আমাদের দেশের আমজনতার শিক্ষা (মূলধারার শিক্ষা, বড়লোকের ইংরেজি মাধ্যম নয়) ব্যবস্থা নিয়ে যারা উদ্বিগ্ন থাকেন তাদের জন্য বিশাল সুখবর, এদেশের আমজনতার শিক্ষা ব্যবস্থাকে ইউরোপের উন্নত দেশ ফিনল্যান্ডের মতো করে গড়ে তোলার ব্যবস্থা হয়েছে! এ ব্যবস্থায় কোন পরীক্ষা নেই। এবছর শুধু ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর জন্য, আগামী বছর থেকে দ্বিতীয়, তৃতীয়, অষ্টম, নবম শ্রেণী এই চার শ্রেণীতেও এই ব্যবস্থা চালু হবে, অর্থাৎ ২০২৬ সালের এসএসসি এই ব্যবস্থায় হবে। এই শিক্ষা ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য:
১) এতে পড়াশোনার মতো বিরক্তিকর ব্যাপার পুরো বাদ! নাচগান- আনন্দমুখর ক্লাস হবে এই ব্যবস্থায়। নানা বিষয়ে হাতে কলমে শিক্ষা দেবার জন্য পিকনিক ও মেলার আয়োজন করা হয়, যেখানে উপস্থিতি বাধ্যতামূলক।
পিকনিক
২) এটা ডিভাইস ভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা। অর্থাৎ ছাত্রদের বেশিরভাগ পড়াশোনা করতে হবে ডিভাইস দিয়ে, ইন্টারনেট ব্যবহার করে। কোনো বিষয়ে জানার জন্য গুগল সার্চ দিয়ে সে বিষয়ে তথ্য এবং ছবি নিয়ে, সেগুলো প্রিন্ট করে কাগজ কেটে সেই কাটা কাগজ খাতায় সেঁটে দিতে হয় মূল্যায়নের জন্য।
৩) পরীক্ষা নামে খাতা কলম নিয়ে বসে লেখার দিন শেষ। প্রজেক্ট, অ্যাসাইনমেন্ট এসবের উপর ভিত্তি করে আছে মূল্যায়ন পদ্ধতি। প্রতি বিষয়ে, ছাত্ররা দলীয় ভাবে কাজ করার পর দলীয় মূল্যায়ন করেন শিক্ষক।
৪) মূল্যায়নের তথ্য এ্যাপ ভিত্তিক প্রযুক্তির মাধ্যমে সংরক্ষণ করা হবে। অতি আধুনিক, ডিজিটাল ব্যবস্থা!
৫)নম্বর বা গ্রেডিং থাকছে না। মূল্যায়নে ব্যবহার হচ্ছে ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ, এবং বৃত্ত। ত্রিভুজের অর্থ, এর যেমন শীর্ষ আছে তেমনি শিক্ষার্থীদের শীর্ষে উঠতে হবে। বৃত্ত বোঝায় সাধারণ শিক্ষার্থী যাদের চলতে চলতে উন্নতি করতে হবে। চতুর্ভুজের অর্থ চার দেয়ালে বন্দী, এদের বিশেষ যত্ন প্রয়োজন। বিভিন্ন সূচক (Indicator) যাচাই করে বৃত্ত ত্রিভুজ চতুর্ভুজ দেয়া হচ্ছে, কিন্তু এই চিহ্ন কেউ জানতে পারছে না একজন ছাত্র অংক করতে কতটা দক্ষ, সাহিত্য বা অন্য বিষয়ে কতটা জ্ঞান অর্জন করেছে, যেটা আগে নম্বর বা গ্রেড জানলেই বোঝা যেত। ফাঁকিবাজ ছাত্রদের এই ব্যবস্থায় খুব লাভ হবে, কেউ পরীক্ষার রেজাল্ট জিজ্ঞেস করলে ছবির মতো এই মূল্যায়ন শীট ধরিয়ে দেবে, দেখে প্রশ্নকারী কিছুই বুঝবে না।
৬) ২০২৪ সাল থেকে ক্লাস নাইনে সাইন্স, আর্টস, কমার্স ইত্যাদি বিভাগ থাকবে না। এখন নবম শ্রেণীতে বিজ্ঞানের ছাত্রদের বিজ্ঞানের তিনটি বিষয় এবং উচ্চতর গণিত বিষয়ে পড়তে হয়। ২০২৪ সাল থেকে নবম শ্রেণীতে উচ্চতর গণিত পুরো বাদ হবে এবং বাকি তিনটি বিজ্ঞানের বিষয়ের তিন ভাগের দুই ভাগ বাদ দিয়ে ১০০ নাম্বারের একটি বিজ্ঞান বিষয়ের পরিণত করা হবে।
৭) ২০২৪ সাল থেকে ষষ্ঠ শ্রেণিতে রেজিস্ট্রেশন হবে, এখনকার মতো নবম শ্রেণীতে নয়। রেজিস্ট্রেশন নম্বর এ্যাপে সংরক্ষিত থাকবে। কোন রোল নাম্বার ব্যবস্থা থাকবে না এরপর।
৮) নম্বর বা গ্রেডিংয়ের ফলে আগে ভালো- খারাপ ছাত্র ইত্যাদি বৈষম্য মূলক পদ্ধতি ছিল। এই বৈষম্যমূলক পরিচিতি লোপাট করে সবাইকে সমান নজরে দেখাই এই মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু হয়েছে। এ সম্পর্কে বলা হয়েছে:
কেউ গোল্ডেন জিপিএ-৫ (সব বিষয়ে ৮০ নম্বরের ওপরে) পেলে তাকে সবচেয়ে মেধাবী বলে বিবেচনা করা হয়। আবার কেউ জিপিএ-৪ বা ৩.৫ পেলে তাকে ততটা মেধাবী নয় বা ফল ভালো হয়নি বলে বিবেচনার সংস্কৃতি বিদ্যমান। এটিকে ‘নন-সেন্স’ ও ‘ইডিয়টিং’, অর্থাৎ ‘কাণ্ডজ্ঞানহীন’ ও ‘নির্বুদ্ধিতা’ বলে মনে করেন নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে কাজ করা অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান। তিনি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) শিক্ষাক্রম ইউনিটের সদস্য।
সূত্র:https://www.google.com/amp/s/www.jagonews24.com/amp/887027
৯) এই দুই শ্রেণীর পাঠ্য বিষয়ে পরিবর্তন আনা হয়েছে (আগামী বছর থেকে অন্য শ্রেণীতেও হবে)। সপ্তম শ্রেণীতে দশটি বিষয় আছে, যেমন: ( ১)বাংলা (২)ইংরেজি (৩)গণিত (৪)বিজ্ঞান (৫)ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান (৬)জীবন ও জীবিকা (৭)স্বাস্থ্য সুরক্ষা (৮)ডিজিটাল প্রযুক্তি (৯)শিল্প সংস্কৃতি (১০)ধর্ম।
কিছু বিষয়ের নাম পরিচিত মনে হলেও, এর শিখন- পঠন পদ্ধতি আমূল বদলে গেছে। মূলত বই খাতা ব্যবহার না করে কাগজ কেটে পড়াশোনা করা এই পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য। বীজ গনিতের এই সমস্যা যেমন কাগজ কাটিং পদ্ধতিতে শেখানো হয়। জ্যামিতিতে ত্রিভুজ কাকে বলে সেটা শেখানো হয় মাঠে গিয়ে দড়ি দিয়ে।
১০)হাতে কলমে শিক্ষা ব্যবস্থার কিছু ছবি দেখা যাক। বিজ্ঞানে ভূমিকম্প নিয়ে শুধু পড়ানোই হয় না, ভূমিকম্প থেকে কিভাবে আত্মরক্ষা করতে হবে তাও শেখানো হয়। (এই ছবি দেখে মনে পড়লো, আমি তো এক চির রুগ্ন ছাত্রী ছিলাম, এইসব জিনিস করতে গেলে চতুর্ভুজ পেতে হতো, ফলে লেখাপড়ার ইতি ঘটতো, ফলে জীবনে কখনো সামুতে আসা হতো না।)
১১)জীবন ও জীবিকা বিষয়ে জীবিকার জন্য প্রয়োজনীয় বিষয় শেখানো হয়। যেমন আলুভর্তা, ডিম ভাজা করা ইত্যাদি। বলা হচ্ছে, বিদেশে এইসব কাজ জানার খুব কদর, তাই এগুলো শেখানো হচ্ছে। মনে হচ্ছে এই শিক্ষার্থী মেয়েরা কাজের মেয়ে হিসেবে বিদেশে গিয়ে অনেক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করবে।
১২) এই শিক্ষাব্যবস্থায় ছেলে এবং মেয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে কোন পার্থক্য রাখা হয়নি। ফলে ছেলেরা রান্না শিখছে, মেয়েরা ধান বোনা শিখছে। ছবি। ছেলেরা কাঁথা সেলাই, পিঠা বানানো শিখছে। ছেলে-মেয়ে সবার জন্য মুরগি পালন শেখা অত্যাবশ্যক। ফলে ঢাকায় ফ্ল্যাটে যারা থাকে, সেই ছেলেমেয়েদেরও বলা হয়েছে ঘরে মুরগি পালন করে মুরগি পালনের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিতে।
১৩) মনে হয় আমাদের ব্লগার শায়মা আর সোহানী এই শিক্ষা ব্যবস্থার পেছনে আছে! একটা পাঠ্য বিষয়ের নাম "জীবন ও জীবিকা", যেটা সোহানীর বইয়ের নাম থেকে নেয়া। আবার বিজ্ঞান ক্লাসে টেরেরিয়াম বানানো শেখানো হয়, যেটা শায়মার প্রিয় বিষয়। এছাড়াও শায়মার প্রিয় নাচ, গান, ছবি আঁকা প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কাগজ কেটে নানাধরনের কারুকাজ করতে হয়, এমনকি কাগজের রোবট পর্যন্ত বানাতে শিক্ষা দেয়া হয় বিজ্ঞান ক্লাসে, এগুলোও শায়মীয় কাজ।
১৪)এই শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের মা-বাপের জন্যও শিক্ষামূলক। শিক্ষার্থীদের নানা রকম পিঠা, যেমন পাটিসাপটা নকশী পিঠা ইত্যাদি ১০ জনের জন্য বানিয়ে নিয়ে যেতে যখন বলা হয়, তখন যেসব মায়েরা পিঠা বানানো না শিখে শুধু আরাম করে দিন কাটিয়েছেন, তারা এসব পিঠা বানানো শিখতে বাধ্য হন। কারণ বানিয়ে না দিতে পারলে সন্তান হয়ে যাবে চতুর্ভুজ!! একই ভাবে যে মায়েরা কাঁথা সেলাই না শিখে জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন, তাঁরাও এখন সন্তানকে ত্রিভুজ করার জন্য কাঁথা সেলাই শিখতে বাধ্য হয়েছেন।
বাবাদের জন্যও দারুন শিক্ষামূলক। অনেক বাবা আগে বাটন ফোন ব্যবহার করতেন। এখন এই শিক্ষা ব্যবস্থায় (যাকে বলা হচ্ছে ডিভাইস ভিত্তিক) শিক্ষার্থীর ল্যাপটপ ডেস্কটপ না থাকুক, ইন্টারনেট সংযোগ সহ একটা স্মার্টফোন অত্যাবশ্যক, কারণ গুগল সার্চ করে তাকে অ্যাসাইনমেন্ট করতে হয়। অতএব বাবারা স্মার্ট ফোন কিনে স্মার্ট হবার সুযোগ পেয়েছেন এই শিক্ষা ব্যবস্থার ফলে। তাছাড়াও সন্তানের লেখাপড়ার জন্য খরচ করা শিখেছেন এই ব্যবস্থায়। আলুভর্তার উপকরণ কিনতে তো লাগে দু্ই পয়সা, কিন্তু বিরিয়ানি রান্নার উপকরণ কেনার জন্য তাদের সন্তানদের বেশ কিছু টাকা দিতে হয়। যারা ঘরে সন্তানদের বিরিয়ানি খাওয়াতে পারেন না, তারা এই ব্যবস্থার ফলে সন্তানদের বিরিয়ানি খাওয়াতে পারছেন।
১৫) এবার দেখা যাক বিভিন্ন বিষয়ে মূল্যায়ন কীভাবে হয়। একজন ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থীর মা বলছেন:
৬ষ্ঠ শ্রেণীর অর্ধবার্ষিক মূল্যায়নের নামে যা ছিল ( পরীক্ষা বলা যাবে না মূল্যায়ন বলতে হবে)
বাংলা -১টি কবিতা আবৃত্তি করতে হবে, সংবাদ পত্র থেকে ৫ লাইন সংবাদ পাঠ করতে হবে এবং একজন বন্ধুর সাথে প্রমিত ভাষার কথোপকথন লিখে জমা দিতে হবে।
ইংরেজি -বন্ধুর সাথে কোন বিষয় নিয়ে কথা বলতে হবে এবং সেই কনভারসেশন লিখেজমা দিতে হবে এবং একটা paragraph লিখতে হয়েছিল।
গণিত -একজন বন্ধু আর একজন বন্ধুর জন্য অংক দিবে সেটা সমাধান করতে হবে।
বিজ্ঞান-বই বাদ দিয়ে করোনা ভাইরাস নিয়ে ১৫টা প্রশ্ন দিয়েছিল সেগুলো গুগল ঘেঁটে বার করতে হয়েছে এবং সেগুলো পরীক্ষায় লিখতে হয়েছিল
ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান-একজন মুক্তিযোদ্ধার সাক্ষাৎকার নিয়ে মুক্তিযোদ্ধার আত্নপরিচয় লিখতে হয়েছিল
জীবন ও জীবিকা- একজন পেশাজীবীর সাক্ষাৎকার
শিল্প ও সংস্কৃতি-কবিতা আবৃত্তি/ড্রইং/গান এবং বন্ধুখাতা
ডিজিটাল প্রযুক্তি- নিজেদের স্কুল নিয়ে ১০টা পাওয়ার পয়েন্ট স্লাইড বানানো তাও বাংলায়
সাস্থ্য ও সুরক্ষা -৭ দিনের দিনলিপি লিখে বর্ননা করা
ইসলাম ধর্ম - কোন বিষয় নিয়ে গ্রুপওয়ার্ক
এগুলো ছাড়াও অনেক গ্রুপওয়ার্ক আ্যসাইনমেন্ট ,পোষ্টার করতে হয়েছে।এই ধরনের মূল্যায়ন ২০/৩০ নম্বরের হতে পারে এর বেশি না।এই মূল্যায়নের জন্য বইয়ের কোন দরকার নেই।
১৬) বাংলা ইংরেজি আগে ছিল দুই পত্র, প্রথম পত্রে সাহিত্য এবং দ্বিতীয় পত্রে ব্যাকরণ ও রচনা লেখা। এখন এইসব ব্যাকরণ রচনা বাদ হয়ে অভূতপূর্ব ধরণের বাংলা ইংরেজি বই হয়েছে। এখানে দলগতভাবে কথোপকথন, অভিনয় করে ক্লাসের সময় পার করা হয়। এই যে দেখেন অভিনয় করার ইংরেজি ক্লাস!
১৭)যেহেতু মূল্যায়নে ছাত্রদের লেখাপড়ার ভূমিকা নেই, শিক্ষকদের ভূমিকা প্রধান, তাই এই শিক্ষা ব্যবস্থার ফলে শিক্ষকদের প্রাইভেট পড়ানো এবং কোচিং ব্যবসার রমরমা অবস্থা হয়েছে। আরও বেড়েছে স্মার্টফোন ইন্টারনেটের ব্যবহার, কাগজ কাপড় চাল ডাল আলু পেঁয়াজ সবকিছুর ব্যবহার। এককথায় দেশের অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করেছে এই শিক্ষা ব্যবস্থা।
আমাদের কার কার সন্তান ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীতে এই অভূতপূর্ব শিক্ষা লাভ করছে? বাকপ্রবাস?
আমার তরফ থেকে বিশাল অভিনন্দন জানবেন!
ছবি সব অন্তর্জাল থেকে সংগ্রহ করা।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে অক্টোবর, ২০২৩ দুপুর ২:৩৬