somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গত শতাব্দীতে মেয়েদের সেলাই।

১৪ ই মে, ২০২৩ সকাল ৭:০৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



আমার মা আর নানীর সময়ের গৃহসজ্জার প্রধান উপকরণ ছিল নানাধরণের সূঁচিশিল্প। বিভিন্ন ধরণের কাপড়ে, বিভিন্ন রঙের সুতা ব্যবহার করে তারা যে শিল্পকর্ম করতেন, এযুগে এমনটা আর দেখা যায় না। বিছানার চাদর, বালিশের ওয়াড়, টেবিল ঢাকা কাপড়, ড্রেসিং টেবিলের আয়নার কাপড়, সোফার পিঠের, রেডিও ঢাকার কাপড়ের উপর তাঁরা রঙিন সুতোয় ফুটিয়ে তুলতেন ফুল লতাপাতার ছবি। আবার এই কাপড়গুলোর ধার মুড়ে বোতাম ঘর সেলাই করতেন, যাতে কাপড়টির স্থায়িত্ব বাড়ে এবং দেখতেও সুন্দর দেখায়! সেলাই দেখেই বাড়ির গৃহিণীর রুচির পরিচয় পাওয়া যেতো। কোনো বাসায় গেলে যদি দেখা যেতো ক্যাটক্যাটে লাল জবা ফুল আর ক্যাটক্যাটে সবুজ পাতার সূঁচিকর্ম, তখন বোঝা যেতো গৃহিণীর রুচি বড় চড়া ধরনের। আবার সূঁচিকর্ম যদি হতো স্নিগ্ধ রঙের সুন্দর শেড সুতা দিয়ে করা, তাহলে বোঝা যেত গৃহিণী রুচি স্নিগ্ধ ধরনের!

এই ধরণের সূঁচিকর্মকে বলা হয় এমব্রয়ডারি, আমার নানী বলতেন "এম্বডারি"। আবার এমব্রয়ডারিরও আলাদা নাম আছে যেমন ভরাট সেলাই(সাটিন স্টিচ), চেইন স্টিচ, লেজিডেজি, হেরিং বোন, শ্যাডো ওয়ার্ক, ফ্রেন্চ নট, গুজরাটি স্টিচ ইত্যাদি। সেলাই গুলোর নাম যেহেতু ইংরেজি, তাই মনে হয় এগুলো বিলাত থেকে এদেশে এসেছে। কিন্তু কিভাবে বিলাতি সেলাই এদেশের ঘরে ঘরে ঢুকে পড়লো তা জানিনা, এ জীবনে আর জানাও হবে না।

এই সেলাই করা হতো যে সুতা দিয়ে সেগুলো ছিল বিলেতি, তার নাম ছিল লাসি সুতা। সুতার লাসিতে কাগজের ট্যাগ লাগানো থাকতো, তাতে একটা নাম্বার দেয়া থাকতো সুতার রং বোঝাতে। সেলাই করতে করতে সুতা শেষ হয়ে গেলে সেই নাম্বার অনুযায়ী রং মিলিয়ে আবার সুতা কেনা যেত।

এমব্রয়ডারি যদি বিদেশী ধরণের সেলাই হয়, তবে কাঁথা সেলাই আমাদের দেশের আদি এবং খাঁটি দেশী ধরণের সেলাই। আজকাল এই সেলাইকে বলে কাঁথা স্টিচ। এও সূঁচ সুতার এক আশ্চর্য শিল্প কর্ম! কোন রকম নকশা না এঁকেই কাঁথার উপর জীবনের নানা ছবি এঁকে চলতেন গৃহিণীরা। কাঁথা সূঁচিকর্মের কদর আগে তেমন ছিল না, এখন বেড়ে চলেছে। কাঁথা সেলাইয়ের জন্য রঙিন সুতা গৃহিনীরা কিনতেন না, বলা যায় কেনার পয়সা থাকতো না। তাঁরা পুরানো শাড়ির পাড়ের সুতা খুলে আলাদা আলাদা রঙের গুটলী বানিয়ে রাখা রাখতেন পরে সেই সুতা দিয়ে কাঁথা সেলাই করতেন। সে সময় আজকের মতো নানাধরণের শাড়ি ছিল না, মহিলারা পরতেন একরঙা জমিনে সুতার নকশী পাড় শাড়ী, তাই সুতা সহজেই সংগ্রহ করা যেত। এই নকশী পাড় দিয়ে আবার জায়নামাজও তৈরি করতেন তারা, কারণ সেসময় আজকালকার মতো মখমলী জায়নামাজ পাওয়া যেতো না। বিভিন্ন রঙের, বিভিন্ন নকশার পাড় জোড়া দিয়ে সুন্দর নকশার জায়নামাজ তৈরি হতো। এই ধরণের জায়নামাজের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম, আমার মায়ের মৃত্যুর পর একদিন মায়ের আলমারির এককোণে একটা শাড়ির পাড়ের জায়নামাজ দেখে মনে পড়লো, একসময় আমাদের মত মধ্যবিত্ত বাড়িতে বেশিরভাগ এধরণের জায়নামাজই থাকতো...

নকশী কাঁথা সেলাইয়ে ফিরি। আমার মা বা নানী নকশি কাঁথা শিল্পে পারদর্শী ছিলেন না, তাই এই অত্যাশ্চর্য জিনিসটি কীভাবে তৈরি হতো সে সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই।

কাট ওয়ার্ক বলে এক ধরনের সেলাই ছিল, যেখানে বোতাম ঘর নামের সেলাই দিয়ে ফুল লতাপাতা আঁকা হতো কাপড়ে। তারপর এর মাঝ থেকে কিছু কিছু কাপড় কেটে নেয়া হতো। এটাও সম্ভবত আমদানিকৃত সেলাই। আজকাল আর হাতে করা কাট ওয়ার্ক সেলাই দেখতে পাই না।

ক্রস স্টিচ নামক সেলাই দিয়ে খুবই সুন্দর বিছানার চাদর হতো। "সেলুলা" নামে একধরনের ফুটাওয়ালা কাপড় পাওয়া যেত, অনেকটা চটে যেমন ফুটা থাকে, তেমনি। এই কাপড়ে ক্রস সেলাই দিয়ে সুন্দর সব ছবি আঁকা হতো চাদরে।

ক্রস স্টিচের ছবি আঁকা হতো গ্রাফ পেপারে, সেই ছবি দেখে ঘর গুনে গুনে সেলাই করতে হতো। এটা বেশ কঠিন কাজ, কিন্তু এই সেলাই এত সুন্দর যে সেলাই শেষ হলে মনে হতো পরিশ্রম সার্থক হয়েছে!

এমব্রয়ডারির নকশার বই কিনতে পাওয়া যেত নিউমার্কেটে, কিন্তু আমার মা এই অহেতুক খরচ করতেন না। ফুল পাতা আঁকতে পারে এমন কাউকে দিয়ে মা কাগজের উপর ছবি আঁকিয়ে নিতেন, এটা সযত্নে রেখে দিতেন এমব্রয়ডারির নকশা হিসেবে ব্যবহার করার জন্য। সেই কাগজের নিচে কার্বন পেপার তার নীচে কাপড়, এভাবে রেখে নকশার উপরে পেন্সিল ঘুরিয়ে নিলেই কাপড়ের উপর কার্বনের দাগে নকশা ফুটে উঠতো, তারপর সেলাই করলেই ফুল পাতা... কার্বন পেপারও পয়সা খরচ করে কিনতেন না, আব্বার অফিসের টাইপ রাইটারে ব্যবহৃত কার্বন পেপার সংগ্রহ করে ব্যবহার করতেন।

আজ আর সেই টাইপ রাইটার নেই অফিসে, কার্বন পেপারও নেই, সেই এমব্রয়ডারি করার মানুষগুলোও নেই...

এসব ছাড়াও আরেক ধরণের সূঁচিশিল্পের চল ছিল নানীর সময়ে, যা পরবর্তীতে আর দেখা যায় নি। কাপড়ের উপর সূঁচিশিল্পের মাধ্যমে কোনো দার্শনিক উক্তি লেখা হতো, তারপর তাকে ফ্রেম করে ঘরের দেয়ালে ঝুলিয়ে দেয়া হতো। এর উদ্দেশ্য কী ছিল গৃহিণীর সূঁচিশিল্পে নৈপূণ্য প্রদর্শন, নাকি গৃহিণীর দার্শনিক মনের প্রকাশ করা, সেটা বুঝতে পারিনি। আমার নানাবাড়িতে ফ্রেমে বাঁধানো নানীর সেলাই করা এই বাণীটি ছিল:

"হৃদয় বোঁটায় আর ফোঁটে না,
ঝরলে পরে আয়ুর ফুল।"

অনেক ভেবেও এই বাক্যের অর্থ উদ্ধার করতে পারিনি, কিন্তু নাম- দেশ- ফুল- ফল খেলায় ফুলের নাম হিসেবে "আয়ু" লিখতাম। কেউ সন্দেহ পোষণ করলে বিপুল প্রতাপে জানাতাম যে এটা আমার নানীর পরিচিত ফুল, অবশ্যই আয়ু নামে ফুল আছে!

অনেক পরে বুঝতে পেরেছি, লেখার ওপর সূঁচিশিল্প নানীর করা হলেও, লেখাটা নানীর না! নানীর হয়তো আমার মতোই এর অর্থ বুঝতে পারেননি।

আরেক ধরণের সেলাই তাঁরা করতেন, তার নাম রিফু সেলাই। শক্ত পোক্ত কাপড় যদি কোনো কিছুতে খোঁচা লেগে ফেঁসে যেত, তাহলে সেই কাপড় বাতিল করে না দিয়ে, সেই কাপড় থেকে কিছু সুতা নিয়ে সোনামুখী সুঁই নামক সরু সুঁই দিয়ে ছেঁড়া জায়গা এমনভাবে রিফু সেলাই করা হতো, যে বোঝাই যেত না কোনো ছেঁড়া ছিল। আমি অবশ্য রিফু সেলাইয়ে পারদর্শী নই, আর এখন তো ছেঁড়া কাপড় বাতিল করে দেয়াটাই দস্তুর, কে আর এখন ছেঁড়া কাপড় রিফু করে! রিফু নামে কোনো সেলাই আছে তাই এখন কেউ জানে না।

আমি এইসব সেলাই খুব ভালো পারতাম না, কিন্তু অন্য একটা সেলাই খুব পারতাম, যা আমার মা বা নানী কখনো করেননি। এই সেলাইয়ের নাম স্মকিং। আমি নিজের জন্য আর পরে ছোটমেয়েদের জন্য স্মক করা জামা অনেক বানিয়েছি।

এতক্ষণ যে এতরকম সেলাইয়ের কথা বললাম সেগুলো আমি নিজে না করলেও চোখে দেখেছি, নামও জানি। কিন্ত আমার মেয়ে এসব কিছুই জানে না। স্কুলের সেলাই ক্লাসের জন্য ছাড়া সে কখনো কোন সেলাই করেনি। তাই বলা যেতেই পারে, আমাদের চার প্রজন্মের মধ্যে আমিই শেষ যে কিনা হাতে সেলাই করতো!! এখন তো হাতে এমব্রয়ডারির যুগ শেষ, চলছে মেশিনে এমব্রয়ডারির যুগ।

মেশিনের কথায় মনে পড়লো, আমার মা-নানীর সময়ে মেশিনে সেলাই করাটা মহিলাদের অবশ্য কর্ম ছিল। তাঁদের সময় পুরুষদের পরিধেয় কাপড় বাদে বাড়ির আরও সমস্ত কাপড় তাঁরা সেলাই মেশিন দিয়ে সেলাই করতেন। কী সেলাই করতেন? বালিশের ওয়াড়, পর্দা, টেবিল ক্লথ, পরিধেয় পোষাক আরো অনেক কিছু। সেলাই মেশিনে সেলাই করে বাঙালি মধ্যবিত্ত ঘরের নারীরা সংসারে অনেক সাশ্রয় করতেন। পুরোনো দিনের সিনেমাতে প্রায়শই সেলাই মেশিনের দেখা মিলতো, বাড়ির দশভুজা নারীটি একহাতে সংসারের সমস্ত কাজ শেষে বাড়তি রোজগারের জন্য মেশিনে সেলাই করে চলেছেন এমন দৃশ্য থাকতো সিনেমায়। মেশিনে সেলাইকারী হিসেবে শাবানা রয়েছেন প্রথম স্থানে। আবার সত্যজিৎ রায়ের "মহানগর" ছায়াছবিতে দেখা গেল বাড়ি বাড়ি গিয়ে সেলাই মেশিন বিক্রি করছেন মাধবী মুখোপাধ্যায়।

আমার নানীর ছিল সিঙ্গার পা মেশিন, আমার মায়ের ঊষা কোম্পানির হাত মেশিন। সেই মেশিনে আমি দীর্ঘদিন নিজের পোশাক সেলাই করেছি, দর্জির খরচ বাঁচানোর জন্য। নিজের সংসারে আমি কিনেছিলাম একটা ব্রাদার ইলেকট্রিক সেলাই মেশিন, যাতে বিভিন্ন ধরনের এমব্রয়ডারি করা যেত। অবশ্য সেই মেশিনে সেলাই বেশিদিন করিনি, কারণ ততোদিনে দর্জির খরচ বহন করার মতো স্বচ্ছলতা এসেছে আমার, আবার অনেক বুটিক শপে পছন্দনীয় পোশাক পাওয়া যায়, সর্বোপরি সময়ের অভাব। বালিশের ওয়াড়, পর্দা এইসবই এখন বাজারে এতটাই সহজলভ্য যে, এখন কেউ ভাবতেই পারবে না একসময় এইসব জিনিস কেউ বাড়িতে সেলাই করতো!! আজকাল তো কেউ এসব সেলাই করে না; আমার মেয়ে একবারও সেলাই মেশিনে সেলাই করেনি, সেই অবকাশ অথবা আগ্রহ তার কখনোই হয়নি। অর্থাৎ সেলাই মেশিন ব্যবহারকারী আমিই ছিলাম শেষ প্রজন্ম!

অথচ আমাদের ছাত্রাবস্থায় মনে হয় শুধু আমাদের দেশে নয়, বিদেশেও আমাদের মতোই সেলাই মেশিন ব্যবহৃত হতো। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার এক বান্ধবী ছিল খুবই ফ্যাশন সচেতন, সে আড়ংয়ের ডিজাইনারও ছিল। সে বিলাত থেকে একধরনের কাগজ আনতো যেটা কাপড়ের উপর ফেলে ইস্ত্রি করলে কাপড়ে দুই লাইন দাগ পড়তো, একটা দাগ বরাবর কাপড় কেটে নিলে মাপ মতো পোশাক কাটা হতো, আরেকটা দাগ বরাবর সেলাই করলেই পোষাক তৈরি হয়ে যেত। মনে হয় বিলাতেও এমন মানুষ ছিল যারা এই কাগজের সাহায্যে কাপড় কেটে ঘরে বসে সেলাই করতো। আমার এই বান্ধবী ছিল উচ্চবিত্ত পরিবারের, সে নিজের পোশাক সেলাই করতো দেখে আমার মনে হয়, সেটা একটা সময় ছিল যখন এদেশে মধ্যবিত্ত উচ্চবিত্ত নির্বিশেষে অধিকাংশ পরিবারেই ঘরে সেলাইয়ের চল ছিল। আজ এই জিনিস আর দেখা যায় না।

আর ছিল উল বোনা!! অবসর সময়ে মা- খালারা উল দিয়ে সোয়েটার, মাফলার, মোজা,কানঢাকা টুপি বানাতেন, এসব যে তৈরি অবস্থায় দোকানে পাওয়া যেতে পারে তা বোধহয় কেউ কল্পনাও করতো না। বাসার ছোট-বড়, পুরুষ মহিলা নির্বিশেষে সকলের জন্য এসব বানানো হতো। কত তার ডিজাইন, সেই ডিজাইন আবার একজন আরেকজনের থেকে শিখতেন, বেশি অভিজ্ঞরা ডিজাইন দেখেই সেটা তুলে নিতে পারতেন । আমার প্রিয় ছিল বকুল ফুল ডিজাইন, আর দুই রঙের উল দিয়ে খোপ খোপ করে বোনা ডিজাইন।

একটা সোয়েটার যে মাত্র একজন মাত্র এক বছর পরবে এমন চিন্তা করে বোনা হতো না, মোটামুটি একটা দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করে সোয়েটার বোনা হতো। যার জন্য সোয়েটার বোনা হবে, প্রথমে তার সোয়েটারের লম্বার মাপ নেয়া হতো আঙুলের হিসাবে, মাপার ফিতা সবার ঘরে থাকতো না। একইভাবে গায়ের মাপ, হাতের মাপ নেয়া হতো। এরপর এইসব মাপের সাথে আরো কয়েক আঙ্গুল করে যোগ করে বড় মাপের সোয়েটার বানানো হতো, যেন দু-তিন বছর পর লম্বায় বাড়লেও সোয়েটারটা পরা যায়। সেই সোয়েটার ছোট হয়ে গেলে ছোট ভাইবোন কেউ আরো কিছুদিন পরত। একেবারে যখন আর কেউই পরার মত থাকতো না, তখন সেই সোয়েটার খুলে উলের বল বানিয়ে রাখা হতো। বিভিন্ন রঙের এই বল দিয়ে নতুন ডিজাইনে কারো জন্য সোয়েটার হতো। আবার কখনো এক রঙের সোয়েটারের বুকে অন্য রঙ দিয়ে কোন ছবি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা হতো, অধিকাংশ সময়েই সে চেষ্টা বিফলে যেতো। আমার একটা লাল সোয়েটারে ছিল হলুদ হরিণের ছবি, একজন দেখে জিজ্ঞেস করেছিল, "এটা কি গরু?" আমি মাকে গিয়ে একথা বলায় মা বললেন, "হরিণের শিং দু'টা বোঝা যাচ্ছে না তো, তাই..."

মা যখন আমার জন্য নতুন সোয়েটার বানাতেন, লম্বার মাপ নিতেন মাঝে মাঝে, তখন সেটা শেষ হবার জন্য অধীর প্রতীক্ষায় থাকতাম। আর তা গায়ে দেবার পর যে অপরিসীম আনন্দ... এই অনুভূতিগুলো আমার মেয়ের কখনো হয়নি। তার জন্য কেনা হতো নানা রকমের অনেক সোয়েটার। সেগুলো সুন্দর, কিন্তু মায়ের হাতে বোনা সোয়েটারে যে ভালবাসা জড়িয়ে থাকে তা তো আর থাকতো না!

আমি প্রথম সোয়েটার বুনেছিলাম দশ বছর বয়সে, নিজের জন্য। সবার কাছ থেকে অল্প করে উল চেয়ে নিয়ে বিচিত্র বর্ণের একটা সোয়েটার বুনেছিলাম। উল কম পড়েছিল, তাই সোয়েটারের হাতা পুরো লম্বা হয়নি। অবশ্য এর জন্য আমার আনন্দ কিছু কম পড়ে নি!!

উল বোনা এখন কেবলই স্মৃতি। অনেক বছর যাবত বোনা ছেড়েছি, হাতে বোনা সোয়েটারের কদর আর নেই। আজকাল কাউকেই আর বুনতে দেখি না। আমার মেয়ে অবশ্য স্কুলের সেলাই ক্লাসের জন্য মোজা, মাফলার বুনে ছিল। কিন্তু সে কোনদিন জানেনি সোয়েটার বোনার আনন্দ কেমন হয়! অবশ্য আমার এক তিরাশি বছর বয়স্কা খালা আছেন, তিনি এখনও নিয়মিত বুনে চলেন ইউ টিউবে ডিজাইন দেখে, তার নাতনীর ছেলেমেয়েদের জন্য। সেই বাচ্চারা বিদেশে থাকে, হয়তো তারা এখনো হাতে বোনা সোয়েটারের কদর করে।

এদেশে সাধারণ মানুষের ঘরে উল বোনার প্রচলন কবে আর কীভাবে শুরু হয় আমার খুব জানতে ইচ্ছা করে। আমার মনে হয় এর শুরু গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকে, কারণ আমি বিশ, ত্রিশ আর চল্লিশের দশকের কিছু পারিবারিক ছবিতে দেখেছি, ছোট-বড় নির্বিশেষে পুরুষরা কোট আর মহিলারা শাল পরে আছেন, কেউ সোয়েটার পরা নেই। তাই মনে হয় বাড়িতে উল বোনা শুরু হয়েছে এই সময়ের পরে থেকে।। কীভাবে শুরু সেটা ভাবতে গিয়ে আমার মনে হয়েছে, এদেশীয় কোন বিলাত ফেরত নারী হয়তো শুরু করেছিলেন আর দ্রুত তা ছড়িয়ে যায়। বিলেত ফেরত বললাম এজন্য যে, এই উল আর বোনার কাঁটা সবই আসতো বিলাত থেকে। উলের নাম্বার থাকতো সরু থেকে মোটা অনুযায়ী, আবার উল বোনার কাঁটা বিভিন্ন নাম্বারের হতো, সবই বিলেতি জিনিস।

আরেকটা সেলাই ছিল কুর্শি কাঁটার লেস বোনা, মা আর নানীর সময়ে কুর্শি কাঁটার সেলাই নারীদের প্রায় সকলেই করতেন। কত রকম টেবিল- ঢাকা আর লেস বানানো হতো! সুতার নাম ছিল ক্রচেট সুতা, গুটলী করা থাকতো সুতা। ক্রচেট সুতা হতো সাদা, লেস বানানোর সময় মাঝে মাঝে এরসাথে রঙিন পুঁতি দিয়ে এখন চমৎকার শিল্পকর্ম হতো। আসলে সেকালে যারা কুরুশ বুনতেন তারা সকলেই দক্ষ শিল্পী ছিলেন। কুরুশের সেলাই আমি খুব কম করেছি, সারাজীবনে শুধু একবার একটা উলের শাল আর একবার মেয়ের জামার লেস। আমার মেয়ে কুর্শির লেস করা দূরে থাক, দেখেছেই খুব কম, এযুগে আর কেউ কুরুশের টেবিল ঢাকা, রেডিও- টেলিভিশন ঢাকা এসব বানায় না।

আজকাল কোনো মহিলা সেলাই করেন শুনলেই মনে হয় তিনি গার্মেন্টস কর্মী!! অথচ একসময় আমাদের মা- নানী অনেক, আর আমিও কিছু কিছু সেলাই করেছি! আমার খুব অবাক লাগে ভাবতে, আমার মা- নানীরা তাদের সংসারের বিপুল কর্মকাণ্ড সামলে কীভাবে এত সেলাই করতেন; নানীর ছিল ডজন খানেক ছেলেমেয়ে, মায়ের হালি খানেক আর আমার দুজন! আসলে সেযুগে তো মায়েদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে স্কুল কোচিংয়ে দৌড়াতে হতো না সারাদিন ধরে, টিভি- সিরিয়ালও দেখতে হতো না, কিন্তু আমাকে এসব করতে হয়েছে। তাই আমার সেলাই করার সময় হয়নি। তাঁরা রান্না আর ঘরকন্নার ফাঁকে ফাঁকে যেটুকু সময় পেতেন সেলাই করতেন। এটা ছিল তাদের বিনোদন। পাড়ার কয়েক জন মহিলা একসাথে বসে গল্পগুজব করার সময়ও বসে সেলাই করতেন, একজন আরেকজনের থেকে নতুন কোনো সেলাই শিখে নিতেন। তখন সেলাইয়ে পারদর্শী হবার একটা উদ্দেশ্য ছিল বিয়ের বাজারে দাম বাড়ানো। আমার মায়ের সময়ে মেয়েদের বিয়ের সময় যেসব গুণ নির্ণয় করে পাত্রী নির্বাচন করা হতো তার অন্যতম ছিল সেলাই কাজে দক্ষতা। আমার সময়ে এই দক্ষতার দাম পড়ে গেছে, তাছাড়া বিয়ের বাজারে দাম বাড়াতে আমি এত কষ্ট করতে অনিচ্ছুক ছিলাম, ফলে আমার দ্বারা তেমন সেলাই কর্ম সম্পন্ন হয়নি। আর আমার কন্যা... তার সময় হাতের মুঠোয় বিশ্ব চলে এসেছে, সেলাই করা তার কাছে নিছকই সময় নষ্ট...

===================================

আমার নানী, মা, আমি, আমার কন্যা- এই চার প্রজন্মের জীবনের নানা দিক নিয়ে আমি মাঝে মাঝে কিছু লিখি, তারপর সেটা শেষ না করে ফেলে রাখি। এই লেখাটা মোটামুটি শেষ করা ছিল। তাই শৈশবের স্মৃতিচারণ নিয়ে ব্লগে পোস্ট দেখে আমার মনে হলো (এই লেখাও অনেকটা স্মৃতিচারণমূলক, যদিও শৈশবের স্মৃতিচারণ নয়) এটা পোস্ট করে দেই। তাই করলাম।

সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই মে, ২০২৩ সকাল ৭:০৮
৩৮টি মন্তব্য ৩৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×