somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কালী পুজার বিশেষ ব্লগ : নজরুলের কালীভক্তির অনন্য নিদর্শন শ্যামা সংগীত!

৩১ শে অক্টোবর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার সময়ের সবচেয়ে আলোচিত কবি ছিলেন। সমাজের নিপীড়িত মানুষকে প্রতিবাদী করে তোলার মত ক্ষমতা একমাত্র নজরুলেরই ছিল। সে সময় ভারতীয় অঞ্চলে নজরুল ব্যতীত অন্য কোনো সাহিত্যিকের সাহিত্য মানুষকে এত আন্দোলিত করতে পারেনি। রবীন্দ্র সাহিত্যভাষা নজরুলের মতো এত প্রতিবাদী ছিল না। উত্তাল ভারতবর্ষে নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ বা ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ অথবা ‘ধূমকেতু’ কবিতা ব্রিটিশ শাসনের শক্ত ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিল। যা অন্য কোনো কবি-লেখকের দ্বারা সম্ভব হয়নি।

নজরুল দ্রুত জনপ্রিয় হয়েছিলেন হিন্দু-মুসলিমে বিভাজিত সে সময়কার ভারতীয় সমাজে। নজরুল বিষয়ে সকল মহলে শুরু হয় বিস্তারিত আলোচনা। তবে আলোচনা শুধু আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, সমালোচনাও ছিল ব্যাপক। মুসলিম হওয়ার কারণে হিন্দুদের একটা শ্রেণি নজরুলকে বিজাতি মনে করত। ঠিক একইভাবে একশ্রেণির মুসলমান নজরুলকে বিজাতি ঘোষণা করেছিল। কারণ ছিল হিন্দু ধর্মের প্রতি নজরুলের অতি আগ্রহ। নজরুলের ‘আমার কৈফিয়ৎ’ কবিতা পড়লে সহজেই বোঝা যায়, ওই সমাজের মুসলিমদের একটা শ্রেণি নজরুলকে কাফির আখ্যা দিতে দ্বিধা করেনি। নজরুল ‘আমার কৈফিয়ৎ’এ লিখেছিলেন-

‘মৌ-লোভী যত মৌলবী আর ‘মোল্লারা ক’ন হাত নেড়ে,
দেব-দেবী নাম মুখে আনে, সবে দাও পাজিটার জাত মেরে!’

বাংলা সাহিত্যে আর কোনো সাহিত্যিককে নিয়ে এত সমালোচনা হয়নি কখনো। বিশেষ করে কট্টরপন্থি মুসলমানদের মধ্যে নজরুল সম্পর্কে সবচেয়ে বড় অভিযোগের কারণ ছিল নজরুলের শ্যামাসঙ্গীত। একটা সময়ে পূর্ববঙ্গের বেতারেও নজরুলের শ্যামাসঙ্গীত সম্প্রচার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল।

তৎকালীন ভারতবর্ষের অবস্থা উত্তাল, একদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আর অন্যদিকে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের প্রস্তুতি। বিশ্বময় পুঁজিবাদী দেশগুলোর আগ্রাসন শুরু হয়েছিল। এমন উত্তাল সময়ে প্রতিবাদই ছিল নজরুলের একমাত্র ভাষা। সে সময় ‘শাক্তদর্শন’ ব্যপকভাবে প্রভাবিত করেছিল নজরুলকে। নজরুল কালি সাধনাও শুরু করেছিলেন।

শাক্তধর্ম মানে শক্তিবাদ। হিন্দুধর্মের প্রধান তিনটি বিভাগের অন্যতম এটি। হিন্দুধর্মের একটি শাখাসম্প্রদায় ছিল এই শাক্ত অনুসারীরা। হিন্দু দিব্য মাতৃকা শক্তি বা দেবী পরম ও সর্বোচ্চ ঈশ্বর– এই মতবাদের ওপর ভিত্তি করেই শাক্তধর্মের উদ্ভব। আর এই শাক্তদর্শন থেকেই নজরুলের শ্যামাসঙ্গীত রচনা শুরু।

হিন্দু পৌরাণিক কাহিনী মতে, দুর্গাদেবীর একটি বিশেষ রূপ হল ‘কালী’। এই কালীদেবীরই অন্য নাম আবার শ্যামা। শ্যামাবন্দনা বা শ্যামাদেবীর উদ্দেশ্যে নিবেদিত গানগুলোকে সাধারণভাবে শ্যামাসঙ্গীত বলা হয়। শাক্তসঙ্গীত নামটিরও ব্যবহার হয় এক্ষেত্রে। ‘শ্যামা মা’র পরিচয় দিতে গিয়ে কবি লিখেছিলেন-

“মার হাতে কালি মুখে কালি,
মা আমার কালিমাখা, মুখ দেখে মা পাড়ার লোকে হাসে খালি।
মোর লেখাপড়া হ’ল না মা, আমি ‘ম’ দেখিতেই দেখি শ্যামা,
আমি ‘ক’ দেখতেই কালী ব’লে নাচি দিয়ে করতালি।”

নজরুলের শ্যামাসঙ্গীত জনপ্রিয় হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল, আবেগের গভীরতা। কেউ কেউ মনে করেন, নজরুল হৃদয়ের গভীর থেকে শ্যামার প্রতি ভক্তি নিবেদন করেছিলেন। আর সে ভক্তি সাকার হয়েছিল তার গানের ভাষাতে। তিনি লিখেছিলেন-
“ভক্তি, আমার ধুপের মত,
ঊর্ধ্বে উঠে অবিরত।
শিবলোকের দেব দেউলে,
মা’র শ্রীচরণ পরশিতে।”

খ্রিস্টীয় দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকে বাংলায় বৈষ্ণবধর্মের পাশাপাশি শাক্তধর্মের উদ্ভব ঘটে এবং তাকে কেন্দ্র করেই শাক্তগীতি চর্চার একটি ক্ষীণ ধারা প্রচলিত হয়। এই সময় বঙ্গদেশে তৎকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বৈষ্ণবধর্মের চেয়ে শাক্তদর্শন ও শক্তিপূজা ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে। শ্যামা সঙ্গীতের ধারাটি বিকাশ লাভ করে খ্রিষ্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীতে। আঠারো শতকের মধ্যভাগে সাধক কবি রামপ্রসাদ সেন এতে প্রাণ সঞ্চার করে বাংলা গানের জগতে শাক্ত পদাবলি বা শ্যামা সঙ্গীত নামে একটি বিশেষ সঙ্গীতধারা প্রতিষ্ঠিত করেন। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ শ্যামা সঙ্গীতকার ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম।

নজরুল প্রায় ৪০০০ গান রচনা করেছেন এবং অধিকাংশের সুর নিজেই করেছেন, যেগুলো এখন নজরুল সঙ্গীত বা ‘নজরুল গীতি’ নামে পরিচিত। যার বড় একটি অংশই শ্যামা সঙ্গীত। সঙ্গীত বিষয়ক নজরুলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হচ্ছে ‘রাঙা-জবা’। ১৯৬৬ সালে ১০০টি শ্যামা সঙ্গীতে সমৃদ্ধ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। তখন মূল্য ছিল মাত্র তিন টাকা। শক্তি পূজায় তাঁর ভক্ত হৃদয়ের অকৃত্রিম আকুলতা ও আর্তি রাঙা-জবা’র গানের মধ্যে রূপায়িত।

নারীশক্তির প্রতি নজরুলের ভক্ত হৃদয়ের অকৃত্রিম আকুলতা চিরকালই ছিল। তাই শুধু শ্যামা সঙ্গীতের প্রভাব সঙ্গীতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। বরং তার কবিতাতেও প্রকাশ পেয়েছিল। ধূমকেতুতে প্রকাশিত ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ নামে যে কবিতাটির জন্য কবির এক বছর সশ্রম কারাদণ্ড হয়। সেই কবিতায়ও ছিল শাক্তসাধনার প্রকাশ-
“আর কতকাল থাকবি বেটী মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল?
স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি চাঁড়াল।
দেব–শিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবকদের দিচ্ছে ফাঁসি,
ভূ-ভারত আজ কসাইখানা, আসবি কখন সর্বনাশী?”

সাহিত্য চর্চার জন্য সামান্য কিছু সময় পেয়েছিলেন নজরুল। কিন্তু জীবনের এই অল্প সময়েই তিনি রেখে যান বাংলার জন্য এক সুর ভাণ্ডার। ধর্মীয় দৃষ্টিতে শ্যামাসঙ্গীত নানাভাবে বিতর্কিত হয়-এটা সত্য। কিন্তু তার শ্যামাসঙ্গীতের রচনা কৌশল আর ভক্তির গভীরতা বোঝা যায় নির্দ্বিধায়। সে সব ভক্তিগীতির মধ্যেও ছিল ধূমকেতুর ন্যায় অন্তরজ্বলা আর বিষেভরা চির বিদ্রোহের বাণী। আজও ভারতবর্ষে শ্যামা সঙ্গীত বিষয়ে আলোচনা উঠলে সবার আগে নজরুলের সৃষ্টি দিয়ে শুরু করতে হয়। শ্যামা সঙ্গীতের নান্দনিক প্রভাব পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের মরমী ও ভক্তিগীতি, এমনকি দেশাত্মবোধক গানের মধ্যে আজও প্রবহমান।


রিফাত বিন সালাম রুপম

সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে অক্টোবর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৯
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৪৪



বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

কেন বিএনপি–জামায়াত–তুরস্ক প্রসঙ্গ এখন এত তপ্ত?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে একটি পরিচিত ভয়–সংস্কৃতি কাজ করেছে—
“র”—ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ে রাজনীতিতে গুজব,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×