শিখাকে...
আমার পরম প্রিয় মানুষ ডোরা আপা আজ ভোরে মারা গেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন। উনি ব্লগার শিখা রহমানের মা। আজ মেঘলা বিষন্ন দিন গেছে, আমার মনও আকাশের মতো বিষন্ন হয়ে আছে।
ডোরা আপাকে প্রথম দেখার কথা খুব মনে পড়ছে। আমি আর আমার বন্ধু সুমি (অন্য নাম) পানি উন্নয়ন বোর্ডে যোগ দিয়েই ঠিক করলাম ডোরা আপাকে দেখতে যাব, কারণ উনি দেশের প্রথম নারী প্রকৌশলী। ডোরা আপা ছিলেন তখন তিস্তা ব্যারেজ ডিজাইনের নির্বাহী প্রকৌশলী। আমি আর সুমি ছিলাম আলাদা দুই অফিসে, দু'জনে একসাথে গেলাম ডোরা আপার অফিসে, বললাম, আপনাকে দেখতে এসেছি। "দেখতে!!" বলে উনি খুব হাসলেন, তারপর কত গল্প যে করলেন। আমাদের চাইতে এত সিনিয়র কিন্তু একটুও অহংকার নেই। ওনার অফিস থেকে বের হয়েই আমি আর সুমি ঠিক করলাম ডোরা আপার অফিসেই কাজ করতে হবে। ক'দিন পর দুজন আবার গিয়ে আবদার করলাম, আমরা আপনার সাথে কাজ করতে চাই। এভাবে ইচ্ছা মতো অফিস বদল করা যায় না, বিশেষ করে পাউবোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তিস্তা ব্যারেজ ডিজাইনে এত সহজে যোগ দেয়া যায়না। কিন্তু আমরা দুজন যোগ দিতে পারলাম, এটা সম্ভব হলো ডোরা আপার জন্যই কারণ নিজের কাজে দক্ষতার জন্য উনার এত সুনাম ছিল যে উনার কথায় আমাদের বদলি হয়ে গেল।
আমাদের অফিসটা ছিল আমরা সবাই রাজা ধরনের, কাজ না করার জন্য কখনো বকা খেতে হতো না বলে খুব ফাঁকি দিতাম, ডোরা আপা কিন্তু খুব কাজ করতেন। মাঝে মাঝে অফিসে আসতেন ডোরা আপার স্বামী আমিন ভাই। উনি পাউবো থেকে ইস্তফা দিয়ে নিজে ফার্ম করেছিলেন। ওঁরা দুজনেই খুব হাসিখুশি আলাপী, কত গল্প যে করতেন। আমরা মাঝে মাঝে ডোরা আপার বাসাতেও যেতাম। শিখাকেও ডেকে আনতেন ডোরা আপা, ও চুপচাপ বসে আমাদের কথা শুনত। ওকে লেখাপড়া থেকে উঠিয়ে আনা ঠিক না এটা আমাদের কখনোই মনে হতো না।
শিখা লেখাপড়ায় ভালো, চাকরি করা মায়ের মেয়ে লেখাপড়ায় ভালো করছে এটা অনেকেরই পছন্দ হতো না, অনেকেই ডোরা আপাকে ঠেস দিয়ে কথা বলতেন। আমিন ভাই মারা যাবার পর যখন অনেকে ডোরা আপার সাথে দেখা করতে গেছেন তখনও এক মহিলা ডোরা আপার সামনে বলে উঠলেন,
- মায়েরা চাকরি করলে ছেলেমেয়ে কখনো মানুষ হয়না। ডোরা আপা চুপ করে থাকলেন, আমি বললাম,
- শিখাকে দেখার পরও আপনি একথা বলেছেন! শিখা লেখাপড়াও করেছে, ভালো মানুষও হয়েছে!
সামুতে যাদের সাথে শিখার ভার্চুয়াল পরিচয় আছে তারা নিশ্চয় জানেন শিখা কতটা বিনয়ী। এটা ডোরা আপার শিক্ষা।
ডোরা আপা খুব ভালো স্ট্রাকচারাল ইন্জিনিয়ার ছিলেন। তিস্তা ব্যারেজের মত বিশাল প্রকল্পের অধিকাংশ ডিজাইন উনি করেছিলেন। এই প্রকল্পটি যদি ব্যর্থ না হতো (কেন ব্যর্থ হলো সেটা সেটা বলা যাবে না) তবে উত্তরাঞ্চলের অনেক মানুষ এর সুফল ভোগ করতে পারত। শুধু অফিসের কাজে না, ডোরা আপা সব কাজেই পারফেকশনিস্ট ছিলেন। উনার বাসা খুব সুন্দর করে সাজানো থাকতো, ইনডোর প্ল্যান্টসগুলোর পাতা এত চকচক করত যে আমি ভাবতাম এগুলো প্লাস্টিকের। শেষ যেবার উনার বাসায় গেছি তখনও দেখেছি সব কিছু সুন্দর সাজানো, কিন্তু দীর্ঘদিনের সংগী স্বামীকে হারিয়ে উনি কিছুটা চুপচাপ, কিন্তু আতিথেয়তায় বরাবরের মতই। আমি বিকালে গিয়েছিলাম, বললেন রাতের খাবার খেয়ে আসতে হবে। বললাম আমাকে তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে। উনি বললেন,
- চুপ! কোন কথা বলবে না, মাগরিবের নামাজ পড়েই খাবার দিয়ে দেব। খেয়েই চলে যেও তাড়া থাকলে।
ধানমন্ডিতে উনার বাসার কাছাকাছি অনেকগুলো খাবারের আস্তানা, উনি ফোন করে খাবার অর্ডার করতে গেলে আমি বাঁধা দিলাম, আমি উনার রান্না করা রুটি তরকারি খেতে চাইলিম। আমার জোরাজুরিতে উনি রাজি হলেন। উনি সবসময় সুন্দর করে টেবিল সাজিয়ে খেতে দিতেন, সেদিনও যখন সুন্দর বাসন, ম্যাট সাজাচ্ছেন তখন আমি জিজ্ঞেস করলাম,
- ডোরা আপা, আপনি একা বসে খান এভাবে টেবিল সাজিয়ে!!
বলেই বুঝলাম তার একাকীত্বর কথা মনে করিয়ে দিয়ে ঠিক করিনি। উনি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন, তারপর বললেন,
- আমি একেকবার একেক ঘরে নামাজ পড়ি, তাহলে আর ঘর খালি খালি লাগে না।
কথা বলতে বলতে একসময় বললেন,
- জানো, শিখা আজকাল গল্প লিখছে। আড়িপাতার বইয়ে ওর তিনটি গল্প ছাপা হয়েছে। ওর বাবার লেখালেখির অভ্যাস ছিল, ও সেটাই পেয়েছে।
ডোরা আপা উঠে গিয়ে আড়িপাতার বই এনে পাতা উল্টে শিখার গল্প বের করে দেখালেন, মনে হয় চাচ্ছিলেন আমি যেন শিখার গল্প পড়ি, কিন্তু আমার ইচ্ছা করছিল ওনার সাথে গল্প করতে। আমি শিখার গল্প পড়ার কোন আগ্রহ দেখালাম না। উনি কিন্তু বইটা ছাড়লেন না, আমার সাথে গল্প করতে করতে বইয়ের পাতা উল্টে তিনটি গল্পই একে একে বের করে গল্পের উপর খুব যত্ন করে হাত বোলাতে লাগলেন। আমার খুব অদ্ভুত লাগছিল, এমন কেন করছেন...
কেন করছিলেন বুঝলাম ক'মাস পরে, যখন আমার মেয়েও এমেরিকা চলে গেল। একদিন ওর টেবিল খালি করার জন্য আমি ওর পুরানো খাতার পাতা ওলটাচ্ছিলাম। হঠাৎ একসময় খেয়াল করলাম আমি খাতার পাতায় হাত বুলিয়ে যাচ্ছি, মনে হচ্ছিল দূরে চলে যাওয়া মেয়েটাকে ছুঁয়ে দেখছি... ডোরা আপার কথা মনে পড়লো, উনিও হয়তো সেদিন শিখার লেখা গল্প ছুঁয়ে শিখাকে স্পর্শ করছিলেন...
অবশ্য শিখার গল্প পড়েছি পরে,সামুতে। শিখা রহমান নাম দেখেই মনে পড়ল, "শিখা আজকাল গল্প লিখছে।" বেশ আগ্রহ নিয়ে পড়লাম, ভেবেছিলাম ডোরা আপাকে বলব শিখার গল্প আমি পড়েছি, কিন্তু কথাটা আর বলা হয়নি...
জিজ্ঞেস করেছিলাম, "একা একা থাকেন... শিখার কাছে চলে যান না কেন!" বলেছিলেন, "এমেরিকা বেশিদিন ভালো লাগে না যে!"
একই মাইক্রোবাসে করে আমরা অফিস যেতাম, পুরো পথ ডোরা আপা অনেক রকম গল্প করতেন, আমরা মন দিয়ে শুনতাম। আজকে মনে হচ্ছে শিখার গল্প বলার এই গুণ ডোরা আপার থেকেও হয়তো পেয়েছে। আমার বন্ধু সুমি যতদিন ছিল দু'জনে খালি ভাবতাম, ডোরা আপা কী করে এত কাজ করার পরও এমন পরিপাটি করে সাজতে পারেন। উনি গাড়িতে উঠতেন সবার আগে, সাড়ে ছয়টায় কারণ উনি বনানীতে পাউবোর কোয়ার্টারে থাকতেন আর গাড়ি সেখানে থাকত। আমরা ভেবেই পেতাম না, এত সকালে উনি বাসার সবকিছু ঠিকঠাক করে, রান্নার ব্যবস্থা করে হাজার সময় কোথায় পান!
সুমি বিদেশে চলে যাবার পর আমার জুনিয়র একটা মেয়ে জয়েন করেছিল, একদিন ডোরা আপা যখন তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে চারতলায় উঠছেন, আর আমরা জিরিয়ে জিরিয়ে, তখন ও বললো,
-ডোরা আপা যেন মহারানী, আর আমরা ফকিরনী, তাই না আপা?
একমত না হয়ে উপায় কী!! ডোরা আপা এত মেধাবী, স্মার্ট- কথায় আর পোশাক আশাকে যে আমরা উনার ধারে কাছেও যেতে পারিনা। ডোরা আপা যে শাড়ি গুলো পড়তেন সেগুলোও আলাদা রকম, অন্যরকম সিল্কের শাড়ি যেগুলোর মতো কোথাও দেখিনা। একদিন জিজ্ঞেস করেই ফেললাম,
- এসব শাড়ি কোথায় পান ডোরা আপা?
- নিজে বানাই। কোন শাড়ি একটু পুরানো হলেও জরিরপাড়- আঁচল নতুন থাকে। আমি সেই পাড় আঁচল সিল্কের থান কাপড়ে বসিয়ে নতুন শাড়ি বানাই।
শুধু শাড়ি না, উনি সবরকম সেলাইয়ে দক্ষ ছিলেন। একদিন একটা বাচ্চা মেয়েদের জামায় এপ্লিকের ডিজাইনের বই দেখে জিজ্ঞেস করলাম এটা কিসের। বললেন দেশে শিখাকে ছোট রেখে থাইল্যান্ডে এআইটিতে পড়তে গিয়েছিলেন। সেখানে সস্তায় থান কাপড় পাওয়া যেত, উনি প্রতিদিন আধা গজ কাপড়ের উপর এপ্লিক করে শিখার জন্য জামা বানাতেন। এসব করে পড়াশোনা কখন করতেন জানিনা, কিন্তু এআইটিতেও ভালো রেজাল্ট করেছিলেন।
অফিসের যার যতরকম সমস্যা আছে সবাই সেসব নিয়ে সমাধানের জন্য উনার কাছে যেতেন, উনিও সবসময়ই সাহায্য করতে থাকতেন। অফিসের সবার উনি আপনজন, তাই পিয়ন থেকে শুরু করে সবাই উনাকে ডোরা আপা বলত, বড়জোর খালেদা আপা। ওনাকে ম্যাডাম বলতে কাউকে শুনিনি। উনার নাম ছিল খালেদা শাহরিয়ার কবির, ডাকনাম ডোরা, সেই নামেই সবাই চিনতো।
এদেশে মেয়েদের প্রকৌশল শিক্ষার পথিকৃৎ ডোরা আপা। ১৯৬৪ সালে উনি সহ তিনজন মেয়ে অনেক চেষ্টার পর প্রকৌশল পড়ার অনুমতি পান, এক্ষেত্রে উনি অগ্রনী ভূমিকা নেন, কারণ উনার বাবা ছিলেন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। ডোরা আপা শুরু না করলে হয়তো মেয়েদের প্রকৌশল পড়া শুরু হতে হয়তো দেরি হতো...
দুমাস আগে ওনার মুখে ক্যানসার ধরা পড়ে। চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হয়ে করোনায় আক্রান্ত হন। উনি সবসময় করোনা থেকে সাবধানতা অবলম্বন করতে বলতেন, একবার আমাকে এমন এক মেসেজে পাঠালেন, "সরকারের কাছে আপনি শুধু একটা সংখ্যা, কিন্তু প্রিয়জনদের কাছে আপনি পুরো পৃথিবী।"
অথচ ডোরা আপা নিজে আক্রান্ত হলেন কোভিডেই, মারা গেলেন, শিখার পৃথিবী শূন্য করে দিয়ে।
প্রিয়জনের মৃত্যুতে মনখারাপ করে পোস্ট দেয়াতে কেউ খোঁচা মারা মন্তব্য করেছেন আগে। দয়া করে এটা এই পোস্টে করবেন না।
/