জুলাই মাসের আঠার তারিখ, বৃহস্পতিবার। বেলা এগারোটা বা বারোটা। ঝলমলে রোদের উজ্জ্বল দিন। আমার চোখ ঝলসে যাচ্ছে আর মন দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে... আমার চারপাশে অনেক মানুষ, তাদের দেখছি, কারো সাথে কথা বলছি কিন্তু মন একেবারে অনুভূতিশূন্য... বড়মামার কথায় বাস্তবে ফিরলাম।
- কুলখানি কবে করবে ঠিক করলে?
কুলখানি কাকে বলে সেটাই বুঝতে পারছিলাম না। তারপর মনে পড়লো মৃত্যু উপলক্ষে দোয়ার নাম করে খাওয়ার আয়োজনকে বলা হয় কুলখানি। আজ ভোর সাড়ে চারটায় আমার মা মারা গেছেন, এখনও কবর দেয়া হয়নি, অথচ আমাদের এখনই কুলখানির কথা ভাবতে হবে!! কী বলবো বুঝতে পারছিলাম না। দেখলাম পাশে বসা আমার বড়বোন বলল,
- ভাইরা তো রওয়ানা দিয়েছে, ওরা আসুক, তারপর না হয় বলি...
বড়মামা খুব বিরক্ত হয়ে বললেন,
- এখন বললে জানাজার সময় এ্যানাউন্স করে দিতাম, সবাই জেনে যেত। এরপর কিন্তু জনে জনে ফোন করে জানাতে হবে। সেটা করতে পারবে তো?
দুজনেই মাথা নেড়ে জানালাম পারবো, কী পারতে হবে সেটা না বুঝেই! মায়ের মৃত্যুর অভিজ্ঞতা জীবনে শুধু একবারই আসে, এই অনন্যসাধারণ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাবার সময় বাইরে থেকে যতই স্বাভাবিক দেখাই না কেন, আসলে মাথা ঠিকমত কাজ করে না। এইসময় কবে, কোথায়, কিভাবে কুলখানি করবো তা ঠিক করা খুব সহজ কাজ নয়!! এইতো, দুদিন আগেই মঙ্গলবার সকালে মায়ের সাথে ফোনে অনেকক্ষণ কথা বললাম, মা পুরোপুরি সুস্থ, অথচ বুধবার ভোরে স্ট্রোক করলেন, আগেই বলে রেখেছিলেন ওনাকে যেন কখনো ভেন্টিলেটরে না দেয়া হয়, তাই দেয়া হয়নি। আজ বৃহস্পতিবার ভোরে আইসিইউ তে মারা গেলেন...
মায়ের কুলখানি করার কথা ভুলে গিয়েছিলাম, রোববার সকালে বড়ভাই বলল আত্মীয় স্বজনরা কুলখানি করতে বলেছেন, এটা নাহলে মায়ের প্রতি সন্তানের শেষ কর্তব্য পালন করা বাকি থাকে! তাই ভাইয়েরা মায়ের কুলখানির আয়োজন করবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে তারা জানে না কুলখানি কীভাবে করতে হয় !!
তাদের দোষ কি!! যখন তারা দেশে ছিল সেসময়ের থেকে আজকের কুলখানি অনেক বদলে গেছে। আমার ছোটবেলায় দেখেছি মৃত্যুর চারদিন পর মসজিদে একটা মিলাদ হতো, তাতে উপস্থিত থাকতেন কেবল পুরুষেরা, মসজিদের হুজুরের দোয়া শেষ হবার পর জিলাপি বিতরণ হতো মৃতের আত্মার শান্তি কামনায়, সেটাই কুলখানি। তারপর চল্লিশ দিন পর চল্লিশা নামক অনুষ্ঠানে পাড়াপড়শি, আত্মীয়-স্বজনদের সপরিবারে ভূরিভোজের আয়োজন হতো, সেখানে দোয়ার চাইতে খাওয়া দাওয়াই মুখ্য ছিল। নব্বইয়ের দশক থেকে শুরু হলো কুলখানির নতুন ধরণ; এসময় চল্লিশা অনুষ্ঠান বাদ হয়ে কুলখানির অনুষ্ঠানের পরিসর বাড়লো। শুরু হলো সপরিবারে কুলখানিতে যাওয়া। সেসময় মৃত ব্যক্তির বাড়িতেই কুলখানির আয়োজন হতো, পুরুষেরা হুজুরের সাথে একঘরে বসতেন, মহিলারা পাশের ঘরে। হুজুর দীর্ঘ সময় বিভিন্ন রকম বয়ান করতেন, তারপর হিসাব দিতেন কতবার কুরআন খতম করা হয়েছে, সোয়া লক্ষবার কলেমার খতম পড়া হয়েছে। এই সোয়া লাখ বার কলেমা পাঠ নাকি মৃতকে কবর আজাব থেকে রক্ষা করে, আর কুরআন খতম, সুরা ইয়াসিনের খতমের সওয়াব হুজুর মৃতের উপর বখশে দিলে মৃতের জান্নাত নিশ্চিত হয়। হুজুরের মুনাজাত এমন," এই বান্দার কবরকে জান্নাতের বাগাআআন বানিয়ে দিন।" জান্নাত অর্থই বাগান, বাগানের বাগান আবার কী জিনিস!
সেসময়, কেবল নিকটজনেরাই কুলখানিতে আসতেন। দুপুর হতেই বাড়িতে আয়োজন শুরু হতো। প্রধান উপকরণ মিষ্টির প্যাকেট, ছিটানোর জন্য গোলাপজল ইত্যাদি চলে আসত, আর আসতো পলিথিন ব্যাগের প্যাকেট আর দোয়া লেখা ছাপা কাগজ। তুলে রাখা বিছানার চাদর বের করা হতো, ঘরের আসবাবপত্র সরিয়ে মেঝেতে চাদর বিছিয়ে বসার ব্যবস্থা হতো। মরা বাড়িতে বেশ একটা উৎসব ভাব চলে আসতো। বাড়িতে ঢোকার মুখে হাতে পলিথিন ব্যাগ আর দোয়ার কাগজ হাতে দাঁড়িয়ে থাকতো কমবয়সী কজন ছেলেমেয়ে, তাদের কাজ অতিথিদের সবার হাতে একটা করে পলিথিন ব্যাগ আর কাগজ ধরিয়ে দেয়া। পায়ের জুতা খুলে ব্যাগে ভরে হাতে রাখতে হবে জুতা চুরি ঠেকাতে, আর কাগজ দেখে ইস্তেগফার, কিছু সুরা আর দরুদ পড়তে হবে পরবর্তীতে তা বখশে দেবার জন্য। এই সওয়াব বখশানো জিনিসটা খুব অদ্ভুত, যতই করিবে দান ততো যাবে বেড়ে ধরণের। একবার আমার প্রতিবেশী খালাম্মা আমাকে বললেন তার হয়ে দুই পারা কুরআন পড়ে দিতে, তার এক প্রয়াত আত্মীয়ের জন্য তাকে পাঁচ পারা পড়তে বলা হয়েছে কুলখানিতে, কিন্তু এতো পড়ার তাঁর সময় নেই। আমি বললাম আমারও সময় নেই। তখন উনি বললেন, "তোমার আম্মাকে বলো আমার হয়ে পড়ে দিতে।" আমি আম্মাকে বললাম ঠিকই, কিন্তু সাথে সাথে আম্মাকে পরামর্শ দিলাম, নিজে কষ্ট করে পড়ে তার সওয়াব অচেনা মানুষকে দেবার দরকার নেই। আমার মা বললেন, মৃতের জন্য সওয়াব বখশে দিলে আল্লাহ তা ডাবল করে দেন, এক ভাগ আম্মার আরেক ভাগ মৃত মানুষটি পাবেন... জানিনা আমার মা এ তথ্য কোথায় পেয়েছিলেন!!
সেইসব কুলখানি অনুষ্ঠানে এক ঘরে হুজুরের কথা চলতে থাকে, অন্য ঘরে মহিলাদের গল্পও চলতে থাকে, মাঝে মাঝে ঝাঁঝরি থেকে গোলাপজল ছিটানো হতে থাকে। আমি আগে ভাবতাম খালি মহিলারাই বোধহয় কুলখানি অনুষ্ঠানে গল্প করেন, কিন্তু একবার এক কুলখানিতে মহিলাদের সমাবেশের জায়গায় একটা বড় পর্দায় হুজুরের বয়ান দেখাচ্ছিল, দেখি হুজুরের আশেপাশে বসা পুরুষেরা হাসি- গল্প করছেন, মোবাইল দেখছেন!! অর্থাৎ কুলখানিতে আগত অতিথিদের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের মনেই থাকে প্রীতি সম্মেলনে আসার আনন্দ। আগে একটা জিনিস করা হতো কুলখানির অনুষ্ঠানে, সমবেত ভাবে "ইয়া নবী সালাম আলাইকা, ইয়া রাসুল সালাম আলাইকা---" পড়ার সময় একবার হুড়মুড় করে উঠে দাঁড়াতে হতো, কারণ নাকি রাসুলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) রূহ এসে গেছেন বৈঠকে, তাই বসে থাকলে তাঁর প্রতি বেয়াদবি হয়... এই আচার অবশ্য এখন বাদ হয়েছে। এখন আবার কুলখানি না বলে এই অনুষ্ঠানকে দোয়া মাহফিল বলা হয়।
প্রয়াতের স্বজনদের জন্য কুলখানির আয়োজন করা খুব সহজ কাজ নয়। স্বজন হারানোর গভীর শোক চাপা দিয়ে, কখনো কখনো অর্থ ঋণ করেও কুলখানি করা লাগে। আমি একবার আট বছরের এক শিশুর কুলখানিতে আমন্ত্রণ পেলাম। ফুলের মত সুন্দর শিশুটির ক্যানসার হয়েছিল কিন্তু চিকিৎসা করার অর্থ ছিল না। চিকিৎসার জন্য আমিও অর্থ সংগ্রহে নেমেছিলাম কিন্তু প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ হবার আগেই শিশুটি মারা গেছিল। ওর মা-বাবা ঋণগ্রস্ত, তাই আত্মীয় স্বজনরা মিলে কুলখানির আয়োজন করেছেন, নাহলে নাকি শিশুটির রুহের মাগফিরাত হবে না!! কুলখানি শেষে হাতে মিষ্টির বাক্স নিয়ে শিশুটির মায়ের সাথে দেখা করতে গেলাম। একমাত্র সন্তান হারানো মা হাতে মিষ্টির বাক্স নিয়ে বসে শুন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন...
আরেকবার, আমার এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয় বিয়ের একমাস পর সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন, কুলখানির দিন নববিবাহিতা থেকে সদ্য বিধবায় পরিনত হওয়া বউটি আপাদমস্তক কাঁথা মুড়ি দিয়ে বিছানার একপ্রান্তে শুয়েছিল, দেখা গেল মহিলারা সব সেই ঘরে গাদাগাদি করে বসে নানারকম আলোচনা করছেন, কখনো কোন গল্পে হাসির হুল্লোড় উঠছে।
ফিরে আসি আমার মায়ের কুলখানিতে। সময়ের সাথে সাথে কুলখানিও অনেক বিবর্তিত হয়েছে, এখন সাধারণত ঝামেলা কমাবার জন্য কোনো মসজিদ বা কমিউনিটি সেন্টারে কুলখানির আয়োজন হয়। কিন্তু তার ঝামেলাও কম নয়, প্রথমে নানা জায়গা দেখে সুবিধাজনক একটা ভেন্যু নির্বাচন, তারপর হুজুর ঠিক করা, তারপর খাবার কি হবে, কতটুকু লাগবে, কত খরচ হবে সেসব হিসাব করে খাবার আনাবার ব্যবস্থা করতে হয়। আত্মীয়- স্বজন পরিচিতদের আমন্ত্রণ জানাতে হয়, অনেকের ফোন নাম্বার না জানায় সেটাও খুঁজে বের করতে হয়, তারপরও কেউ বাদ পড়ে গেলে সেজন্য পরে মনোমালিন্যও হয়!!
ভাইরা খুব ছুটাছুটি করে দুই দিনে সব আয়োজন শেষ করলো। এতদিন পর সব ভাইবোন একসাথে হয়েছি, কিন্তু একসাথে বসে মাকে নিয়ে কথা বলবার বা দোয়া করবার কোন সুযোগই পেলাম না।
আমার মায়ের কুলখানির আয়োজন হলো একটা কমিউনিটি সেন্টারে, মঙ্গলবার বাদ আসর। দুপুরে ক্লান্ত- বিধ্বস্ত আমার ছোট ভাই হয়তো মনে মনে হিসাব মিলাচ্ছিল সব ঠিকমতো হয়েছে কিনা, হঠাৎ মনে পড়ল তার পাঞ্জাবি নেই। আমাকে জিজ্ঞেস করল পাঞ্জাবির দোকান কাছাকাছি কোথায় আছে। শুনে আমার মনে পড়লো,কুলখানিরও একটা ড্রেস কোড হয়েছে, পুরুষের জন্য পাঞ্জাবি, আর ইদানিং শুরু হয়েছে মহিলাদের জন্য পুরো সাদা বা সাদাটে পোশাক।। আমি ভাবতে শুরু করলাম, সাদাটে পোশাক না পরে গেলে লোকজন আমাকে কী ভাববে!!
নির্দিষ্ট সময়ে দেখা গেল অতিথিরা এসে গেছেন, সাজগোজ করে, সবাই হাসিখুশি। আমার পাশে বসে অনেকেই নানা রকম গল্প করতে লাগলেন। আমি ধৈর্য্য ধরে বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম অনুষ্ঠান শেষ হবার; শুধু মনে হচ্ছিল গত মঙ্গলবারে এ সময় আমার মা "দিদি নাম্বার ওয়ান" দেখছিলেন, এই মঙ্গলবারে তার কুলখানি হচ্ছে!! এরই মাঝে আমার একজন খালা আমাকে ডেকে বললেন, "দ্যাখো, আমার মেয়ে তোমার মায়ের মৃত্যু সংবাদ পেয়েই শেষ দেখা দেখবার জন্য পাঁচ ঘন্টা জার্নি করে ছুটে এসেছে, অথচ তাকে কেউ দুপুরে খেয়ে যেতে বলেনি..." কেউ বলতে কি আমাকেও বোঝালেন!! কী বলবো বুঝতে পারলাম না!
মাগরিবের কিছু আগে অনুষ্ঠান শেষ হলো, কিন্তু অতিথিদের গল্প গাছা চলতেই লাগলো, তাই আমরাও বসে রইলাম। অবশেষে রাত নটার দিকে ফিরতে পারলাম মায়ের বাড়িতে, প্রথমবারের মতো অবকাশ পেলাম মা হারানোর শূন্যতা অনুভবের।
মায়ের কুলখানির অভিজ্ঞতার পর থেকে আমি নিজের মৃত্যু নিয়ে যখনই ভাবি তখনই আমার কুলখানির ভাবনা এসে যায়। আমার কুলখানির আয়োজন করতে গিয়ে আমার শোকার্ত দুই ছেলেমেয়ে দিশাহারা হয়ে পড়ছে, এই দৃশ্য ভাবলেই আমি বিপন্ন বোধ করতে থাকি! আমি আমার ছেলেমেয়েদের পালন করেছি ফার্মের মুরগী পালনের ধরণে (জানি এটা ভালো প্যারেন্টিং নয়)! যদিও এখন তারা আমার সাহায্য ছাড়াই চলছে, তবু এখনও তাদের কষ্ট পেতে দেখলে আমি কষ্ট পাই। তাই একবার ভেবেছিলাম আমি বেঁচে থেকেই একটা ভোজের আয়োজন করে সবাইকে জানিয়ে দেই এটা আমার অগ্রিম কুলখানি, দয়া করে আমি মরে গেলে আমার ছেলে মেয়েদের রেহাই দিও! কিন্তু এটা সম্ভব নয়, প্রথমত আমি হুমায়ূন আহমেদ নই যে সবাই এটা ভালোভাবে গ্রহণ করবে, দ্বিতীয়ত এটা করলেও মৃত্যুর পরের কুলখানি করতে হবে না এমন কোন গ্যারান্টি কেউ আমাকে দেবে না।
অনেক ভেবেও বুঝতে পারছি না কী করবো!
ছবি: অন্তর্জাল থেকে সংগৃহীত।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে আগস্ট, ২০২৩ সকাল ১০:২২