ কর, ডেভিডকে শুনতে দাও...
ডেভিডের মনে হলো ঝাঁকে ঝাঁকে মৌমাছির গুঞ্জন শুনতে পাচ্ছে, রোজালিনকে জিজ্ঞেস করল এ কিসের শব্দ!
- বুঝতে পারলে না ডেভিড, অসংখ্য মানুষ, সব আমাদের মত!
একটু সময় শুনে ডেভিড বুঝতে পারল রোজালিন ঠিকই বলেছে, ও বুঝতে পারল যে এসব স্বপ্ন নয়, সবই বাস্তব, কারণ আগে স্বপ্নে কখনো সাথে রোজালিন ছিল না! ডেভিড রোজালিনের ভাবনার সুখী, আনন্দিত আকার দেখতে পেল, সেই আনন্দিত রোজালিন খুশি হয়ে ডেভিডকে কিছু বলতে যেতেই মাথায় প্রচণ্ড ধাক্কা লাগল, দু'জনেই হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরলো! চারপাশে যেন প্রতিবাদের ঝড় উঠলো, আবারো পেট্রা অনিয়ন্ত্রিতভাবে তার আনন্দ- উত্তেজনা প্রকাশ করেছে, তাই এই ধাক্কা! পেট্রা লজ্জা পেয়ে সবার কাছে ক্ষমা চাইলো, তারপর বলল,
- ওফ্! কী দুর্দান্ত, সবকিছু...
রোজালিন হাসতে হাসতে বলল,
- এমন ধাক্কা দেবার জন্য এই প্রথমবার তোমাকে কোনোই দোষ দিচ্ছি না পেট্রা! সত্যি... সবকিছুই কী দুর্দান্ত!!!
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে এপ্রিল, ২০২০ রাত ৮:৪০